#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
২৩.
আদ্রিশ চারদিন যাবৎ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরেছে। হাসপাতালে ওকে নয়দিন থাকতে হয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর বাড়িতে এসেছে। ও বাড়িতে ফেরার পর আর বের হয়নি। ওর অফিস, ব্যবসা বানিজ্য সেজান সামলাচ্ছে। আদ্রিশের এসব আর ভালো লাগে না। কিছু করতে ইচ্ছে হয় না। ইচ্ছেগুলো রুশা সাথে করে নিয়ে গেছে। নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছে। যখন সবকিছু মাথায় চাড়া দিয়ে উঠে তখন সামনে যা পায় তাতে রাগ মিটিয়ে ড্রিংক করে নেশায় বুদ হয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় রুশার মুখোমুখি হতে, জানতে ইচ্ছে করে কোন অপরাধের এত বড় শাস্তি পেল। কিন্তু ইচ্ছে করেই সেই ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখে। রুশা এখন কোথায় আছে জানে না আর জানতেও চায় না। রুশার মুখোমুখি হলে একটা অঘটন ঘটে যাবে। যেটা আদ্রিশ চাইছে না। তবে কতদিন পর্যন্ত এই ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে পারবে তাতেও বেশ সন্দিহান৷ সেজান আদ্রিশের এই অবস্থা নিতে পারছে না। ও এখন আদ্রিশের বাড়িতে থাকে। যতদিন সিচুয়েশন স্বাভাবিক না হচ্ছে এখানেই থাকবে। আদ্রিশকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে অনেক বার জিজ্ঞেস করে ফেলেছে রুশার ব্যাপারে, সেদিন কি হয়েছি সে ব্যাপারে কিন্তু আদ্রিশ একটা কথাও বলেনি আর সেজানের উপর রাগারাগিও করেনি। সেজান এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। তবে সেদিন কিছু একটা তো হয়েছিলই যে কারণে আদ্রিশ এমন বিহেভ করছে। আর রুশা নিজে বলেছে ও রুশা না পিউ, ওদের শত্রু। রুশার অন্য একটা পরিচয় আছে কিন্তু সেটা কি আর ও কে কিছুই জানে না। এতকিছুর মধ্যে একটা প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা হলো রুশা আদ্রিশের শত্রু হওয়ার পরেও কেন ওকে বাঁচালো? কেন নিজের লোকের সাথে লড়ায় করে আদ্রিশকে ওর হাতে তুলে দিল? সেজান জানে না কিছু।
দুদিন আগের ঘটনা। সেজান রাতের বেলায় কথার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। ওর মাথায় রিভলবার রেখে বলেছিল রুশার ব্যাপারে যা যা জানে সবকিছু বলতে। কিন্তু কথা বেচারি রুশার ব্যাপারে এসব শুনে ট্রমায় চলে যায়। কারণ ও নিজেও এতটুকুই জানতো যতটুকু সেজান জানে। সেদিন কথা বলেছিল,
“বিশ্বাস করুন, আমি রুশা আপুর ব্যাপারে এটুকুই জানি যে উনার কেউ নেই। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাড়িতে তিনি অনাথ আশ্রম গড়েছেন। বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য টিচার প্রয়োজন তাই আমি এপ্লাই করেছিলাম। আর জবটা পেয়ে যাই।”
সেজান ওর কথা বিশ্বাস করেনি সেদিন। রিভলবার আরো চেপে ধরে বলেছিল,
“সত্যিটা বলে দেও, নয়তো আজ শেষ বারের মতো পৃথিবীর আলো দেখবে।”
“আমি কোন সত্যি বলব? আমি এটুকুই জানি।”
“অসম্ভব। একটা মেয়ে এখানে বসে এতকিছু করেছে আর তুমি ওর কাছের মানুষ হয়ে জানবে না? তুমিও ওর সঙ্গে আছো তাই না? তোমার এই পরিচয়টাও ফেক তাই না? তোমারও অন্য পরিচয় আছে। তোমরা কার হয়ে কাজ করো?”
কথা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“কি বলছেন আপনি এসব? আমাকে দেখে এমন মনে হয়?”
“ভাবিকে দেখেও এমন মনে হয়নি। কিন্তু তিনি যে খেল দেখালো তাতে অনেক কিছুই মনে হচ্ছে। ভাবি এখন কোথায় আছে? তাড়াতাড়ি বলো।”
“আমি জানি না। আমি সত্যিই কিছু জানি না। আমি রুশা আপুকে তার বিয়ের দুইমাস আগে থেকে চিনি। তার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।”
সেজান এক কথা শুনতে শুনতে রেগে যায়। তরতর করে ঘামছে। রাগান্বিত কন্ঠে বলেছিল,
“যারা কোনো গ্যাং এর হয়ে কাজ করে তারা এমনই বলে। জান দিয়ে দেবে তবুও মুখ খুলে না। এতদিন শুনেছি আজ নিজের চোখে দেখলাম। আর এই তোকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। এতদিন মনে মনে চেয়েছিলাম, স্বপ্ন দেখেছিলাম। বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। ছিহ! আজ ঘৃণা হচ্ছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া ভাইয়ের মতো ধোঁকা খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার আগে বেঁচে গেছি।”
কথা নির্বাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। স্থির চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কয়েকবার পলক ফেলে বলল,
“এর বাইরে আমার আর কোনো পরিচয় নেই। আপনাদের সাথে যে ধোঁকা হয়েছে আমার সাথেও একই ধোঁকা হয়েছে। আপনারা যতটুকু জানেন আমিও ততটুকুই জানি। যদি বিশ্বাস না হয় তবে যা করতে এসেছেন তাই করুন। আমি মরে গেলে এই পৃথিবীতে কাঁদার মতো কেউ নেই। কেউ আমার জন্য কষ্ট পাবে না। আর আমারও আফসোস নেই।”
সেজান প্রতি উত্তরে কিছু না বলে রিভলবার প্যান্টে গুজে চলে গেল। কথা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। সেজান ওকে ভালোবাসত, বিয়ে করতে চেয়েছিল? কথারও মনে হয়েছিল সেজান ওকে পছন্দ করে। ওর নিজেরও সেজানকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল। তারপর বারবার নিজেকে ফিরিয়ে নিয়েছিল। মনকে বুঝিয়েছিল ওর ধারণা সত্যি না হলে এই অনুভূতির জন্য কষ্ট পাবে। কিন্তু আজ ওর ধারণা সত্যি হওয়ার পরেও কষ্ট হচ্ছে। সেজানকে আজ পেয়েও হারিয়ে ফেলল। সেজান ওর সরলতাকে বিশ্বাস করছে না।
****
অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। রুশা শহর থেকে দূরে এক ফ্লাটে একা থাকে। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় গোপনে আদ্রিশের খোঁজ নিয়েছে। ওর সুস্থতা নিশ্চিত করার পরেই লন্ডন যাওয়ার জন্য কাগজপত্র তৈরি করেছে। রুশা এখন লন্ডনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কাগজপত্র প্রস্তুত হতে একটু সময় লাগবে। আগামী দশ-বারো দিনের মধ্যে লন্ডন চলে যেতে পারবে বলে আশা করছে। মোটামুটি সব মিলিয়ে দুই মাসের জন্য ও বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। যতদিন দরকার এখানে থাকবে। এখানেই নিয়মিত বেবির চেকাপ করছে। রকি এর মধ্যে একবার কল করেছিল। রকির সাথে ওর কথা কাটাকাটি হয়। দুজনের মধ্যেই বেশ রাগারাগি হয়েছে। দুজনের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তা নষ্টের পথে।
কয়েকদিন পর আদ্রিশ সিদ্ধান্ত নিল রুশার মুখোমুখি হবে। নিজের জন্য না হোক ওদের বাচ্চার জন্য। প্রথমে হাসপাতালে সেই ডাক্তারের সাথে মিট করে যিনি রুশার মিস ক্যারেজ কনফার্ম করেছিলেন। তাকে গিয়ে হুমকি দেওয়ায় গরগর করে সব সত্যি বলে দেয়। রুশা নাকি উনার পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করে বলেছিল ওর স্বামী বাচ্চা চায় না। বাচ্চা মেরে ফেলার জন্য চেষ্টা করেছে আর এখন মানুষের সামনে ভালো সাজার জন্য নাটক করেছে। উনি যেন বলে দূর্ঘটনায় বাচ্চা মারা গেছে। তাহলে রুশা আদ্রিশের হাত থেকে বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারবে। তাই মিথ্যা বলেছিল আদ্রিশকে। আদ্রিশ সব শুনে চোখ বন্ধ করল। সেজান পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সবকিছু ওর মাথার উপর দিয়ে গেল।
হসপিটাল থেকে বের হয়ে আদ্রিশ হাঁটছে আর ওর পেছনে পেছনে সেজান।
“ভাই, আমাকে একটু বলবেন কি হচ্ছে?”
আদ্রিশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“রুশার আসল নাম পিউ চৌধুরী। শান চৌধুরীর বোন। ওদের বড় ভাইয়ের সাথে দেড় বছর আগে পার্টনারশিপে নতুন বিজনেস লন্স করেছিলাম তারপর কি হয়েছিল মনে আছে?”
“থাকবে না আবার? সব মনে আছে। আর সেদিন কী ঘটেছিল তাও মনে আছে।”
“এর বদলা নিতেই পিউ রুশা সেজে আমার লাইফে আসে। ওকে না চেনার কারণ ও লন্ডনে থাকত। পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।”
“বাপরে!”
“সেই হুডি পরা মানুষটাই রুশা মানে পিউ।”
“ভাবি তো দেখছি খুবই ডেঞ্জারাস। উনাকে দেখে কখনো এমন মনে হয়নি।”
“আমার মনে হয়েছে। অনেক বার মনে হয়েছে। সবচেয়ে বড় ডেঞ্জারাস কাজ কি করেছো জানো?”
“কী ভাই?”
“আমার বাচ্চা এখনও আছে। সহি সালামত আছে। বাথরুমে পড়ে যাওয়া, মিস ক্যারেজ সব ওর সাজানো নাটক ছিল।”
সেজানের মাথা ঘুরছে। এত এত টুইস্ট নিতে পারছে না।
“ভাবি এমন কেন করল? কী চাইছেন উনি? আর আপনার ক্ষতি চাইলে সেদিন সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আপনাকে বাঁচালো কেন?”
“হয়তো এর পেছনেও কোনো কারণ আছে। কোনো বড় খেলা খেলছে রুশা। ও এখন কোথায় আছে জানা জরুরি। আমি আমার বাচ্চাকে নিজের থেকে দূরে থাকতে দেব না। ওকে খুঁজে বের করো সেজান। ওর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে।”
“ওকে ভাই, চেষ্টা করছি।”
কিছুদিন পর।
রুশার লন্ডনের ফ্লাইট দু’দিন পর। লাস্ট টাইম চেকাপের জন্য রুশা তৈরি হয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বের হচ্ছে। দরজা খুলতেই রুশা স্তব্ধ হয়ে যায়। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পা দুটো যেন মেঝের সাথে আঁটকে গেছে। নড়তে পারছে না। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড দ্রুত চলছে। রুশা ঘনঘন ঢোক গিলছে। দরদর করে ঘামছে। কপাল বেয়ে চিকন ঘামের রেখা ফুটে উঠেছে। সামনে আদ্রিশ শান্ত দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক কষ্টে অনেক দিন ব্যয় করে রুশাকে খুঁজে পেয়েছে। রুশা দুপা পিছিয়ে গেল। আদ্রিশ ওর ফ্লাটের ভেতরে ঢুকে গেল। রুশা কি করবে বুঝতে পারছে না। টেবিলের উপরে রাখা ছুরিটা হাতে নিয়ে পেছাতে পেছাতে বলল,
“আমার কাছে আসবে না।”
কিন্তু আদ্রিশ ওর কথা শুনছে না। এগিয়ে যাচ্ছে ওর দিকে। রুশা বাম হাতে ছুরি রেখে জোরে টান মারল। ঘন লাল রক্তে হাত মেখে যাচ্ছে। মেঝেতে টপটপ করে রক্তের ফোঁটা পড়ছে। আদ্রিশ দাঁড়িয়ে গেল। রুশা এখন যা খুশি করতে পারে। নিজের ক্ষতি করবে কিন্তু আদ্রিশের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে না।
আদ্রিশ দাঁড়িয়ে বলল,
“ওকে আমি আগাবো না। এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।”
রুশা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মাথাটা কেমন ঘুরছে। গলা শুকিয়ে গেছে। রুশা আদ্রিশকে বলল,
“এখানে কী চাই তোমার? চলে যাও। আমার দিকে আসার চেষ্টা করলে বারান্দা থেকে লাফাবো তবুও তোমার কাছে নিজেকে সমর্পণ করব না।”
আদ্রিশ আগেই বুঝেছে রুশা সহজে ধরা দিবে না। রুশা দৃষ্টি সরিয়ে হাতের দিকে নিল। হাতটা জ্বলে যাচ্ছে। আদ্রিশ এই সুযোগে রুশাকে ধরে হেচঁকা টান মারল। ওর ডান হাত চেপে ধরে ছুরিটা ফেলে দিয়ে ঘুরিয়ে ওকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে এল। বাম হাত কাটা থাকায় রুশা তেমন প্রতিরোধ করতে পারল না।
“ছাড়ো আমাকে? ছাড়ো।”
“ছাড়ার জন্য তো ধরিনি। তুমি জানো না আমাকে? এত বড় অন্যায় করার পর তোমাকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেব?”
“তুমি কী ছাড়বে আমাকে আমি সেদিন তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি।”
“আমি তোমার কাছে একবারও দয়া চেয়েছি? বাঁচার আকুলতা দেখিয়েছি?”
“কারণ তুমি তো মানুষ নও তাই মৃত্যু ভয় তোমার নেই। খুন করতে করতে মৃত্যুকে ভয় পাও না।”
“বাজে কথা রেখে বলো কেন আমার সাথে এমন করলে? কী পেলে এসব করে? আমি জানতাম তুমি যেমন দেখতে তেমন নও। তুমি কোনো খেলা খেলছো। জেনে-বুঝে চুপ থেকেছি। আমার মন মানতে চায়নি। ব্রেন বারবার তোমার ভুলগুলো আমাকে ধরিয়ে দিলেও মন মানতে চাইতো না। আমি কিছুতেই চাইতাম না তুমি আমার কাছে অপরাধী প্রমাণিত হও। তাহলে যে তোমাকে শাস্তি দিতে হবে। আমি হারিয়ে ফেলব তোমাকে। তাই দেখেও না দেখার ভান করে থাকতাম। বলে না অন্ধ ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয়?
আমি ঠিক তেমন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু বিশ্বাস করো একবারো ভাবতে পারিনি তুমি এত বড় মাপের খেলোয়াড়।”
রুশা ঝারা মেরে আদ্রিশকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তাই তো সহজ-সরল,ভোলা ভালা মেয়ে সেজে তোমার জীবনে প্রবেশ করি। নিজেকে প্রস্তুত করতেও কয়েক মাস সময় নিয়েছি। বিয়ে তুমি নও আমি করেছি তোমাকে, প্রতিশোধ নিতে। নিজেকে প্রতিনিয়ত দূর্বল হিসেবে উপস্থাপন করেছি। কথায় কথায় কেঁদে কেটে ভাসিয়েছি। শক্তিমান মানুষেরা দূর্বল মানুষ খুব পছন্দ করে। ভয় পেতে দেখলে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পায়। তাই নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করেছি।”
আদ্রিশ পাশের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল,
“ভালোবাসাটাও অভিনয় ছিল?”
রুশা ওড়না দিয়ে হাত পেচিয়ে আদ্রিশের দিকে চেয়ে বলল,
“আই উইশ তাই হতো। ভালোবাসা নিয়ে যদি অভিনয় করা যেতো, আজকে এই দিন দেখতে হতো না। তোমাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। এই ভুলটা যদি না হতো আজকে আমি একা হয়ে যেতাম না, ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হতো না, আমাকে এভাবে পালিয়ে বাঁচতে হতো না, আমাকে এভাবে কাঁদতে হতো না, অপরাধবোধে ক্লান্ত হতে হতো না, দু-হাত তুলে ভাইয়ার কাছে বারবার ক্ষমা চাইতে হতো না, আমার প্রতিজ্ঞা পূরণ হতো আর প্রতিশোধ নেওয়াও হয়ে যেত। কিন্তু কিছুই হলো না।”
“আমার সাথে তোমার সমস্যা কী? কীসের প্রতিশোধ নিতে চাও তুমি? তোমাকে তো আমি চিনতামই না। মাসখানেক আগে নতুন করে চিনেছি। তোমাকে কী বলে ডাকব রুশা না পিউ চৌধুরী? সাজ্জাদ চৌধুরী আর শান চৌধুরীর একমাত্র আদরের ছোট বোন পিউ চৌধুরী। তার পড়াশোনা লন্ডনে। ইঞ্জিনিয়ারিং করে দেশের একজন নামকরা ব্যবসায়ীর পেছনে পড়েছে। তাকে বিয়েও করেছে।”
আদ্রিশ তাচ্ছিল্য হাসল।
“শাট আপ! নিজেকে কী মনে করো? তোমাকে আমার মতো মেয়ে খুব সহজে বিয়ে করেছে? আমার মতো একটা মেয়ে তোমাকে বিয়ে করবে? সিরিয়াসলি? দশ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছি। তারপর আমার বড় ভাই আমাকে আর শান ভাইয়াকে বাবা-মায়ের আদর স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন। আমাদের সব সময় আগলে রেখেছেন। এক হাতে সব দিক সামলেছেন। বাবা-মার অভাব বুঝতে দেয়নি। নিজের কথা কখনো ভাবেনি। সব সময় চেষ্টা করেছেন আমাদের ভালো রাখতে। তিনি অসম্ভব ভালো মানুষ ছিলেন। শত্রুও স্বীকার করবে তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। কাউকে আঘাত করার কথা কখনো ভাবেনি। আমাদের জন্য বিয়ে পর্যন্ত করতে চায়নি। ছুটিতে আমি দেশে এসে জোর করে ভাইয়াকে বিয়ে করিয়েছি। অনেক ভাগ্য করে এমন ভাবি পেয়েছিলাম। কিন্তু তার একটা বাচ্চা না থাকায় দুঃখের শেষ ছিল না। ভাইয়া এ নিয়ে তাকে কখনো কিছু বলেনি। তবুও কষ্ট পেত। কারণ ভাইয়াকে খুব ভালোবাসত। অবশেষে আল্লাহ মুখ তুলে তাদের দিকে তাকালেন। আমাদের পরিবারে আনন্দ ফিরে এসেছিল। আমি শুধু ভাবতাম কবে পরীক্ষা শেষ হবে আর এই মুহুর্তগুলোর ভাগ পাবো। পরীক্ষা চলাকালীন ভাইয়া ভাবি কাউকে কলে পাইনি। শান ভাইয়া বলেছিল সাজ্জাদ ভাইয়া বিজনেসের কাজে ডুবাই গেছেন। সাথে ভাবিও। আমি যেন বাড়ির কথা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে শুধু পরীক্ষার কথা ভাবি। সেদিন শান ভাইয়া মিথ্যা বলেছিল আমাকে।”
রুশা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
“আমি শেষ বারের মতোও সাজ্জাদ ভাইয়াকে দেখতে পারিনি। সে আমার ফেরার আগেই কবরের বাসিন্দা হয়ে গেছে। আমার ভাই, আমার ভাইকে আমি চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেললাম। আমাকে আর জড়িয়ে আদর করবে না। বলবে না পিউ কলিজাটা আমার। পুরো পৃথিবী এক দিকে আমার পিউ একদিকে। বিদেশে একা আমি নিজেকে সামলাতে পারব না তাই শান ভাইয়া আমার দেশে ফেরার অপেক্ষা করেছিল। আমি দেশে ফিরে ভাইয়াকে না পেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তার মৃত্যুর কথা শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। টানা ছয়দিন হাসপাতালে ছিলাম। আমি আর শান ভাইয়া হাসতে ভুলে গেলাম। পুরো বাড়ি মৃত্যুপুরী হয়ে গেল। কেন করলে আদ্রিশ এমন? আমার ভাইয়া তোমার কী ক্ষতি করেছিল?”
আদ্রিশ ঘাবড়ে গেল ওর কথা শুনে।
” মানে কী? কী বলছো এসব?”
“নাটক করো না। আমি জানি তুমি আমার ভাইয়ার খুনি। খুন করেছো একটা পরিবারকে।”
“তোমার ভাই,ভাবি কার এক্সিডেন্টে মারা গেছেন।”
“হ্যা, তুমি ঘটনাটা এভাবেই সাজিয়েছো। তুমি তো কোনো কাজের প্রমাণ রাখো না। কোথাও বিচার পাব না তাই নিজেই শাস্তি দিতে এসেছিলাম।”
আদ্রিশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“পাগল হয়ে গেছো তুমি।”
তারপর রুশার ডান হাত চেপে ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল।
“ছাড়ো আমাকে। কোথাও নিয়ে যাচ্ছো?”
“হাসপাতালে। তোমার এই নাটকের এসপার উসপারা করতে।”
চলবে…..
(পোস্টটা যাদের কাছে পৌছাবে তারা কমেন্ট বক্সে রেসপন্স করবেন প্লিজ। আমার পাঠকদের দেখতে চাই।)