“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ২০
(নূর নাফিসা)
.
.
পরবর্তী দিনগুলো ভালোই কাটছিলো। ছোটখাটো সংসারের ছোট ছোট প্রয়োজন ভালোভাবেই মেটাতে সক্ষম হচ্ছে সাদাফ। হায়দারের ঘটনার পর থেকে আর অস্ত্রসস্ত্র কিংবা পোটলা পুটলি নিয়ে ঘরে ফিরে না সে। জমিজমার কাজকর্মে একটু বেশি মনযোগী হয়েছে আগের থেকে। আগে মন চাইলে কাজ ধরতো, মন না চাইলে ফিরিয়ে দিতো। এখন আর ফিরিয়ে দেয় না। কাজ এলে সেটাকে পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করে এবং মোটামুটি ভালোই উপার্জন করে। তাদের দুজনের গড়া সংসারের প্রয়োজন এতে অনায়াসেই মিটে যায়। আর অবসরে মাঝে মাঝে দাবা ঘরে কাটে সময়। তবে রাত পর্যন্ত থাকার অভ্যাস একদমই চলে গেছে। কাজে থাকুক আর যেখানেই থাকুক, সন্ধ্যার পরপরই যেন বাড়ি ফিরে এটা শ্রাবণের নির্ধারিত শর্ত। পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে স্মরণ করে সাদাফও চেষ্টা করে যথাসময়ে বাড়ি ফিরতে। কারণ বাইরে থাকা অবস্থায় একটু দুশ্চিন্তা ঘিরে থাকে শ্রাবণের জন্য। নয়তো অন্য কোনো কারণ নেই ঘরকে স্মরণ করার। শুনেছিলো হায়দার ছাড়া পায়নি। কিন্তু তার স্ত্রী সুস্থ হয়েছেন অনেকটা। বয়স হয়েছে, শারীরিক মানসিক চাপের পর পুরোপুরি সুস্থতা প্রত্যাশ
যায় না। তবে ভালো আছেন এখন।
পাশের ঘরের ভাড়াটিয়া চলে গেছে, এক নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। দুইটা বাচ্চা সারাদিন ছোটাছুটি করে গেইটের ভেতরের এই ফাঁকা জাগায়টুকুতে। শ্রাবণের কাছে ভালোই লাগে বাচ্চা দুটোকে। মাঝে মাঝে সাদাফ মুখোরুচো খাবার নিয়ে এলে কিংবা সে ঘরে কোনো রুটি পিঠা তৈরি করলে বাচ্চাদের ডেকে খেতে দেয়। প্রকৃতির মমতাময় ধারাবাহিকতায় নারীদের মধ্যে মাতৃত্বের স্বাদ জাগাই স্বাভাবিক। শ্রাবণেরও জেগেছে। বাচ্চাদের দেখলে আরও বেশি প্রত্যাশা জাগে মা হওয়ার। তাইতো শ্রাবণ এরই মধ্যে একদিন সাহস করে সাদাফকে বলে ফেললো,
“বাচ্চারা খেলামেলা করলে ঘর থইথই করে, পাশের ঘরের বাচ্চাগুলো ভারি দুষ্টু। সারাদিন এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছোটাছুটি করে। কি ভালো লাগে দেখতে! আমার ঘরে কি দুষ্টুদের প্রয়োজন নেই?”
সাদাফ দুহাতের তালুতে তার দুগাল চেপে ধরে বললো,
“এখনই কিসের বাচ্চাকাচ্চা! দু-এক বছর পাড় হোক, পরে খেলা করুক দুষ্টুরা। স্বাচ্ছন্দ্যে খেলা করার জন্য তো নিজেদের ঘরবাড়িও চাই তাদের। সব কিছুরই তো একটু সুযোগ সুবিধা প্রয়োজন।”
কথার সাথে সাদাফের মুখে হাসির রেখা উঁকি দিয়েছে। তাই লজ্জায় পড়ে গেলো শ্রাবণ। বুঝতে পারলো সাদাফও তাহলে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে। প্রচেষ্টা করছে হয়তো, জীবনকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার। তাই সে আর কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করলো না।
কিন্তু নিয়ম মেনে চলা দিনগুলোর উপর হঠাৎ একদিন অনিয়মের ছায়া যে পড়ে গেলো! সাদাফ সেই যে দুপুরে বেরিয়েছে, রাত হয়ে এসেছে তবুও তার ঘরে ফেরার খবর নেই। যাওয়ার সময় শ্রাবণ জিজ্ঞেস করেছিলো,
“কোথায় যান?”
“এদিকেই। বাজারের দিক থেকে একটু ঘুরে আসি। কেন, কিছু প্রয়োজন?”
“না, একটু বিশ্রাম নিলে হয় না? আপনার শরীরটা এমনিতেই কেমন রোগা রোগা দেখায় আজকাল।”
“ঘরে শুয়ে বসে কতক্ষণ ভালো লাগে?”
“হ্যাঁ। দাবা খেলতে শুধু ভালো লাগে! আর এক পেয়েছে সিগারেট, উঠতে বসতে খেতে ঘুমাতে সবসময় তাকে লাগে। কি যে মজা পায় এতে, তিনিই জানেন! নামাজটা পড়তে পারে না ঠিকমতো। নামাজের কথা তুললেই বলে পড়বো, পড়বো৷ কবে যে পড়বে, আল্লাহই ভালো জানেন!”
কথা কানে গেলেও মগজে না এঁটে চলে গেছে সে। তবে শ্রাবণ অস্বীকার করতে পারবে না যে সাদাফের পরিবর্তন হয়নি। আগের থেকে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে তার৷ বেআইনি কাজ থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছে সে। সুশৃঙ্খল জীবনযাপনও করছে। শুধু নিজের শরীরের যত্নটা নিতেই বুঝে উঠতে পারেনি এখনো। শ্রাবণের প্রচেষ্টায় টিকে আছে যতটুকু!
রাত ঘনিয়ে আসছে আর শ্রাবণের দুশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে। কান্নাও পাচ্ছে খুব। কখনো রাগ হচ্ছে কখনো ভয় হচ্ছে। এতো দেরি করছে কেন সে? সাদাফ কি আজ মাতাল অবস্থায় ফিরবে তাহলে? গত দিনগুলোতে তো মদ্যপান করেনি লোকটা, আজ যদি এমন হয়, প্রচুর ঝগড়া করবে তার সাথে। বড়সড় এক ঝাড়ি দিতেই হবে এবার! কত বলে নামাজ কালাম পড়তে, তা শুনে না। যা-তা খেয়ে দিন পাড় করবে, মাতাল হয়ে ঘরে ফিরবে এসব তো চলতে দেওয়া যায় না। মনে মনে বিড়বিড় করছে আর রাগে ফাটছে! আবারও ভয়ে ভাবনা থেমে যাচ্ছে, লোকটার কোনো বিপদ হলো না তো? এমনিতেই কত শত্রু, কত বিপদ ঘটে যাচ্ছে একের পর এক! আবারও চলে এলো না তো বিপদের দিন!
রাত কেটে যায়, সাদাফ আসে না। মধ্যরাতেও আজ অপেক্ষার অবসান ঘটে না। ভোর হয়ে আসছে, সাদাফ ফিরে না ঘরে। শ্রাবণ ভাবতে পারছে না কিছু! নির্ঘুম রাতটা কাটিয়ে দিলো কান্নায় কান্নায়। ইচ্ছে করছিলো রাতেই বেরিয়ে যাক, তাকে খুঁজতে। কিন্তু সেই সাহস জাগ্রত হয়নি তার হৃদয়ে। তাছাড়া অপেক্ষা আটকে রেখেছে তাকে। আসবে আসবে সেই প্রত্যাশায় বসে ছিলো সারারাত ধরে। কিন্তু এলো না তো সে ঘরে!
