“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ৯
(নূর নাফিসা)
.
.
এতোক্ষণ চিন্তায় চিন্তায় সময় কাটিয়ে অবশেষে দুপুরে ভাত খাওয়ার জন্য ডাকলো শ্রাবণ। কয়েকবার দরজায় টোকা দেওয়ার পর সাদাফ সাড়া দিয়েছে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“কে?”
“আমি, শ্রাবণ। ভাত খাবেন না? বিকেল হয়ে যাচ্ছে যে।”
“খাবো না।”
“সকালেও খেলেন না ঠিকমতো, এখনো না খেয়ে এভাবে কতক্ষণ থাকবেন!”
সাদাফ চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলে বেরিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
“খাবো না এখন। যাও। পরে ভালো লাগলে খেয়ে নিবো।”
“আপনার কি শরীর খারাপ?”
“হ্যাঁ, খারাপই একটু। জ্বর জ্বর লাগছে।”
সাদাফ বাথরুমে চলে গেলো। শ্রাবণ রুমে এসে রুমটা ঝাড়ু দিতে লাগলো। সকালে ঝাড়ু দেওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে তেমন একটা ময়লাও হয়নি। মানুষটা একটু পরিবর্তন হয়েছে৷ চারপাঁচ দিন যাবত আবার ঘরে জুতা নিয়ে প্রবেশ করে না। তাই ঘরটা কমই ময়লা হয়। বিছানার একপাশে এক পাতা নাপা ট্যাবলেট পড়ে আছে। তারমধ্য থেকে একটা খাওয়া হয়েছে। সাদাফ বাথরুম থেকে ফিরে আবার শুয়ে পড়েছে। ঝাড়ু দেওয়া শেষ হলে শ্রাবণ দরজা চাপিয়ে রেখে চলে এলো। সারাটাদিন না খেয়ে আছে তাই সন্ধ্যায় খাবার গরম করে তার রুমে এলো শ্রাবণ। একটু নাহয় জোর করাই যাক। দরজা ঠেলে রুমে এসে দেখলো রুম অন্ধকার। লাইট জ্বালিয়ে দেখলো লোকটা কাথা মুড়ে ঘুমাচ্ছে। আবহাওয়ায় মোটামুটি অনেকটাই ঠান্ডা নেমে এসেছে তারউপর জ্বরের শরীর। যেন এই কাথাটা আরাম এনে দিতে পারছে না। শ্রাবণ আশপাশে তাকালো একাধিক কাথার খোঁজে। কিন্তু কিছুই পেলো না তার উপর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। চেয়ারে খাবারের প্লেট রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মাথার পাশে দাঁড়ালো শ্রাবণ। মুখখানা একদিনেই কেমন শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে। এই চেহারায় তাকাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। লোকটার কি কেউই নেই দেখাশোনা করার মতো? কেউ নেই একটু শাসনে রাখার মতো? তাহলে তো আজ এমন অবস্থা হয়না তার। লোকটা কি বিয়েও করেনি আজ পর্যন্ত? একটা পরিবারের ভার বহন করার ক্ষমতা তো তার আছে। তাহলে গড়ছে না কেন পরিবার? ভেবে ভেবে খুব ব্যাথিত হয়ে উঠলো শ্রাবণ। মনে নানান সংকোচ নিয়ে হাতটা বাড়িয়ে কপালে স্পর্শ করে শিউরে উঠলো সে! প্রচুর গরম শরীর। শ্রাবণ গালে হাত রেখেও দেখলো তাপমাত্রা অনেক। স্পর্শ পেয়ে সাদাফ কুচকানো চোখে তাকালে সে দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে বললো,
“আপনার তো দেখছি অনেক জ্বর। ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।”
সাদাফ আবার চোখ বুজে বললো,
“নাপা খেলেই সেড়ে যাবে।”
এই কথায় মন মানলো না শ্রাবণের। বুঝতেই পারছে সাদাফ যাবে না ডাক্তারের কাছে। তাই সে দ্রুত বেরিয়ে এসে বাথরুমে চলে এলো। মগ এবং অর্ধেক বালতি পানি নিয়ে আবার রুমে ফিরে এলো। একটা পলিথিন ব্যাগ চিরে নিয়ে সাদাফের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনি এদিকে মাথা রাখুন। মাথায় পানি ঢেলে দেই।”
সাদাফ আবার চোখ খুলে বললো,
“লাগবে না। এমনিতেই সেরে যাবে।”
“সারবে না। উঠুন। মাথায় পানি ঢাললে একটু ভালো লাগবে।”
বলতে বলতে বালিশ টানতে লাগলো শ্রাবণ। সাদাফও হালকা নেড়েচেড়ে শুয়ে পড়লো। মাথার নিচে পলিথিন রেখে বেশ কিছুক্ষণ পানি ঢাললো শ্রাবণ। যতক্ষণ পর্যন্ত মুখমণ্ডল ঠান্ডা হয়ে না আসছে ততক্ষণ পানি ঢাললো। তারপর মাথা মুছে দিয়ে তাকে উঠে খেয়ে নিতে বাধ্য করলো। সাদাফ ওষুধ খেয়ে আবার শুয়ে পড়তে যাচ্ছে। শ্রাবণ সব গুছিয়ে নিতে নিতে বললো,
“লেপ কম্বল নেই আপনার?”
“আছে।”
“এই কাঁথায় কি উষ্ণতা পায়? ঠান্ডায় বরং জ্বর আরও বাড়বে। লেপ কম্বল নিয়ে নিন।”
“ঠান্ডায়ই তো শরীর ঠান্ডা হয়ে জ্বর তাড়াতাড়ি কমবে।”
শ্রাবণ মৃদু হাসলো তার কথায়। তারপর বললো,
“কে বলেছে এসব কথা? আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে। শরীরের তাপমাত্রা ঠিক না থাকলে শরীর রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। ভারি কিছু মুড়ে ঘুমান। কোথায় রাখা আছে, বলুন। আমি নিয়ে দেই।”
“আমিই নিচ্ছি।”
সাদাফ বিছানা ছেড়ে নেমে এলো। শ্রাবণ থালাবাটি গুছিয়ে নিয়ে চলে এলো। সাদাফ ঘর থেকে ডাকলে সে আবার এসে হাজির হলো। সে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে বললো,
“কাথা কম্বল আছে তোমার?”
“আপনার দেওয়া মাদুরটাই আছে আমার।”
“এই কাঁথাটা নিয়ে যাও।”
সাদাফ উঠে এসে আলমারি থেকে মোটা আরেকটা কাঁথা বের করে বললো,
“এটাও নিয়ে যাও। যত্ন করে রেখো। মায়ের দেওয়া দুইটা কাঁথাই আমার।”
শ্রাবণ কাথা দুটো নিয়ে চলে এলো। আজ সে-ও তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমাতে চলে গেছে। ব্যাগের পরিবর্তে পাতলা কাঁথাটা ভাজ করে মাথার নিচে দিয়ে মোটা কাঁথার অর্ধেকটা মাদুরে বিছিয়ে অর্ধেকটা শরীরের উপর দিলো। এতোটা শীত পড়েনি এখনো তাই এই মোটা কাঁথায় তার বেশ গরম লাগছে। সে উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে আগের মতো ওড়না ছড়িয়েই ঘুমিয়ে রইলো। তবে নিচের দিকটা আরামদায়ক হওয়ায় আজ বেশ আরামের ঘুম হয়েছে তার। ঘুম থেকেও উঠলো খুব ভোরে। সবার আগে সাদাফের দরজার সামনে এলো কিন্তু সাদাফ ঘুম থেকে ওঠেনি এখনো। এতো সকালে ডাকাও ঠিক মনে করলো না। রান্নাবান্নাও আজ তাড়াতাড়িই শেষ হয়েছে। সাদাফের শরীরটা এখন কেমন তা জানতে আবার দরজার কাছে গিয়ে দেখলো দরজা চাপিয়ে রাখা আছে। তারমানে এরমধ্যে সাদাফ উঠে বাইরে এসেছে যা খেয়ালই করেনি সে। ভেতরে আসতেই সাদাফ চোখ খুলে তাকালো। শ্রাবণ তাকে নাস্তা খাওয়ার জন্য ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো। আজ নাস্তায় তাকে ভাতের পরিবর্তে রুটি আর ডিম ভাজি খেতে দিলো। সকালে নিজের টাকায় আটা কিনে নিয়ে এসেছে দোকান থেকে। সাদাফ খাওয়ার পর ট্যাবলেট খেয়ে সিগারেট ধরালো। যা একটুও ভালো লাগলো না শ্রাবণের কাছে। বরং বিরক্ত বোধ হলো। একটু বোধহয় ভালো লাগছে শরীরটা, তাই আবার শুরু হয়েছে ধোঁয়া উড়ানো!
কাজকর্ম সব সেড়ে দুপুরের আগেই গোসল সেড়ে নিয়েছে শ্রাবণ। সাদাফ আজ গোসল করবে না। দুপুরের খাবার দিবে তাই তরকারি গরম করে নিচ্ছে। ভাত কিছুক্ষণ আগে রান্না করেছে তাই গরমই আছে। এরই মধ্যে সাদাফ ডাকলো তাকে। চুলা নিভিয়ে সে রুমে এসে বললো,
“ডেকেছেন আমাকে?”
“হ্যাঁ। জ্বরটা বোধহয় আবার বেড়েছে। মাথা গরম হয়ে আসছে। পানি ঢালো তো।”
কাল পানি দিতেই চায়নি অথচ আজ নিজেই বলছে। হয়তো ভালো লেগেছিলো গতকাল তা ভেবে শ্রাবণ আবার পানি নিয়ে এলো। সাদাফ আগেই এদিকে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে। শ্রাবণ মাথায় পানি ঢেলে গামছা ভিজিয়ে সাদাফের হাতে দিলো শরীর মুছে নেওয়ার জন্য।
বিকেলেও আবার ডেকেছে মাথায় পানি ঢালার জন্য। মাথা গরম হয়ে উঠলেই যেন তার পানি ঢালতে হবে। শ্রাবণও দৌড়ে এসে কাজ করে দিয়ে যাচ্ছে। কাজের সাথে সাথে লোকটার দ্রুত সুস্থতাও কামনা করছে। রাতে সে ডাকার আগে নিজেই বালতি নিয়ে এলো শ্রাবণ। আবারও পানি ঢেলে মাথা ঠান্ডা করে দিলো। তারউপর একটু পরপর খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারেও বেশ সচেতন। তিনদিনের মাথায়ই জ্বর পুরোপুরি সেড়ে উঠেছে। তবে শরীরের দুর্বলতা দূর হয়নি। তাই সকাল বিকেল ডিম সিদ্ধ খেতে দিচ্ছে। শরীরটা একটু ভালো হয়ে উঠতেই আবার বাইরে ছুটাছুটি শুরু। আজ চারদিন পর সে বাইরে বেরিয়েছে। এই চারদিনে শ্রাবণ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে সাদাফের সাথে, যতটা গত এক মাসেও সম্ভব হয়নি তার। সাদাফও ছোট খাটো প্রয়োজন হলেই তাকে ডেকেছে। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিতেও যেন তার আসা লাগবে।
বিকেলে বেরিয়ে সন্ধ্যার দিকেই বাড়ি ফিরে এসেছে সে। শ্রাবণকে ডেকে বললো খাবার দিতে। গত তিনদিনের অভ্যাসে আজও এসময় ক্ষুধা লেগে গেছে তার। শ্রাবণ মাত্রই রান্না শেষ করেছে। তাই এখন খাবার চাওয়ায় শ্রাবণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কেননা একটু আগে এসে চাইলেই হয়তো সাথে সাথে খাবার দেওয়া সম্ভব হতো না। সাদাফ খাচ্ছে, পাশে চেয়ারে বসে শ্রাবণ ভাত তরকারি বেড়ে দিচ্ছে। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে এক লোক ছুটে এসে দাঁড়িয়েছে দরজার পাশে। হাপাতে হাপাতে বললো,
“ভাই, দাবাঘরে আগুন লাগায় দিছে জানোয়ারের বাচ্চারা।”
সাদাফ বিস্মিত হয়ে ভাতের প্লেট থেকে চোখ সরিয়ে তাকালো দরজার দিকে। শ্রাবণও সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। যদিও দাবাঘর সম্পর্কে তার জানা নেই। সে দাঁড়িয়েছে হঠাৎ লোকটার আগমনের কারণে। ওদিকে সাদাফ বসা থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
“কারা?”
“কইতে পারি না।”
কথার পরপর আবারও অজানা লোকদের প্রতি গালি ছুড়ে দিলো লোকটা। সাদাফ রেগে প্লেট রেখে নেমে গেলো বিছানা থেকে।