#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_৬
#জান্নাত_সুলতানা
-“শাড়ী পরে যাবে?”
আবরাজ দৃষ্টি এদিক-ওদিক ঘুরালো। রাগ না-কি অন্য কোনো কারণ ফিজা বুঝতে পারে না। ফিজা শাড়ির আঁচল টা তাই ভাজ করে হাতের ওপর রাখতে রাখতে বলে উঠলো,
-“হ্যাঁ। কেনো?”
মাথা নিচু করে রেখে ছিলো ফিজা। তবে হঠাৎ করে নিজের সম্মুখে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে একটু চমকে উঠলো। দৃষ্টি তুলে সামনে তাকাতেই আবরাজ খানের মাদকাসক্ত দৃষ্টি জোড়ার সাথে নিজের দৃষ্টির মেলবন্ধন ঘটলো। আবরাজ ওর গলা টা আচমকাই চেপে ধরে ঠিক নিজের দিকে টেনে আনলো। ব্যাথা পায় মেয়ে টা। অথচ আবরাজ সে-সব তোয়াক্কা করে না। সে শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
-“শাড়ী বাদ দিয়ে যা ইচ্ছে পরো সুইটহার্ট। নিজের ভালো চাইলে।”
ফিজা চোখ বন্ধ করে বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ফেললো। এভাবে আক্রমণ যখন-তখন তার দম আঁটকে না কোনো দিন এই পুরুষ তাকে মেরে ফেলে। ফিজা আবরাজ এর হাত ছাড়িয়ে নিলো। কিসের ইঙ্গিত যে দিচ্ছে সেটা খুব ভালো করে ফিজার এতোদিনে বোঝা হয়ে গিয়েছে। তাই কথা না বাড়িয়ে আবারও ওপরে গেলো। ক্লোজেট থেকে একটা ওভার কোট এর সেট নিয়ে পড়ে এলো। গলায় মাফলার টা পেঁচিয়ে তবেই নিচে এলো। আবরাজ এপর্যায়ে এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকালো। মেয়ে টা বেশি সুদর্শনা? হ্যাঁ, এক কথায় অতিরিক্ত সৌন্দর্যের অধিকারিণী। লম্বা হাঁটু সমান সিল্কি চুল। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। টানাটানি ভ্রু জোড়ার নিচে দীর্ঘ কালো আঁখি। সরু ছোট নাক আর চিকন পাতলা অধর। গোলগাল মুখ খানা বড্ড মায়াবী। সৌন্দর্যের কোনো কমতি সৃষ্টিকর্তা রাখে নি এই রমণী কে তৈরী করতে। যার প্রমাণস্বরূপ রমণীর এই সৌন্দর্য। আবরাজের হঠাৎ করে মস্তিষ্ক সচেতন হলো। তারই মতো কেউ এই রূপের বর্ণনা আগে করেছে? কথা টা ভেবে চোয়াল টা চেপে এলো। নিশ্চয়ই করেছে। অসহ্য লাগলো তার। বিরক্ত হয়ে সে আগে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। ফিজার তেমন ভাবান্তর হলো না। সে নিজের মতো হেঁটে বাইরে এলো। দামী দামী পাঁচ টারও বেশি গাড়ি রয়েছে গ্যারেজে। আর বাকিগুলো গার্ডেনে রাস্তা টায় এমনিতেই পার্ক করা আছে। ফিজা অবাক না হয়ে পারে না। একটা মানুষের এতোগুলা গাড়ি। আর সে বলছে বউ নিয়ে থাকার জন্য বাড়ি টা নিজের বাবা-র থেকে গিফট পেয়েছে! এটা আদৌও কতটুকু সত্য? ফিজা বিস্ময় চেপে যখন আবরাজের সাথে গাড়িতে বসলো। তখন সকালে এয়ারপোর্টে যেভাবে বাকি গাড়ি গুলো লাইন ধরে আসছিলো ঠিক সেভাবে আবারও এখনো আসছে। ফিজা আবরাজ কে এপর্যায়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-“গাড়ি গুলো আমাদের ফলো কেনো করে আবরাজ?”
আবরাজ জবাব দিলো না। সে নিজের মতো কার ড্রাইভিং করতে ব্যাস্ত। ফিজা আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলো না। তবে তার অনুমান শক্তি জানান দিচ্ছে আবরাজ খান নামক পুরুষ টা সাধারণ হতেই পারে না।
——
ফ্রেইবুর্গ শহরের একেবারে শহরতলির দিকে, সবুজে মোড়ানো এক পাহাড়ঘেঁষা জায়গায় অবস্থিত “ডি আর্তে হাউস” শহরের সবচেয়ে অভিজাত এবং নিরিবিলি পার্টি ভেন্যুগুলোর মধ্যে একটি। পুরো হলটা আধুনিক জার্মান স্থাপত্য আর ঐতিহ্যবাহী ইউরোপীয় ডিজাইনের মিশেলে বানানো। বাইরের দিকটা পুরোটা কাঁচঘেরা, যার ভেতর দিয়ে দেখা যায় চারপাশের ব্ল্যাক ফরেস্টের ঘন সবুজ গাছপালা। দূরের সাদা সাদা কাঠের বাড়িগুলোর সারি আর সূর্যের আলো পড়ে থাকা নুড়িপথ।
হলঘরের ছাদ অনেক উঁচু। কাঠের বিম দিয়ে তৈরি। মাঝখানে ঝুলছে বড় এক ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি। যার আলোর প্রতিচ্ছবি পড়ে চকচকে কাঠের ফ্লোরে। দেয়ালে আধুনিক আর্টের বিশাল পেইন্টিং। আর কর্নারে কর্নারে সাদা-সোনালি রঙের ফুল দিয়ে সাজানো ফুলদানি। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে হালকা জ্যাজ মিউজিক।
হলের এক পাশে রয়েছে গ্লাসের দরজায় ঘেরা একটা বড়ো টেরেস, যেখান থেকে দেখা যায় পুরো ফ্রেইবুর্গ শহরের আলো-আঁধারি দৃশ্য।
ভেতরে সারি সারি গোল টেবিল। প্রত্যেকটিতে সাদা রেশমি টেবিলক্লথ। মাঝে মোমবাতি আর লিলি ফুলের গুচ্ছ। সাইডে একটা মিনি স্টেজ। যেখানে জ্যাজ ব্যান্ড পারফর্ম করছে। আরেক পাশে রয়েছে একদম নিখুঁতভাবে সাজানো বুফে টেবিল। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক খাবারে পরিপূর্ণ। ফিজা এতো সব বিস্ময় নিয়ে দেখলো চারপাশ। আবরাজের বাহু আঁকড়ে ধরে হাঁটছে ও। আবরাজ নিজেও আগলে রেখেছে বউ কে। অপরিচিত সব মুখ ফিজার অস্বস্তি হচ্ছে। আর সেই অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়ে একটা মেয়ে এসে একপাশ থেকে আবরাজ কে জড়িয়ে ধরলো। আবরাজের মুখের ভাবভঙ্গি জুড়ে তখন রাজ্যের বিরক্তি। সেই বিরক্তিকর মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়ে টা কিছু টা অপ্রস্তুত হয়েছে বোধহয়। তাই তো আবরাজ কে ছেড়ে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে যায় আবার। আবরাজ ধুলো ঝাড়বার মতো করেই নিজের ব্লেজার টা ঝেড়ে নিলো।
-“আবরাজ তুমি আমাকে এভাবে অপমান করতে পারো না।”
-“আবরাজ খান স্বয়ং নিজের স্ত্রী কে সাক্ষী রেখে, তোমাকে অপমান করলো। তুমি কী করবো করো। নাউ জাস্ট গেট লস্ট।”
অপমানে মেয়ে টার মুখ থমথমে হয়ে এলো। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। ফিজার দিকে একবার ক্রোধিত চোখে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। ফিজার বোধগম্য হলো না গোটা বিষয় টা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন ছেলে এসে উপস্থিত হলো সেখানে। দেখতে সুদর্শন। মুখে চাপদাড়ির রেখা। ট্রিম করা দাড়ি। দেখতে সুদর্শন তবে ঠোঁটের হাসি টা বিশ্রী লাগলো ফিজার। সে নিজে কে আড়াল করলো। আবরাজ বউ কে আরও গভীর করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। তখনই সামনের যুবক বলে উঠলো,
-“ফাইনালি বিয়ে টা করেই নিলে!”
আবরাজ জবাব দিলো না। শুধু তাকিয়ে আছে সামনের যুবকের দিকে। আবরাজের থেকে জবাবের অপেক্ষা না করে আবারও বলে উঠলো,
-“ভাবি কিন্তু দেখতে চমৎকার।”
একপর্যায়ে এসে আবরাজ চোয়াল টা দৃঢ় করে হাসলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
-“অন্যের জিনিসের প্রতি নজর এখনো ঠিক করতে পারো নি। এরকম হলে ভবিষ্যতে প্রস্তাবে।”
আবরাজ হাসলো একটু। ফিজা বুঝতে পারে না এভাবে কথা বলছে কেনো তারা দু’জন। তবে সামনের যুবকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ঘাটতি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ তৈরী হচ্ছে।
আবরাজ ফিজা কে নিয়ে আরও অনেকের সাথে পরিচিত হলো। প্রথমজনের নাম জানার জন্য তেমন আগ্রহ নেই ওর। তবুও আবরাজ শুধু নাম টাই জানালো। নাম শুনে ফিজার কেমন লাগলো। জুনায়েদ কবির। নাম টা যেমন হোক। মানুষ টা ঠিক তার বিপরীতে।
——–
রাত সাড়ে এগারো টা বাজে যখন ওরা বাড়ি ফিরলো পুরো বাড়ি তখন অন্ধকার। ফিজা অন্ধকার হাতিয়ে আবরাজের বাহু আঁকড়ে ধরলো। ভীতু স্বরে বললো,
-“আবরাজ আমার ভয় লাগছে।”
-“ভয় নেই সুগন্ধি ফুল।”
বলতে বলতে আচমকাই আবরাজ ওকে কোলে তুলে নিলো। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে নিজের রুমে এসে দরজায় নামিয়ে রাখলো ফিজা কে। ফিজা অবাক হয়। সন্ধ্যায় দেখে যাওয়া রুম আর এখন রুমের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। ঘরটা যেনো কোনো রাজকন্যার স্বপ্নের মতো সাজানো। ছিমছাম, আধুনিক ছোঁয়ায় তৈরি এই ঘরের প্রতিটি কোণ জুড়ে ছড়িয়ে আছে নান্দনিকতা আর মুগ্ধতা। সাদা রঙের দেয়ালে মোলায়েম লাইটিং পড়ে যেনোএক রূপকথার আবহ তৈরি করেছে।
ঘরের মাঝখানে রাখা বিশাল কিং-সাইজ বেড টার যার চারদিকে ঝুলছে সেমি-ট্রান্সপারেন্ট নেটের পর্দা। বেডের উপর বিছানো আছে হালকা স্যাটিনের শিট। যার রঙ নরম ল্যাভেন্ডার। বালিশের উপর ছড়ানো লাল সাদা গোলাপের পাঁপড়ি। আর বেডের মাথার ওপরে ছোট ছোট ফেইরি লাইট। যেনো জোনাকিরা একত্র হয়ে আলো দিচ্ছে।
ঘরের এক কোণে রাখা মার্বেল টপের ড্রেসিং টেবিল টা, যার পাশে রাখা গোলাপজল ও পারফিউম। দেওয়ালে ঝুলছে একজোড়া সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো দুজনার নামের আদ্যাক্ষর, A & F, সোজাসুজি একটা হৃদয়ের মাঝে লেখা।
বিশাল কাঁচের দেয়ালের ওপাশের ব্যালকনি টার দরজা খোলা। হালকা ঠান্ডা হাওয়া পর্দা নাচিয়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে এক অনুপম প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যালকনির পাশে রাখা ছোট্ট এক কাঠের টেবিলে দুটো গ্লাস। পাশে রাখা এক বোতল শ্যাম্পেন। টেবিলের উপর একটি ক্যান্ডেল ঝাড় জ্বলছে ধীরে ধীরে।
ঘরে কোথাও কোনো অতিরিক্ত জিনিস নেই। কিন্তু প্রতিটি জিনিসই পরিপাটি। প্রেমে ভরা, এবং নান্দনিকতার ছোঁয়ায় সাজানো। চোখ জুড়িয়ে দিতে এমন সুন্দর একটা পরিবেশ যার সাথে জুড়ে আছে এমন সুন্দর পরিপাটি ঘর। ফিজা কয়েক মূহুর্তের জন্য হয়তো ভুলেই গিয়েছিল নিজের স্থান। তবে আবরাজের কথায় বাস্তবতা মনে পড়লো। আবরাজ ওর চুল গুলো ধীরে কাঁধ থেকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে নাকমুখ ঘষে দিয়ে বললো,
-“আই নিড ইউ সুগন্ধি ফুল। প্লিজ ডোন্ট স্টপ মি।”
কী বলবে ফিজা! মানুষ টা যেনো কথা দিয়ে তার মুখে এক অদৃশ্য তালা মেরে দিয়ে চাবি টা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। শরীর টা কাঁপছে, হৃদপিণ্ডটা অস্বাভাবিক ভাবে খুব লাফঝাঁপ করছে। শুধু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারিত হলো না। গলা টা মনে হচ্ছে কেউ চেপে ধরে বলছে, “যা বলছে মেনে নে।”
#চলবে…..
[আগামী পর্বে অধৈর্য পুরুষ আবরাজ খান কে দেখতে পারবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]