#ইহান_ভাই
#সাদিয়া
৮
কয়েকদিন ধরেই ইহান বারবার মিহুর সামনে যেতে চাইলেও মিহু তার থেকে দূরে দূরে থাকছে। কলেজেও যাচ্ছে না। চুপচাপ ফোন নিয়ে ঘরে বসে থাকে। ইহান ম্যাসেজ করতেই সে ডাটা অফ করে বের হয়ে আসে। মিহুর মনে অজানা ভয় কাজ করছে। ভেতরের কথা আর মস্তিষ্ক এক হচ্ছে না। দু রকমের মতবাদে হাপিয়ে উঠেছে সে।
“মিহু ছাদে আমার সাথে দেখা করবি রাতে। কথাটা যেন মাথায় থাকে।”
মিহু ম্যাসেজ দেখে ঢোক গিলল। মনে মনে অনেক চিন্তা করতে লাগল সে। বিড়বিড় করে বলল “ইহান ভাই কেন এমন করছেন আপনি? মিথ্যে মায়াই কেন জড়াতে চাইছেন? এ মায়া তো আমার সইবে না ইহান ভাই।”
রাতে মিহু দরজা বন্ধ করে শুয়ে ছিল। আজ ডাটাও অন করে নি। জানে ইহান ভাই হয়তো অনেক গুলি ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে। ভেতরে ভয় হচ্ছে। অনুভূতি ভাঙ্গার নিদারুণ নির্মম কষ্ট!
১১ টার উপরে বেজে গেলেও ইহান মিহুর সন্ধান পাচ্ছে না। রাগে শরীর টা জ্বলে যাচ্ছে। ফেসবুকে ঢুকে দেখে মিহু ৪ ঘন্টা ধরে ফেসবুকেই নেই। মেজাজ একদম বিগড়ে গেল। মিহুর ঘরে যাওয়ার জন্যে নামতে যাওয়ার আগেই তিশা এসে হাজির। আচমকা ইহান বলে ফেলল “মিহু তুই.”
তিশা কপাল এক করে জবাব দিল “ইহান ভাইয়া আমি।”
“ওও তুই? এত রাতে ছাদে।”
“এমনি। তুমি কি করছিলে?”
“একটু বাতাস খেতে এলাম।”
“তাহলে চলো যাই।”
“হুম।”
ইহান আবার ছাদে গেল। তিশা তার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের জোরাজোরি তে এসেছে সে। ইহান কে ছাদে আসতে দেখেই তিশা কে জোর করে পাঠালেন স্বপ্না বেগম। মেয়ে কথা শুনেছে বলে খুব খুশি তিনি। এদিকে খানিক অস্বস্তি হচ্ছে তিশার। স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ইহান ভাইয়া দিন কাল কোমন যাচ্ছে তাহলে?”
“এই তো।”
“আবার বিদেশ ফিরে যাবে নাকি?”
“ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এখন নেই।”
“কেন? কারণ টা কি মিহু?”
চমকে উঠল ইহান। চটজলদি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল তিশার দিকে। তিশা উত্তরে মুচকি হেসে “কি ভেবেছো? বুঝি না কিছু? বুঝতে পারি ইহান ভাইয়া” নরম গলায় বলল।
ইহানের গলা দিয়ে কথা আসছে না। সে কিছু বলতে যাবে তখন তিশার ফোনে কল এলো। তিশা নাম্বার দেখে ইহান কে বলে ছাদের এক কোণায় চলে গেল কথা বলতে বলতে। বোধশক্তি শূন্য লাগছে নিজের কাছে। কেমন অস্থির লাগছিল বলে নিচে নামতে যাওয়ার আগে আবার থমকে গেল সে। সামনে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন “এসো আমার সাথে।”
ইহান কিছু না বলে চুপচাপ বাবার পিছু যেতে লাগল।
আফজাল সাহেব ইহানের রুমে এসেছেন। পিছনে ইহানও। আমতাআমতা করে বলল “কিছু বলবে আব্বু?”
উনি কিছুক্ষণ থমকে ছিলেন। তারপর বলতে লাগলেন,
“ইহান বাবা তুমি তো জানোই মিহুর ব্যাপারে। খুব ছোটবেলায় ওকে এনেছিলাম এ বাসায়। ওর বাবা মা কেউ ছিল না। অনেকটাই ছোট ছিল তখন। মিহু কে আদর করে বড় করেছি। তিতুন, তিশার থেকে কখনো আলাদা করে দেখিনি। যখনই ওদের জন্যে কিছু এনেছি তখন মিহুর জন্যেও এনেছি। মিহুও আমাদের খুব ভালোবাসে। যখন যা করতে বলি তাই করে। মিহুর সাথে ছোটবেলা থেকেই তোমার সম্পর্ক বেশ একটা ভালো ছিলো না। ঝগড়া করতে মারতে ওকে। এখনো দেখি তেমন পরিবর্তন হয়নি। মেয়েটার আপন বলতে আমরা ছাড়া কেউ নেই। কখনো এমন কিছু করো না যেন কষ্ট পায়। কাউকে আঘাত দেওয়া ঠিক নয় বাবা। আর একটা কথা তুমি বড় হয়েছো। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজের নেওয়ার সময় এসেছে তোমার। কখনো তোমার উপর কিছু চাঁপিয়ে দিব না আমি।”
আফজাল সাহেব দম নিলেন। তারপর আবার বললেন “রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো মাই সন।”
আফজাল সাহেব চলে যাওয়ার পর ইহান বিছানায় বসে পড়ল। তাকে চিন্তিত লাগছে। বাবার বলে যাওয়া কথাগুলি মাথায় লাগছে ঘন বস্তুর মতো। চোখ বন্ধ করে ভাবতে বসল।
—-
১২ টার উপরে বাজে। ইহান বাহির থেকে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল। আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো চোখ মুখ করে ধীর পায়ে সে ভেতরে ঢুকল। নিজের কাছে বিশ্বাসই হচ্ছে না এমন কিছু। নিষ্প্রাণ নির্জীব এক খন্ড দেখাচ্ছে তাকে। আস্তেআস্তে এগিয়ে গেল ভেতরে। ড্রয়িংরুমের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়াল। মিহু শাড়ী পড়েছে। জর্জেট নেবি ভ্রু আর কালোর মাঝে একটা শাড়ী। কি অসম্ভব মায়াবতী লাগছিল তখন। মাথা নিচু করে সে সবাই কে শরবত আর নাস্তা দিচ্ছে। কাজল কালো অশ্রু সিক্ত দুই নয়নে একবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার নামিয়ে ফেলল। ইহানের বুকে সেই চাউনি বাণ হয়ে বিঁধল। আহ কি মরণ যন্ত্রণা! ভেতরটা ছারখার করে দিচ্ছে।
স্বপ্না বেগম ইহানের দিকে তাকিয়ে বাঁকা ঠোঁটে হাসলেন। অবশেষে মনের আশা পূর্ন হলো। কাঙ্ক্ষিত চাওয়ার অনেক দূর এগিয়ে গেছেন তিনি। আর একটু বাকি। আফজাল সাহেব কে কয়দিন ধরেই এক কথা বলছেন তিনি। অবশেষে তিনিও রাজি হলেন বিয়েতে। হবে নাই বা কেন ছেলের অবস্থা বেশ ভালো ৫৬ হাজার টাকার বেতন ঢাকা শহরে বাড়ি গাড়ি সব আছে। আর কি চাই?
আফজাল সাহেব বললেন “আপনাদের কি মেয়ে পছন্দ হয়েছে?”
চোখ বন্ধ করে নিল ইহান। ভেতরটা তছনছ হয়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। চোখের কোণায় আসা পানিটা আড়াল করে নিলেও মায়ের চোখ এড়াই নি। তিনি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেন।
তাদের থেকে উত্তর এলো “মেয়ে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। আপনাদের ছেলে পছন্দ হলে বিয়ের কথা এগিয়ে নিব।”
“আলহামদুলিল্লাহ।” আফজাল সাহেবের সাথে বাকি সবাই বলল।
তিনি মিহু কে ভেতরে যেতে বললেন। মিহু চলে গেল। বুকটা ফেটে কান্না আসছে। মায়া কেন সবাই কে ঘিরে ধরে? চাইলেও কেন ছাড়ানো যায় না এই জাল?
মিহু যাওয়ার পর ইহানও নিজের রুমে চলে গেল। দরজা আটকে চাঁপা কান্নায় কষ্ট বের করে দিচ্ছে। “ভালোবাসা হারানোর কষ্ট কোনো পুরুষ কে শক্ত থাকতে দেয় না। চোখের কোণায় অশ্রু দেখা দিতে আসবেই সে সময়টায়। নোনাজল তখন সঙ্গী হয়ে উঠে।”
কান্না করতে করতে ইহান ঘুমিয়ে গেছে। সেদিন আর বের হয় নি ঘর থেকে। এরপর দিন সকাল সকাল বাড়ির সবাই ছেলের বাড়ি দেখতে যাবে। ইহান কে রেহেলা বেগম ডাকলেও সে যাবে না বলে দিয়েছে। মিহুকেও নিতে চেয়েছিলেন আফজাল সাহেব। বলেছিলেন “থাকবি তুই। সংসার টা তোর হবে। তোর দেখে নেওয়া টা জরুরি না?” মিহু শরীর খারাপের বাহানাতে থেকে গেল। ভাঙ্গা হৃদয়ে আর সুখে থাকার স্বপ্ন দেখে না সে।
পুরো বাড়ি নীরব স্তব্ধ গম্ভীর। কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। মিহু অনেক ভেবে ইহানের ঘরের সামনে গেল। গলা উবচে কান্না আসলেও হজম করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। তবে অশ্রু সিক্ত ওই লাল চোখ দুটি আড়াল করতে পারল না। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে ইহানের দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে শব্দ পাওয়া গেল না। মিহু আবার টোকা দিল। ইহান ধারস্ত গলায় প্রশ্ন করল “কে?”
মিহু জবাব দিতে পারছে না বলে আবার টোকা দিল। ইহান রাগি আর বিরক্তির কন্ঠে বলল “কে বলবে তো? কেন বিরক্ত করছো?”
মিহু ধরে আসা গলায় বলল “ইহান ভাই আমি।”
বিষয়টা ইহান কয়েক সেকেন্ড ধরে বুঝল। তারপর বিদ্যুৎ গতিতে দরজা খুলেই মিহু কে জড়িয়ে ধরল সে। ইহানের চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগল। মিহু কে ছাড়া থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। মিহু কে হারাতে দিতে পারবে না সে। বুকের সাথে শক্ত করে চেঁপে ধরেছে।
মায়া থেকে ভালো লাগা। তারপর ভালো লাগা থেকে কখন ইহান তার মনে একটা জায়গা করে নিয়েছে মিহুর অজানা। সে চোখের পানি ঝেড়ে ফেলে নিজেকে ছাড়াল ইহানের থেকে। নাক টেনে বলল,
“আপনার সাথে দেখা করতে এলাম।”
“….
“হয়তো আর কখনো এভাবে দেখা হবে না। আপনার তো ভালোই ঝগড়া করতে হবে না। কাউকে সহ্য করতে হবে না।”
লাল লাল চোখ দুটি নিয়ে ইহান মিহুর বাহু চেঁপে ধরল। দাঁত চেঁপে বলতে বলল,
“তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না মিহু।”
“….
খুব কষ্ট হচ্ছে মিহুর। ভেতরটা মনে হচ্ছে এখনি ভেঙ্গে গুঁড়াগুঁড়া হয়ে যাবে।
“আর তোকে হারাতে দিতে পারব না। পারব না। তুই এই বিয়ে করতে পারবি না।”
“….
“না করে দে বিয়েতে।”
মিহু ছাড়িয়ে নিল নিজেকে শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল, “আমি একা যে বিয়ে করছি এমন তো নয় ইহান ভাই।”
কপাল কুঁচকে সে জিজ্ঞেস করল “মানে?”
“মানে আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার দুই দিন পরই আপনার বিয়ে।”
“….
“আমি বউ ভাতের পর দিন এখানে আসার পর আপনার গায়ে হলুদ হবে ইহান ভাই। আর তারপরে তিশা আপুর সাথে বিয়ে।”
গলা ভার হয়ে এলো মিহুর। ইহান অনেক রেগে গেছে। মিহু কে আবার বাহু খামছে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। বলল
“তোর মাথা ঠিক আছে মিহু?”
“….
“তিশা কে আমি কখনো বিয়ে করব না।”
“আপনার কথাতেই হবে না ইহান ভাই। চাচ্চু অনেক আগে থেকেই স্বপ্না চাচির সাথে কথা বলে রেখেছে এ বিষয়ে।”
“এসব কি বলছিস মিহু? তোকে ছাড়া আমি কাউকে চাই না।”
স্তব্ধ হয়ে গেল মিহু। কি বলবে এখন? আবার কেন যেচেপড়ে মিথ্যে মায়ায় আটকাতে এলো নিজেকে? ভাগ্য কে সে মেনে নিবে। মিহু চলে যেতে চাইলে ইহান তার পথ আটকায়।
“মিহু তুই কি ওই ছেলেটাকে বিয়ে করে সুখি হবি?”
“….
“আমার প্রতি কি তোর কোনো অনুভূতি নেই?”
চোখ ভর্তি পানি নিয়ে মিহু ইহানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
“আমি তোকে বিয়ে করব। আজ এখনি। আয় আমার সাথে।”
মিহু কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না ইহান ভাই কি বলছে। কানে ভো ভো করে শব্দ হচ্ছে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে শুধু।
“আমি তোকে বিয়ে করব। তারপর যা হবার হবে। আর আশা করি আম্মু আব্বু নারাজ হবে না কিন্তু আমি আগে তোকে বিয়ে করে নিজের করে নিতে চাই।”
“ই ইহান ভাই।”
“একেবারে চুপ। আর কোনো কথা বললে একদম মাটিতে পুতে রেখে দিব। তুই অন্য কারো হতে পারবি না। তুই এই বাড়ি থেকে চলে গেলে আমি ঝগড়া করব কার সাথে? কার ফোলা গাল দেখব আমি। তোকে বিয়ে করে আমার করে নিব মিহু।”
ইহান কথা শেষ করে মিহু কে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল। মিহু কিছু বলছে না। বেকুবের মতো চেয়ে আছে শুধু। এই সম্পর্ক অন্য কেউ মেনে না নিলেও চাচ্চু মেনে নিবে এতে তার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু টান পাওয়া সুঁতা যে ছিঁড়তে চাইছে না। মনে মনে শুধু ভাবছে,
“এই ইহান ভাই কে বিয়ে করে আমি বিয়ের পর ঠিকঠাক ভাবে থাকতে পরবো তো? লোকটা কি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে? হায় ইহান ভাই!”
সমাপ্ত