সকাল হতেই ছুটে গেলো বাজারে। দাবাঘর চেনা আছে তার কিন্তু কেউ নেই সেখানে। পাশের দোকানে জিজ্ঞেস করলো এটা খুলবে কখন, কিন্তু তার নিশ্চয়তা পেলো না কোনোভাবে। বাড়ি ফিরে দেখলো ঘরের সামনে বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে। মাস শেষ হয়ে এসেছে, সাদাফ আজ ভাড়া দিবে বলেছিলো৷ তাই নিতে এসেছেন তিনি। শ্রাবণ আলমারি থেকে টাকা নিয়ে ভাড়া দিয়ে দিলো। কোনো একটা লোক পেলো না যে একটু খোঁজ নিতে পাঠাবে সাদাফের। উপায় না পেয়ে একা ঘরে কাঁদলো কিছুক্ষণ বসে বসে! আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো, কোনো কাজে দূরে গেছে হয়তো কোথাও, তাই হয়তো দেরি হচ্ছে ফিরতে। এসেই তো খাবার চাইবে, রান্না করা দরকার। শ্রাবণ ঘর গুছিয়ে রান্নার আয়োজন করতে গেলো রান্নাঘরে। সবজি কাটছিলো সে। এমন সময় হনহনিয়ে এক লোক এসে উঁকি দিলো দুয়ারে। শ্রাবণ একটু ভরকে গিয়েছিলো এ আবার কোন ডাকাত এলো খোঁজ নিতে! কিন্তু খোঁজ নয়, খবর নিয়ে এসেছে সে। শ্রাবণকে দেখেই বললো,
“ভাবি, ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। হসপিটালে আছে গত রাত থেকে।”
শ্রাবণের হৃদয় কেঁপে উঠলো ধুক করে! সে সবজি ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“কি বলেন এসব! কি হইছে?”
“সন্ধ্যায় দাবা খেলছিলো। হঠাৎ করেই বসা থেকে শুয়ে পড়লো। অবস্থা খারাপ দেইখা হসপিটাল নিলাম৷ ডাক্তার জানাইলো স্ট্রোক হইছে। কথা বলতে পারে না। কিছুক্ষণ আগে একটু একটু করে বলছে আপনারে নিয়ে যাওয়ার কথা। এই দৌড়ে এলাম।”
“আল্লাহ গো…”
শ্রাবণ কাঁদতে কাঁদতে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে কিছু টাকা হাতে নিয়ে ঝটপট বেরিয়ে এলো। ঘরে তালা ঝুলিয়ে লোকটার সাথে ছুটলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। পড়ে রইলো রান্নাবান্না আর খাওয়াদাওয়া। আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে অতিক্রম করলো পথ। তাড়া থাকলে পথ যেন শেষই হতে চায় না। কি হয়েছে, কি অবস্থায় আছে ভাবতেই পারছে না শ্রাবণ। মাথায় কেমন দুশ্চিন্তার পাথর চাপা পড়েছে। যার ভার বহন করা খুবই কষ্টকর।
হসপিটালের বেডে লোকটাকে প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আর সামলে রাখতে পারলো না নিজেকে। মুখে ওড়না চেপে কেঁদে উঠলো সে। শরীরে সেলাইন, নাকে নল লাগানো। ডাক্তার নার্স সবাই পাশেই আছে। কান্নার শব্দে তারা পিছু ফিরে তাকালো। সাথে আসা লোকটা শ্রাবণকে ইশারায় নিষেধ করলো কাঁদতে। শ্রাবণ পারছে না কান্না থামাতে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো,
“সে কে?”
লোকটা জবাব দিলো,
“রোগীর স্ত্রী।”
“আচ্ছা, বাইরে নিয়ে যান তাকে। এভাবে শব্দ করা যাবে না।”
লোকটা তাকে কেবিনের বাইরে নিয়ে এলো। এখানে আরও দুজন লোক আছে। এদের একজনকে চিনতে পেরেছে শ্রাবণ। ওইতো, সেদিন তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো সেই লোকটা। তাই বুঝতে পারলো এরা সবই সাদাফের সাঙ্গপাঙ্গ। ডাক্তার রোগী দেখে বেরিয়ে আসতেই একজন জিজ্ঞেস করলো,
“কি অবস্থা, ডাক্তার?”
ডাক্তার হতাশাজনক ভাবে মাথা নাড়লেন এবং বললেন,
“ফুসফুসে ঘা হয়েছে। দুটো কিডনিই ড্যামেজ। স্ট্রোক মারাত্মক। এর কোনোরকম নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারছি না।”
“স্ট্রোক কেন হলো?”
“কত কারণই তো আছে। দুশ্চিন্তা থেকে হতে পারে, ধুমপান থেকে হতে পারে। এমনকি হয়েই থাকে। রোগী তো ধূমপায়ী। উনার রক্তকণিকাই দূষিত।”
শ্রাবণ আর দাঁড়িয়ে নেই ডাক্তারের কথা শুনতে। সে পাশ কেটে চলে গেলো ভেতরে। চাপা কান্না নিয়ে দাঁড়ালো সাদাফের কাছে। সাদাফ পলকহীন তাকিয়ে আছে তার দিকে। শ্রাবণ কণ্ঠস্বর নিচু রেখে কান্নাজড়িত গলায় বললো,
“আপনি মানুষটা এমন কেন? আপনি জানেন আমি কত অপেক্ষায় বসে ছিলাম কাল থেকে? রাতে একা ঘরে থাকতে আমি ভয় পাই না? আর আপনি জেনেশুনেও বাড়ি ফিরলেন না। এবার সারারাত যে আমি ঘুমাতে পারলাম না! ভালো হয়েছে না?”
সাদাফ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। কিছু বলতেও যেন পারছে না। অথচ কত কথা ভাসছে ওই চোখ জোড়ায়! শ্রাবণ হাটু ভর করে বসে পড়লো মেঝেতে। সাদাফের মুখোমুখি হয়ে বসে বললো,
“শুনলেন তো ডাক্তার কি বললো? কত না নিষেধ করেছিলাম ওসব ধোঁয়া খেতে? শুনলেন না তো আমার কথা। নিলেন না তো নিজের যত্ন। আমার এতো যত্ন নিয়ে কি হবে, যদি আপনিই ভালো হয়ে না থাকেন আমার পাশে? এই যে অসুস্থ হয়ে গেলেন, এইবার আমার যত্ন নিবেন কি করে? ঘরের চাল ফুরিয়ে গেলে আপনাকে বলতে পারবো না, প্রতিদিন বাজারে যাওয়ার কথাও তো এখন আপনাকে বলতে পারবো না। ওষুধপত্রই আর কে কিনে আনবে? সব জায়গায় এখন আমাকে পাঠাতে আপনার ভালো লাগবে? নিজের ভালোটা তো পাগলও বুঝে, আপনি ভালো মানুষ হয়েও কেন বুঝলেন না? আমি আসার পর থেকেও তো নিষেধ করলাম, কেন শুনলেন না?”
শ্রাবণ হু হু করে কেঁদে উঠলো। সাদাফের ভেতরে বেশ তোলপাড়। মুখের ভাষা তালাবদ্ধ। কম্পিত শরীরের হাতটা তুলে এনে রাখলো শ্রাবণের মাথায়। শ্রাবণ তার স্পর্শ পেয়ে ঠোঁট উল্টে কাঁদতে লাগলো। সাদাফের হাতের উপর হাত রেখে হাতটা নিজের মাথায় চেপে ধরে বললো,
“আর একদিন যদি আপনি সিগারেট খেয়েছেন তো আপনার খবর আছে। খাওয়ার হলে শুধু দুধ ডিম আর ভাত খাবেন। দাবাঘরে যাওয়াও বন্ধ। সারাদিন ঘরে থাকবেন আর আমাকে যত্ন নিতে দিবেন। দেখবেন কদিনেই সুস্থ হয়ে গেছেন। একদম অবাধ্য হবেন না বলে দিচ্ছি। আমি কি আপনার কথার অবাধ্য হই? তাইতো দিব্বি সুস্থ আছি আমি। আপনাকেও বাধ্য হয়ে চলতে হবে। এই যে অসুস্থ হয়ে আছেন, নিজেরই তো কত খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে। এখন কে নিচ্ছে এই কষ্টের ভার?”
কথার সাথে সাথে অনবরত ঝরছে বৃষ্টি। সাদাফের নিষ্পলক চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা অশ্রু। প্রাণটা ভরছে না এই শ্রাবণকে দেখে। কত উজ্জ্বলই না হয়ে গেছে এই মুখখানা৷ কত যত্নই না নিতো মেয়েটা। জোর গলায় বলতে পারতো না কিন্তু বিড়বিড় করে রাগে গজগজ করতো সারাদিন। কত বলতো নামাজের কথা, আজ যে বড় ইচ্ছে করছে নামাজ পড়ার! খুব ইচ্ছে করছে শ্রাবণের কথার বাধ্য হয়ে চলার। কিন্তু সামর্থ্য যে হারিয়ে গেছে, এখন কি হবে তার! শ্রাবণ দ্রুত মুছে দিলো সাদাফের চোখের ধার। গলার স্বর পরিবর্তন করে খুব আশ্বাস দিলো মুখখানা স্পর্শ করে,
“দেখবেন, আপনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনাকে সুস্থ হতেই হবে।”
সাদাফ তার মাথাটা কাছে টানলো। শ্রাবণ আবারও ঠোঁট বাকিয়ে কান্না চাপা দিলো। মাথাটা এগিয়ে রাখলো সাদাফের বাহুতে। কিন্তু অশ্রু চাপা পড়ে না যে! ফুপিয়ে ফুপিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে বাহু। সাদাফ কনুই ভেঙে গালের উপর দিয়ে হাত নিয়ে জড়িয়ে রেখেছে তার মাথা। শ্রাবণ বিড়বিড় করে বলছে গত রাতের অপেক্ষার গল্প। মনের কষ্ট ভাগ করছে তার সাথে। নিশ্চুপ নিরিবিলিতে তাকে শুনছে সাদাফ। কখন যে ভুবনটা স্থির হয়ে গেছে টেরই পেলো না শ্রাবণ। থেমে থেমে তার গল্প চলছেই। সাথের লোকগুলো শ্রাবণকে পাশে দেখে আর আসেনি কেবিনে। কিন্তু নার্স এসে শ্রাবণের গল্প নাশ করে দিলো! নার্সের মুখে অপ্রত্যাশিত কথা শুনে চমকে উঠে সে একটু নড়তেই সাদাফের নিস্তেজ হাতখানা সরে গেলো তার মাথা থেকে। এ মেনে নিতে পারছে না সে, এ মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু কারো মানা আর না মানায় এ পৃথিবীর নিয়মও তো ভঙ্গ হয় না। যে চলে যায়, তাকে ফিরিয়ে আনার সাধ্যও কারো হয় না। সে-ও চলে গেছে চিরতরে। ফিরবে না আর কভু সেই ঘরে। রয়ে গেছে কত স্মৃতি, রয়ে গেছে কত কাজ বাকি। সময়ে তো সম্পাদন হলো না, ভেবে রাখা কার্য সম্পাদনের সময়ও আর এলো না!
বিয়ের একটা বছর পূর্ণ হয়ে গেলো। কিন্তু মানুষটার অভাব, অপূর্ণতা থেকে যাবে চিরকাল। শ্রাবণ এখন তার আম্মার কাছে থাকে। মেয়ের মতো লালন পালন করেন তাকে। কাজকর্ম করে দেয় তার। ডেকে নিয়েছে আহার আশ্রয়ের হাকে। ঘর দুখানা ছেড়ে দিয়েছে শ্রাবণ। তবে স্মৃতিগুলো বেঁধে রেখেছে মনে। নামাজ পড়ে, কুরআন পড়ে, আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকে। আল্লাহর কাছে কেঁদেকেটে দোয়া করে পিতা মাতা ও স্বামীর জন্য। সমাজের চোখে হয়তো মন্দ কিন্তু মানুষটা বড্ড ভালো মানুষ ছিলো তার কাছে। লোকে বলে অপকর্ম জাহান্নামে ডাকে, কিন্তু কার কোন কর্ম কোন পর্যায়ে ঠেকে তা তো আল্লাহই ভালো জানেন। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে মনেপ্রাণে দোয়া করে পরপারে যেন লোকটার সাথে সুখের সংসার হয় তার। এপারে তো হলো না, পরপারের আশা তাই আরও ছাড়ে না। প্রায়ই খুব মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। কিছুতেই ভুলতে পারে না তার সাথে কাটানো কয়েকটা মাসের কথা। আজও যত্নে রয়ে গেছে লাল শাড়ি দুইটা। মনে পড়ে সাদাফের মুখের সেই কথা,
“লাল শাড়িতে তোমাকে ভালোই দেখায়। তাই আরেকটা নিয়ে এলাম।”
তখন এই একাকী মনটা কাঁদে ভীষণ, প্রাণ ভরে চোখ জুড়ে তাকিয়ে দেখে তার উপহার। আর মনে মনে বলে,
“প্রিয়, আজ যদি আপনাকে কাছে পেতাম। তাহলে আরও একটা লাল শাড়ির আবদার রাখতাম।”
(সমাপ্ত)