#গাংচিল
#১৮তম_পর্ব
সীমান্ত হেসে উঠলো। তার হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা খুব প্রিয় মৌপ্রিয়ার। ঘরে ঢুকে তাকে বিছানায় শায়িত দেখেই কলিজায় কামড় পড়েছিলো। তার ফ্যাকাশে মুখখানা দেখে বুকে হাজারো তীর আঘাত হানছিলো। ভালোবাসা এতোটা বেদনার এই প্রথম টের পেলো মৌপ্রিয়া। সীমান্ত খেতে লাগলে মুগ্ধ নজরে তাকে দেখতে লাগে মৌপ্রিয়া। হঠাৎ ই বলে উঠে,
“আমার আপনাকে কিছু বলার আছে, একান্তে বলতে চাই। তাই খাওয়া শেষে একটু সময় হবে কি?”
সীমান্ত খানিকটা থমকে গেলো। আড়চোখে টগরের দিকে তাকালো। টগর খানিকটা ইতস্ততস্বরে বললো,
“আমি খেয়েই বেড়িয়ে পড়বো।“
টগর খাবারের বেগ বাড়ালো। সীমান্ত কিছুক্ষণ ভাতের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরপর শান্ত গলায় বললো,
“মৌপ্রিয়া, তুমি তো জানো এটা ছেলেদের মেস। এখানে যদি এভাবে একজন যুবক, যুবতী একই রুমে বেশ কিছুক্ষণ বদ্ধ থাকে তবে তাদের নিয়ে অহেতুক কথাটা রটবে। সেই কথাগুলো খুব একটা শ্রুতিমধুর লাগবে না তোমার।“
“আপনি কবে থেকে লোকের কথায় কান দিচ্ছেন?”
“আমাকে নিয়ে কথা উঠলে হয়তো কান দিতাম না, কিন্তু সেখানে তুমিও থাকবে।“
এবার মৌপ্রিয়া হো হো করে হেসে উঠলো। খিলখিল হাসিতে পুরো ঘর মুখোরিত হয়ে উঠলো। সীমান্ত অবাক ক্লান্ত নজরে মৌপ্রিয়াকে দেখছে। একটা মানুষের সব কিছুই কি সুন্দর হতে পারে? পারে না। কিন্তু এই মেয়েটির সবকিছুই সুন্দর। তার কান্নারত মুখ, তার হাসি, তার চোখ, তার ঠোঁট সব সুন্দর। মৌপ্রিয়া হাসি থামিয়ে বললো,
“মাস্টারমশাই এর চিন্তায় আমি শিহরিত। তবে আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি এখানে আসার আগে বাবাকে বলে এসেছি। কথাটা যদি খুব জরুরি না হতো, তবে এতোটা ব্যাস্ত হতাম না। আর কথাটা খুব ব্যাক্তিগত। চিন্তা করবেন না, বেশি সময় নিবো না। আপনি নিশ্চিন্তে খেয়ে নিন। আমি অপেক্ষা করছি। আপনার খাওয়া শেষে নাহয় চা খেতে কথা বলা যাবে। আমার কাছে অঢেল সময়।“
সীমান্ত আর কথা বললো না। খাওয়াতে মন দিলো। অনেকদিন পর যেনো জিবে স্বাদ এসেছে। পেটের ক্ষুধাটাও যেনো দ্বিগুন হয়ে গেছে। সীমান্তের মনে হলো একটা রাক্ষস তার পেটে ভর করেছে। গোগ্রাসে গিলছে সে। আর মৌপ্রয়া মুগ্ধনয়নে তার মনের মানুষটিকে দেখে যাচ্ছে। পিপাসু চোখজোড়া যেনো শান্ত হয়েছে তাকে দেখে। কি অদ্ভুত এই প্রেম!
টগরের খাওয়া শেষে সে তৈরি হলো বেরিয়ে যাবার জন্য। মৌপ্রিয়া সব প্লেটগুলো গুছিয়ে নিলো। বের হবার আগে টগর সীমান্তের উদ্দেশ্যে বললো,
“বন্ধু, আমি বের হচ্ছি। ফোনটা কাছে রাখিস। কোনো অসুবিধা হলেই ফোন দিস। আমার একটু দেরিও হতে পারে। আসার সময় খাবার নিয়ে আসবোনে। আসলাম।“
“ঠিক আছে।“
টগর বেরিয়ে গেলে সীমান্ত মৌপ্রিয়াকে বলে,
“আমার টেবিলের উপরের ঠোঙ্গাটা দিবে? ঔষধ খেতাম।“
“দিচ্ছি।“
“তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম, তাই না?”
“কষ্টের কি আছে, দু কদমের মধ্যেই তো ছিলো। এমন একটা ভাব নিচ্ছেন যেনো আমি হনুমানের মতো পর্বত উঠিয়ে নিয়ে এসেছি।“
ঔষধের প্যাকেটটা দিতে দিতে মৌপ্রিয়া কথাটা বললো। সীমান্ত হেসে উঠলো। হঠাৎ তার কপালে হাত রাখলো মৌপ্রিয়া। মুচকি হেসে বললো,
“যাক বাবা জ্বরটা নেই। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম। জ্বরের মানুষটাকে কিভাবে নিয়ে বের হবো।“
মৌপ্রিয়ার এমন কাজে বেশ চমকে উঠে সীমান্ত। মৌপ্রিয়া আজ তাকে বার বার চমকে দিচ্ছে। প্রথমত মেসে এসে একবার চমকে দিয়েছে, তারপর আরেকবার চমকে দিয়েছে তার জন্য রান্না করে নিয়ে এসে, তৃতীয়বার চমকে দিয়েছে তার সাথে একান্তে কথা বলার আবদার করে, এখন আবার জ্বর মাপার বাহানায় কপাল ছুয়ে চমকে দিয়েছে। মেয়েটা কি ভুলে গিয়েছে সে একজন পুরুষের সান্নিধ্যে আছে। বলা তো যায় না, কুমতলব থাকলেও থাকতে পারে। সীমান্ত মুখ ফিরিয়ে নিলো। অস্থির কন্ঠে বললো,
“বের হবে মানে?”
“আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যেতাম। তাই আর কি!”
“ওহ!”
“জিজ্ঞেস করবেন না কোথায়?”
“নাহ। আমি জানি ক্ষতিকর কোনো জায়গায় তুমি নিয়ে যাবে না। আচ্ছা, কি কথা বলতে চেয়েছিলে, এখন বলো। কেউ তো নেই আমি আর তুমি ছাড়া।“
কথাটা শুনেই মৌপ্রিয়া চুপ হয়ে যায়। মনে মনে কথাগুলো গুছাতে থাকে। কোথা থেকে শুরু করবে বুঝে উঠছে না। মৌপ্রিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে সীমান্ত বলে,
“কি হলো বল।“
“আমি , আমি”
“হ্যা তুমি?”
“আমি আপনাকে……”
“হ্যা, তুমি আমাকে?”
“আমি আপনাকে নিয়ে সূবর্ণা বেগমের সাথে দেখা করতে যেতে যাই।“
তাড়াহুড়ো করে কথাটা বলে ফেলে মৌপ্রিয়া। এই কথাটা বলতে এতো দূর সে মোটেই ছুটে আসে নি। তবুও এই কথাটাই তার মুখে থেকে বেরিয়েছে। যে কথাগুলো বলতে তার এখানে আসা, কথাগুলো যেনো এলোমেলো হয়ে আসে। এই বিক্ষিপ্ত কথাগুলো মোটেই সাজাতে পারছে না মৌপ্রিয়া। খানিকটা লজ্জাও বোধ হচ্ছে। একটা মেয়ে প্রেম নিবেদন করবে, নব্যাপারটা খুব লজ্জার। মেয়েদেরকে প্রেম নিবেদম করা হয়, কিন্তু মেয়ে কিভাবে নির্লজ্জের মতো প্রেম নিবেদন করে? সীমান্ত খানিকটা সন্দীহান কন্ঠে বললো,
“তুমি তো স্যারকেই বলতে পারো। সে তোমাকে নিয়ে যাবে। আমি কেনো?”
