#হৃদয়ে_আগন্তুক
#ফরহাদ_হোসেন
#গল্প
পর্ব-৭
তিথি কঠিন স্বরে বলল, ‘এসব কি হচ্ছে, হাসান?’
হাসান সামনে এগিয়ে এসে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এত তাড়তাড়ি ফিরে এলে যে? শরীর খারাপ?’
‘না শরীর খারাপ না। শরীর ঠিকই আছে।’
‘তাহলে?’
‘কি তাহলে? কেন আমি এসে ডিসটার্ব করলাম?’
‘এসব কি বলছো রূপা?’
‘রূপা?’
‘সরি, আই মিন তিথি!’
‘মাথার মধ্যে বেশ ভাল ভাবেই ঢুকেছে তাহলে?’
‘কীই বলছো তুমি?’
‘কী বলছি, বুঝতে পারছ না?’
‘না বুঝতে পারছি না।’
‘ভেতরে এসো, তোমার সাথে আমার কথা আছে।’ বলেই তিথি রূপার দিকে একটা অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
হাসান একবার তাকাল রূপার দিকে। দুজনেই এতটাই বিব্রত বোধ করছে যে কেউ কারো দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারল না।
প্রচন্ড অপমানে রূপার কেঁদে ফেলার মত অবস্থা হলো। সে মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকল। দেখল তিথি বসে রয়েছে অন্যদিকে তাকিয়ে। রূপা লিভিং রুমের টেবিল থেকে কর্ডলেস ফোনটা নিয়ে তার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
হাসান ভেতরে ঢুকতেই তিথি উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘কি বুঝতে পারছ না বলো। আবার বলো না যে আমি যা ভাবছি তা ঠিক না।’
‘হ্যাঁ তাই।’
‘আমার নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে বলো? এখন যা দেখলাম আর দু’দিন ধরে যা দেখছি সে গুলো?’
হাসান বলল, ‘তিথি, প্লিজ আমার কথা শোন, আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলব।’
‘ঠিক এই কথাটাই যে বলবে—তাও আমি জানতাম। কি বোঝাবে তুমি? তুমি ভেবেছ আমি কিছু বুঝি না? আমি তো তিতলি না, তিথি। আই এক্সাটলি নো হোয়াটস গোয়িং অন। ডোন ইভেন ট্রাই টু ফুল মি!’ বলেই তিথি সোফায় বসে অঝরে কান্না শুরু করল।
হাসান বুঝতে পারছে না কি করবে। সে অসহায়ের মত বসে রইল অন্য সোফাতে।
রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল রূপা। অপমান আর অভিমানে তার চোখ ভিজে গেছে। কিছুতেই সে নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা কাগজে লেখা নাম্বার দেখে ডায়াল করল।
আকাশের এক দুঃসম্পর্কের চাচা থাকেন ডালাসে। তার কিছু বন্ধুও আছে। তবে এখানে এলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তার চাচার বাসাতেই থাকে সে। আজকে তার ফিরে যাবার কথা ছিল। কিন্তু সে যায়নি। আকাশের খুব ইচ্ছা হলো রূপার সঙ্গে আরেকটিবার দেখা করে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো রূপার কোনো ফোন নেই—আর তাড়াহুড়োয় ওদের কারো ফোন নাম্বার নেয়া হয়নি। কাল রাতে রূপাকে নামাতে হয়েছে বলে বাসার ঠিকানাটা ওর মনে আছে। ইচ্ছে করলে সে চলে যেতে পারবে অনায়াসে। কিন্তু যদি বাসায় না থাকে। তাই সে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ভেবে পেল না। কিন্তু ওর মন বলছে রূপা একবার হলেও একটা ফোন করবে। রূপার কাছে ওর নাম্বার আছে। কাল রাতে রেস্টুরেন্টে ডিনার করার সময় একটা কাগজে লিখে রূপার হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘যখন ইচ্ছে ফোন করো। রিমেম্বার, আই অ্যাম অনলি এ ফোন কল অ্যাওয়ে। কল দিলেই চলে আসব সে আমি যত দুরেই থাকিনা কেন। আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব।’
রূপা হাসতে হাসতে বলেছে, ‘বাব্বা-এত প্রেম কোথায় ছিল এতদিন?’
আকাশের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ওর মন বলছে এটা রূপার ফোন। সে ফোন ধরেই বলল, ‘রূপা!’
রূপা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। ফোনের ওপাশ থেকে আকাশ তার ভারী নিঃশ্বাসটা বুঝতে পারল। সে আবার বলল, ‘রূপা, তুমি?’
‘হ্যা।’ ভারী কণ্ঠে রূপা বলল, ‘তুমি কি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে?’
‘হ্যাঁ পারব। কখন আসতে হবে বলো?’
‘এক্ষুনি।’
‘নো প্রব্লেম। আই অ্যাম অন মাই ওয়ে।’
আকাশের সংগে কথা শেষ করে রূপা দ্রুত তার সুটকেসটা গুছিয়ে নিল। কিছু ব্যবহারের কাপড় ছিল বাথরুমে সেইসাথে প্রসাধনীর যা যা ছিল সব ভরে ফেলল। তারপর সাইড টেবিল থেকে একটা কাগজ বের করে তিথির জন্যে একটা ছোট্ট মেসেজ লিখল। মেসেজ না বলে চিঠিও বলা যেতে পারে।
তিথি,
আমি চলে যাচ্ছি। আরো দুটো দিন থাকার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে জটিল হচ্ছে তাতে সংকট আরো বেড়ে যেতে পারে। জেনে শুনে সংকট বাড়ানোর কী দরকার।
আমি যেদিন প্রথম আমেরিকায় ট্রেনিং-এর চিঠি পেলাম—সেদিন খুব খুশি হয়েছিলাম সেটা আমেরিকায় আসার জন্যে না—শুধু তোর সাথে দেখা হবে এই ভেবে। দুর্ভাগ্য আমার তোর সাথে দেখা হলো কিন্তু তার পরিনতি যে এমন হবে তা আমার কল্পনার অতীত ছিল। আফসোস থেকে গেল যে তোর সাথে দু’দন্ড সময় কাটাতে পারলাম না—যদিও এতে তোর কোন হাত ছিল না। আমেরিকার জীবনটাই যে এমন, হয়ত না এলে কিছুই বুঝতে পারতাম না।
যাওয়ার আগে দুটি কথা বলা দরকার।
হাসান ভাইকে তোর চেয়ে পৃথিবীর আর কেউ ভাল চিনে সেটা আমি বিশ্বাস করি না। তারপরেও একজন মেয়ে হয়েই বলছি—আমার ধারণা, বিয়ের আগে অথবা পরে, তুই ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের একাকী সান্নিধ্যে সে যায়নি। মানুষটা খুবই সরল এবং কিছুটা বোকাও। সে ভনিতা করতে জানেনা। না, তার হয়ে সাফাই গাইছি না। আমি শুধু আমার উপলব্ধির কথাটা তোকে বললাম। তুই তাকে ভুল বুঝিস না। এটুকুই শুধু আমার অনুরোধ থাকবে তোর কাছে।
আবার কোনদিন দেখা হবে কিনা জানিনা। পারলে ক্ষমা করিস। তিতলির জন্য আদর।
ভাল থাকিস।
ইতি, তোর রূপা।
লেখা শেষ করে রূপা বড় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর চিঠিটা ভাঁজ করে নাইটস্ট্যান্ডের উপরে রেখে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকল।
তিথি আরো কিছুক্ষণ কেঁদে কেটে তার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।
তিথিকে না ডেকে হাসান গেল তিতলিকে আনতে। গাড়িতে উঠেই তিতলি বুঝতে পারল তার বাবার মুড খারাপ। সাধারনত হাসান খুব হেসে হেসে জিজ্ঞেস করে, তোমার স্কুল কেমন গেল আজকে? এনিথিং ইন্টারেস্টিং টু শেয়ার? তখন তিতলি গরগর করে সব কথা বলা শুরু করে। বাসায় তেমন কোনো কথা না বললেও গাড়িতে উঠলেই তিতলি নন-স্টপ কথা বলে। সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ইউ ওকে বাবা?’
‘ইয়েস, আই’ম ফাইন।’ হাসান তিতলির দিকে না তাকিয়েই অন্যমনস্ক ভাবে বলল।
‘ইউ সিমস আনমাইন্ডফুল।’
হাসান কোনো কথা না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে থাকল। তিতলি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়্যার ইজ রূপা আন্টি?
‘শী’জ অ্যাট হোম।’
‘আই থট শী’জ উইথ ইয়্যু!’
‘এত প্রশ্ন করছ কেন তিতলি? বললাম না সে বাসায়? তোমার আম্মুও বাসায়।’
হঠাৎ করে হাসানের রেগে যাওয়ায় তিতলি ঘাবড়ে গেল। সে বুঝতে পারল না তার বাবার কি হয়েছে। তবে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে সেটা বুঝতে তার কষ্ট হলো না। সেদিনও সে দেখেছে তার আম্মুকে বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে। কিছু একটা হচ্ছে কিন্তু সে বুঝতে পারছে না সেটা কী। মনে হয় বড়দের ব্যাপার তাই সে আর কোনো কথা না বলে চুপ রইল।
হাসান বাসায় ফিরে ড্রাইভওয়েতে গাড়ি পার্ক করতেই তিতলি বলল, ‘আই’ম সরি, বাবা।’ বলেই সে দৌড়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল। হাসান চুপচাপ বসে রইল গাড়িতে।
আমি এক্ষুনি আসছি বলে আকাশ এলো চার ঘন্টা পর। ওর দেরী হচ্ছে দেখে এক ঘন্টা পর রূপা আরেকবার ফোন করল তাকে। কিন্তু সে ফোন ধরল না। ইতিমধ্যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। এই সময়টুকু পার করতে রূপাকে যথেষ্ঠ ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হলো। রূপা ভেবে পেল না, তার সাথেই কেন সব সময় এমন হয়। সে ঘন ঘন ঘড়ি দেখল। কয়েকবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
রূপার ঘুম ভাঙ্গল তিতলির ডাকে। সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে মনে করতে পারল না। সে উঠে দরজা খুলে দিতেই তিতল বলল, ‘তোমার বন্ধু এসেছে।’ তিতলির মুখে পরিষ্কার বাংলা শুনে রূপার বেশ ভাল লাগল। হঠাৎ করে মনে হলো, তিথির মেয়েটা বেশ সুন্দর হয়েছে। ওর খুব ইচ্ছে হলো ওকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তার আগেই তিতলি দৌড়ে চলে গেল।
রূপা চোখ-মুখে পানি দিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে তার সুটকেসটা নিয়ে দ্রুত বের হয়ে এলো। এসেই দেখল আকাশ বসে আছে হাসি হাসি মুখ করে। হাসানের সঙ্গে কথা বলছিল হয়তো। হাসানকেও দেখল, কিন্তু বেশ গম্ভীর। বোঝাই যাচ্ছে দুপুরের বিষয়টা তাকে নিশ্চয়ই যন্ত্রণা দিচ্ছে। সে সামনে এগিয়ে এসে আকাশকে বলল, ‘এতক্ষণে এলে?’
আকাশ হাসতে হাসতেই বলল, ‘আর বলো না, একটা ঝামেলা হয়েছিল। পরে বলছি সবকিছু।’
‘ঠিক আছে চলো।’
হাসান চমকে তাকাল। এবং বুঝতে পারল রূপা চলে যাচ্ছে—একেবারে। সে কী বলবে বুঝতে পারল না।
আকাশ ওর সুটকেসটা নিয়ে বের হয়ে গেল। রূপা বলল, ‘হাসান ভাই, আমি চলে যাচ্ছি। অনেক কষ্ট দিয়ে গেলাম।’
হাসান কিছু বলল না। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।
তিতলি কাছেই দাড়ান ছিল—রূপা তিতলিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। তিতলি বুঝতে পারছে না রূপা আন্টি কাঁদছে কেনো। সেও রূপাকে জড়িয়ে ধরে থাকল কিছুক্ষণ।
হাসানের বলতে ইচ্ছে করছে অনেক কিছুই কিন্তু সে কিছুই বলতে পারল না। রূপা এভাবে হুট করে চলে যেতে চাইবে সেটা ছিল তার ধারণার বাইরে। রূপার এভাবে চলে যাওয়াটা শোভনীয় হচ্ছে না—কিন্তু তাকে থাকতেও বলতে পারছে না। নিজেকে হঠাৎ করেই খুব ছোট মনে হলো। তবুও হাসান একবার বলল, ‘তিথিকে বলে যাবে না।’
রূপা কিছু বলল না। তিতলিকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শুধু। তারপর ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বের হয়ে গিয়ে আকাশের গাড়িতে উঠল।
আকাশ একবার তাকাল রূপার দিকে তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বের হয়ে গেল ড্রাইভওয়ে থেকে।
হাসান ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাড়িয়েই দেখল তিথি অঝরে কাঁদছে।
(চলবে…)