গাংচিল, পর্ব:১৬

0
297

#গাংচিল
#১৬তম_পর্ব

মিজান সাহেবের ঠান্ডা গলার কথায় থমকে যান সুমী বেগম। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, ধরা গলায় বলেন,
“আপনাদের এই মান অভিমান আর জেদের যুদ্ধে আমার ছেলেটাই না হারিয়ে যায়, দেখবেন পরে যেনো আফসোসটা না হয়।“

কথাটা বলেই ভেতরে চলে গেলেন সুমী বেগম। মিজান সাহেবের উত্তরের অপেক্ষাটুকু। স্ত্রীর অভিমানটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছেন তিনি। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। শূন্য দৃষ্টি প্রয়োগ করলেন বাহিরের দিকে। এখনো আকাশের ক্রন্দন থামে নি, মুক্তার ন্যায় বারি বর্ষন হচ্ছে সবুজ চা বাগানের উপর। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে প্রকৃতির এই অপরুপ মায়া দেখতে লাগলেন মিজান সাহেব। হয়তো এভাবেই নিজের ভেতরে চলা লড়াই থেকে কিছুটা হলেও নিজেকে বিরতি দিতে পারবেন_________________

৮.
মেসের সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সজোরে ধাক্কা খেলো টগর। তাড়ার মাঝে যেনো তাড়া আরোও বাড়ে বলে মনে হলো তার। আজ ব্লাড দিয়ে মেসে নিয়ে এসেছে সীমান্তকে। সকাল থেকেই হাসপাতালে ছিলো তারা। ব্লাড ম্যানেজ করতে এবার বেশ ভুক্তে হয়েছে। ব্লাড ব্যাংকে ব্লাড এভ্যেইলেবল ছিলো না। পরে পরিচিত এক বন্ধু ব্লাড দিয়েছে। সীমান্তের শরীরটা বেশ দূর্বল। কেমন যেনো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। জ্বর, ঠান্ডা একেবারেই কাবু করে ফেলেছে তাকে। রুমে কোনো খাবার নেই। দুপুরের খাবারের ব্যাবস্থাটা তার ই করতে হবে। তাই বেশ তাড়ায় আছে সে। এর মাঝেই এই কান্ড। রেলিং ধরে নিজেকে সামলে নিলো টগর। মাথা তুলে শাসিয়ে উঠলো,
“চোখ কি ব্যাগে নিয়ে হাটেন নাকি? দেখে চলবেন তো।“
“মাফ করবেন, আসলে দোষটা আপনার। আপনি ই দ্রুত নামছিলেন। শুধু তাই নয়, আপনি দেখেন ও নি আমি উঠছি। যাই হোক। সরি”

টগর মেয়েটির এমনধারা কথা শুনে খানিকটা অবাক হলো। সে একই সাথে তাকে সরি বলছে এবং টগরের ভুলটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ভুলটা টগরের ই ছিলো। দ্রুত নামার তাড়ায় মেয়েটাকে সে খেয়াল করে নি। টগরের সামান্য লজ্জাবোধ হলো। কিন্তু তা টিকসই হলো না। যখন তার মনে পড়লো এটা ছেলেদের মেস। এখানে কোনো মেয়ের প্রবেশটা অনেকটা মরুভূমিতে বর্ষণ। এবার বেশ মনোযোগ দিয়ে টগর মেয়েটিকে দেখতে লাগলো টগর। কালো একটি শাড়ি পরিহিত মেয়ে, চুলগুলো বেশ সুন্দর করে খোঁপা করা। শ্যাম মুখখানায় এক অন্যরকম মায়ার ছাপ, কাজলকালো স্বচ্ছ চোখগুলো আভিজাত্যের পরিচয় দিচ্ছে। পাতলা ঠোঁটের কোনায় মাখা হাসিটা যে কারোর দিন ভালো করে দিতে পারে। হাতে একটা হটপট। মেয়েটা যদি কোনো নাটক থিয়েটার করতো তবে খুব সহজেই “পারমিতা” এর ললিতা হতে পারতো। টগরকে নিজের দিকে এভাবে খুটিয়ে দেখতে দেখে মেয়েটা ধীর স্বরে প্রশ্ন করে,
“কিছু বলবেন?”
“আপনি কার কাছে এসেছেন?”

স্পষ্ট জড়তাবিহীন কন্ঠেই প্রশ্নটা করে টগর। মেয়েটা হয়তো প্রস্তুত ছিলো না এই প্রশ্নের জন্য। তার চোখে মুখে এক অস্বস্তি কাজ করছে। তবুও ইতস্তত স্বরে বলে,
“সীমান্ত সাহেব কি এই মেসেই থাকেন?”
“আপনি সীমান্তের কাছে এসেছেন?”
“আপনি তাকে চিনেন?”

বেশ উৎফুল্ল হয়ে মেয়েটি প্রশ্ন করে। তার চোখ চকচক করছে। যেনো অনেক খোঁজার পর অবশেষে সে এক দূর্মূল্য জিনিস পেয়েছে। টগর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে তার দিকে। তারপর প্রশ্ন করে,
“সীমান্তের কাছে আপনার কি কাজ?”
“তার সাথে যে কাজ তা নাহয় আমি তাকেই বলবো, আপনি একটু আমাকে উনার কাছে নিয়ে যেতে পারবেন?”
“সে অসুস্থ, এখন কারোর সাথে দেখা করতে পারবেন না।“
“আমি জানি সে অসুস্থ, কিন্তু আমার সাথে দেখা করতে তিনি মানা করবেন না। আপনি কথা বাড়াচ্ছেন শুধু শুধু। অনুরোধ করছি, প্লিজ আমাকে উনার কাছে নিয়ে যান। উনার সাথে অনেক কথা আছে আমার।“

টগর খানিকটা বিরক্ত হচ্ছে, মেয়েটি রীতিমতো তাকে ওর্ডার করছে। কিন্তু সেটাকে অনুরোধের ভঙ্গিতে করছে। তাই তাকে মানা করার উপায় পাচ্ছে না সে। তাই বিরক্তের সাথেই বললো,
“চলুন”

মেয়েটার ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হলো। সে টগরের পিছু পিছু সীমান্তের ঘর অবধি গেলো। সীমান্ত তখন চোখের উপর হাত ঢেকে শূয়ে আছে। টগর তাকে ধীর গলায় বললো,
“সীমান্ত, একজন মহিলা তোর সাথে দেখা করতে এসেছেন। উঠ।“

সীমান্ত ক্লান্ত কন্ঠে বললো,
“কে এসেছে?”
“পরিচয় দিচ্ছেন না, উঠেই দেখ।“

সীমান্ত কোনোমতে উঠে বসলো। তখনই মেয়েটি টগরের পেছন পেছন ঘরে প্রবেশ করলো। তাকে দেখেই সীমান্তের চোখ বিষ্ময়ের চোটে বড় বড় হয়ে গেলো। মুখ থেকে বেড়িয়ে গেলো,
“মৌপ্রিয়া”
____________________________________________________________________________
ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াশা, ক্লান্ত চোখ জোড়া মেঘের আনাগোনা দেখতে ব্যাস্ত। তিয়াশার মা অর্থাৎ রহিমা বেগমের শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো নেই। ডায়াবেটিসটা কন্ট্রোলে থাকছে না, ফলে গতকালে মাছের কাটা ফোটা জায়গাটা পেকে গেছে।থাতের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ঔষধ দিতে পারছে না বিধায় শুধু নাপা আর হেক্সাসলের ডেসিং করতে হচ্ছে। ডাক্তারটা দেখাতে পারলে উপকার হতো। মাসের শুরু, কিন্তু বেতনটা এখনো পাওয়া হয় নি তিয়াশার। প্রতিদিন এডমিনিস্ট্রেশনের রুমে ধন্না দিতে হচ্ছে। টাকাটা পেলে ডাক্তার দেখাতো মাকে। এই ঢাকা শহরে ডাক্তাররা সোনার ব্যাপারী থেকেও জল্লাদ, একটা ভিজিটে দেড়টা হাজার টাকা চলে যায়, ঔষুধপত্রের কথা নাই বা বলা হোক। মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে নিজেকে। গতমাসে মাথাটা না ফাঁটালে আজ টাকার চিন্তাটা করতে হতো না। মৌকে বললে, সে চোখ বুঝে ধার দিতো। কিন্তু তার করুনা নিতে ইচ্ছে করছে না তিয়াশার। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। মাঝে মাঝে নিজের অপারগতার উপরে খুব রাগ হয়। আজ আবার এডমিনিস্ট্রেশনকে জানাবে। আশা করছে আজ তাকে শূন্য হাতে যেতে হবে না। মোবাইলে ঘড়ির সময়টা দেখে নিলো সে। লান্স টাইম শেষ। ডেস্কে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। ডেস্কে যাবার জন্য ঘুরতেই একজন মানুষের সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো সে। তিয়াশার মনে হলো একটা বিশাল পাথর এসে ধাক্কা দিয়েছে। অসতর্কতায় নাকে বেশ লেগেছেও। নাকে হাত দিয়ে মাথা তুলে তাকায় তিয়াশা। মাথা তুলতেই পা জোড়া ঠান্ডা হয়ে গেলো তার। তার সম্মুখের মানুষটি আর কেউ নয় বরং অন্তু। সুগভীর নয়নে সে তাকিয়ে আছে তিয়াশার দিকে। অন্তুকে এখন এখানে মোটেই আশা করে নি সে। ছাদের এই জায়গাটা শুধু তার একান্ত একাকীর সঙ্গী। সেখানে আর যাই হোক অন্তুকে সে আশা করে না। বিগত তিনদিন যেখানেই যায় না কেনো লোকটা তার পিছু নিচ্ছে। যা তিয়াশাকে অসম্ভব অস্বস্তিতে ফেলছে। দু একবার কথা বলার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু তিয়াশা এড়িয়ে গছে। অনুভূতিকাতর মনটাকে পুনরায় দূর্বল করতে চায় না সে। এখনো তাই করবে, এড়িয়ে যাবে অন্তুকে। তিয়াশা মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে যেতে গেলেই হাতটা টেনে ধরে অন্তু। হ্যাচকা টানে তিয়াশাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে সে। অবাক নয়নে অন্তুর দিকে তাকায় তিয়াশা। এর পর অন্তু আরো অবাক করে তার কোমর চেপে ধরে। সুঠান পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠে তিয়াশা। জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টি প্রয়োগ করে সে অন্তুর দিকে। কিন্তু অন্তু তো অন্তু। নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সে। হাতের বাঁধন ছাঁড়াতে অক্ষম হলে তিয়াশা স্বর খাঁদে নামিয়ে মিনমিন করে বলে,
“ছাড়ো”
“যদি না ছাড়ি, কি করবে?”

কথাটা শুনেই চমকে অন্তুর দিকে তাকায় তিয়াশা। অন্তু তখন……………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here