“বাবার সাথে যেতে চাইছি না। আপনি কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত নেই। যেতে না চাইলে যাবেন না। আমার আপত্তি নেই।“
কাঁপা স্বরে কথাটা বললো মৌপ্রিয়া। সীমান্ত তখন হেসে বললো,
“যেতে চাইছি না, ব্যাপারটা তা নয়। আসলে শরীরটা ভালো নেই। তাই আর কি”
“সমস্যা নেই। আপনার যেদিন যেতে ইচ্ছে হবে। সেদিন না হয় যাবো। আমার তাড়া নেই।“
“বেশ, যাব ক্ষণ। আচ্ছা লেখা কতদুর? এবার কি বই টা বের হচ্ছে?”
“আলবত, শুধু শেষের দুই পরিচ্ছদ বাকি। ওইটা লেখা হলেই হয়ে যাবে।“
“মিলটা কি হচ্ছে রাসেল আর মৌ এর?”
“এখনো জানা নেই। হতেও পারে নাও পারে। একটু দ্বিধায় আছি।“
এবার সীমান্ত কিছুক্ষণ চিন্তা করলো। তারপর বললো,
“একটা এন্ডিং আইডিয়া দিবো?”
“দিন”
“এন্ডিং টা আংশিক রাখো। পূর্নতা টেনো না। ধরো, রাসেলের সাথে মৌ এর বিচ্ছেদ বাদে, আবারো তাদের দেখা। হঠাৎ অফিস থেকে ফিরে দেখলো রাসেল বসে আছে সেই টেবিলে। ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে মৌ। এমন?”
“তাহলে কি তাদের বিচ্ছেদটা হবে?”
“প্রেমে বিচ্ছেদটা জরুরি। বিচ্ছেদটা প্রেম প্রেম নয়। শুধু কিছু ভ্রান্ত আবেগ।“
মৌপ্রিয়া কোনো উত্তর দিলো না। অবাক নয়নে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হঠাৎ করেই বুকের বা পাশে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। এ কি তবে বিচ্ছেদের ব্যাথা! তাদের ও কি বিচ্ছেদ হবে? কিন্তু তাদের গল্পটা তো এখনো শূরুই হয় নি। তার আগেই কি এই বিচ্ছেদটা হবে! মৌপ্রিয়া বুকের ব্যাথা তীব্র হচ্ছে। কে বলেছে প্রেমে সুখ? মোটেই নয়। বরং প্রেম মানে বিষাধ, বিষাক্ত নীল বিষাদ_________________
৯.
ভাদ্রের ২৫ তারিখ, অথচ অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে ঢাকা শহরের বুকে। সকাল থেকে টানা বৃষ্টি। হয়তো অসহ্য গরমের থেকে নিস্তার পেতেই এই বৃষ্টিপাত। মিরপুরে বৃষ্টি মানেই বন্যা। বন্যা মানেই তলিয়ে যাওয়া রোডঘাট। অবশ্য বাসায় থেকে বারান্দা থেকে বৃষ্টি দেখতে খারাপ লাগে না তিয়াশার। গ্রিল ধরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করা। নিজেকে তখন হুমায়ুন আহমেদের লেখা কোনো নায়িকা লাগে। বৃষ্টির দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াশা, তখন ই রহিমা বেগমের আগমন ঘটে। তাকে স্বাভাবিক থেকেও উচ্ছ্বাসিত লাগছে। মহিলা সবসময়ই একটু বেশি উৎসাহিত থাকেন। তাই তিয়াশার আগ্রহ হলো না কারণ জিজ্ঞেস করার। তিনি তার মতো ঘর গুছাতে ব্যাস্ত। তিয়াশা বাহিরে মনোনিয়োগ করে। তখনই তিনি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,
“একি তুই এখানে বসে আছিস কেনো? তাড়াতাড়ি গোসল করে রেডি হয়ে নে?”
“আজ, অফিস নেই মা। তাই আজ কোথাও যাবো না। তোমাকে তো বলেছিলাম।“
“আরে তুই যাবি কেনো? তুই গেলে পাত্রপক্ষ কাকে দেখবে?…………….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি