❤#মেঘ_বৃষ্টি_রোদ
#একাদশ_পর্ব ❤
ঘড়িতে তখন বারোটা বেজে দুই মিনিট হয়েছে সবে, এখনো অবধি কেউ তো ফোন বা মেসেজ করলনা! কেউ না হোক, পর্ণা তো প্রতিবার তাকে বারোটা বাজার আগেই ফোন করে….তাহলে এবারে কী হল সবার? মনটা সামান্য খারাপ হয়ে গেল তৃণার। শুধু পর্ণা নয়, সে আরো একজনের ফোনের অপেক্ষা করেছিল সকাল থেকে। কিন্তু ফোন তো দূর, সেই মানুষটার মেসেজ বা কোনো খোঁজখবর কিছুই আর নেই। এই পরীক্ষার কয়েকদিন, বা তার পরেও, সৌমাভ একবারও নিজে থেকে এসে ওর সাথে কথা বলেনি। তৃণা নিজেও বলেনি, রেজাল্ট এর অপেক্ষায়। তবে এই কয়েকদিনের ব্যবধানে মাঝে কত কী যে হয়েছে সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তৃণার। এমন সময় হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনতে পেল তৃণা। তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নীচে নেমে দাঁড়াল সে। এতরাতে ঘরে কে আসতে চাইছে? মা বাপি? কিন্তু মা বা বাপি তো কখনো এরকম রাত বারোটায় তাকে উইশ করেনা জন্মদিনে। তাহলে কে? কৌতূহলী হয়ে, ফোনটা হাত থেকে টেবিলে রেখে দরজার ছিটকিনিটা খুলে দিল সে। আর ঠিক তার সাথে সাথেই হইহই করতে করতে দরজা দিয়ে দুজন ঢুকে পড়ল ঘরের ভিতরে। আচমকা এইরকম ঘটনায় এমন অবাক হয়ে গেল তৃণা যে কোনো কথাই বলতে পারলনা না প্রথমে। ও দেখল, দরজার বাইরে বাপি -মা দাঁড়িয়ে হাসছে মুচকি মুচকি, আর ঘরের ভিতরে হাসিমুখে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে সৌমিক আর পর্ণা। ওদের হাতে কিছুর একটা প্যাকেট, কেকই হবে সম্ভবত। তৃণা বুঝতে পারল না এসব কান্ড কখন হল! সন্ধ্যের পর থেকেই ও নিজের ঘরে ছিল আজকে। খাওয়ার সময়টুকু কেবল বাইরে গিয়েছিল, তখনও তো এসবের কিচ্ছু বুঝতে পারেনি। তৃণাকে এরকম হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, পেছন থেকে পর্ণা হাসতে হাসতে ওর কাঁধে একটা হাত রেখে বলল,
-‘আরে কী এত ভাবছিস? চল, কেকটা কাটবি চল। হ্যাপি বার্থডে পাগল। কাকু- কাকিমাকে আমরা সব আগে থাকতে বলেই রেখেছিলাম , আর তোকে এসব ব্যাপারে বলতে একদম বারণ করে দিয়েছিলাম। বুঝলি? চল আয়”
ওর কথায় সায় দিয়ে সৌমিকও এগিয়ে এসে বলল,
-” হুমম তৃণা, হ্যাপি বার্থডে। এবার চল কেকটা কাটবি চল, বারোটা কখন বেজে গেছে।”
আনন্দে চোখে জল চলে এল তৃণার। এরকম ভাবে ঠিক রাত বারোটার পরেই, কেক কেটে জন্মদিন পালন সম্ভবত তার জীবনে প্রথমবার হতে চলেছে। মা প্রতিবছর এই দিনটাতে পুরোনো রীতি অনুযায়ীই পায়েস, মিষ্টি করে খাইয়েছে। আর মাঝে মাঝে কেক কাটাও হত। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা, একদম নতুন। ওর আনন্দের কথা ভেবে সৌমিক আর পর্ণা গোপনে গোপনে এত কান্ড করে ফেলল, আর সে কিচ্ছুটি টেরও পেলনা?
চোখের কোণে চলে আসা জলটা মুছে নিয়ে হাসিমুখে সৌমিক আর পর্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো তৃণা। ওরা ততক্ষণে কেকটা বের করে সুন্দর করে মোমবাতি দিয়ে সাজিয়েও ফেলেছে। তৃণা চুলটা একটা ক্লিপ দিয়ে আটকে, মোমবাতির দিকে ফুঁ দেওয়ার জন মুখটা এগিয়ে গেল। অন্ধকার ঘরে সেই হলদে মোমবাতির আলোয় তৃণার মুখটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছিল। ওর মুখের এই আনন্দটুকু দেখে সৌমিকের ভীষণ ভালো লাগল। এই সমস্ত প্ল্যানের মাথা হল পর্ণা। এরকম একজন বন্ধু যদি কোনো মানুষের জীবনে থাকে, যে অপরজনের মুখের হাসি ফুটিয়ে তুলতে এতটা ভাবতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে সেই মানুষটা পৃথিবীর সেরা ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন। এক নিমেষে পর্ণার প্রতি অনেকখানি ভালোলাগা, সম্মান যেন বেড়ে গেল সৌমিকের। ও তৃণার থেকে চোখ সরিয়ে পর্ণার দিকে একবার তাকালো, এই সুন্দর আলো-আঁধারির পরিবেশে পর্ণার মুখটা কম মিষ্টি লাগছেনা। একটা সবুজ- লালের কম্বিনেশনের কুর্তিতে, আর অল্প খোলা চুলে একটু বেশিই যেন সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। নিজের মনের ভাবনা বুঝতে পেরে, নিজেই অবাক হয়ে গেল সৌমিক। কই এর আগে তো তার এরকম মনে হয়নি কখনো পর্ণার ব্যাপারে? নাকি তৃণাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে, কখনো সেভাবে সে লক্ষই করেনি একে?
-” সৌমিক কেকটা খাও, কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে তৃণা হাতে নিয়ে!,”
-” কী? ওহ হ্যাঁ, খাচ্ছি।” পর্ণার ডাকে ভাবনার জগত থেকে আচমকাই বেরিয়ে এল সৌমিক। কেকটায় সামান্য কামড় বসিয়ে, আবার সেটা তৃণাকে খাইয়ে দিল ও। এরপর ওরা নিজেরা কেকটাকে ভাগাভাগি করে খাওয়া শুরু করল। ছবিও তোলা হল অনেকগুলো। হাসি-ঠাট্টায় জমে উঠল চারিদিক।তৃণার মা-বাবাও আর কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেলেন। সৌমিক এবার মুখটা মুছে নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল,
-‘ওকে, পর্ণা তুমি আজ রাতে এখানে থাকবে তো? আমাকে এবার তাহলে বেরোতে হবে, অলরেডি একটা বেজে গেছে, আর বেশী দেরী করলে মা চিন্তা করবে”
-” হ্যাঁ, তুমি তাহলে বেরিয়ে পড়ো। সাবধানে যেও”
-” হুমম, আসছি। টাটা তৃণা, টাটা পর্ণা”
-” হুমমম টাটা” –
সৌমিকের চলে যাওয়ার দিকে আনমনা হয়ে তাকিয়ে, পর্ণা বলল। ওর এই আনমনা ভাবটা চোখ এড়ালোনা তৃণার। ও বেশ কৌতূহলী হয়ে পড়ল ব্যাপারটায়। এই চোখের চাউনিটা বিশেষ চেনা তৃণার, তবে কি পর্ণা আর সৌমিকের মধ্যে কিছু চলছে?
****************
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই, ঘুমচোখে তাড়াতাড়ি করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল তৃণা। অনেক আশা নিয়ে মেসেজ এর অপশনে গিয়ে সেই নির্দিষ্ট মেসেজটার খোঁজ করতে লাগল সে। কিন্তু নাহ্, কয়েকটা বন্ধুর সাধারণ মেসেজ ছাড়া আর কারো মেসেজ নেই। মনের এতদিনের আশাটা যেন হঠাৎই নিভে যেতে লাগল তৃণার। তবে কি ও ভুল বুঝল ব্যাপারটাকে? সৌমাভর তরফ থেকে তাহলে কোনো সাড়াই কখনো ছিলনা? এতটা বুঝতে ভুল হল তৃণার? এতদিন ধরে জন্মদিনের জন্য অপেক্ষার আনন্দটা একধাক্কায় যেন ভেঙে খানখান হয়ে গেল। সকালের রোদ ঝলমলে দিনটা বড্ড ধূসর মনে হল তৃণার। পর্ণা ভোর বেলাতেই বাড়ি চলে গেছে, এখন বিছানায় পুরোপুরি একা, বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে তৃণা। আজকে ভেবেছিল ও কলেজ যাবে, কিন্তু হঠাৎ করেই সেই ইচ্ছেটাও আর হচ্ছেনা। ধীর পায়ে বিছানা থেকে নেমে, বাথরুমের দিকে সে পা বাড়াতে যাবে, এমন সময় পিছনে টেবিলে রাখা ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। কানে রিংটোনের শব্দটা যেতেই মনের সুপ্ত আশাটা ফের জেগে উঠল তৃণার। একছুটে ফোনের সামনে গিয়ে ও দেখল কটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসছে। তবে কি! আর ভাবতে পারলনা সে, তাড়াতাড়ি করে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ বেশ জোরালো কন্ঠে বলে উঠল,
-‘এটা কি তৃণা বোসের নম্বর?”
-” হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন?” – অবাক গলায় বলে উঠল তৃণা। এটা আবার নতুন কোন চরিত্র?
-” আমি যেই হই না কেন, তোমার জেনে খুব বেশী লাভ নেই। শুধু এটুকু সাবধান করার জন্য ফোন করেছি, যে নিজের খুশি টুকু নিয়ে ভালো থাকো। অন্যের জিনিস নিয়ে টানাটানির কি খুব প্রয়োজন?”
-” মানে??? কে আপনি? আর এসব কথারই বা মানে কী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। ”
-” বুঝতে পারছ না, নাকি বুঝতে চাইছ না? আমি মৌলি বলছি, আশাকরি এবার বুঝতে পেরেছো?”
খুব শীতল গলায় কেটে কেটে কথাটা বলল মৌলি। ওর কথা বলার ধরন শুনে ভীষণ একটা ভয় চেপে বসল তৃণার মনের ভেতরে। কাঁপা কাঁপা গলায় ও বলল,
-” আপনি কী বলতে চাইছেন একটু পরিস্কার করে বলবেন? আমার এত হেঁয়ালি ভালো লাগছে না”
-“বেশ এত বেশিই যখন ন্যাকামি করতে শিখে গেছ এই বয়সে,তাহলে পরিস্কার করেই বলছি, তোমার সাথে সৌমাভর কী সম্পর্ক? বলো আমাকে”
-” সম্পর্ক?? উনি আমার স্যার হন, এটাই…মানে আর থেকে আর কী বেশি….”
-” ব্যাস? শুধুই স্যার? এইজন্যই সৌমাভর ফোনের গ্যালারিতে তোমার এতগুলো ছবি সেভ করে রাখা? শুধু এইটুকুর জন্যই আলাদা করে সৌমাভর ফ্ল্যাটে পড়তে আসতে হয়?? আনসার মি”
ফোনের ওপারে প্রায় চিৎকার করে উঠল মৌলি। তৃণা বুঝে পেলনা কী উত্তর দেবে। সৌমাভর ফোনের গ্যালারিতে ওর নিজের ছবি ভর্তি? এটা কি সত্যি !তবে সেটা মৌলি মানে মৌলি দিদি কীভাবে জানল? আর ফ্ল্যাটে যাওয়ার ব্যাপারটাই বা কী করে ও জানল? ঠিক জুতসই উত্তরের অভাবে একটাও কথা না বলে চুপ করে রইল তৃণা। জন্মদিনের রাতে একটা সারপ্রাইজ পেয়েছিল, দিনের বেলা উঠেও যে এরকম কিছুর মুখোমুখি পড়তে হবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
অপর প্রান্ত থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আরো জোরে চিৎকার করে উঠল মৌলি। দাঁতে দাঁত চেপে ও বলল,
-” তৃণা শোনো, তুমি হয়তো ভাবছ আমি এসব কী করে জানলাম তাই তো? তাহলে ভালো করে কান খুলে শুনে রাখো, আমি সৌমাভর গার্লফ্রেন্ড। আমি আর ও বহুবছর ধরে একে অপরের বন্ধু, এবং প্রায় ছয় মাস হতে চলল আমরা সম্পর্কে আছি। সৌমাভ ছেলেটা একটু অন্যরকম, ওকে আমার থেকে ভালো আর কেউ বোঝেনা। তাই ওর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করো, ও আমাকে সব কথা বলেছে, আর এও বলেছে যে তুমি বেশি প্রশ্রয় দিয়েছ তাই ও বাধ্য হয়েছে তোমাকে মেনে নিতে , এবং এরপর থেকে আর ও তোমার সাথে কোনোরকম কথা বলবেনা বা কিছু রাখবেনা। আশাকরি এই কয়েকদিনে সেটা টেরও পেয়েছ তুমি, তাই তো?”
-” আপনি যা বলছেন, সেগুলো সব যে সত্যি তা বিশ্বাস করব কেমন করে সেটা একটু বলবেন?”
এতক্ষণ পরে একটা উত্তর দিল তৃণা, কারণ আর চুপ করে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলনা। রাগের সাথে সাথে, একটা অদ্ভুত দলাপাকানো কষ্ট ওর বুকে জমে আসছে যেন। সৌমাভ এরকমটা করতে পারল? ওদের ছয় মাসের রিলেশন? আর তা সত্ত্বেও সৌমাভ এমন আচরণ করত যেন ও নিজেও পছন্দ করত তৃণাকে। তাহলে সেগুলো কেন করল সৌমাভ? আর মৌলির কাছেই বা এরকমভাবে কেন বলল, যাতে মৌলি দিদি ওকে এতটা অপমান করতে পারে! এত কিছুর পরও কি কখনো আর এমন বলা যায়, যে সৌমাভ তাকে পছন্দ করে? কোনো আলাদা অনুভূতি আছে ওর জন্য সৌমাভর মনে? বোধহয় না…… একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস অজান্তেই বেরিয়েই এল তৃণার মনের ভিতর থেকে।
-” কোনো উত্তর দেবে? নাকি এটুকু ভদ্রতাও শেখোনি?”
-” কী উত্তর দেব, আপনিই বরং বলে দিন ”
নিস্পৃহ গলায় কথাটা বলল তৃণা। ওর পরাজয়টা অনুভব করে যেন মনে মনে প্রচন্ড খুশি হল মৌলি। গলার আওয়াজটা আরো একটু বাড়িয়ে সে বলল,
-” আজ বিকালে আমি আর সৌমাভ বেরোচ্ছি একটু, নিজেদের সম্পর্কটা আরো বেশি মজবুত করার জন্য, বোঝাপড়া টা আরো সুন্দর করার জন্য। বুঝতে পারছ তো ব্যাপারটা? ওহ হ্যাঁ, আজ তোমার জন্মদিন না?”
-” হুমমম। হ্যাপি বার্থডে। ভালো থেকো। অন্য কোনো ভালো কাজে, নিজেকে ব্যস্ত রাখো। দেখো ভালো লাগবে, তাহলে আর এদিকে ওদিকে মন যাবেনা। কেমন? রাখছি ফোনটা।”
কঠিন কন্ঠে কথাটা বলে, আর কোনো অপেক্ষা না করেই ফোনটা কেটে দিল মৌলি। জন্মদিনের সুন্দর সকালটা যে এভাবে, পুরোপুরি নষ্ট, বিস্বাদ হয়ে যাবে তা কালকে রাত অবধিও ভাবতেও পারেনি তৃণা। ফোনটা রেখেই, ও ছুটে চলে যায় বাথরুমের দিকে। কলটা সজোরে চালিয়ে, মেঝের কাছটায় বসে পড়ে তৃণা। এতক্ষণের চেপে রাখা জলটা যেন অঝোর ধারায় বেরিয়ে আসে ওর চোখ বেয়ে। এই প্রথম নিজের জন্মদিনে সকাল বেলাতেই চোখের জল ফেলতে হল তৃণাকে। ভালোবাসা-প্রেম শুরু হওয়ার আগেই এভাবে চোখের জল ফেলতে হয়? এটা কি শুধুই মানুষকে কাঁদাতে আসে? তাহলে এত কষ্ট পাওয়ার জন্য মানুষ ইচ্ছে করে কেন বারবার প্রেমে পড়ে? কেন ভালোবেসে ফেলে বারংবার?
(ক্রমশ)