তোমার সন্ধানে, পর্ব:১

0
1299

ছোট চাচার বিয়েতে এসে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে দেখে চমকে উঠল শুদ্ধ। অবাক চাহনি এবং বিচলিত হয়ে তাকিয়ে আছে সে। বিশ্বাস করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। গতকাল অব্দিও তো সব ঠিকঠাক ছিল। তাহলে হঠাৎ মিলি এমন কেন করলো? মাথায় হাত দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো শুদ্ধ। এরই মাঝে ছোট চাচার কণ্ঠে খানিক চমকে উঠলো সে,

–” কি রে শুদ্ধ তুই এইখানে বসে আছিস কেন? চাচী মাকে দেখে নিশচয়ই অবাক হচ্ছিস। আমি জানতাম তুই অবাক হবি।”

শুদ্ধ একবার চাচার দিকে তাকিয়ে পরে মিলির দিকে চোখ জোড়া নিক্ষেপ করলো। মিলি তখন ঠোঁট কামড়ে বাঁকা হাসি দিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে বলল,

–” তোমার ভাতিজা দেখছি ভীষণভাবে চমকে উঠেছে। ওকে ঠান্ডা কিছু খাওয়াও নয়তো বেচারা হার্ট অ্যাটাক ফ্যাটাক করে ফেলবে হাহাহা।”

মিলির কথায় হুস আসলো শুদ্ধের। মিথ্যা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখে স্বাভাবিক ভাবেই বলল,

–” কি যে বলেন চাচী আম্মা। আসলে অবাক হওয়ার কারণ কি জানেন? যে মেয়ের পিছনে হাজারো ছেলের লাইন থাকতো আজ সেই মেয়ের বিয়ে কিনা তার থেকে অর্ধেক বছরের বড় কোনো পুরুষের সাথে, তার উপর সেই পুরুষ বিবাহিত, পাঁচ ছয় বছরের একটি মেয়ে আছে তার।”

শুদ্ধের কথা মিলি কিংবা তার স্বামীর ঠিক ভালো লাগলো না। কঠিন কণ্ঠে শুদ্ধের চাচা অর্থাৎ ফিরোজ আলম বলে উঠলেন,

–” কিসব আবোল তাবোল বলছ শুদ্ধ? মানুষের বয়স দ্বারা কখনই প্রেম ভালোবাসা বিচার করা ঠিক নয়। পিহুর আম্মু অর্থাৎ আমার প্রাত্তন স্ত্রী সে কিন্তু আমার ক্লাসমেট ছিল। পরে কি হলো মেয়ের চার বছরের মাথায় অন্য এক ছেলের সাথে প্রেম করে আমাদের দুজনকে ছুঁড়ে ফেলে চলে গেছে। আর মিলি সেতো আমাকে নতুনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে। তুমি হয়তো জানো আমরা দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আমাদের রিলেশন দেড় বছরের।”

শুদ্ধ আবারো অবাক হলো । সে জানতো তার চাচার কোনো এক মেয়ের সাথে রিলেশন আছে কিন্তু সেই মেয়েটা যে মিলি সে জানতো না। কারণ, গতকাল অব্দিও মিলি তার গার্লফ্রেন্ড ছিল। হঠাৎ রাতে মিলি ফোন দিয়ে বলল, তার এক্ষুনি দুইলক্ষ টাকা লাগবে। শুদ্ধ সোজাসুজি বারণ করে দেওয়ায় রাতে তাদের ঝগড়া হয়। শুদ্ধ ভেবেছিল চাচার বিয়ের কাজ শেষ করে এসে মিলির সাথে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে নিবে কিন্তু এখন বিয়েতে এসে পাত্রীর জায়গায় মিলিকে দেখলো সে। রাগে, ঘৃণায় মিলির মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে না তার। তিন বছরের সম্পর্ক তাদের। তিন বছরে মিলির চাওয়া পাওয়ার শেষ ছিল না। প্রতিদিন দামী দামী গিফ্ট দিতে হতো তাকে । শুদ্ধ একজন জাতীয় দলের নামকরা খেলোয়াড়। কোনো কিছুরই কমতি ছিল না তার। মিলির চাওয়া পাওয়া সে সব সময় পূরণ করতো কিন্তু ‘অপচয়’ নামক শব্দটি শুদ্ধ ভীষণ অপছন্দ করত , সেই কারণে তাদের মাঝে প্রায়ই ঝগড়া হতো। পরে শুদ্ধ নিজেই সব ঠিকঠাক করতো। এইসব ভেবে ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে চাচার বিয়েতে আনা চাচীর জন্য গোল্ড জুয়েলারির বক্স মিলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

–” আপনার জন্য চাচী আম্মা। পিউর গোল্ড কিন্তু। বিশ্বাস না হলে সেকরার কাছে যাচাই করে আসবেন।”

ভাতিজার এই ধরনের কথা শোনে খুবই বিরক্ত এবং নিরাশ হচ্ছেন ফিরোজ আলম। শান্ত , শিষ্ট, ভদ্র, বড়দের চোখের মণি বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলের এবং বিহেভ ভীষণ আশ্চর্য হচ্ছেন উনি। তবুও খুশি মনে বলে উঠলেন,

–” এইসব আনার কী খুব প্রয়োজন ছিল বাবা? তুই যে এসেছিস এইটাই অনেক। তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে আমার এই বিয়েতে তুই খুশি নস। মিলিকে তো তুই চিনিস তাহলে কী আমার কোনো কাজে তুই বিরক্ত বাবা?”

চাচাকে মুহূর্তেই জড়িয়ে ধরলো শুদ্ধ। চোখের পানি যেন বাঁধ মানছে না তার। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যকারো হওয়া দেখে বুকটা আগেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল তার। তার উপর সেই মানুষটা এখন নিজের আপন চাচী। মিলির চোখে মুখে কোনো দ্বিধাবোধ নেই। সে জানতো এমন কিছুই হবে। জেনে শুনেই এই কাজটা সে করেছে ভালোই টের পাচ্ছে শুদ্ধ। এখন এইটাও বুঝতে পেরেছে, চাচার কাছ থেকে যখন চাচীর নাম জানতে চাইত তখন ফিরোজ আলম বলতেন, হঠাৎ একদিন চমকে দিবো তোকে, সারপ্রাইজ হিসেবে মনে গেঁথে রাখ। তোর চাচী বলেছে তোর জীবনের সব’চে বড় সারপ্রাইজ হবে সেদিন, যেদিন তোরা দুজন দুজনের সম্মুখে দাঁড়াবি। তাই এখন বলব না। তাছাড়া ওর ব্যাপারে আমার থেকে ভালো তুই জানিস তাইতো প্রথম ও যখন প্রপোজ করে আমিও হ্যাঁ বলে দেই। শুধুমাত্র তোর উপরে বিশ্বাস রেখে।

কথাগুলো ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে শুদ্ধর। তার চাচা তাকে হিন্টস দিয়েছিল কিন্তু সে বুঝতে পারেনি। চাচা তার উপর বিশ্বাস করে খুব বড় ভুল করেছে। এই মেয়েটা কখনই তাকে ভালোবাসেনি। হতে পারে টাকার লোভে ভালোবাসার নাটক করেছে। কিন্তু এই কথাগুলো সে এখন বলতে পারবে না কারণ, চাচার মনে কষ্ট দিতে চায় না সে। যখন সময় আসবে তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী তার চাচা সবই বুঝতে পারবে। আবারো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিষ্টি হেসে বলল,

–” খুব খুশি হয়েছি চাচা। অনেকদিন পর এইভাবে তোমাকে হাসি খুশি দেখছি তো তাই পাগল হয়ে গেছি। তুমি তো দেখছি দিনদিন ইয়াং হয়ে যাচ্ছ। চাচী কি ভিটামিন টিতামিন দিয়েছে তোমায় হুম?”

শুদ্ধের এই দুষ্টু কথায় ফিরোজ আলম কিছুটা লজ্জা পেয়ে চোখ গরম করে বলে উঠলেন,

–” তুই যে এমন লাগাম ছাড়া মানুষ আগে জানা ছিল না শুদ্ধ। দিনদিন ভারী দুষ্টু হয়ে গেছিস।”

–” কি করবো বলো? তুমি যে হারে হ্যান্ডসাম হচ্ছো কিছুদিন পর আমাকে লোকে তোমার চাচা ভাববে। বাই দা ওয়ে, পিহু কোথায়? ওর জন্য চকোলেট এনেছিলাম কিন্তু ওর দেখা নাই।”

–” পিহু তো ওর ফ্রেন্ডের সাথে। গিয়ে দেখ মেয়েটা নতুন মা পাবে বলে কত্ত খুশি।”

শুদ্ধ চলে যেতে গিয়েও থেমে গেলো। পিছন ফিরে মিলিকে চোখ টিপ দিয়ে বলল,

–” কনগ্রাচুলেশন চাচী আম্মা।”

মিলি শুদ্ধের এমন ব্যবহারে ভীষণ অবাক, সে চেয়েছিল শুদ্ধ ভেঙ্গে পড়ুক, কষ্ট পেয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলুক কিন্তু শুদ্ধ এমন কিছু না করে বরং শুভকামনা জানালো। মিলি এইবার মনে মনে প্রচুর রেগে আছে। পরবর্তী কি করবে সেই চিন্তায় নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো।

এলোমেলোভাবে হাঁটতে লাগলো শুদ্ধ। আচমকা ঝড়ের আঘাত সইতে পারেনি সে। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে। নিরব কান্নার মত ভয়ানক কান্না দুটো নেই। চিল্লিয়ে কান্না করলে মনের ভিতর থেকে কষ্টের পাহাড় হয়তো কমে কিন্তু নিরব কান্নাতে সেই পাহাড় আরো ভারী হয়। প্রথম ভালোবাসা সহজে ভুলা যায় না, তেমনভাবেই প্রথম ভালোবাসার মানুষটি যদি বিশ্বাসঘাতক হয় তাহলে তো কষ্ট দ্বিগুণ হবেই। এতদিন যাকে প্রেমের বর্ষণ হিসেবে জেনে এসেছে আজকে তাকে প্রেমের মৃত্যু বলা যায়। নিজেকে সামলানোর জন্য কিছু একটা করতে হবে থাকে কিন্তু কিছুতেই ভেঙে পরা যাবে না, মিলির সামনে তো নই। মিলি যে খেলা শুরু করেছে সেই খেলাতে মিলিকে জয়ী কিছুতেই হতে দিবে না শুদ্ধ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের পানি বাঁ হাতে মুছে ছাদ থেকে নেমে পিহুর রুমের কাছে যেতেই দেখলো মেয়েটা তার ফ্রেন্ডের সাথে হাসছে। বাচ্চা মেয়েটার হাসি দেখে সহজেই মন ভালো হয়ে গেলো শুদ্ধের।

–” পিকু মণি কি করছে হুম?”

–” দা’ভাই? তুমি কখন আসছ? জানো কত্ত সময় ধরে ওয়েট করতেছি। আমার বান্ধবীদের বলেছি আমার দা’ভাই খুব হ্যান্ডসাম। ওরা তো তোমার খেলা দেখে। কিছুদিন আগে কত্তগুলো ছক্কা মেরেছ আমি তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছিলাম দা’ভাই।”

শুদ্ধ মুচকি হাসলো। যখন পিহুর আম্মু চলে যায় তখন পিহুর বয়স ছিল চার। বর্তমানে ছয় বছর রানিং। ছোট বয়সেই সে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। মায়ের প্রতি তার তীব্র রাগ, অভিমান কিন্তু ঘৃনা নয়। সন্তানরা কখনোই মাকে ঘৃনা করতে পারে না, যতই অন্যায় করুক না কেন। এখনও মায়ের ছবি দেখে প্রতিনিয়ত কান্না করে মেয়েটি। পিহুর সবচেয়ে যাকে বেশী ভালোবাসে সে শুদ্ধ। বাবাকেও এত ভালো সে বাসে না। মাকে হারিয়ে বাবাকে কাছে পায়নি। শুদ্ধ নিজের কাজ শেষ করে পিহু নামক মেয়েটির জন্য বাকি সময় ধার্য করে রাখতো।

শুদ্ধ বলল,

–” বুঝলাম তো মন কেমন এখন? পিকু মণি কী এখন নতুন মাকে পেয়ে আমায় ভুলে যাবে? নাকি আগের মতোই দা’ভাইকে সব থেকে বেশী ভালোবাসবে হুম?”

–” আমার দা’ভাই অলটাইম বেস্ট ওকে। তোমার জায়গা কেউ নিতে পারবে না। কিন্তু…?”

ভ্রু কুঁচকে তাকালো পিহুর মুখে। মুখটা মলিন হয়ে বলল পিহু,

–” নতুন আম্মুকে আমার কেমন যেন লাগে?”

–” কীরকম?”

–” এই ভালো তো এই পঁচা। জানো আমি দৌঁড়ে নতুন মায়ের কাছে যেতেই নতুন মা ধমক দিয়ে বলল, পিহু আস্তে, দেখতে পাচ্ছো না আমি ভারী শাড়ি পড়েছি, আমার সাজগোজ নষ্ট করবে না খবরদার। আর এইটাও বলল, তোমাদের বাসায় বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে ছিঃ কী বাজে। আমার আব্বু আম্মু বিয়েতে রাজি থাকলে ইশ কত্ত ভালো হতো। যৌথ ফ্যামিলি মানেই প্যারা।”

এইটুকু বলে ছলছল চোখে আবারো বলল পিহু,

–” আব্বুকে যখন বলেছি তখন আব্বু বলল, তোমার নতুন আম্মুর কষ্ট হচ্ছে। দেখছনা এই বিয়েতে ওর পরিবারের কেউ আসেনি। তাই একটু বকেছে। তাছাড়া আম্মু বকা দিলে কষ্ট পেও না বরং ভাববে আম্মু ভালোর জন্যই বকা দিয়েছে কেমন? দেখেছো আব্বু কত্ত পঁচা হয়ে গেছে। নতুন আম্মু বকেছে তবুও কিছু বলল না। সবাই পঁচা শুধু আমার দা’ভাই ভালো।”

শুদ্ধের গলা জড়িয়ে ধরে আপ্লুত হয়ে বলল। শুদ্ধ পিহুর চকোলেট বক্স ধরিয়ে দিয়ে বলল,

–” রাগ করে না পিকু মণি। আমি বকে দিবো তোমার নতুন আম্মুকে ওকে। তুমি বরং তোমার ফ্রেন্ডের সাথে আনন্দ কর কেমন?”

–” আচ্ছা দা’ভাই।”

শুদ্ধ চলে আসলো। বিয়ের স্টেজের দিকে যেতেই তার চোখজোড়া মিলির উপরে পড়লো। আঁতকে উঠলো মন। কত সুন্দর করে ফটোশুট করছে মিলি। মন থেকে মিলি নামক শব্দটি দূরে সরানোর জন্য আপাতত এখন তাকে কিছু করতে হবে। মিলির দিকে তাকিয়ে আবারো চোখ ফিরিয়ে বাহিরে চলে গেলো সে,

চলবে,

#তোমার_সন্ধানে
#ফারজানা_আফরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here