#শেষ_চৈত্র [১০]
চৈত্রমাস পেরুনোর পথে, আর এ সময়কার সকাল বেশ বিষ্ময়কর! শেষ রাত অব্দি গরমের প্রভাব থাকলেও ভোরের দিকে মুগ্ধকর ঝিরিঝিরি বাতাস সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। এইতো আমরা এই মূহুর্তে সবকিছু ভুলে গেছি, অমিতও ভুলে গেছে রাতের হাউমাউ করে কান্নাগুলো!
আমি আর অমিত জানালা দিয়ে ভোর দেখছি! এটা আমাদের একসাথে প্রথম সূর্যদয় , সংসার জীবনের মইও বলা চলে। যার সূচনায় দুজন একসাথে পা রেখেছি, আর একসাথেই বেয়ে উঠবো।
নিজেকে কখনো এতটা সুখী মানুষ হিসেবে দেখতে পাবো কল্পনা করিনি। আমি বাইরে তাকিয়ে আছি আর অমিত আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
‘
কিছুক্ষণ পরে আমি চললাম রান্নার আয়োজন করতে। এখনো সামনের দরজা খোলা হয়নি। আমার শাশুড়ী ধোয়ার কাজ করছে। আমি যেতেই উনি বললেন,
‘ বউ দরজা কিতা খুলতাম না?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
‘ উনিই জানেন ভালা।
আমার শাশুড়ী আর কিছু বললেন না। আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করে করে তরকারি কাটলাম। রান্না করলাম,কিন্তু বাইরের কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। আগ বাড়িয়ে দরজাও খুলতে গেলাম না।
৯ টার দিকে অমিত খেতে আসলো। এসে সে চুপচাপ ছিল এমনও না, খেতে খেতে অনেক কথা বলছিলো। কিন্তু তবুও আমরা সুমনার সাড়াশব্দ পেলাম না।
খাওয়াদাওয়ার পরে অমিত বাইরের দিকের জানালা খুলে দিলো। দেখলো বারান্দায় কাউকেই দেখা যাচ্ছেনা। এটা দেখে সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ মনে হয় সুমনা চলে গেছে। চৈতি আমি দোকানে যাবো। দুপুরে আসবো। কিছু হলে আম্মার মোবাইল থেকে কল দিও।
আমি একটু ইতস্তত হয়ে বললাম,
‘ আপনার ফোনডা তো ভাইঙা ফেলছিলেন,তাইলে কেমনে ফোন দিমু?
অমিত রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো,
‘ কিনবো আরকি বাজারে গিয়ে। সিম তো ভেঙে যায়নি, আর নাম্বার আম্মার মোবাইলে সেইভ আছে।
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। উনি রুমে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে শার্ট পরিধান করলেন। তারপর আমার মাথায় হাত রেখে মুচকি হাসির সাথে বললেন,
‘ ভয় পেওনা, সুমনা আসলেও ভেতরে আসার সুযোগ দিবেনা। দরজা বন্ধ করে রাখবে।
আমি চুপচাপ সেটাতেও সম্মতি দিলাম।
অমিত দ্রুত পায়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বের হলো। সুমনাকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছেনা। আর পেছনে তাকিয়ে বলে দিলো,
‘ দরজা বন্ধ করে দাও।
আমি উনার যাওয়ার শেষ দৃশ্য পর্যন্ত দরজা বন্ধ করবোনা বলে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অমিত আড়াল হতেই আমি হাসিমাখা মুখটা মলিনতার চাদরে ঢেকে দরজা বন্ধ করতে যাবো তখনি আমি আৎকে উঠলাম। সুমনা! তাও আমার সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছে। এতো দ্রুত কোথা থেকে বের হলো? আর সে কি অমিতের যাওয়ার অপেক্ষা করছিলো নাকি? আমি বুঝতে পারলাম না!
আমি অমিতের কথা মনে হতেই দরজা বন্ধ করতে যাবো তখন সুমনা দরজা ঠেলে জোর করে ভেতরে প্রবেশ করে ফেললো। কারো বাঁধাকে পরোয়া না করে একদম রান্নাঘরে ছুটে গেলো, আমি বড়বড় চোখ করে ওর পিছু নিচ্ছিলাম। সুমনা নিজে নিজেই হাড়ি পাতিল ঘেঁটে খাবার খেতে শুরু করলো। ১০ দিনের অনাহারীর ন্যায় তার খাবারের ধরণ। আমি কোনো বাঁধা দিতে পারলাম না। আম্মাও চুপ করে আছে।
ওর খাওয়া শেষ হতেই সে একটা বিশাল ঢেঁকুর তুলে বললো,
‘ অল্পের জন্যে বেঁচে গেলাম। মরেই যাচ্ছিলাম আমি।
বলেই সে আবার অদ্ভুতভাবে ডুকরে কেঁদে ওঠলো। কান্নার মধ্যে বলতে লাগলো,
‘ আমি দেড়দিন কিছু না খেয়েই এমন পাগল পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম! তাহলে অমিত সাড়ে চারদিন কীভাবে ছিল?
আমি চুপ করে দেখছি আর শুনছি। কিন্তু সুমনার এই কথায় আম্মা অবাক হলেন, ওর কাছে বসে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ আমার অমিত সাড়ে চাইরদিন না খাইয়া আছিল মানে কিতা?
সুমনা কাঁদো কাঁদো চোখে বললো,
‘ আমি! আমি ওকে খেতে দেইনি। ওর রুমে তালা মেরে চলে গিয়েছিলাম!
আমি সবকিছুই জানি তাই কোনো প্রশ্ন করছিলামনা। কিন্তু আম্মা এসব শুনে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠলেন। উল্টো আবার প্রশ্ন করলেন,
‘ কেরে দরজা বন্ধ কইরা রাখছিলা কেরে? কই গেছিলা?
সুমনা চোখ তুলে বললো,
‘ হৃদ! হৃদের জন্য। সেবার বাবা-মা দেশে আসছিলেন ১ মাসের সফরে। আমি প্রতিদিন লুকিয়ে হৃদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছিলাম না। তাই অমিতকে আটকে হৃদের বাসায় চলে গিয়েছিলাম।
আম্মা আস্তে আস্তে বললো,
‘ হৃদ কেডা?
সুমনা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
‘ ওহোমের বাবা।
আম্মা আবার প্রশ্ন করলেন,
‘ তহন অমিতের লগে বিয়া হইছিলো?
সুমনা একটু হাসির চেষ্টায় বললো,
‘ হ্যাঁ তার দুইমাস আগেই বিয়ে হয়েছিল। ওহোমের বাবার দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছিলাম অমিতের উপর। কারণ হৃদ বাচ্চার দায় নিবেনা, এবং বিয়ের জন্যও সময় চায় ৪ বছর। কিন্তু আমি ওহোমকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। সেটার জন্য বুদ্ধি পেলাম আমাদের ঘরের সহজ সরল ড্রাইভারের উপর চাপিয়ে দেওয়াকে। কেননা ড্রাইভারকে বিয়ে করা না করা তো সমান, কেননা সে আমাদের কথার গোলাম। আর মনে হলো এটা করলে আমি হৃদকেও পাবো,সন্তানও বাঁচবে। আর হৃদ তো জানেই ওহোম তার সন্তান, পরে যখন ওর বিয়ের অবস্থান পাকা হবে তখন অমিতকে একটা সাইনেই আজীবনের জন্য ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো হৃদের কাছে! বাবা অমিতকে এই অপরাধে অনেক মেরেছিলো, তার সাহসের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন, দরিদ্রতা ছাড়া ওর মধ্যে খারাপ কিছু তো দেখেনি। কিন্তু আমি মানিনি, আমার অত্যাচারে অমিত জর্জরিত ছিলো। বাসায় ছিলাম আর ওর উপর কোনোভাবে আঘাত করিনি এমন একটা দিনও ছিল না। চাচ্ছিলাম এবার সরে যাক, বাচ্চার দায়ভারে তো আর আমাকে জবাবদিহি করতে হবে না! অমিত সব সহ্য করেও কেন জানি ছিল!
ওর বেতন কমিয়ে দিলাম, খাবার ঠিকঠাক ছিলোনা, তারপর তো আঘাত আছেই । আর আমি ব্যস্ত ছিলাম হৃদকে নিয়ে।
কিন্তু বাচ্চা ডেলিভারির চারমাস আগে থেকে হৃদের সাথে দেখা হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
আর আমি বিরক্ত হতে থাকি অমিতের উপর, ওর সাথে খারাপ আচরণের পরিমাণ যেন কয়েকগুন বেড়ে গেলো। এর অবশ্য কারণ ছিলো, সেটা হলো আমি শুনছিলাম হৃদ অন্য কারো সাথে ঘুরাফেরা করছে! আমার খোঁজখবরও নিচ্ছেনা।
এইটুকু বলার পর পরেই আমার শাশুড়ী কানের দিকে এলোপাতাড়ি একটা থাপ্পড় মারলেন। থাপ্পড়ের ঝাঁকিতে অর্ধেক চুল এসে তার মুখ ঢেকে দিলো।
সুমনা তবুও স্বাভাবিক চোখে তাকালো। আমার শাশুড়ীর নাকের ডগা লাল হয়ে গেলো। কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
‘ অসভ্য! আবার বড় গলায় বলিতেছিস এসব? আমিও তো উত্তর মিলাতে পারিনা, আমার ফুলের মতো ছেলেটা হঠাৎ কাঁটায় রূপ নিলো কেন? তারপর তারপর বল আর কি করেছিস? তোকে পুলিশে দিবো আমি !
সুমনা হাসলো। আর তীব্র হাসির সাথেই বললো,
‘ বহু শাস্তি পেয়ে গেছি আমি,আর কোনো শাস্তির পরোয়া করিনা এখন । আমাকে হৃদও ছেড়ে গিয়েছিলো।৷ আর তখন সেই এলোমেলো সময়ে অমিতের উপর আরো অত্যাচার করছিলাম, আরো খারাপ আচরণের স্বীকার হচ্ছিলো সে! কিন্তু অমিত তখনো ধৈর্যশীল ছিলো, সে ওহোমের ঠিকঠাক যত্ন নিতো, আমার যা যখন লাগবে সব উপস্থিত রাখতো।
আমি ভেবেছিলাম অমিত সবসময়ই বুঝি এমন থাকবে, ভীষণ সস্তা আর অবহেলায় ওকে রোজ ক্ষত বিক্ষত করার মাঝে হঠাৎই একদিন দেখলাম অমিতও নেই। অমিত কোথাও নেই! না না তখনও আমি অমিতের শূন্যতা বুঝতে পারিনি। বুঝতে পেরেছিলাম কয়দিন পরে! মা যখন স্ট্রোক করে মারা গিয়েছিল। আর তখন বাবাও সুন্দরমতো আরেকটা বিয়ে করে নিয়েছিলো। দুনিয়ায় আমার বলতে আর আমি ওহোম ছাড়া আর কাউকেই দেখছিলাম না। ঘরে ভালোমতো ঠাঁই পাচ্ছিলাম না, ওই নতুন মায়ের সব খবরদারী চলতো!
তখন শুধু মনে হতো অমিতের উপরে করা প্রতিটা আঘাতের কথা। আমি রাতবিরেতে অমিতকে স্বপ্নে দেখে কেঁদে ওঠতাম। তন্নতন্ন করে খুঁজে চললাম, শুধু প্রায়শ্চিত্ত করতে! কিন্তু ওকে আর পাইনি। আমার সেই করুণ অবস্থায় আবার ওহোমও এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়, কয়েকদিনে সেও আমাকে ছেড়ে চলে যায়। শুধুমাত্র বাবা ছিল, যেও কিনা থেকেও নাই হয়ে গেছে। নতুন মায়ের কথায় উঠবস করতো, বৃদ্ধ বয়সে ২৫ বছরের মহিলা বিয়ে করেছিলো যে! আমার চেয়েও ওই মহিলার বয়স কম ছিলো। বাংলাদেশী এক প্রবাসীকেই বিয়ে করেছিলেন।
এদিকে অমিতের জন্য পাগলের মতো চারদিকে ছুটতে লাগলাম, কোনো দিশা পাইনি। শেষ পর্যন্ত অনেক খোঁজ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলাদেশে আসবো, মনে হচ্ছিলো হয়তো অমিতের অভিশাপেই আমি এমন অভিশপ্ত জীবনের সম্মুখীন হয়েছি, এখন তার পায়ে পড়ে যদি একটু করুণা পাই তাহলেও আমি শান্তি পাবো। কিন্তু এসে দেখলাম নাহ সব অন্য রকম হয়ে গেছে। অমিত আর অমিত নেই, একটা পাথর হয়ে গেছে সে। অবশ্য এর জন্য আমিই দায়ী। একটা ভালো মানুষের মস্তিষ্ককে আমি কলুষিত করে ফেলেছি। ও আমাকে জীবন গেলেও ক্ষমা করবেনা, আর সেটা সারারাতে উপলব্ধি করে ফেলেছি আমি ।
বলেই সুমনা থামলো। আমি আস্তে আস্তে বললাম,
‘ আপনারে আবার দেখলেও উনি কিরম মাত্রায় রাগেন আল্লাহ ভালা জানে!
সুমনা আমার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমার গালে একটা হাত বললো,
‘ তুমি বড় ভাগ্যবতী! আমি আর অমিতের সামনে আসবোওনা। কেননা তার জীবনকে দ্বিতীয়বার নরক বানানোর অধিকার নেই, না আছে তার সুখে অসুখ হয়ে দাঁড়ানোর অধিকার। তবে ভীষণ লাগছে একটা সুখী সুন্দর সম্পর্ক দেখতে। ভালো থেকো চৈতি! ওকে বলো যেন আমাকে পারলে ক্ষমা করে।
বলেই সুমনা পেছনে তাকাতে তাকাতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। অমিতের মতো সেও বললো,
‘ দরজাটা লাগিয়ে দাও।
আমি বাধ্যমতো দরজা বন্ধ করে দিলাম! আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনার মুখটা মলিন।
আমি উনার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
‘ এইডা কোনো বিয়াই আছিল না আম্মা। এইডা একটা অত্যাচার আছিলো, তাই এরপর যখন অমিতের এইডা মনে হয়তো তখনই রাইগা যাইতো।
আম্মা মাথা ঝাকালো।
দুপুরের দিকে অমিত আসলো! হাতে রক্তলাল দুইটা জবা! দরজা খুলে দিতেই অমিত দুটো জবাকেই আমার এক কানে গুঁজে বললো,
‘ আমার রাঙাবউ!
আমি মাথা নুয়ে হাসলাম। অমিত প্রশ্ন করেনি সুমনা এসেছিলো কিনা! শুধু হাসিমুখে বললো,
‘ চৈতি খেতে দাও। আর শুনো নাফিজসহ তোমাদের বাড়ির সবাইকে আজকে বিকেলে আমাদের এখানে নিয়ে আসবো! ওদের সবার দাওয়াত আজকে।
আমি কোনো প্রশ্ন না করে হাসলাম। একটা স্নিগ্ধসুন্দর হাসি! শেষ হচ্ছে একটা মানুষের ভেতরকার উত্তাপময় চৈত্র! সেখান থেকে শুরু হবে বৈশাখ, আর সাথে নতুনত্ব! একটা নির্মল নিষ্পাপ প্রাণের পুনরায় সূচনা হচ্ছে, এখানে অনেক চৈত্র আসবে তবে আর ভেতর ছুঁবেনা, কোনো ভয়ংকর উত্তাপ ছড়াবেনা।
(সমাপ্ত)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার