#গাংচিল
#১২তম_পর্ব
সীমান্ত এগিয়ে পাশে দাঁড়ালো মৌপ্রিয়ার, তার গাল ভেজা। মেয়েটী কি কাঁদছিলো! কেনো কাঁদছিলো? উৎসুক মন অস্থির হয়ে উঠলো। কিন্তু সাহস হলো না জিজ্ঞেস করার। বরং উৎফুল্ল গলায় বললো,
“আজ ঘুরতে যাবে? নরম আবহাওয়ায় ঘুরতে ভালো লাগে”
মৌপ্রিয়া অবাক চোখে তাকালো সীমান্তের দিকে। তার চোখ এখনো ভেজা। সীমান্ত ধীর স্বরে বললো,
“সুন্দর, খুব সুন্দর।“
মৌপ্রিয়া ভ্রু কুচকে সন্দীহান চোখে তাকায় সীমান্তের দিকে। চিন্তার ঢেউ এ সীমান্তের কথাটা ঠিকমতো শুনতে পারে নি সে। তাই ধরা কন্ঠে বলে,
“কিছু বললেন?”
“নাহ, শুধু বলেছি আজ ঘুরতে যাবো। আমি নিচে অপেক্ষা করছি।“
বলেই হাটা ধরে সীমান্ত। কিন্তু কি মনে করে যেনো দাঁড়িয়ে যায় দরজার কাছে। মুচকি হেসে বলে,
“আজ নীল শাড়ি পরো, নীল শাড়িতে তোমায় খুব মানায়।“
বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যায় সীমান্ত। মৌপ্রিয়া কিছুক্ষণ বেকুবের মতো চেয়ে থাকলো দরজার দিকে। তার মনে হলো তার কান গরম হয়ে আসছে। শিরদাঁড়া বেয়ে এক ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেলো। মনের ব্যালকানির জমা মেঘ ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগলো। এক স্নিগ্ধ রোদের কিরণ এসে ভিড়েছে সেখানে। রংধনুময় মনে হচ্ছে সবকিছু। সে কি ধীরে ধীরে অসুস্থ মানুষে পরিণত হচ্ছে? কে জানে?
বিকেল ৫.৩০টা,
রমনা পার্কের একটা বেঞ্চি রুমাল দিয়ে মুছে দিলো সীমান্ত। ইশারা করে বসতে বললো মৌপ্রিয়াকে। মৌপ্রিয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও বারণ করলো না। কিছুক্ষণ পূর্বেও বৃষ্টি হয়েছিলো। এই প্রথম ভাদ্র মাসেও ক্ষনে ক্ষনে বৃষ্টি হচ্ছে। এই রোদ এই বৃষ্টি। প্রকৃতির যেনো এক অনন্য লুকোচুরি খেলা। সীমান্ত বুটের ঠোঙ্গাটা এগিয়ে দিলো মৌপ্রিয়ার দিকে। মৌপ্রিয়া আলতো হাতে নিলো ঠোঙ্গাটা, অহেতুক কারণে তার মনে হচ্ছে সে যেনো প্রেম করতে এসেছে। ব্যাপারটা হাস্যকর। জীবনে সে কখনো প্রেম করে নি, এই ব্যাপারটা সবথেকে কম আগ্রহ তার। অথচ আজ প্রথম বার ব্যাপারটায় বেশ আগ্রহ জন্মাচ্ছে মৌপ্রিয়ার। লাজুক নয়নে আড়চোখে দেখে যাচ্ছে সীমান্তকে। লোকটার মাঝে আহামরি কিছু নেই, সাধারণ একজন পুরুষ। কিন্তু কেনো যেন লোকটির সাথে থাকলে বেশ নিরাপদ অনুভূতি হয় মৌপ্রিয়ার। মেজাজ খারাপ হলেও মন খারাপ হয় না। মাঝে মাঝে নিজের কষ্ট গুলো ভুলে যায় সে। এটা কেনো হয়! উত্তরটা হয়তো বিজ্ঞান ও দিতে পারবে না।
সীমান্তের সামনে কিছু বাচ্চা ছেলে মেয়ে খেলছে। সীমান্ত মুগ্ধনয়নে দৃশ্যটা দেখছে। আর মৌপ্রিয়া তাকে দেখছে। হঠাৎ সীমান্ত বলে উঠলো,
“তোমার মন ভালো হয়েছে মৌপ্রিয়া?”
চমকে উঠে মৌপ্রিয়া। দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
“আপনি কিভাবে জানলেন আমার মন খারাপ?”
“নীলাঞ্জনা বললো। জানার অধিকার তো নেই, তবুও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে কেনো কাঁদছিলে?”
“আমি কাঁদতে যাবো কোন দুঃখে? বড্ড বাজে বকেন আপনি, জানেন তো?”
“তাই বুঝি, বেশ আর বকলাম না। তবে কি জানো তো কান্না খুব ছোয়াছুয়ি, দেখা যাবে তোমাকে কাঁদতে দেখে আমিও কাঁদতে লাগলাম।“
সীমান্তের এমন কথা শুনে হিনহিনে কন্ঠে মৌপ্রিয়া বলে,
“অকারণে কাঁদবেন কেনো? অদ্ভুত তো?”
“পৃথিবীতে অনেক অদ্ভুত জিনিস ঘটে, আমাদের সামনেই ঘটে। শুধু আমরা তাতে মাথা ঘামি না। তুমি চাইলে আমায় বলতে পারো কি হয়েছে। আমি কিন্তু শ্রোতা হিসেবে খুব ভালো।“
মৌপ্রিয়া চুপ করে থাকে। না চাইতেও মনের মাঝে হাজারো ঝড় কুন্ডুলি পাকাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে কখনো কাউকে মন খুলে কিছু বলা হয় নি। খুব কষ্ট হতো যখন দেখতো প্রতিটা বাচ্চার মায়েরা তাদের টিফিন হাতে অপেক্ষা করছে। অথচ তার মা নেই। তার বাবা জ্বলে যাওয়া রুটিতে জ্যালি লাগিয়ে টিফিনে ভরে দিতো। টিফিনের সময় সেই জ্বলা রুটিটাই খেতে হতো মৌপ্রিয়াকে। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে অভিযোগ করতে পারতো না সে। আজ হঠাৎ করেই সেই বেড়াটানা জাল বেধ করে সীমান্ত ঢুকে পড়েছে তার আঙ্গিনায়, জানতে আচ্ছে তার না বলা কথা। তাই ক্ষণিকের জন্য হলেও বিব্রত হচ্ছে মৌপ্রিয়া। মৌপ্রিয়ার চুপ থাকা দেখে আলতো হাসে সীমান্ত। তার দৃষ্টি চলে যায় বাচ্চাগুলোর দিকে। তখন মৌপ্রিয়া বলতে শুরু করে। সময় পার হতে থাকে, মৌপ্রিয়া বলতে থাকে তার সকল অভিযোগ, মায়ের প্রতি তার ঘৃণার প্রবল জোয়ার। সীমান্ত শুনতে থাকে। বিকেলের সোনালী রোদ আছড়ে পড়ছে চারিদিক। কি চমৎকার ঝলমলে রোদ, কিন্তু কোথাও যেনো ঠিক মেঘের ঘনঘটা হচ্ছে। কালো মেঘ জমেছে পূবের আকাশে।
সময় পেড়িয়ে গেলো মৌপ্রিয়ার গলা ধরে এসেছে। তার চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। গাল ভেজা, মোটা কাজল লেপ্টে গেছে চোখের নিচে। গোলগোল চোখজোড়া টুইটুম্বর হয়ে আছে। সীমান্ত তার চশমাটা মুছে নিলো তারপর ধীর স্বরে বললো,
“এতো শুনলাম স্যারের প্রেক্ষাপট, তা ম্যাডামের প্রেক্ষাপট টা কি?”
“মানে?”
“মানে, ম্যাডামের পক্ষের কোনো বাক্য নেই? একজন মানুষ অহেতুক তো কোনো কাজ করে না। তার ও কিছু কারণ থাকে। ম্যাডামের কারণটা কি?”
“একটা মহিলা তার নিজস্ব স্বার্থপরতার জন্য তার মেয়েকে ছেড়ে চলে গেছে, তার স্বামীকে অবহেলা করেছে, তার ভালোবাসাকে অপমান করেছে সেটার আবার কি কারণ থাকতে পারে?”
বেশ তীব্র কন্ঠে কথাটা বললো মৌপ্রিয়া। সীমান্ত মুচকি হেসে বললো,
“তুমি এতোটা কনফিডেন্ট কিভাবে যে তোমার বাবা স্বামী হিসেবে খুব ভালো ছিলেন?”
“অবশ্যই ছিলেন। আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা, তার সব কাজ সে পার্ফেক্টলি করে। অবশ্যই সে স্বামী হিসেবে ভালো ছিলেন।“
“হতেই পারে, হতেই পারে তিনি বাবার চরিত্রে দশ এ এগারো। কিন্তু তারমানে এটা মোটেই নয় যে তিনি স্বামী হিসেবেও দশে দশ। তুমি তার বাবা চরিত্র দেখেছো, প্রেমিক চরিত্র কিন্তু স্বামী চরিত্রটা দেখো নি। তা দেখেছেন তোমার মা। তুমি তো তোমার মার পক্ষটা জানোই না, তাহলে তাকে ভুল কিভাবে বলছো?”
এবার মৌপ্রিয়া ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
“আপনি কি তবে পরকীয়াকে সাপোর্ট করছেন?”
“আমি কিছুই সাপোর্ট করছি না, শুধু দুটো পক্ষ শুনতে চাচ্ছি। আমার মতে কোনো মানুষ ভুল হয় না; শুধু তাদের চিন্তাধারা, দৃষ্টিকোন গুলো আলাদা হয়। তখনই লাগে গন্ডগোল। তাই তো জীবনের হিসেবে কখনোই দুই আর দুই এ চার হয় না, মাঝে মাঝে পাঁচ ও হয় আবার বাইশ ও হয়। তুমি তো লেখিকা, এই সহজ হিসেব টা তো তোমার জানা। তাই নয় কি?”
মৌপ্রিয়া চুপ করে রইলো। সীমান্তের যুক্তির কাছে যে ব্যার্থ। হঠাৎ ই টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো। রোদের মাঝেও পানির বর্ষণ করছে আকাশ। মৌপ্রিয়া মাথায় হাত দিয়ে উঠে যেতে গেলেই হাতটা টেনে ধরে সীমান্ত। ধীর কন্ঠে বললো,
“প্রকৃতির এই অবিরাম মায়াকে অগ্রাহ্য করবে? থাকো না।“
মৌপ্রিয়া দাঁড়িয়ে রইলো, তার হাত সীমান্তের হাতে। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। স্বর্ণালী রোদের মাঝে অঝর ধারায় বর্ষন। কি চমৎকার মায়া স্রষ্টার_____________________
৬.
বাসায় ঢুকতেই অন্তু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। গিজগিজ করছে মানুষ। বাসায় কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে সেটা তার জানা ছিলো না। ক্লান্ত শরীরটা টানা চব্বিশঘন্টা ডিউটি করে আর ধকল নিতে পারছে না। তাই ভেবেছিলো বাসায় এসেই শান্তির ঘুম দিবে সে। কিন্তু এখানে তো হুলস্থুল কান্ড। বসার ঘরে চার পাঁচজন মুরব্বি বসে আছেন। তাদের কাউকে সে চিনে না। মাকেও দেখতে পাচ্ছে না। নয়তো জিজ্ঞেস করতো। অন্তু ঘরে ঢুকতেই সাফায়াত সাহেব বলে উঠলেন,
“অন্তু চলে এসেছে, যাক ভালোই হলো। আসো বাবা, আংকেলদের সালাম দাও।“
অন্তু খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। তাও বাবার সম্মানের জন্য সালাম দিলো। তারপর বললো,
“বাবা, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি?”
“হ্যা হ্যা, শিওর। উনারা তো আছেন।“
উনাদের থাকা বা না থাকায় কার কিছু যায় আসলেও অন্তুর কিছুই যায় আসে না। কিন্তু সাফায়াত সাহেব কেনো এটা বললেন সেটা অন্তু ঠিক বুঝতে পারলো না। সে অহেতুক মাথা না ঘামিয়ে ভেতরে চলে গেলো। শাহানা বেগম রান্নাঘরে ব্যাস্ত। অন্তু ফ্রেস হয়ে তার কাছে এসে দাঁড়ালো। কৌতুহলী কন্ঠ জিজ্ঞেস করলো,
“ইনারা কারা মা? বাবার বন্ধু?”
“আরে না, বন্ধু হবে কেনো? ইনারা তোকে দেখতে এসেছেন। তোর ফুপা সম্মন্ধ করেছেন। মেয়ের বাবা, খালু ইনারা এসেছেন। আর তুই এটা কি পড়েছিস? যা একটা ভালো শার্ট পড়ে আয়। এই গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পড়ে কি তাদের সামনে যাবি নাকি?”
শাহানা বেগম বেশ উৎফুল্ল কন্ঠে কথাটা বললেন। কিন্তু তার উৎফুল্ল কন্ঠ অন্তুকে উৎফুল্ল করতে পারলো না। তার মাথায় যেনো বাজ পড়লো এমনটা বোধ হলো। তাকে দেখতে এসেছে? মানে টা কি? সে কি কোনো হাটের গরু? তাকে কেনো দেখতে আসবে? আর বিবাহিত ছেলের কি না দ্বিতীয়বার বিয়ের জন্য লাফালাফি করছে তার বাবা মা। মানুষের একবার বিয়ে হয় না, আর তার কিনা দ্বিতীয়বার বিয়ে হবে। অন্তু কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর সেই অবস্থায় বসার ঘরে চলে গেলো। এদিকে শানা বেগম পেছন থেকে বলতে লাগলেন,
“অন্তু, এই জামায় যাস নে। কি ভাববে ওরা”
কিন্তু তার কথায় গুরুত্ব দেবার সময় নেই। অন্তু সঠান দেহে বসার ঘরে গেলো। সকলের চোখ তার দিকে। সবার চোখকে অগ্রাহ্য করে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আংকেল, আপনি এখানে কি মনে করে এসেছেন জানি না। তবে আপনি নিশ্চয়ই নিজের মেয়েকে কোনো বিবাহিত পুরুষের সাথে বিয়ে দিবেন না।“
বলা নেই কওয়া নেই অন্তুর এমন ধারা কথা শুনে………
চলবে
[]
মুশফিকা রহমান মৈথি