#গাংচিল
#১৩তম_পর্ব
অন্তু কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর সেই অবস্থায় বসার ঘরে চলে গেলো। এদিকে শানা বেগম পেছন থেকে বলতে লাগলেন,
“অন্তু, এই জামায় যাস নে। কি ভাববে ওরা”
কিন্তু তার কথায় গুরুত্ব দেবার সময় নেই। অন্তু সঠান দেহে বসার ঘরে গেলো। সকলের চোখ তার দিকে। সবার চোখকে অগ্রাহ্য করে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আংকেল, আপনি এখানে কি মনে করে এসেছেন জানি না। তবে আপনি নিশ্চয়ই নিজের মেয়েকে কোনো বিবাহিত পুরুষের সাথে বিয়ে দিবেন না।“
বলা নেই কওয়া নেই অন্তুর এমন ধারা কথা শুনে সবার হতবাক দৃষ্টি চলে যায় অন্তুর দিকে। থমথমে পরিবেশ। মেয়েপক্ষ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে অন্তুর দিকে। একজন তো রসগোল্লা মুখের সামনে এনেও থেমে গেছে। মেয়ের বাবা ক্ষনে ক্ষনে সাফায়াত সাহেব এবং অন্তুর ফুফার দিকে তাকাচ্ছেন। সাফায়াত সাহেবের মস্তিষ্ক যেনো শূন্য হয়ে যায়। অন্তু বিবাহিত; কিভাবে, কোথায়, কখন আর কার সাথে প্রশ্নগুলো তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অন্যসময় হলে এক চড়ে অন্তুর মাড়ির দাঁত ফেলিয়ে দিতেন। কিন্তু মেহমানদের সামনে ছেলেকে কিছু বলতেও পারছেন না। অন্তুর এমন অদ্ভুত আচারণ তাকে বিব্রত ই করছে। তিনি জোরপুর্বক হাসি একে বলতে লাগলেন,
“অন্তু মজা করো না বাবা। আমার ছেলে বেশ মজা করতে ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকেই এই স্বভাব। এমন কথা বলবে, সবাইকে চমকে দিবে। আপনারা কিছু মনে করবেন না।“
সাফায়াত সাহেবের কথায় থমথমে পরিবেশটা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মেয়ের বাবা হো হো করে হাসতে হাসতে বলেন,
“যাক বাবা, কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম। অন্তু বাবা সত্যি ই আমাদের চমকে দিয়েছিলো।“
সব মুরুব্বিদের চিন্তিত মুখটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। এতে অন্তুর মেজাজটা আরোও খিচে গেলো। সে মোটেই চমকেদেবার জন্য কথাটা বলে নি। সে সত্যি বলেছিলো। সে সত্যিটা এতোগুলো বছর ব্যাপি মনের কোনে আটকে রেখেছিলো সে। কপাল কুচতে বরফ শীতল কন্ঠে বললো,
“আমার মুখ দেখে কি আপনাদের মনে হচ্ছে আমি ফাজলামি করছি। আই এম ডেম সিরিয়াস। আমার বাবা হয়তো আমার সিরিয়াসনেসের গভীরত্ব বুঝতে পারছে না। বাট আপনারা তো বোঝার ট্রাই করুন। আশ্চর্য্য তো, আপনাদের সাথে আমার পরিচয় আজকেই প্রথম। সুতরাং আপনাদের চমকে দেবার কোনো কারণ ই আমার কাছে নেই। নিজেকে বিবাহিত দাবী করে চমকে দেবার মতো কারণ তো নেই ই। আমি সত্য কথা বলছি। চাইলে আমার ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখতে পারেন। আমি খুব যত্নে রেখেছি সেটা। তবুও যদি নিজের মেয়েকে আমার গলায় ঝুলাতে চান, আই হ্যাভ নো ইস্যু। গো এহেড।“
সাফায়াত সাহেব নিজেকে সংযম রাখতে পারলেন না, বেশ চটে গেলেন। শুধু তাই নয়, বেশ হাইপার হয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
“চড়িয়ে তোমার দাঁত ফেলে দিবো। মশকরা করো তুমি? কি আবল তাবল বলতেছো, তোমার বিয়ে হলে বৌ কই?”
অন্তু ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
“সে আমার সাথে থাকতে চায় না, কিন্তু আমাদের বিয়ের সাত বছর হয়ে গিয়েছে। আর বাবা তুমি ভুলে যাচ্ছো তোমার ছেলে এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে না।“
অন্তুর নির্লিপ্ত বক্তব্যে আর কথা বলার অবকাশ পেলেন না সাফায়াত সাহেব। বরং তার দৃষ্টি চলে গেলো মেয়েপক্ষের দিকে। তাদের মুখ দেখে মনে হলো এমন অপমান জীবনে প্রথমবার হয়েছে তারা। মেয়ের বাবার থমথমে মুখখানা দেখে সাফায়াত সাহেবের মাথা নিচু হয়ে যায়। একে একে সবাই উঠে পড়ে। শাহানা বেগম খাবার কথা বললে, মেয়ের মামা হিনহিনে কন্ঠে বলে,
“আমাদের পেট ভরে গেছে, এমন আপ্পায়ন জীবনে কোথাও পাই নি।“
অন্তু নিজ রুমের দিকে হাটা দেয়। নিজের মা-বাবাকে সবার সামনে অপমান করার ইচ্ছে তার ছিলো না। কিন্তু এ ছাড়া উপায় ও ছিলো না। কেউ জানুক বা নাই জানুক সে জানে তিয়াশার সাথে তার বিয়েটা আর যাই হোক আবেগের ঘটঘটা ছিলো না। তার কাছে এই বিয়েটার মূল্য ছিলো সর্বাধিক। শুধু এই সত্যটা তিয়াশাকে বোঝাতে অপারগ ছিলো সে। যতই হোক জোর করে কাউকে ধরে রাখা যায় না। কারোর মন বাঁধা সবার দ্বারা সম্ভব হয় না______________
গায়ে জ্বর নিয়ে পড়ে রয়েছে সীমান্ত। মেসে থাকার জন্য একাই নিজের সহচর্চা করতে হচ্ছে। সেদিন বৃষ্টিতে ভেজাটা মোটেই উচিত হয় নি তার। কিন্তু মৌপ্রিয়ার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার লোভ সামলাতে পারে নি সে। ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিলো তারা। শুধু তাই নয় সেই ভিজা পাঞ্জাবীতেই থেকেছিলো ঘন্টার পর ঘন্টা। সেটার ফলাফল ই ভোগ করতে হচ্ছে তাকে। মেসে ফেরার পর থেকে মাথা যন্ত্রণা, গায়ে ব্যাথা। ভোর রাতে তুমুল জ্বর। মাথায় পানি দেবার মতো কেউ নেই। সেই জ্বর নিয়ে পড়ে রয়েছে আজ দুদিন। টগর জানতে পেরে মেসে এসেছিলো তাকে দেখতে। খাবাবের জোগানটা সেই দিচ্ছে। জ্বরটা বেশ জিদী, কমলেও ফের বেড়ে যায়। বেশ দূর্বল হয়ে গিয়েছে সীমান্ত। বুকে ব্যাথাটাও বেশ বেড়েছে। শরীরটা হয়তো তার সাথে আর টিকতে চাচ্ছে না। টগর ওয়ার্নিং দিয়েছে আজ জ্বর না কমলে হাঁসপাতালে ভর্তি করাবে। সীমান্ত রাজী হচ্ছে না বলেই সমস্যা বাড়ছে। হাসপাতাল সীমান্তের মোটেই ভালো লাগে না, সেখানের ফিনাইল এবং ঔষধের গন্ধে তার শ্বাস আটকে আসে। ছোটবেলা থেকে এই হাসপাতাল নামক স্থানের প্রতি একটা অভক্তি চলে এসেছে তার। সব কষ্ট সহ্য করে নিবে তবুও হাঁসপাতালে যেতে তার বাহানা।
শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলো তখনই ফোনটা বেজে উঠে। হাতে নিতেই ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠে সীমান্তের। শ্লেষ্মাজড়ানো কন্ঠে বলে,
“কেমন আছো মা?”
ওপাশ থেকে ধরা গলায় সুমী বেগম বলে উঠেন,
“আর কেমন থাকবো খোকা?”
“তুমি কাঁদছো?”
“কাঁদবো না, কতদিন পর তোর কন্ঠ শুনলাম বলতো। টগর ফোন করেছিলো, বললো তোর নাকি জ্বর। বাঁধালি কি করে?”
“বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। তাই হুট করেই…”
“আমি চলে আসি? দেখবি ভালো করে যাবি”
“তোমার বর কি আসতে দিবে তোমায়?”
“ভুলে যাস না সে তোর বাবা”
খানিকটা তীক্ষ্ণ কন্ঠেই কথাটা বললেন সুমী বেগম। সীমান্ত হাসলো। তারপর মৃদু স্বরে বললো,
“জানি তো, কিন্তু সে যে আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন।“
“এসব ত্যাজ্য পুত্র ফুত্র আমাদের মধ্যে হয় না। বললেই হলো, নয়মাস তো আমি তোকে গর্ভে ধরেছি নাকি।“
“তাই তো তোমাকে মা বলছি, আর তাকে বলছি তোমার স্বামী।“
“মশকরা করিস না বাপ, তুই ভালো করেই জানিস তোর শরীরটা ভালো নেই। এক কাজ করি আমি এসে যাই, ইকবাল ভাই ও ঢাকায় আছেন। উনি একটা সুখবর দিয়েছে জানিস। একটা ডোনার পাওয়া গেছে। ইকবাল ভাই চাচ্ছিলেন আগামী মাসে তোর অপারেশনটা করাতে। তখন আর তোকে মাসে মাসে রক্ত দেওয়া লাগবে না।“
সীমান্ত চুপ করে রইলো। ছোট বেলা থেকে সে লিউক্যুমিয়া নামক রোগে আক্রান্ত। তার শরীর কোনোভাবে পর্যাপ্ত পরিমান লোহিত রক্তকণিকা উৎপন্ন করতে পারে না। তাই প্রতিমাসে ব্লাড ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে তাকে রক্ত দিতে হয়। জীবনের এতোগুলো বছর এভাবেই কেঁটেছে তার। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট নামক ব্যাপারটা এখন অনেক কমন হলেও ডোনার পাওয়াটা অনেক দুষ্কর একটা ব্যাপার, বিগত ছয়বছর ধরে এই ডোনার খোঁজার কাজটি তার চাচা ইকবাল সাহেব করে এসেছেন। তিনবার ডোনার পেয়েও গিয়েছেন। কিন্তু সীমান্ত এবং তার বাবা মিজান সাহেবের মাঝের সম্পর্কটা অটপটে হবার জন্য সীমান্ত জিদ করেই অপারেশনটা করায় নি। সে নিজস্ব টাকা দিয়েই এই অপারেশনটা করাতে চায়। নিজস্ব প্রকাশনীর আয় দিয়ে। সেকারণে এতো বয়স হবার পর ও তার এই রোগটা নিরাময় হয় নি। সীমান্ত ধীর কন্ঠে বললো,
“মা, মাথা ব্যাথা করছে। ঘুমাবো। রাখলাম।“
বলেই ফোনটা কেটেদিলো সীমান্ত। বাঁচার ইচ্ছা সকলের হয়, কিন্তু নিজের আত্নসম্মানটা খুইয়ে নয়। যতই নিজের বাবা সে, তবুও তার কাছে মাথা নত করতে রাজী নয় সীমান্ত। হাতে সময় কম, হয়তো এই বছর বাদে তার এই পৃথিবীতে থাকা হবে না। কিন্তু এতে তার কোনো আফসোস নেই। সে বিশ্বাস করে, মৃত্যু সবাইকে ছুবে। নয়তো কারোরটা আগে, কারোরটা পরে কিন্তু ছোবে সে সবাইকে। হয়তো সীমান্তের মৃত্যুটা একটু তাড়াতাড়ি হবে। তাই সেই ভয়ে যুদ্ধে মাথা নত সে করবে না। কিন্তু বাবা ছেলের এই শীতল যুদ্ধে জিত যার ই হোক না কেনো হারটা যে দুজনার ই; এই সহজ হিসেবটা জানা স্বত্তেও বাবা এবং ছেলে কেউ ই নিজের জিদ ছাড়তে রাজী নয়। মাঝখান থেকে পিসছেন সুমী বেগম। তিনি যে একই সাথে মা এবং স্ত্রী। যেকোনো একজনকে বেঁছে নেওয়া যে তার পক্ষে অসম্ভব____________
অন্তুর সামনে বসে রয়েছেন শাহানা বেগম এবং সাফায়াত সাহেব। দুজনের মুখ থমথমে। সাফায়াত সাহেব প্রথমে হুমড়ি তুমড়ি করলেও এখন ক্লান্ত হয়ে গেছেন। যতই হোক, ছাব্বিশ বছরের ছেলেকে মারতে সে পারবেন না। কথায় আছে,
“ছেলের পায়ের জুতো যখন বাবার পায়ের জুতোয় সমান হয়ে যায় তাদের মাঝে শাসনের সম্পর্কটা খাটে না, তখন বাবা হয়ে যায় ছেলের বন্ধু।“
কিন্তু সাফায়াত সাহেব এই যুক্তির ধার ধারেন না। অন্তু কলেজে উঠেও বাবার বেতের বাড়ি খেয়েছে। তখন কিছুর থেকে কিছু হলেই তিনি হুংকার ছাড়তেন,
“তোকে আমি খাওয়াই, একটা পয়সা কামাই করছিস?”
কিন্তু এখন কথাটা সেটা নেই, অন্তু নিজের খরচ নিজে চালায়। শুধু তাই নয়, ঘরের অর্ধেক খরচ তার বেতনেই চলে। সুতরাং এই হুমকিটা এখন ঠিক খাটে না। শাহানা বেগম ছেলের সাথে রাগারাগি করতে চাচ্ছেন না। বলা যায় না, ছেলে ঘর ছেড়েও চলে যেতে পারে। অন্তুর জিদটা তার জানা। তাই মধ্যস্থতা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে তার ধারণা। তাই নম্র স্বরে ছেলেকে তিনি বলেন,
“বৌমাকে ঘরে কবে আনছিস?”
“তোমার বউমা আমার সাথে থাকতে চায় না………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি