দু’মুঠো_প্রেম
ফারজানা_আফরোজ
৫
ফয়সাল এইবার আরিফের উপরে উঠে বসলো। আরিফের চুল টেনে বলা শুরু করলো,
– আমি বুড়ো হলে তুই কি? শালা, তুই তো বুইড়া খাটাস।
আরিফকে এইবার সুড়সুড়ি দিতে লাগলো ফয়সাল। অনেকক্ষণ ধরে দুই বন্ধুর ঝগড়া, খুনসুটি চলতে লাগলো। ফয়সাল খাটের এক মাথায় শুয়ে মাথার নিচে হাত রেখে আরিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– জানিস আরিফ, এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে এতটা ভালো লেগেছে। তার ঝাঁঝালো কথা, কান্না মাখা মুখ এক কথায় অসাধারণ। দোস্ত আসলেই আমি প্রেমে পড়েছি রে। আমার ইচ্ছা করছে আমার প্রেম ভালোবাসা ওই মেয়েটার দু’হাতের মুঠোয় রেখে দিতে। যেন তার ছোঁয়া আমি সব সময় অনুভব করি। আমি যে কাউকে ভালোবাসতে পারবো কখনও ভাবিনি।
আরিফ তখন এক হাতে ফয়সালকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– মেয়েটা কে? আংকেলের সেই পছন্দ করা মেয়েটি নাকি?
– হুম। কিন্তু আমি না ওর সাথে খুব খারাপ কাজ করেছি। লোকজনের সামনে অপমান করেছি যা আসলেই আমার করা উচিৎ হয়নি। আসলে প্রচুর রেগে ছিলাম তার উপর ও রাস্তাঘাটে দৌড়াদৌড়ি করছে দেখে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো। কেন বের হবে সে রাস্তায়? জানে না অন্য কেউ ওকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখলে আমার রাগ হয়? ভালো নজর কিংবা খারাপ নজর দুইটাই আমি দেখবো অন্য কেউ নয়।
– ইসস প্রেম শুরু হবার আগেই ভুল বুঝাবুঝি। তোকে কতবার বলছি মাথা সব সময় শান্ত রাখবি। জানিস মেয়েরা রাগী বর কখনও পছন্দ করে না। মুভি, উপন্যাসে রাগী ছেলের প্রেমে পড়লেও সত্যিকার অর্থে প্রেম হয় না। কোন মেয়ে চায় কথায় কথায় মার খেতে বল তুই? উপন্যাসে পড়ি, নায়ক নায়িকাকে মেরে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে তবুও সেই নায়িকা কিনা নায়কের জন্য পাগল। বাস্তব জীবনে যদি এমন হয় পরের দিনই ছেলেটির নামে কেস করে বসবে মেয়েটি। এখন ভালো বুদ্ধি দিচ্ছি যত পারিস মেয়েটার সামনে শান্ত থাকার ট্রাই করবি, রোমান্টিক ভাব নিয়ে চলবি, আর মেয়েরা গিফট পেলে ভীষণ খুশি হয় বিশেষ করে চকোলেট, শাড়ি, পুতুল, টেডি এইসব। ওইগুলো দিয়ে সারপ্রাইজ দিবি। দেখবি খুব তাড়াতাড়ি তোর বিয়ের রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
আরিফের কথা শোনে ফয়সাল এইবার নিজেই জড়িয়ে ধরলো আরিফকে। আরিফ এতদিনের সঞ্চিত প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ হাত ছাড়া না করে বলেই ফেলল,
– এই ছিঃ ছিঃ তুইও দেখছি আজকাল গেঁ হয়ে যাচ্ছিস। লজ্জা বলে একটা শব্দ আছে মাথায় রাখ। বিয়ের পর বউকে এইভাবে জড়িয়ে ধরিস ছাড় বলছি।
ফয়সাল জোড়ে জোড়ে হাসতে হাসতে বলল,
– ছেড়ে দে শয়তান, তুই আমার দেহ পাবি কিন্তু মন পাবি না, হাহাহা।
– ওইটা পেলেই হবে। হাহাহাহা। বাংলা সিনেমার ডায়লগ মানেই তো এইসব। হাহাহা।
__________________
সন্ধ্যার পর আদিবা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ পানে তাকিয়ে থেকে চোখের পানি ফেলছে। কিছুতেই সে সেদিনের অপমান ভুলতে পারছে না। হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইয়ে গেলো আদিবার শরীর স্পর্শ করে। কেঁপে উঠলো সে। মনের ভিতর শুরু হলো সেদিনের কংকালের ভয়ার্ত মুহূর্তের কথা। ভ্যাপসা গরমেও এখন তার শীত করছে। পৌষ মাঘ মাসের শীত যেনো এসে পড়েছে তার। ভয়ে ছাদ থেকে নামতে নিতেই কিছু একটার সাথে পা বেজে নিচে পড়ে গেল সে। শব্দ করে চিৎকার দিলো সে, মনে হলো কিছু একটা ছিল তার আশপাশে, কিন্তু কি ছিল? সে তো কিছু দেখতে পায়নি শুধু অনুভব করেছে। মনে মনে দু’আ পড়লো অনেকগুলো। সাহস জুগিয়েে দৌঁড় দিলো সে। ড্রয়িং রুমের কাছে আসতেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। আদিবার মা বড় মেয়েকে এইভাবে দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে কাছে আসতেই আদিবা হাত দিয়ে তাকে ইশারা করলো সে পানি খাবে। এক গ্লাস পানি আদিবার কাছে নিয়ে যেতেই ঢকঢক করে সবটুকু শেষ করে কান্না করতে থাকলো,
– মা কি হয়েছে তোর? ভয় পেয়েছিস?
– আম্মু আমার মনে হয় কেউ আমাকে ফলো করছে। সে মানুষ নয় অন্য জগতের কেউ। আচ্ছা আম্মু ভুত, আত্মা, জীন বলে কিছু আছে?
– ইসলামে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহতায়ালা মানুষ ও জিনদের সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আজ-জারিয়াত, আয়াত : ৫৬) তাই জ্বীন আছে আমরা তা বিশ্বাস করতে বাধ্য তবে ভুত, আত্মা এইসব বলে কিছু নেই। মনে রাখবি মৃত ব্যক্তি কখনও ফিরত আসে না। তবে কিছু পাজি জ্বীন মৃত ব্যক্তি কিংবা মানুষের রূপ ধারণ করে ভয় দেখায়।
– আম্মু আমার পিছনে জ্বীন পড়েছে। আমাকে নিয়ে যাবে।
কথাগুলো বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আদিবা। সন্ধ্যার কাহিনী বলল মাকে। আদিবার মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– এইসব কল্পনা মা। তুই হয়তো কিছু নিয়ে ভাবছিলি সেইজন্যই এমন মনে হয়েছে। হ্যালুসিনেশন থেকে এমন হয়েছে তোর। হ্যালুসিনেশন হলো এমনি একটি মানসিক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি কোনো প্রকার উদ্দীপনা ছাড়াই বিশেষ ইন্দ্রিয়ানুভূতি লাভ করে। এ অনুভূতির সঞ্চার স্বাভাবিক অনুভূতির মতোই ঘটে। সন্ধ্যায় বাতাস বইতে পারে স্বাভাবিক, প্লাজোতে উষ্টা খেয়ে অনেকবার পড়েছিস তুই সো এইটাও এমন কিছু হতে পারে, ভয় থেকে তোর মাথায় ঢুকেছে কেউ তোকে ফলো করছে। বাজে চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। আর হুম এখন থেকে নিয়মিত নামায আদায় করিস বাজে কিছু তোকে স্পর্শ করতে পারবে না।
অনেকটা স্বস্তি বোধ করলো আদিবা। মায়ের কোলে মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে নিজের রুমে হাঁটা দিল সে।
__________
ক্যান্টিনে চুপচাপ বসে আছে আদিবা ও অরিন। মুখে তাদের রাজ্যর বিরক্তি। ভার্সিটির এক সিনিয়র ভাইয়া তাদের সামনে বসে আছে সাথে রয়েছে বেশ কিছু ছেলে। বড় ভাইদের সাথে লাগলে সমস্যা সেই কারণে তাদের কথামত তারা দুইজন চুপচাপ বসে আছে। শ্যাম বর্ণের একটি ছেলে আমতা আমতা করে অরিনের উদ্দেশ্য বলতে লাগলো,
– আপনার নাম কি?
পিছন থেকে তাদের দলের একজন ছেলেটির পিঠে হালকা চড় মেরে ধমকের সুরে বলল,
– বিড়ালের মত মিউ মিউ করছিস কেন? আপনি আপনি না করে সোজা বল, তুই ওই মেয়েকে পছন্দ করিস। এখন আপাতত প্রেম করতে চাচ্ছিস।
কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে আদিবার চোখের দিকে তাকাল অরিন। আদিবা শান্ত ভঙ্গিতে ইশারা দিয়ে বুঝাতে লাগলো,
– চিন্তা করিস না। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস প্রেমের অফার আসবে। স্বাভাবিক। এখন চুপচাপ ওদের কথাগুলো গিলতে থাক।
আদিবার ইশারা বুঝে চুপ করেই রইলো অরিন। আচমকাই ছেলেটি অরিনের হাত জোড়া চেপে ধরে বলতে লাগলো,
– প্লিজ ফিরিয়ে দিও না। তাহলে কিন্তু আমি বাঁচতে পারব না। হঠাৎ তোমাকে দেখেই আমার মনে প্রেম প্রেম অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে প্লিজ শুরুতেই শেষ করে দিও না।
ক্ষেপে গেলো আদিবা। পাবলিক প্লেসে একটা মেয়ের হাত ধরে প্রোপজ করা, মেয়েটার অনুমতি ছাড়াই। কিন্তু এখন শক্ত কণ্ঠে কথা বললে এতে বিপরীত কিছু হয়ে যেতে পারে সেইজন্য কিছুক্ষণ চিন্তা করলো না। এরেই মাঝে তার মাথায় শয়তানি এক বুদ্ধি এসে গেলো। মনে মনে নিজেকে বাহবা দিতে লাগলো সে,
– ওয়াও আদু, ইউ আর আ গ্রেট বেবি। এই রকম একটা বুদ্ধি যদি মাথায় সব সময় ঘুরাঘুরি করতো তাহলে তুই তো ফেমাস হয়ে যেতে এতদিনে।
আদিবা এইবার উচ্চ সুরে বলে উঠলো,
– ভাইয়া ও কিন্তু রাজনীতিবিদ ফয়সাল আহমেদের গার্লফ্রেন্ড। ফয়সাল ভাই যদি জানে উনার গার্লফ্রেন্ডকে নিজের গার্লফ্রেন্ড বানানোর প্ল্যান করছেন তখন কি করবে আপনাদের জানেন? কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলে আসবে। বলবো কি ভাইয়াকে?
ফয়সাল আহমেদ নামটি শোনে ভয়ে ঢুক গিললো ছেলেগুলো। যে ছেলে প্রপোজ করেছিল সে ভয়ে ভয়ে বলল,
– আরেহ আমি তো মজা করছি। প্লিজ ভাইয়াকে কিছু বলবেন না। এখন থেকে আপনারা আমাদের ধর্মের বোন। আজ থেকে যদি কেউ আপনাদের বিরক্ত করে আমাদের বলবেন কেমন? দেখবেন কি অবস্থা করি। প্লিজ তবুও ভাইকে কিছু বলবেন না।
ছেলেগুলো দৌঁড়ে পালালো। আদিবা তো হেসে কুটিকুটি। অরিন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
– মিথ্যা কেন বললি?
– নিজেদের বাঁচানোর জন্য। শোন এখন থেকে আমরা ভেজাল মুক্ত তাছাড়া ফয়সাল ভাই আর এইদিকে আসবে বলে মনে হয় না। উনি কাজ নিয়েই পরে থাকেন সব সময়।
– কি বুদ্ধি রে তোর।
আদিবা এখন নিজের বুদ্ধি নিয়ে গর্ববোধ করছে। এতদিন পর তার ফাঁকা মাথা ভালো কিছুতে ভরপুর হয়েছে বলেই শান্তি শান্তি ভাব নিচ্ছে।
__________
আদুরী গালে হাত দিয়ে বসে আছে। খেলার মতো কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। পাজি তুহিন সবাইকে চকোলেট খাইয়ে নিজের দলে নিয়ে গিয়েছে। কেউ এখন আদুরীর সাথে খেলছে না। মাঠের এক কোনায় মুখ কালো করে অন্যদের খেলা দেখছে সে এমন সময় প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে নায়ক নায়ক ভাব নিয়ে এন্ট্রি ঘটে তুহিনের। ভ্রু নাচিয়ে আদুরীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
– কি রে কেউ খেলে না তোর সাথে? বিচ্ছু মেয়েদের সাথে কেউ খেলতে চায় না রে।
আদুরী এইবার কান্না করে দিলো। এমনিতেই সে কষ্টে আছে এখন আবার তুহিন তাকে কষ্ট দিচ্ছে। এত কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বেচারি মেয়েটা এইবার কেঁদে বন্যা বানাতে শুরু করে দিলো। তুহিন তখন কষ্ট মাখা ভাব নিয়ে বলল,
– হইছে আর কান্না করতে হবে না। চল খেলি আমরা।
তুহিন আদুরীর এক হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো খেলার জন্য। আদুরী মনে মনে বলল,
– চান্দু কি ভেবেছিস এত সহজেই আদুরীকে হারাবি? অপেক্ষা কর , তুই যদি হিরো সালমান খান হস আমিও কিন্তু আদুরিনি। আমার বুদ্ধির সাথে তুই একটা তিন দিনের বাচ্চা। আজ খেলার ছলেই তোর মাথা ফাটিয়ে বলব, আমি কিছু জানি না কারণ তোর সাথে তো আমার ঝগড়াই হয়নি। আমি তো গুড গার্ল।
চলবে,
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ব্যাস্ততার কারনে রি-চেইক হয়নি।