সুগন্ধি ফুল২ ( শেষ পর্ব )

0
2

#সুগন্ধি_ফুল_২
#অন্তিম_পর্ব
#জান্নাত_সুলতানা

-“এই ভীতুরানী!”

আব্রাহামের ডাকে মেহরিন চোখ খুললো পিটপিট করে। সামনে স্যুট বুট পরে আব্রাহাম খান কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে ওঠে বসতে বসতে জবাব দিলো,

-“জ-জি জি। সকাল হয়ে গেলো?”

মেহরিন আশেপাশে তাকালো। আর বুঝলো বেলা ভালোই হয়েছে।
সে অস্বস্তি নিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। আর আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

-“আপনি অফিস চলে যাচ্ছেন?”

-“হুঁ।”

-“ইশ আমাকে ও তো যেতে হবে।”

-“হবে না। নতুন এসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দিয়েছে আব্বু।”

আব্রাহাম বিছানার ওপাশ থেকে ঘুরে ওর দিকে আসতে আসতে কথা টা বললো। মেহরিন তো মাথা নিচু করে রেখে ছিলো। তাই তেমন বুঝতে পারলো না। যতক্ষণে বোধগম্য হলো ততক্ষণে আব্রাহাম তার এলোমেলো চুল কানের পিঠে গুঁজে দিচ্ছে। মেহরিন সামন্য কেঁপে উঠলো। আব্রাহাম ওর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। মেয়ে টা সুন্দর। তার দেশের এবং বিদেশের কিছু ফ্রেন্ড তার বউ দেখতে চাই ছিলো। আব্রাহাম কী করবে? এমন সুন্দর পুতুল টাকে কারোর সামনে নিবে সে? যদি নজর লাগে? উঁহু, তার মন সায় দেয় না। নেওয়া যাবে না। আব্রাহাম হঠাৎ করে ওর দিকে কিছু টা ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো,

-“ঘুরতে যাবে?”

-“হুঁ?”

মেহরিন না বুঝে অবাক হয়ে শুধায়। আব্রাহাম আবারও বললো,

-“ঘুরতে। যাবে?”

-“আপনি অফিস যাচ্ছেন।”

মেহরিন আস্তে করে বললো। আব্রাহাম কাঁধ উঁচিয়ে বলে উঠলো,

-“রাতে নিয়ে যাবো।”

-“আচ্ছা।”

-“অপেক্ষা করো।”

-“আচ্ছা।”

মেহরিন আবারও এটাই বলে। ছোট ছোট জবাবে আব্রাহাম বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে নেয়। আর বিরক্তিকর স্বরে বলে উঠলো ,

-“তুমি আর কিছু জানো না?”

-“কী জানবো?”

মেহরিন বোকার মতো তাকিয়ে শুধায়। আব্রাহাম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-“উফ। কিছু না। আস্তে আস্তে আমি সব শিখিয়ে দেবো।”

চলে যেতে নিয়ে আবারও দাঁড়িয়ে পরে আব্রাহাম। মেহরিন যা-ও একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতেই যাচ্ছিলো আব্রাহাম এরমধ্যে আবারও ঘুরে ওর ফোলা গালে টুপ করে চুমু দিলো। মেহরিন হকচকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। আব্রাহাম ফিসফিস করে হেঁসে দেয়। আর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মেহরিন চোখ খুলে আব্রাহাম কে না দেখে বুকে হাত দেয়। হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক ধুকপুক করেই যাচ্ছে। সে বিছানায় বসে শ্বাস ফেললো স্বস্তির। তখন দরজা থেকে আব্রাহামের কণ্ঠ আবারও শোনা গেলো,

-“শোনো মেয়ে, শাড়ী পড়ো। তুমি শাড়ী পড়লে তোমাকে আমার আমার লাগে। গুলুমুলু সুন্দরী বউ আমার।”

মেহরিন চমকে ওঠে বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আব্রাহাম মিষ্টি হেঁসে আড়ালে চলে গেলো। মেহরিন তখনও ফ্যালফ্যাল করে দরজার দিকে শূন্যে তাকিয়ে রইলো।

——

বোন আর শাশুড়ির সাথে আড্ডা দিয়ে আব্রাহাম আসার আগেই মেহরিন রুমে ফিরে এলো। আর রুমে ফিরে একটা মেরুন রঙের শিফন শাড়ী। মেহরিন সেটা পরেই রেডি হলো। আর আব্রাহাম রুমে ফিরে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আব্রাহাম এক সময় ফিসফিস করে বলে উঠলো,

-“আজকে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমার মন অন্য কিছু চাচ্ছে মেহুরানী।”

মেহরিন কিছু বুঝলো না। সকালে তো নিজেই বলে গেলো ঘুরতে নিয়ে যাবে। এখন আবার কী হলো? মেহরিন না বুঝে শুধু শাড়ী আঁচল টা হাতে নিয়ে পেঁচাতে লাগলো। আব্রাহাম এবার দরজা বন্ধ করে এগিয়ে আসে ধীরপায়ে। মেহরিন এবার অস্থির হয়। বুকের ভেতর কেমন করছে। এলোমেলো লাগছে সবকিছু। আব্রাহাম ওর থুতনিতে আঙুল ছুঁতে গিয়েও ছুয় না। হাত টা গুটিয়ে নেয় আর ফিসফিস করে আবারও বলে উঠলো,

-“আমি তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেই? তুমি কী হারিয়ে যাবে?”

এবার ও কোনো জবাব দিতে পারলো না মেহরিন। আব্রাহাম ওর নীরবতায় আরও অস্থির হয়ে উঠলো। আর অধৈর্য হয়ে বলতে লাগলো,

-“শোনো মেয়ে, তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে আমি দমন করতে পারছি না। একটু ছুঁয়ে দিলে কী তুমি রাগ করবে?”

-“না।”

মেহরিন ছোট করে অনুমতি দিলো। আব্রাহাম শার্টের বাটনে হাত রাখলো। মেহরিন চমকে উঠলো। বুঝতে অসুবিধা হলো না এই পুরুষ কী চাইছে। সে চোখ দু’টো খিঁচে বন্ধ করে নিলো যখন তার মেরুন রঙের লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁট দু’টো আব্রাহাম নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো।

-“তুমি আমার এক অদ্ভুত নেশা। যা থেকে আমি কখনো মুক্তি পেতে চাই না। বরং আরও তীব্রতায় ঘিরে যাক আমায়।”

মেহরিন অক্সিজেন নিজের ফুসফুসে টেনে নেওয়ার সুযোগ টুকু পেলো না। আব্রাহাম তাকে আবারও আলিঙ্গন করলো। ধীর গভীর। মেহরিন এই বাঁধন কে সনন্দে গ্রহণ করলো। সে কখনো মুক্তি পেতে চায় ও না এই কঠিন বাঁধন হতে।

-“ভালোবাসেন না?”

মেহরিন আব্রাহামের গলা জড়িয়ে ধরে রাখলো। আব্রাহাম তখন মেয়ে টার গলায় লাগাতার চুমু দিচ্ছে। আব্রাহাম সেখানে ছোট করে কামড়ে দেয়। হিমবাহের ন্যায় শীতল কণ্ঠে সে এক সময় বললো,

-“অভ্যাস থাকা ভালো। আর তুমি আমার অভ্যাস। যা কখনো বদলানো যাবে না।”

-“আমি আপনাকে ভালোবাসি। যেদিন প্রথম চেক শার্টে দেখেছিলাম আপনাকে সেদিন থেকে।”

আব্রাহাম বোধহয় চমকে উঠলো। তোতাপাখি তার কথা বলছে। তা-ও অনুভূতি ব্যাক্ত করছে। হায়। আব্রাহাম নিজে কে পাগল পাগল লাগছে। উন্মাদনায় সে প্রায় দিশেহারা বউয়ের ঠোঁটের ভাজে আবারও ঠোঁট চেপে ধরে। আর কিছু সময় পর ছেড়ে দিয়ে বললো,

-“আর জ্বালিয়ো না জান। এখন শুধু আমার পালা।”

মেহরিন আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। আব্রাহাম তাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলো। ঘর জুড়ে তখন নিস্তব্ধতা।

——

দেশে আসার পর ফিজা বেশ কয়েকবার জনের সাথে যোগাযোগ করেছে। তৃণা মেন্টাল সিক। সে এখনো হসপিটাল আর মিস্টার জি মেয়ের অবস্থায় হার্ট-অ্যাটার্ক করেছেন। তিনিও হসপিটাল ভর্তি। হয়তো আর কখনো সুস্থ হবে না। আর এমনিতে সব ঠিকঠাক মানে আবরাজের কোম্পানি বেশ ভালো করছে। ফিজা স্বস্তি পায়। সে-ও এখানে ভালো আছে। আবরাজ আগে যেমন নিজের সব লুকিয়ে একদম ভালো সাজার অভিনয় করতো এখন আর সেটা করতে হয় না। ফিজা চুক্তি করে নিয়েছে আবরাজ যদি কখনো আর কোনো খারাপ কাজ করে তাহলে সে হারিয়ে যাবে একদম নিঃশব্দে। আবরাজ সেদিন পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিল। বউ তার সব পাপ কে নিয়ে তার সাথে থাকবে। এরচেয়ে বেশি পাওয়া তার কাছে কিছু নেই। মা বাবা ভাই সুন্দর একটা পরিবার আর তার ভালোবাসার মানুষ। অর্থসম্পদ সব আছে। এসব করার প্রয়োজন ও হবে না কখনো।

-“আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি পাপি জানা স্বত্বেও আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে আর ধোঁকা দিয়েন না শখের পুরুষ।”

এই শব্দ গুলো আবরাজের বুকে ছুড়ি আঘাতের মতোই ক্ষত-বিক্ষত করেছিলো তেমন ভালো ও লাগছিল তার সব কিছু জেনে তাকে তার সুগন্ধি ফুল নিজের হৃদয়ে রেখে ভালোবাসে। আবরাজ ওয়াশরুম বাথটাবে বসে আছে। রাত করে এভাবে শাওয়ার নেওয়া একদম পছন্দ করে না তার সুগন্ধি ফুল। কিন্তু সারাদিন বাইরে থেকে বাড়ি ফিরে শরীর কেমন অস্বস্তি বোধ করে। আবরাজ অফিস থেকে ফিরে বউ কে লিভিং রুমে পেয়েছে। শাশুড়ী আর বোনের সাথে গল্প করছে। আবরাজ আর পেছনে দেখে নি। তবে সে জানে। সে আসার পরপরই সুড়সুড় করে বউ তার রুমে এসে বসে আছে। আবরাজ গলা উঁচিয়ে মোলায়েম স্বরে ডাকলো কিন্তু বউয়ের সাড়াশব্দ নেই। আবরাজ ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিলো। বউ কী তবে তার পেছন পেছন রুমে আসে নি? আবরাজ আবারও শব্দ পেলো কিছুর। আর এবারের ও সে আগের স্বরেই ডেকে উঠলো,

-“সুগন্ধি ফুল! কোথায় তুমি?”

-“রুমে তো।”

আচমকাই হকচকিয়ে গিয়ে উত্তর দিলো ফিজা। আবরাজ ওর উত্তর পেয়ে স্বস্তি পায়। আর বলে,

-“টাওয়াল দাও।”

-“ওহ সরি। শুনতে পাই নি।”

ফিজা টাওয়াল দিতে গেলেই আবরাজ টাওয়াল সহ ওর হাত ধরে ওয়াশ রুম নিয়ে গেলো। ফিজা তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

-“আপনার জন্য আমরা একটু স্থির হতে পারছি না।”

আবরাজ প্রথমে ঠিক পুরো বাক্য টা খেয়াল করে নি। সে তো বউ কে জ্বালায়। প্রচুর জ্বালায়। খেতে গেলে ঘুমতে গেলো সকালে ফ্রেশ হতে এসে। শাওয়ার নিতে এসে। রুমে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে আর অফিস গিয়ে ল্যাপটপে বসে সারাক্ষণ বউয়ের ওপর নজর রাখা। তবে সে ফিজার বলা কথাগুলো বেশ কয়েকবার আওড়াল। আর কিছু বুঝতে না পেরে শুধায়,

-“আমরা?”

ফিজা কিছু বলে না। আবরাজের চুল শুকিয়ে দিচ্ছে সে মন দিয়ে। আবরাজ ওর হাত ধরে আর কাজে বাঁধা দেয়। ফিজা মাথা নিচু করে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। আবরাজের চোখ জোড়া ছলছল করে। আবরাজ গলা পরিষ্কার করে। বলে,

-“ইউ মিন,,,

কিন্তু তবুও কণ্ঠস্বর ভাঙা শোনায়। সে মাঝপথে থামে। ফিজা আবরাজের গালে হাত ছুঁয়ে দেয় আর মাথা নাড়ে সমানে বেশ কয়েকবার। আর আবরাজ তাকে শক্ত করে নিজের বুকে আগলে নেয়। ফিজার সামন্য কুঁকড়ে ওঠে আর মুখ দিয়ে করুণ শব্দ করে,

-“উম।”

আবরাজ সাথে সাথে নিজের হাতের বাঁধন হালকা করে। ফিজা স্বস্তির নিঃশ্বাস টানে। আবরাজ ওর অবস্থা দেখে ভয় পায়। সে কী খুব জোরে চেপে ধরেছে? পেটে চাপ পরেছে? ব্যাথা পেয়েছে কী পেটে থাকা ছোট্ট প্রাণ? আবরাজ থতমত খেয়ে ফিজা কে ছেড়ে দেয়। ফিজা ভ্রু কুঁচকে তাকায় আবরাজের মুখের দিকে। সে সাথে সাথে অস্থির হয়ে বলতে থাকে,

-“আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি সুগন্ধি ফুল। বেবি কী ব্যাথা পেয়েছে? ইশ ওর কী শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? হসপিটাল নেবো? অ্যাম্বুলেন্স কল করব,,,”

-“আবরাজ! আবরাজ! আপনি প্লিজ শান্ত হোন। আমার কথা শুনুন।”

ফিজা আবরাজ কে থামাতে চায়। শান্ত করতে চায়। আবরাজ এদিকে ওকে কোলে নিয়ে ওয়াশর রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ফোন খুঁজে এদিক-ওদিক। আর আবারও অস্থির কণ্ঠে বলতে থাকে,

-“হ্যাঁ বলো জান। তোমাদের দুজনের কী কষ্ট হচ্ছে?”

-“উফ! চার সপ্তাহের বেবির এ-সব কিচ্ছু হয় না আবরাজ। ওর এখনো হার্ট ও আসে নি। তাহলে শ্বাস নেওয়ার কথা কিভাবে ভাবেন আপনি? হাহ্।”

ফিজা আবরাজের কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়। আবরাজ বোধহয় একটু শুনলো বউয়ের কথা। আর সাথে সাথে বোকাবোকা হেঁসে ফিজার দিকে তাকায়। ফিজা উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে। আবরাজ ওকে বিছানায় বসিয়ে মাথা চুলকে বলে উঠলো,

-“ওহ হ্যাঁ, তাই তো। আমি আ-আমি আসলে একটু বেশি,,,

-“এক্সাইটেড হয়ে সব ভুল গিয়েছেন। ইট’স ওকে। মাঝেমধ্যে এমন হয়।”

আবরাজের অসম্পূর্ণ কথা সম্পূর্ণ করে ফিজা। আবরাজ লাজুক হাসলো। জীবনে প্রথম বোধহয় কোনো পুরুষের এমন লাজুক চেহারা দেখে ফিজার মন দুলিয়ে উঠলো। আবরাজ খান লজ্জা পায় এটা যেনো সূর্যগ্রহনের মতোই বছরে একবার। ফিজা আবরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে এসব ভাব ছিলো আবরাজ তখন চোয়ালে হাত বুলিয়ে মিনমিন করে বললো,

-“আমি আগে আর বাবা হইনি না।”

-“আমিও আগে আর মা হইনি।”

ফিজাও নকল করে আবরাজ কে। আবরাজ এবার খুব জোরে হাসলো। আর ফিজাও সাথে তাল মেলালো। একজন জীবনসঙ্গী একজন মানুষের পুরো জীবন বদলে দিতে পারে। সেটা কখনো বা খারাপ আর হয়তবা ভালো। দুইটার একটা হলে জীবন অসাধারণ যা কল্পনা ও করা যায় না। ভালো হলে ভালো আর খারাপ হলে খারাপ। দুইটাই কল্পনার বাইরে।

~সমাপ্ত

[দীর্ঘ দিন সাথে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা আমার প্রিয় পাঠকবৃন্দ। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#জান্নাত_সুলতানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here