#গাংচিল
#২য়_পর্ব
বসার ঘরে যেতেই ইফতেকার সাহেবের ভারী কন্ঠ কানে আসে মৌপ্রিয়ার। তিনি হো হো করে হাসছেন। তার ঠিক অপরপাশেই হলদে বাদামী রঙ্গের পাঞ্জাবী পরিহিত এক যুবক বসে রয়েছে। শ্যমলা বর্ণের খানিকটা ধারালো মুখশ্রী তার, নাকটা একটু খাড়া, চোখের পাঁপড়ী গুলো বেশ লম্বা লম্বা, খোঁচা কোঁচা দাঁড়ি, বেশ অনিয়ন্ত্রিত ভাবে তার গালকে ঘিরে রেখেছে। চোখে কালো রঙ্গের প্লাস্টিকের ফ্রেম। লোকটির কাধে একটি চটের ব্যাগ। এই লোককে ঠিক কোথা থেকে তুলে এনেছেন ইফতেকার সাহেব সেই প্রশ্নের উত্তর শুধু তিনি ই জানেন। মৌপ্রিয়া শান্ত গলায় বললো,
“বাবা ডেকেছিলে?”
“আরে এসেছিস মা, ও হচ্ছে সীমান্ত। আজ থেকে তোর লেখালিখির শিক্ষক যাকে বলে গুরু। সালাম দে।“
ইফতেকার সাহেবের কন্ঠ বেশ উৎফুল্ল লাগছে। হয়তো নিজের কার্যে তার বেশ গর্ববোধ হচ্ছে। মৌপ্রিয়ার ইচ্ছে করছিলো বলতে,
“গুরু গুরু করে একটা গরুকে তুলে এনেছো বাবা।“
কিন্তু কথাটা বলা হলো না, নিজের মাঝেই চাপিয়ে রাখতে হলো। বাবার উৎসাহিত ঝলমলে মুখখানাকে আষাঢ়ের কালো আকাশের ন্যায় করার ইচ্ছে তার ছিলো না। প্রতিটা মানুষের ভেতর একটি সুপ্ত পাগল লুকায়িত থাকে। যখন তার হৃদয় সকল সংযম হারিয়ে ফেলে তখন সেই সুপ্ত পাগলটি লুকায়িত প্রকোষ্ঠ্য থেকে তেড়ে বেড়িয়ে আসে। তার জীবন্ত উদাহরণ ইফতেকার সাহেব। সমাজের সামনে তিনি একজন সম্মানীয় ব্যাক্তি, শিক্ষক। কিন্তু মৌপ্রিয়ার কাছে তিনি একজন পাগল, তা যদি নাই হতো কোন বাবা তার মেয়ের জন্য লিখালিখির শিক্ষক আনতে পারে? লিখালিখির শিক্ষক হয় না কি? উনি কি শিখাবেন? শব্দ গঠন নাকি বাক্যগঠন? কিভাবে শিখাবেন? ‘রাসেল ভাই আমার ঠোঁট চেপে ধরলেন’ বাক্য টি ঠিক নয়, হবে ‘রাসেল ভাই আমার উষ্ঠজোড়া নিজের মাