#মনের_অন্দরমহলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫৪
ঘড়ির দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে মৃধা। এখনো বারোটা বাজেনি। গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে সে। ইতিমধ্যে জীবন ভাইয়া কয়েকবার ডেকে গেছে খাওয়ার জন্য। কিন্তু এই মূহুর্তে তার গলার নিচ দিয়ে খাবার নামবে বলে মনে হয় না। বেডের এক কোণায় জানালার ধারে বসে আছে। বাইরে আমগাছের পাতাগুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে। মাঝে মাঝে আকাশে দেখা যাচ্ছে আলোর ঝিলিক। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে ওঠাতেই ফোনের দিকে চোখ পড়ে মৃধার। অর্ক একাধারে ফোন করে যাচ্ছে তাকে। তবুও মৃধার কোনো হেলদোল হয় না। ফোন তোলে না সে। ফোনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে বাইরের মেইন রোডের ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোর দিকে তাকায়। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।
এই বৃষ্টি কি মৃধার মনের সব অস্বস্তি এবং অস্থিরতা ধুয়ে দিয়ে সক্ষম? তার মনে পড়ে বিকেলের কথা।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্ক। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের মিষ্টি রোদটুকু ছুঁয়ে গেছে তাকে। হালকা চোখমুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে সে। প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেল তার এখানে আসার। কিন্তু মৃধা এখনো এসে পৌঁছায়নি। কপাল কুঁচকে একধ্যানে চেয়ে আছে নদীর দিকে। স্রোতধারা বয়ে যাচ্ছে। সেটা দেখে অর্ক ভাবে, এই স্রোতধারার মতো জীবনটা যদি মৃধার সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া যায় তাহলে জীবনের পর্যায়ে বিভিন্ন ধাক্কাগুলো সে অনায়াসে সামলে নিতে পারবে। মৃধার হাসিমুখটা দেখে সে শতশত দুঃখ নিজের কাঁধে তুলতে পারবে।
মুচকি হাসতে থাকে অর্ক। হাসতে হাসতে তার চোখে আঁটকে যায় লাল রঙের ড্রেস পড়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসা মেয়েটি। ওড়না এদিক-ওদিক সামলিয়ে হেঁটে আসছে মৃধা। অর্কের হাসি প্রসারিত হয়। তাড়াহুড়ো করে অর্কের সামনে এসে দাঁড়ায় মৃধা। আর বাহানা দেখিয়ে বলে,
–“সরি সরি! লেট হয়ে গেল। আসলে আমার মনে হয় সময় আমার সাথে কোনো শত্রুতা করে। নয়ত আপনিই ভাবুন আমি যেখানেই বের হতে যাই সেখানেই লেট?আমি তো বুঝতেই পারি না আমি সময়ের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি।”
অর্ক মৃধার এমন উদ্ভট কথা শুনে উচ্চস্বরে হেঁসে দেয়।
–“সময়েরও কারো সাথে শত্রুতা থাকে? আপনি না বললে জানতামই না।”
–“এজন্যই তো বলি আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। অনেককিছু শিখতে পারবেন।”
–“আপনার কথাই তো সারাজীবন শুনতে চাই। আপনি যদি সুযোগ দেন তো!”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকায় মৃধা। অর্ক তার দিকে শীতল নয়নে তাকিয়ে রয়েছে। সে তো মজা করছিল। কিন্তু অর্ক কখন সিরিয়াস হয়ে গেল? মৃধা দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
–“সামনে হাঁটা যাক? জায়গাটা সুন্দর। হাঁটতে থাকি?”
অর্ক মাথা দুলিয়ে মৃধার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। এ পর্যায়ে সে বলে,
–“আমার চাকরিটা হয়ে গেছে। ভাইবা, পরিক্ষা সব দেওয়ার পর অবশেষে চাকরিটা হয়ে গেল।”
মৃধা খুশিতে আটখানা হয়ে বলে,
–“সত্যি? কংগ্রাচুলেশনস।”
অর্ক এর পরিবর্তে মিষ্টি হেঁসে দেয়। আর মিহি সুরে বলে,
–“চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে মা তো একেবারে জেদ ধরেই বসেছে এবার উনার একটা বউমা চাই। ভাবছি বিয়েটা করেই ফেলব।”
–“তো করে ফেলুন। যেহেতু চাকরিও পেয়ে গেছেন। আন্টিও চাইছেন। শুভ কাজে দেরি কীসের?”
–“আমিও সেটাই ভাবছিলাম। বিয়েটা করেই ফেলা যাক। যদি পছন্দের মানুষ রাজি থাকে তো দেরি করে কি লাভ?”
মৃধার পা থেমে যায় কোনো এক কারণে। হয়ত অর্কের ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছে সে। সে ইতস্ততবোধ করে বেশ। কি বলবে বুঝতে পারে না। আচমকা অর্ক তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ানোতে ভড়কে যায় সে।
–“আর হাঁটবেন না?”
মৃধার এমন প্রশ্ন পাত্তা দেয় না অর্ক। অর্কের হাতে একটা শপিং ব্যাগ ছিল। সেখান থেকে একগুচ্ছ গোলাপের ফুল বের করে অর্ক। মৃধা অবাক নয়নে দেখে তার কর্মকান্ড। অর্ক কি করতে চায় সেটা খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছে সে। ঢক গিলে তাকায় মৃধা অর্কের দিকে। অর্ক আচমকা মৃধার হাত ধরতেই চমকে উঠে তাকায় মৃধা। তার চোখমুখের রঙ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে।
–“ক…কি করছেন আপনি?”
–“আমি আপনাকে ভালোবাসি মৃধা। হঠাৎ করেই দমকা হাওয়ার মতো আপনি আমার জীবনে এসেছিলেন। আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ ঝড়ের মতোই হয়েছিল। ঝড় হঠাৎ গিয়েছিল। আমি তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের মতো থেকেছি এক বছর। এক বছর সেই তৃষ্ণা মেটাতে আপনার আগমন হলো। বুঝেছিলাম আপনি আমাকে আমার মন থেকে আপনাকে মুছতে দেবেন না। নয়ত কেনই বা আপনার আগমন ঘটল আবার? আমি লুকোচুরি খেলতে পারি না। ধরা দিলাম আপনার সামনে। বাকিটা আপনার হাতে। আমি আপনার সঙ্গে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত কাটাতে চাই।”
ভাষা হারিয়ে ফেলল মৃধা। স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল এক নয়নে। কি বলবে সে? বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর মৃধা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। অর্ক তার সামনে গুচ্ছ গোলাপফুল ধরল। আর বলল,
–“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। জোরজবরি করে নয়। যদি আপনার ইচ্ছে থাকে তবেই বিষয়টা এগোবে।”
–“আপনাকে আমি প্রথম থেকে বন্ধু ভেবে এসেছি। আপনি তো জানেন মনের এক স্থান আমি আয়াশ স্যারকে দিয়েছিলাম। যখন জানলাম উনাকে নিয়ে মিছিমিছি এতো ভাবছি, অযথায় এতো স্বপ্ন দেখছি তখন ভেঙে পড়লাম। আপনি আমায় সামলালেন। হঠাৎ করে বিয়ের প্রস্তাব আমি মানতে পারছি না। আমাকে সময় দেবেন প্লিজ?”
অর্ক হতাশ হলেও আশা হারালো না। মৃধা তো ওকে সরাসরি মানা করে দেয়নি। সে জোর করে হেঁসে বলল,
–“আমিও পাগল। সময় না বুঝেই বিয়ের কথাও বলে ফেললাম। আপনি সময় নিন।”
–“আ..আব আমার ফোন এসেছে মণিমার। আমায় যেতে হবে।”
বাহানা খুঁজে না পেয়ে ফোনের বাহানা দিল মৃধা। অর্ক চোখমুখ মলিন করে মাথা দুলাতেই পিছু ফিরে হাঁটতে শুরু করে মৃধা। পেছন থেকে আবারও ডাকে অর্ক। এসে মৃধার খোঁপায় দুটো লাল গোলাপ গুঁজে দেয় হঠাৎই। আর বাকি ফুলগুলো মৃধার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
–“বন্ধু হিসেবেও তো ফুলগুলো গ্রহন করতে পারেন।”
বর্তমানে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বসে আছে মৃধা। বৃষ্টির বেগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ফোনে মেসেজ এলো। মৃধা ফোন হাতে নিল না। স্ক্রিন থেকেই দেখল অর্কের নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে। লিখা রয়েছে, ‘বিকেলের কোনো কথা কি আপনার খারাপ লেগেছে? তাহলে দুঃখিত।’
ফোনটা তবুও হাতে ধরে না মৃধা। পলকহীন ভাবে চেয়ে থাকে। তার কি করা উচিত?
তখন থেকে চোখবুঁজে শুয়ে রয়েছেন আয়াশ। কথার কোনোপ্রকার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। আমি হতাশ চোখে উনার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। কি হয়েছে উনার?
–“কি হয়েছে আপনার? এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছেন কেন আপনি?”
এবার বিরক্ত হয়ে চিল্লিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি। আয়াশের তবুও হেলদোল হলো না। আসার পর থেকে সেই এক কাপড়ে শুয়ে রয়েছেন। এবার নড়চড়ে উঠে চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন উনি। এবার আমার হাত ধরে টেনে আমায় বুকে ফেলে লাল চোখজোড়া দ্বারা আমায় পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। বাইরে ঝুম বৃষ্টির আওয়াজ কানে আসছে আর শীতল আবহাওয়া মনকে মাতোয়ারা করে তুলছে। কিন্তু আমি জানতে চাই আয়াশের কি হয়েছে?
–“আমি কেঁদেছি তুমি কি করে বুঝলে?”
আমার দিকে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন উনি। আমি সোজাভাবে উত্তর দিলাম,
–“রাগলে মানুষের চোখ লাল হয়ে যায় সেটা জানি তবে সেটা ক্ষণিকের জন্য। কাঁদলে চোখজোড়া ফুলে ওঠে। সেটা বোধহয় আপনি জানেন না।”
–“আচ্ছা নিশাপাখি মানুষ যদি মারা যায় তাকে ফিরে পাওয়া যায় না?”
স্তব্ধ হয়ে গেলাম এমন কথায়। বুঝতে দেরি হলো না যে উনি উনার মাকে মিস করছেন! হয়ত সেকারণেই কেঁদেও ফেলেছেন। আমি কিছু না বলতেই উনি নিজেই হেঁসে দিয়ে নিজের মাথায় টোকা মেরে বললেন,
–“আমিও না পাগল! কি করে ফিরে আসবে? আসার তো কোনো পথ নেই।”
–“আপনার কষ্ট আমি ভাগ করে নিতে চাই। পারলে আপনার সব কষ্ট আমি শুষে নিতে চাই। আপনাকে যে সেই হাসিমুখেই বড্ড মানায়। সেই মনোমুগ্ধকর মানুষটাকে হাসিতেই মানায়।”
আনমনে হয়ে উনার বুকে মাথা রেখে বললাম আমি। আয়াশ হাসলেন। উনার হাসিতে মুখরিত হলো পরিবেশ। অতঃপর বললেন,
–“সেই কষ্ট শুষে নেওয়ার জন্য তুমি কি থাকবে?”
মুখ তুলে হতভম্ব হয়ে তাকালাম আমি। মানে কি বলছেন? আয়াশ উঠে বসলেন। আমি উনাকে প্রশ্ন করতে চাইতেই উনি বললেন,
–“শাওয়ার নিতে যাচ্ছি।”
উঠে হনহনিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন উনি। আমি হা হয়ে চেয়ে থাকলাম। ফোন নিয়ে বসে পড়লাম এবার। ফোনের স্ক্রিন অন করতেই চোখে পড়ল তারিখের দিকে। আর একটু পরই বারোটা বাজবে। মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি! তারপর তো আমার জন্মদিন। আয়াশ কি এবার আমার জন্মদিনের কথা ভুলে গিয়েছেন? যেতেই পারে। তাতে তো আমারই ভালো। আমি সময় পেয়ে যাব বেশি করে সোজাসুজি মনের কথা বলবার। ফেসবুকে ঢুকতেই নিউজ সাইটগুলোতে চোখ পড়ে আমার। সঙ্গে সঙ্গে চোখজোড়া কপালে উঠে যায়। আরো ঘাঁটাঘাঁটি করে বের বিস্তারিত। বড় বড় করে লিখা আছে,
–“অবশেষে তিন অপরাধীর খোঁজ পাওয়া গেল। রক্তিম বাহাদুর, মালিহা রায়হান এবং নীলাদ্র হোসাইনকে গ্রেফতার করল পুলিশ।”
লিখার সঙ্গে ছবিও দেওয়া আছে। কিন্তু ছবিগুলো চিনতে পারছি না কেন? এ কেমন অবস্থা সবার? তিনজনের মধ্যে একজনেও মাথাতেও চুল নামক কোনো জিনিস নেই। উদ্ভট লাগছে সকলকে ছবিতে। কি রিয়েকশন দেব বুঝতে না পেরে খিলখিল করে হেঁসে দিলাম। যদিও আমার হাসা উচিত নয়। তবুও হাসি পেল আমার। হাসতে না চেয়েও হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেলাম আমি। বলা যায় কিছুটা হলেও শিক্ষা হয়েছে। কিন্তু এদের এই অবস্থা করল কে? আয়াশ?
উনার কথা ভাবতে ভাবতেই ওয়াশরুমের দরজার দিকে চোখ পড়ল। তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল। খালি গায়ে টাওয়াল পেঁচিয়ে দাঁড়ালেন দরজার কাছে আর বললেন,
–“এভাবে হাসলে ওয়াশরুমে শাওয়ার নেওয়া যায়?”
আমি চোখজোড়া সরু করে বললাম,
–“আমি তো এখানে হাসছি। সমস্যা কোথায়?”
–“বিরাট বড় সমস্যা, অনেক বড় সমস্যা। যার হাসির শব্দ মনের মধ্যে উথাল-পাতাল ঢেউ খেলিয়ে দেয় তাকে সামনাসামনি না দেখে কি করে থাকব?”
হাসিটা পরক্ষণেই বন্ধ হয়ে এলো আমার। এতোটা লজ্জায় ফেলার কোনো কি দরকার আছে? কেন এতোটা ভালোবাসতে বলেছে উনাকে? এই ভালোবাসায় যে আমি তলিয়ে যাই। আয়াশ ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,
–“এনিওয়ে, এখানে আরেকটা টাওয়াল কোথায়? মাথা মুছব কি দিয়ে?”
–“দুটো টাওয়াল ওয়াশরুমেই থাকে।”
–“এখানে নেই বলেই জিজ্ঞেস করছি। এখানে এসে দেখো।”
আমি আগে ঘরের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। ঘরে তো টাওয়াল নেই। উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম ওয়াশরুমের সামনে। ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিতেই আচমকা ঠান্ডা হাতটা আমার কোমরে রাখলেন আয়াশ। চোখ দুটো রসগোল্লার মতো হয়ে গেল আমার। কিছু বলা বা করার আগেই টেনে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে নিলেন উনি। দরজাটা বন্ধ করে দিতেই চিল্লিয়ে বললাম,
–“কি করছেন? আপনি শাওয়ার নিচ্ছিলেন আমায় কেন টেনে আনলেন।”
আয়াশ তার জবাব না দিয়ে একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বাথটাবের কাছে গিয়ে সেখানে বসলেন। পানিভর্তি বাথটাবে বসে পড়তেই আমি রেগেমেগে বললাম,
–“আপনি কি নিজে কি করে শাওয়ার নিচ্ছেন সেটা আমায় দেখাতে এনেছেন?”
আচমকাই আমার হাতটা ধরে টান দিতেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে পড়লাম পানিভর্তি বাথটাবে আয়াশের ওপর। পুরো শরীর, মুখ আর চুল ভিজে একাকার হয়ে গেল আমার। এখনো পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি আয়াশের বুকে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
–“কি করলেন আপনি এটা? রাতের বেলা আমাকে ভিজিয়ে দিলেন?”
এরপর উনি আমাকে যা বললেন তাতে আমার সব বিরক্তি উধাও হয়ে গেল।
–“হ্যাপি বার্থডে নিশাপাখি। ইউ আর এইটটিন নাউ। জীবনের সব খুশি, সব আনন্দ যেন তুমিই পাও। তোমার জীবনের সব কষ্ট দূর হয়ে যাক। সেইসব কষ্টগুলো যেন আমি পাই আর আমার খুশি যেন তুমি পাও।”
আমি স্থির হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলাম। কন্ঠস্বর মিলিয়ে গেছে। কথা বলার মতো শক্তি পাচ্ছি না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে শক্তি জুগিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করতেই আয়াশ নিজের পানি দিয়ে ভেজা হাত আমার ঠোঁটে রেখে মাথা নাড়িয়ে বললেন,
–“না! বলবে না কিছু। তুমি হয়ত এটাই ভাবছো যে, কেন আমার খুশি তুমি নেবে? কেন তোমার দুঃখ আমি নেব? এতোটা ভালো কি করে আমি? তাহলে তুমি ভুল ভাবছো। আমি সেই খারাপই আছি। নিজের স্বার্থের কথায় ভাবছি। তোমাকে আমার খুশি নিতে বললাম কারণ তোমার খুশিতে আমি নিজের সুখ খুঁজে পাই। তোমার জন্য আমি মোটেও এই কথা বলিনি। বলেছি তো নিজের সুখের জন্য। হলাম না আমি স্বার্থপর?”
–“এতোটা স্বার্থপর না হলেও পারতেন। স্বার্থপরতা যে এতোটা সুন্দরও হতে পারে সেটা আপনি দেখিয়ে দিলেন।”
আয়াশ আমার ঠোঁটের সাথে লেপ্টে থাকা ভেজা চুল সরিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন,
–“এখানে ছুঁইয়ে দেওয়ার অধিকার তো একমাত্র আমারই ছিল না? তোমার চুল কি করে এই অধিকার পেলো?”
আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থেমে থেমে বললাম,
–“চুল তো যেখানে সেখানে পড়তেই পারে।”
–“না থাকবে না। আই এম জেলাস!”
এবার সত্যিই উনার কথায় হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারছি না আমি। দোটানা রিয়েকশন নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। উনি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
–“আমিই হয়ত ফার্স্ট পারসন যে নিজের বউকে বার্থডে উইশ ওয়াশরুমে এমন রোমান্টিক স্টাইলে করছে।”
লজ্জায় কান গরম হয়ে এলো আমার। উনার বুকে কয়েকটা কিল দিয়ে উঠে দৌড়ে বাইরে চলে এলাম। বড় বড় শ্বাস নিতে থাকলাম। এ ছিল আমার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি!
গাড়ি ছুটছে। হয়তবা প্রায় একটা বাজে। ঢাকা শহরে সারারাত গাড়ি চলাচল করলেও এসময় রাস্তা অনেকটা ফাঁকা থাকে। আয়াশ গম্ভীর মুখভঙ্গি নিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবারের মতো কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাওয়া গেল না। কিন্তু রাস্তার বোর্ড দেখে মনে হচ্ছে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছি। এবার কোন চমক দিতে চলেছেন উনি? আমার মনে পড়ল তখন নীলাদ্র আর বাকি সকলের কথা। উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–“নিউজ পেজে দেখলাম ওরা মানে রক্তিম বাহাদুর রা ধরা পড়েছে। কিন্তু ওদের ওই অবস্থা কেন? আপনি করেছেন?”
–“আমি করব কেন? জনগন করেছে। গণধোলাই খেলে যা হয়। মাথার চুল কেটে দিয়ে ঘোল ঢেলে দিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরানো হয়েছে। অগুনতি মাইর তো আছেই।”
নির্বিকার সুরে বললেন উনি। আমি বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে রইলাম। উৎকন্ঠা হয়ে জানতে চাইলাম,
–“কিহ? গণধোলাই খেয়েছে ওরা? কি করে?”
–“সিম্পল। ওরা আমার কাছে ছিল ছেড়ে দিয়ে লোকজন দ্বারা ওই অঞ্চলের সকলকে জানিয়ে দিয়েছি। আর যেখানে ওরা ছিল সেই জায়গা থেকে ওরা একটা মেলা থেকে প্রায় ২০-৩০ জন মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। যারা অনেকে উদ্ধার হয়েছে আবার অনেকে নির্যাতনে মারা গিয়েছে। সেই হিসেবে লোকজন ওদের ওপর ক্ষেপে ছিল। সকলের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিল ওরা। কিন্তু পরিবর্তে মার জুটল কপালে। আমি তো জাস্ট ইনজয় করছিলাম। অবশেষে পুলিশ খবর পেয়ে এসে ধরে নিয়ে গেল।”
হা হয়ে গেলাম। বিস্ময় কাটাতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। তখনই আয়াশ গাড়ি থামিয়ে কোথাও একটা গেলেন আমায় থাকতে বলে। মিনিট পাঁচেক পর দুটো জুস নিয়ে এসে আমায় দিয়ে বললেন,
–“নাও খাও।”
আমি খেতে না চাইলেও গলা ভেজাতে ঢকঢক করে খেয়েই ফেলি। আয়াশ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আবারও ড্রাইভ করা শুরু করলেন। মিনিট দুয়েক পরই চোখে সবটা ঘোলা দেখতে শুরু করলাম। আয়াশ হেঁসে বললেন,
–“আমায় এতো বিশ্বাস করলে? মনে আছে আগের বছরের কথা? মনে হয়নি? এবারও একই কাজ করতে পারি?”
আমি চোখ মেলে থাকার চেষ্টা করেও ঢলে পড়লাম আয়াশের কাঁধে। অস্পষ্ট কন্ঠে বলার চেষ্টা করলাম,
–“আ…আপনি… আপনি!”
–“আমি অনেক খারাপ নিশাপাখি। ওই বছর আর এই বছরের পার্থক্য একটাই ওই বছরে তোমায় ফিরিয়ে এনেছি নিজের বাড়ি থেকে এই বছরে তোমায় নিজের বাড়ি রেখে আসব। মুক্তি করে দেব। ১ বছর শেষ।”
আমি কিছু বলতে পারছি না শুধু শুনছি। উনি আবারও বললেন,
–“ডিভোর্সের জন্য কোনো পেপার লাগবে না। ডিভোর্স স্পেশালিষ্ট লইয়ার আমায় বললেন আমাদের বিয়েটা যেহেতু আইনত হয়নি সেহেতু তুমি আমায় মৌখিক ডিভোর্স দিতে পারো। আজকে তোমার জন্মদিন। এটা তোমার জীবনের সবথেকে বড় পাওনা! মুক্তি! ঠিক কি না?”
সবকথা শুনতে পাওয়ার পরেই পুরো চোখ বন্ধ হয়ে এলো আমার। আর কিছু বলতে পারলাম না। শোনার অবস্থাতেও রইলাম না।
চলবে…
[বি.দ্র. আর দুই পর্বে শেষ করে দেবার চেষ্টা করব। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতা খুঁজবেন না। ]