#গাংচিল
#১৪তম_পর্ব
শাহানা বেগম ছেলের সাথে রাগারাগি করতে চাচ্ছেন না। বলা যায় না, ছেলে ঘর ছেড়েও চলে যেতে পারে। অন্তুর জিদটা তার জানা। তাই মধ্যস্থতা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে তার ধারণা। তাই নম্র স্বরে ছেলেকে তিনি বলেন,
“বৌমাকে ঘরে কবে আনছিস?”
“তোমার বউমা আমার সাথে থাকতে চায় না। হয়তো আমি তার যোগ্য নই, তাই তো আমাদের বিয়ের কথাটা সে গোপন করে গেছে। আমিও তাকে জোর করি নি। ও না চাইলে আমি ওর কাছে স্বামীর অধিকার নিয়ে কখনোই দাঁড়াবো না“
“বিয়েটা কি ছেলেখেলা নাকি? ইচ্ছে হয়েছে বিয়ে করে ফেলেছো, এখন ইচ্ছে করছে না বলে সম্পর্কটা ভেঙ্গে ফেলবে। যদি এক সাথে সংসার ই না করবে তাহলে তখন ওই নাটকটা করার তো কোনো মানেই হয় না।“
“আমি তো বলি নি আমি সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলবো শুধু বলেছি ওকে জোর করবো না। তবে সে মানুক আর নাই মানুক আমি তাকেই আমার স্ত্রী মানি। আর সারাজীবন তাকেই আমার স্ত্রীর স্থান দিয়ে যাবো।“
অন্তুর কথায় খানিকটা শাসিয়ে উঠলেন সাফায়াত সাহেব। একরাশ বিরক্তিনিয়ে বললেন,
“যতসব, শুনেছো শাহানা তোমার ছেলের কথা। এই ফাউল কাজের জন্য আমরা তাকে কলেজে পাঠাতাম। বাবু পড়াশোনা শিকে তুলে প্রেম করতেন, এখন শুনছি বিয়েও করেছেন। লজ্জা, লজ্জা।“
শাহানা বেগম স্বামীর কথাকে খুব একটা তোল্লায় নিলেন না। বরং ছেলের দিকে সন্দীহান দৃষ্টিতে তাকালেন। অন্তুকে একজন ব্যার্থ পরাজিত সৈনিকের মতো মনে হচ্ছিলো তার। তিনি কিছু একটা ভেবে জড়তাহীন গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,
“ভালোবাসো তাকে?”
শাহানা বেগমের প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকে অন্তু। বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে তার। এই দীর্ঘশ্বাসে রয়েছে না পাওয়ার আক্ষেপ। মাথা নত করে বলে,
“খুব ভালোবাসি তাকে, কিন্তু সেই শুধুবোঝে নি।“
এবার শাহানা বেগম তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“তোমাদের এই ইয়াং এজের পোলাপাইনের সমস্যা কি জানো? তোমরা অতিদ্রুত হাল ছেড়ে দাও। কোনো কাজ করার সময় তোমাদের খেয়াল থাকে না, কিন্তু দায়িত্বের বেলায় তোমাদের যত বাহানা। ভালোবাসতে যখন পেরেছো, তাহলে সেই ভালোবাসাটাকে নিজের করে রাখতেও শিখো। ভালোবাসলেই হয় না। সেটাকে অর্জন করতে হয়। হয়তো তুমি তার মনে তোমার প্রতি বিশ্বাস তৈরি করতে পারো নি, পারলে হয়তো সে তোমাকে ছেড়ে দিতো না। একটা মেয়ে যখন কলেজে পড়ে তখন তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার বাসার পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে যায়। তুমি তো নিজেই বললে ও টেস্ট এক্সামেও এটেন্ট করে নি। স্বাভাবিক কি নয় তখন সে সব মিলিয়ে মানসিক ঝামেলার মধ্য নিয়ে যাচ্ছিলো। তাই তোমার সাথে বিয়েটা পালন করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। আর তুমি কি অদ্ভুত প্রানী, তোমার বউ ঘর করবে না বলে তুমিও তাকে বাঁধা দেবার চেষ্টা করো নি। উলটো মেন ইগো নিয়ে বসে আছো। ও না চাইলে আমি জোর করবো না—- এই বুলশিট আমাকে শোনাবে না অন্তু। আমি তোমাকে সাতদিন সময় দিচ্ছি, তুমি আমার বৌ মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি আনবে। না পারলে আমি দেখবো, আমার বৌমাকে কিভাবে বাড়ি আনা যায়। এন্ড দ্যাটস ফাইনাল।“
শাহানা বেগমের কথায় ভাষা হারিয়ে ফেললো অন্তু এবং সাফায়াত সাহেব। ঠিক কি প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত তাদের, সেটা বুঝে উঠতে পারছে না তারা। সাফায়াত সাহেব হতভম্বের মতো জিজ্ঞেস করলেন,
“শাহানা, তুমি কি পাগল হলে? একটা মেয়েকে জানো না চিনো না, বৌ মার পরিচয় দিয়ে দিলে?”
“কেনো? জানতে চিনতে হবে কেনো? বিয়ের আগে তো আপনাকেও জানতাম না, চিনতাম না। তাই বলে কি আপনাকে বর হিসেবে অগ্রাহ্য করেছি? বরং আঠাশটা বছর সংসার করে এসেছি। আমার ছেলে কোনো ফালতু মেয়ে বিয়ে করবে না সেই বিশ্বাস আমার আছে। এতো কথা বলবেন না তো, সংসার কি আমি আপনি করবো? সংসার করবে আমার ছেলে। তাই তার জীবনসঙ্গী সেই বাছুক। আমরা এর মধ্যে না পড়ি। শুধু একবার ভাবুন তো, মেয়েটা যদি এই বিয়ের উছিলায় আমার ছেলেকে তখন ব্লাকমেইল করতো, কিছু করার ছিলো? মেয়েটা ভালো বলেই তাকে ছেড়ে দিয়েছে। আমি হলে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাতাম। আকাম্মা কোথাকার।“
শেষ কথাটা অন্তুর দিকে তাকিয়ে শাহানা বেগম বললেন। অন্তু সাথে সাথে মাথা নত করে ফেললো। তবে এতোদিনের জমাট বাধা পাথরটা যেনো বুক থেকে নেমে গেলো। বিয়েটা মা মেনে নিবে এটা কল্পনার বাহিরে ছিলো, কিন্তু তিনি মেনে নিয়েছেন। ভাবতেই ভালো লাগছে অন্তুর। এখন শুধু আগামী সাতদিনের অপেক্ষা। তিয়াশাকে বোঝানোর অপেক্ষা________________
৭.
ভাদ্রের পনেরো তারিখ, তীব্র রোদে ঝলসে যাচ্ছে ঢাকা শহর। দুপুর বেলায় কুকুরপোড়া গরমটা যেনো মাত্রা ছাড়িয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই মৌপ্রিয়ার। মনের বড় যন্ত্রণা তার, কোনো কারণে কেউ তার হাসিটা কেড়ে নিয়েছে। তাই মুখটা গোমড়া করে বসে রয়েছে। তার ঠিক উলটো পাশে বসে রয়েছে তিয়াশা। বেশ কায়দা করে চকবার খাচ্ছে সে। মৌপ্রিয়ার মন খারাপে যেনো তার কিছুই যায় আছে না। একবার সেধেছিলো যদিও কিন্তু মৌপ্রিয়া মানা করায় আর জোরাজোরি করার ইচ্ছে হচ্ছে না। ক্লান্ত দুপুরে ঘামার্ত শরীরে আইসক্রিম খাবার মজাই আলাদা। তার মাথার অবস্থা এখন অনেকটাই ভালো। শুধু খুব বড় একটা দাগ হয়ে থাকবে। বিয়ের জন্য পাত্রপক্ষ আসলে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে,
“আপনার মাথায় দাগ কেনো?”
মৌপ্রিয়া তখন বেশ উত্তেজিত ভাবে বড়াই করে বলবে,
“আরে বলবেন না, সে এক হুলস্থুল কান্ড। আমাদের হাঁসপাতালে কি একটা গন্ডগোল হল। সব রোগী, ডাক্তার ক্ষেপে গেছে। ইট, পাটকেল যা পেরেছে হাতে নিয়ে নিয়েছে। পুলিশ এসেও থামাতে পারছে না। আমি তো সৎ ইমপ্লোয়ি তাই পালাতে পারি নি। সঠান হয়ে সেখানে লড়েছি। তখন ই একটা ইট মাথায় লাগে। আমার মাথা থেকে রক্ত ঝড়তে থাকে, কিন্তু আমি হাল ছাড়ি নি। লড়াই করে গেছি। সেটার স্মৃতি এই দাগ। আমার বীরত্বের পরিচয়।“
বেশ মজা লাগছে ভেবেই। তিয়াশাকে হাসতে দেখে মৌপ্রিয়া খানিকটা বিরক্ত হয়। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,
“আমি এদিকে মরছি আমার জ্বালায় আর তুই কি না হাসছিস? কি পাষন্ড রে তুই?”
“তুই তোর জ্বালায় মরছিস, আমি কি করতে পারি তাতে? এই আগুন তো আমি জ্বালাই নি। যে জ্বালিয়েছে তার কাছে যা।“
“বাজে কথা রাখতো, আমার জানে কি হয়েছে বুঝলি। এই অনুভূতিগুলো খুব যন্ত্রণাদায়ক। আমার না খেতে ইচ্ছে করে না, না ঘুমোতে ভাল লাগে। লিখতে গেলো ওই লোকটার কথা বলে পড়ে। আমি কাল পুরো চারহাজার শব্দ লিখেছি। কিন্তু সেই শব্দে আমি শুধু তাকে ভেবেছি। বোঝ তা? আর ভালো লাগছে না। তার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে, বেহায়ার মতো আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি জানিস। তাকে নির্ভাবনায় আমি এমন এমন কথাও বলে ফেলি যা তোকেও বলি নি। কেমন আশ্বস্ত লাগে তার কাছে। আজ পাঁচদিন সে আবার ডুব মেরেছে, আর এদিকে আমার অবস্থা বেহাল। আমি যেনো তাকে না দেখতে পেরে ক্লান্ত হয়ে উঠেছি। অদ্ভুত কথা শুনবি, এখন আমি “ব্যার্থ মানুষ” এর প্রোফাইল ও ঘাটি না। আমার কি মনে হয় বলতো, লোকটা জাদু জানে, নয়তো ঝাড়ফুক। আমার মনে হয় আমার উপরে ব্যাটা কালো জাদু করেছে। আমার পৃথিবীর কেন্দ্র হয়ে গেছে দোস্ত। সব কিছুতেই যেনো আমার তাকে চাই। কেনো এমনটা হচ্ছে বলতো?
“……”
“আরোও অবাককর কথা শুনবি, আমি তার সাথে সূভর্ণা দেবীকে নিয়েও কথা বলেছি। এও কি সম্ভব? প্রথমে ভেবেছি আমার সীমান্তফোবিয়া হয়েছে। কিন্তু এটা যেনো ধীরে ধীরে বাড়ছে। খুব গুরুতর হয়ে উঠেছে। কেনো, কি কারণ বুঝছি না। চুপ করে আছিস কেনো? কিছু তো বল”
তিয়াশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকিয়ে আছে মৌপ্রিয়ার দিকে। তারপর বেশ চিন্তার ভঙ্গি করে বললো,
“হুম্মম, আমি কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছি।“
“কি?”
মৌপ্রিয়া উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে শোনার জন্য। তখন তিয়াশা চিন্তিত কন্ঠে বলে,
“দোস্ত, ব্যাপারটা গুরুতর। আমার মনে হয় তুই প্রেমে পড়েছিস………………”
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি