সুগন্ধি ফুল২ (পর্ব ১৩)

0
2

#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_১৩
#জান্নাত_সুলতানা

-“মেহরিন! কোথায় তুই মা? তাড়াতাড়ি আয়।”

আব্রাহাম অপরিচিত নারী কণ্ঠ শুনে সে তীব্র বিরক্ত ঠেলে ইজি চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। হাতে থাকা “দ্য সুইটেস্ট অব্লিভিয়ান” নোবেল টা পাশের গোল চকচকে কাচের টেবিল টায় অবহেলায় রাখলো। বইয়ের অর্ধেক টা টেবিল বাকি অর্ধেক টেবিলের বাইরে। তার আজ কোনো কিছুতেই লাগছে না মন টা। সে ঠোঁট কামড়ে ধরে কণ্ঠস্বরের উৎসাহ খোঁজার জন্য জানালার পাশে গেলো। পর্দা ঠেলে সরিয়ে দেয়। একদম সন্ধ্যা শেষ পুরো আকাশ জুড়ে যখন হালকা হালকা লাল আভা ছড়ায় সাথে আবছা অন্ধকার চারদিকে ঘিরে থাকে। আব্রাহাম খুব ভালো করে দেখলো। একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে সাথে তার মাকে দেখা যাচ্ছে। দারোয়ান গেইট খুলে রেখেছে। আব্রাহাম ভ্রু কুঁচকে নিলো। মহিলা টা কী তার ভাবির মা? হতে পারে। সে টি-শার্ট এর ওপর একটা চেক শার্ট জড়িয়ে নিলো। আর তারপর নিচে নেমে এলো।
সে যতক্ষণে বাইরে এসছে ততক্ষণে দু’জন লিভিং রুমে বসে আছে। একজন মহিলা এবং একটি মেয়ে। সে পেছন থেকে অনুমান করলো তারাই তার ভাবির মা এবং বোন। সে নিজে কে প্রস্তুত করলো। আর তাদের সামনে গেলো। মিলন খান ততক্ষণে ছেলের নাম ধরে ডাকছে। আর বলছেন,

-“আব্রাহাম এদিকে এসো। দেখো তোমার আন্টি। সালাম দাও।”

মোহিতা বেগম মৃদু হাসলেন। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো আব্রাহামের দিকে। সে হাসি হাসি মুখে মোহিতা বেগমের সঙ্গে কথা বললো। তবে পাশের বসা মেয়ে টার দিকে তাকিয়ে তার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো। স্থির হয়ে গেলো কণ্ঠ। গলা দিয়ে কোনো শব্দ সে চেয়ে ও বের করে আনতে পারলো না। বাবা-র পাশে চুপ করে বসলো সে। তাদের মধ্যে কথাবার্তা ঠিকই জমজমাট হয়ে উঠলো এক সময়।
তবে মাথা নিচু করে বসে আছে মেহরিন। সে চুপচাপ স্বভাবের। মানুষের কোলাহল একদম পছন্দ নয়। তাই যখন বোনের দেবর এসছে দেশে আর তাদের খান বাড়িতে আসতে হবে জেনেছে তখনই সে মা’কে নিষেধ করে ছিলো সে আসবে না। কিন্তু মা তাকে জোর করে আত্মীয়তা রক্ষার খাতিরে নিয়ে এসছে। সামনে বিশেষ কয়েক পদের নাশতা দেওয়া থাকলে-ও মেহরিন কিছুই ছুঁয়ে দেখে নি। আব্রাহাম ওর দিকে আঁড়চোখে বারকয়েক তাকায়। মেয়ে টা দেখতে একটু গুলুমুলু। কী সুন্দর একটা বিড়াল ছানার ন্যায় মায়ের পাশে গাপটি মেরে বসে আছে। গায়ে ধূসর রঙের থ্রি-পিস। চুলের বেণী টা কী দারুণ মোটা। আব্রাহাম খুব বেশি সময় বসে থাকতে পারলো না। তার শরীর অস্থির লাগছে। গরমে অসহ্য। সে ওঠে দাঁড়ালো। মা’কে বললো,

-“আম্মু আমি রুমে যাচ্ছি।”

-“আচ্ছা। তবে খাবারের আগে নিচে চলে এসো।”

ইলা বেগম মুখে মৃদু হাসি টেনে বললো। আর মেহরিনের মুখে এক টুকরো আপেল তুলে দিলো। একটা মেয়ের যে কত শখ ছিলো ওনার। তবে সব শখ পূরণ হয় না। এটা তিনি মানে। তাই তো ফিজা, মেহরিন দুই বোন কেই তিনি নিজের মেয়ে বানিয়ে বসে আছে। যদিও ফিজা কে কাছে পায় নি। আর মেহরিন তেমন আসতে চায় খান বাড়িতে। তবে যখনই আসে তিনি ওকে খুব আদর করে। আব্রাহাম মায়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। এতো আদর করার কোনো কারণ নেই। মুখ ভেংচি কেটে যখনই সে ওপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তখনই পেছন থেকে মিলন খান ডেকে উঠলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,

-“আ শোনো আব্রাহাম। মেহরিন কে নিয়ে যাও সাথে, একা বসে থেকে বোরিং হচ্ছে।”

-“হ্যাঁ যা মা।”

ইলা বেগম ও ঠেলে দিলেন যেনো। মেহরিন না চাই তেও দাঁড়িয়ে গেলো। আব্রাহাম চোখ বন্ধ করে তাদের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার রাগ হচ্ছে বাবা-র ওপর। যেই কারণ সে এখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলো বাবা তার সাথে সেটাই বেঁধে দিলো। এখন সে কিভাবে এই আগুন সাথে নিয়ে হাঁটবে? তার যে প্রচুর গরম লাগছে।

——–

পুরো সাতচল্লিশ মিনিট ধরে ফিজা একই যায়গায় একই ভাবে বসে আছে। তার কোমর ব্যাথা করছে। শরীর টা ম্যাজম্যাজ করছে। আবরাজ কী সেটা বুঝতে পারছে না? তার ঘুম পাচ্ছে। এভাবে বসে থাকতে থাকতে ক্ষুধা বেড়েছে। ফিজা আবরাজের শান্ত চোখের দিকে তাকালো। আর পিটপিট করে আহ্লাদী স্বরে বললো,

-“এই শুনুন না, আমার ঘুম পাচ্ছে।”

-“না।”

আবরাজ এক শব্দে তার সিদ্ধান্ত জানায়। ফিজা তেতে উঠে এবার। ঝাঁজালো স্বরে আওড়ায়,

-“কী না? ঘুমাব আমি।”

এরমধ্যেই ওর পেটে গড়গড় শব্দ করে। ও চোরা চোখে তাকায় আবরাজের দিকে। আবরাজ পিটপিট করে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“তুমি সন্ধ্যায় খাবার খাও নি, কেনো?

ফিজা ঠোঁট কামড়ে ধরলো। এখানে এসছে পর সে একদিন ও আবরাজের সাথে ডিনার করতে পারে নি। আর এটাই ওর আফসোস সাথে আরও একটা আছে। সেটা হলো আবরাজ এতোদিনে তাকে নিয়ে একবার বাইরে যায় নি। সে রাতে খাবার খায়। তবে কখনোই সেটা তৃপ্তির হয় না। কেনো জানি আজ ইচ্ছে করেই খায় নি। ওর ভাবনার মাঝেই আবরাজ ওঠে এলো। হাত থেকে ঘড়ি টা খুলে রাখলো। আর শার্টের হাতা ফোল্ড করতে লাগলো। ফিজা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। আবরাজ তার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে গম্ভীর স্বরে বলে গেলো,

-“ওয়েট ফর মি, সুগন্ধি ফুল।”

ফিজা ঠোঁট ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। দম বন্ধ হয়ে বসে ছিলো সে৷ আবরাজ বেরিয়ে যেতেই নিজের উন্মুক্ত বাহু আরেক হাতে ছুঁয়ে দিলো। শরীরের যেনো জ্বলছে এখনো। কী অদ্ভুত মানুষ এভাবে অর্ধ উন্মুক্ত করে বসিয়ে রাখা কোনো মানে নেই। শুধু শুধু ঠান্ডার মধ্যে তাকে কষ্ট দিচ্ছে। যদিও রুমে হিটার চালু আছে। আর তারচেয়ে বড়ো হিটার তো আবরাজ খান। যে আশেপাশে থাকলে ফিজার অস্থির লাগে।

—–

-“কাম, বেবি গার্ল।”

ফিজা চোখ উলটে চাইলো আবরাজের দিকে৷ খাবার খাইয়ে দিয়েছে আবরাজ তাকে। আর এখন এতো সুন্দর করে ডাকছে। ফিজা সোফায় বসে আছে। সে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বললো,

-“আপনি কাল আমাকে বাইরে নিয়ে যাবেন।”

-“এটা নিয়ে কাল কথা হবে। এখন এদিকে এসো, জান।”

আবরাজ গম্ভীর স্বরে বললো। ফিজা মুখের পানি গিলে নিলো। যেনো সাথে ভয় ও গিলে খেয়ে নিচ্ছে। আবরাজ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যা আরও ফিজার অস্থিরতা কারণ। ফিজার এখন অস্বস্তি হচ্ছে না। আবরাজ তার আরও একটা সৌন্দর্য খুঁজে বের করেছে। যা সে নিজেও জানতো না। ফিজা হাত দু’টো সামনে রেখে নখ খুঁটতে খুঁটতে লাগলো। আর এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। আবরাজের এতো ধৈর্য আছে? সে অস্থির কণ্ঠে আবার ডাকলো,

-“ফাস্ট, সুগন্ধি ফুল।”

ফিজা মিটমিট করে হাসলো। তার ভালোই লাগে যখন আবরাজ তাকে অনেক বেশি প্রায়োরিটি দেয়। যত্ন করে। আর যখনই কাছে আসে তখন পুরো উন্মাদ। ফিজার গাল লাজরাঙা হয়ে ওঠে। আবরাজ ওকে হঠাৎ করে হেঁচকা টানে আর নিজের বাহুর ওপর শুইয়ে দেয়। ফিজা চোখ বন্ধ করে নেয়। আবরাজ ওর চোয়ালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে থুতনিতে এসে আঙুল ঠেকায়। আর ফিসফিস করে বলে,

-“তুমি নব্বইয় দশকের কোনো এক জমিদার প্রেমিকার মতো দেখতে লাগছো, সুগন্ধি ফুল।”

-“ওই জমিদার প্রেমিকটা কী জমিদার আবরাজ খান?”

-“অফকোর্স, তোমার জমিদার প্রেমিক আবরাজ খান।”

ফিজার কুঁচকানো ভ্রু জোড়া টানটান হয়ে আসে। আবরাজের কথা শুনে হঠাৎ করে মেয়ে টা জোরে জোরে হাসতে লাগলো৷ আবরাজ বউয়ের প্রাণখোলা হাসির দিকে কিছু সময় মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। ফিজার চোখের কোলে জল জমেছে। সে তবুও হাসছে। মনে হচ্ছে বিশ্বের সেরা জোক্স টা আবরাজ তার সাথে করেছে। আবরাজ বউয়ের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দিলো। যা দেখে ফিজার গলা আবার শুঁকিয়ে আসে। আবরাজ ফিজার চোয়াল আঙুল ছুঁয়ে ধীরে ধীরে স্লাইড করে। ফিজা ক্ষণেক্ষণে কেঁপে ওঠে। ফিসফিস করে অনুরোধ স্বরে বললো,

-“এমন করবেন না প্লিজ। আমার অস্থির লাগে।”

-“ফর মি।”

ফিজা দুইদিকে অনবরত মাথা নাড়ে। আবরাজ বাঁকা হেঁসে বলে,

-“ডোন্ট বি লায়িং, সুগন্ধি ফুল।”

আবরাজ খুব সন্তপর্ণে বউয়ের গলায় মুখ গুঁজে দেয়। ফিসফিস করে আওড়ায়,

-“তোমার স্মেল! এটা আমায় তুমি ছাড়া সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। ওয়াইনেও এতো নেশা হয় না। যতোটা তোমার শরীরের সুগন্ধি থেকে হয়, সুগন্ধি ফুল।”

ফিজা আবরাজের পিঠের দিকে শার্ট টা শক্ত করে হাতের মুঠো পুরো নেয়। আবরাজ শব্দ করে চুমু দেয় ফিজার ঘাড়ে। আর হেঁসে উঠে উচ্চস্বরে। সে জানে এই মেয়ের ছোট ছোট আঙুলের ডগায় থাকা গোলাপি নখ তার হাল খুব শীগ্রই বেহাল করে দিবে।
আর সে টি-শার্ট উলটো করে মাথার ওপর দিয়ে খুলে নিতেই ফিজা চোখ বন্ধ করে নেয়। পেশিগুলো ক্রমে ভেসে উঠছে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়ে। দীর্ঘ দিন ওয়াকআউট এমন সুন্দর ফিটনেস দিতে পারে। ফিজা ঢোক গিলে। গলা শুঁকিয়ে আছে, পানির অভাব বোধ করে। অথচ সে একটু আগেই অনেকটা পানি খেয়েছে। আবরাজ ওর হাত দু’টো বিছানায় চেপে ধরে হাতের দিকে ইশারা করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস টেনে বলে,

-“এগুলো কাল সকালে সাইজ করবো জান। জানো তো, ক্ষত স্থানে পানি লাগলে খুব জ্বলে।”

ফিজা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে দুই দিকে মাথা নেড়ে বলে,

-“প্লিজ না।”

-“ইয়েস।”

মাথা দুলিয়ে আবরাজ বাঁকা হেঁসে লাইট অফ করে। ফিজা একটু স্বস্তি পায়। একটা নির্লজ্জ পুরুষ। যার মুখে কিচ্ছু আঁটকায় না। আর অদ্ভুত হলে-ও সত্যি সে এই মানুষ টাকে ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলেছে। যার সাথে সে এখন ছোট একটা সংসারের স্বপ্ন দেখে।

#চলবে……

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here