ভয়_আছে_পথ_হারাবার পর্ব 36

0
934

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৩৬,,

সকালে শাওয়ার নিয়ে তিলো শোবার ঘরের দরজা খুলে বের হতেই লিভিং কাম ডাইনিং এর, ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকালো। সেখানে গতকালকের সেই যুবতী বসে আছে। ডানহাতে কফি মগ আর বামহাতে একটা ম্যাগাজিন চোখের সামনে মেলে রেখেছে। তিলো জানতে পেরেছে মেয়েটার নাম রোৎশী। সে অরিকের বড় মামার বড় মেয়ে। তার পাশে বসে আছে তার বড় ভাই রাফি। সে মোবাইল স্ক্রোল করে চলেছে। সে গতকাল বিছানার তলা থেকে বেরিয়েছিলো। ওদের আরেকটা বোন আছে। কিন্তু সে আসেনি।
তিলোকে বের হতে দেখে রোৎশী তাকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-কেমন আছো ভাবি?

তিলো স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘ভালো।’

মেয়েটা ঠোঁট টিপে হেসে বললো,
-আচ্ছা, ঠিক আছে। ভাইয়া ওঠেনি।

তিলো হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললো,
-নাহ্। তিনি এখনো ঘুম।

-তাতো হবেই। যতোই হোক, সারারাত জেগে প্রেম ….। আহহ্।

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই রাফি ওর হাতে চিমটি কাটলো। রোৎশী কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-শালার রাফু। চিমটি কাটলি ক্যান?

রাফি উত্তর না দিয়ে উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। রোৎশী ওর দিক থেকে নজর সরিয়ে তিলোর দিকে তাকিয়ে দেখলো তিলো সেখানে নেই। রোৎশী হতাশ হলো তিলোকে লজ্জায় ফেলতে ব্যর্থতা মেনে নিয়ে।

তিলো যেন ওর সামনে থেকে পালিয়ে বেঁচে গিয়েছে। মেয়েটা বড়ই নির্লজ্জ বলে মনে হচ্ছে ওর। কিভাবে রাফির সামনে কথাগুলো বলতে যাচ্ছিলো! পরে মনে হলো, না ঠিক আছে। ওরা মজা করবে না তো করবে কে? তিলো নিজে থেকে একটু লজ্জাশীল হওয়ার পাশাপাশি রক্ষণশীলও যথেষ্ট। তাই বলে সবাই তো আর তা হবে না। রোৎশী তিলোর বয়সী প্রায়। তবে একটু বেশিই এক্ষেত্রে ম্যাচিউর বোঝা গেলো।

তিলো রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো, কাজের মেয়েটার পাশাপাশি অরিকের বড় মামীও হাতে হাতে রান্না করছেন। তিলো বেশ লজ্জা পেলো। আজ তো ওর রান্না করা উচিত ছিলো। এতো দেরি হয়ে গিয়েছে ওর খেয়ালই নেই।
তিলো রান্নাঘরে ঢুকে রোৎশীর মাকে সালাম দিলো। ওনি উত্তর দিলেন ঠিকই তবে সেটা ঠিক আন্তরিকতার ধারে কাছেও ছিলোনা। তিলো সেদিকে পাত্তা দিলো না। হয়েই থাকে সংসারে এসব। নিজেদের রক্তের সম্পর্কের বাইরের মানুষগুলোর ক্ষেত্রে বাছবিচার বেশি করা হয়ে থাকে। কারণ সেখানে নির্বাচন করার সুযোগ থাকে। আর নিজেদের ভেতর তা থাকে না। এটা সোভিয়েত স্টাইলে নির্বাচন হয়ে থাকে আসলে।
এই কৌতুকটা এইরকম –
সোভিয়েত স্টাইলে নির্বাচন শুরু হয়েছে কবে থেকে?
-যেদিন ইশ্বর ইভকে সৃষ্টি করে আদমকে বলেছিলেন নিজের স্ত্রী বেছে নাও।

এখানে আসলে তাঁর আর কাউকে বেছে নেওয়ার সুযোগই নেই।
কিন্তু বাইরে কোথাও সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রণয় ঘটিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হতে পারে। বেশ কয়েকজন প্রার্থীর মাঝে কাউকে বেছে নেওয়া আরকি।

তিলো কফি তৈরি করতে করতে আপনমনেই কথাগুলো ভেবে মনে মনে হেসে চলেছে।
কালো কফিতে চিনি ব্যতীত ঘি ঢেলে তিলো আবারও অরিকের রুমে প্রবেশ করলো।
অরিক তখনও উবু হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তিলো বেডসাইড টেবিলের উপর কফিটা রেখে অরিককে ডাকতে শুরু করলো। অরিক পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো। তিলো তা দেখে হেসে দিলো। এখানে হাস্যরসের কিছু নেই। কিন্তু তিলোর ভেতর একটা আনন্দ কাজ করছে, যার ফলে আশেপাশের প্রতিটা ঘটনা দ্বারাই মস্তিষ্কে যেন সুড়সুড়ি লাগছে। অরিক নিজেও হেসে দিয়ে উঠে বসলো। বিছানার ঠিক পাশে পড়ে থাকা টিশার্টটা গায়ে চড়াতে চড়াতে তিলো বললো,
-তুমি দেখতে পাও কি করে বলো তো ওই টুকু চোখ দিয়ে?

অরিক নাকের রন্ধ্রগুলো ফুঁসিয়ে বললো,
-নিজের চোখজোড়া একটু বড় বলে উঠতে বসতে আমাকে যে কথা শোনাবে আমি সেটা ভালো করে বুঝতে পারছি। এখন বলো, নাস্তা করেছো?

-নাহ্।

-কেন? তোমার না ক্ষুধা লেগেছে?

-তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও একসাথে করবো।

অরিক আর কিছু বললো না। কফি মগে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভ্রু যুগল উঁচু করে চুল পর্যন্ত উঠিয়ে বললো,
-এটার স্বাদ ভালো।

-অভ্রকে একবারও দেখিনি। ও কোথায়?

অরিক ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,
-অভ্র সিমলা গিয়েছে বন্ধুদের সাথে। তোমার হঠাৎ অনুমতি দেওয়ায় ও ফিরে আসার সময় পায়নি। আজ ফিরবে৷ হয়তো এতক্ষণে বর্ডারের এপারেও চলে এসেছে। বেচারা একটা ব্যাচেলর পার্টির আয়োজন করতে চেয়েছিলো বিয়ের আগের রাতে। কিন্তু ও নিজেই ছিলোনা বিধায় হয়নি।

-এখানে আসবে?

-হুম।

আবারও দুজনের মাঝে কিছুক্ষণের নিরবতা শেষে অরিক বললো,
-সামনের সপ্তাহে আব্বু ছোটখাটো একটা রিসেপশনের ব্যবস্থা করেছে।
তিলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
-তোমার কোনো আপত্তি আছে?

তিলো স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে এক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে বললো,
-নাহ্। কোনো আপত্তি নেই।

অরিক প্রত্যুত্তরে হেসে দিয়ে ওকে জানালো যে, আশাতীত উত্তরে অরিক সন্তুষ্ট।

তিলো সেখানে আর দাঁড়ালো না। বেরিয়ে এলো এই আশায় যে কোনো কাজ সে পাবে করার জন্য।

বিকালের দিকে অভ্র এসে উপস্থিত হয়েছে। সাথে তুষারও এসেছে তার কিছুক্ষণ পরই। অভ্র এসে কোনো ক্লান্তির চিহ্নমাত্র মুখে না রেখে আবদার জুড়ে বসলো আজ রাতে তারা নিজেদের ভেতর ছোট একটা পার্টি দেবে। শুধু এই জেনারেশন নিয়ে। প্রাক- বৈবাহিক পার্টিটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্ষোভ থেকেই বিবাহ পরবর্তী পার্টির আয়োজন করবে তারা। ওদের বাকি কাজিনদের মাঝেও সমান উত্তেজনা দেখা গেলো বিধায় ওরা আর নিষেধ করেনি।
অরিকের থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হতেই অভ্র ছুটলো সানজিদের কাছে। তারা ছাদে আয়োজন করবে এসবের। অরিকের মামী, খালারাও চলে গিয়েছে আজ বিকালে। শুধু তাদের ছেলেমেয়েরা রয়েছে। কিন্তু নতুনতম সদস্যটি নেই। সে তার মায়ের নেওটা।

সব আয়োজন ওরা করে ফেলেছে খুব দ্রুততার সাথেই। তিলো সেই উপলক্ষে একটা অফ হোয়াইট শাড়ি পড়েছে। গায়ের রঙের জন্য ও বরাবরই উজ্জ্বল হালকা রঙগুলো বেছে নেয় নিজের সাজসজ্জার জন্য। রঙের জ্ঞান এবং ওর পছন্দমত বাছাইকৃত কাপড়গুলো, তাদের বুনন ওর রুচিশীলতার পরিচয় দেয়। পাশাপাশি তার ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে। খানিকটা ধূর্ততা। নিজেকে আড়াল করার অদম্য চেষ্টা। যেমনটা মানুষ আসলে বলে থাকে, ওর গায়ের রং চাপা, কালো পোশাক বা নীল পোশাক মানাবে না। উজ্জ্বল রঙ দাও ওকে। লোকের চোখে যেন সেটা না পড়ে এবং সে যেন গিরগিটির ন্যায় মিশে থাকে নিজেকে লুকিয়ে।
আবার ফর্সাদের বলে, ওদের তো যেকোনো রঙ মানাবে। তেমনি একটা ব্যাপার পোশাক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। পোশাক কি তবে গিরগিটিয় অস্ত্র? তিলোর মনে প্রশ্নটা মাঝে মাঝেই জাগে।

তিলো এখন ভাবলো না ওর সার্বিক ভাবনাগুলো নিয়ে। এখন সে নিজেকে প্রস্তুত করতে ব্যস্ত। অরিক রুমে ঢোকার মূহুর্তে তিলোকে একমনে সাজতে দেখে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। হাত দুটো জিন্সের পকেটে পুরে রেখেছে।

অরিক ধীর তৃপ্ত উল্লাসে নিজের চোখজোড়া বিচরণ করে বেড়াচ্ছে তিলোর সমস্ত শরীরে। যতোই হোক, এখন সেই অবচেতন আতঙ্কটা নেই যে, তিলো কেবলই তার জীবনের মাঝখান থেকে পার হয়ে যাচ্ছে, যেন মরুভূমির ভেতর থেকে পার হওয়ারত একটি উট বা গভীর সমুদ্রের তলে কোনো ছোট মাছের ঝাঁকের একটা ক্ষুদ্র মাছ যারা ঝাঁক বেঁধে কেবল এগিয়েই চলেছে বা কোনো পেশাদার পর্যটক, যে একদিন তাকে ছেড়ে যাবেই। তিলো কোনো ক্ষণস্থায়ী স্টেশন নয় অরিকের জীবনে যেখানে কিনা যাত্রাপথে থামে কেবল চা পান করতে। অরিকের জন্য তিলো কেবল গন্তব্য। তার শেষ এবং স্থায়ী গন্তব্য।

অরিক এগিয়ে গেলো তিলোর দিকে। পকেট থেকে তিলোর জন্য কেনা পেনডেন্টটা বের করে হুট করেই পেছন থেকে তিলোর গলায় আবৃত করে পেছনে আটকে দিতে শুরু করলো। তিলো প্রথম ছোঁয়ায় চমকে উঠলেও অরিককে দেখে স্বস্তি পেলো।

অরিক ওর ঘাড়ের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে চেইনটা আটকে দিয়ে মুখ নিচু করে ওর ঘাড়ে নিজের ওষ্ঠজোড়া ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,
-পছন্দ হয়েছে?

তিলো পেনডেন্টটা হাত দিয়ে একবার ছুঁয়ে বললো,
-ভীষণ।

-উপরে চলো। ওরা অপেক্ষা করছে।

তিলো ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা আংটিটা অনামিকায় পড়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে অরিককে ইশারায় যেতে বললো। অরিকও ওর সম্মতিক্রমে যাত্রা শুরু করলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here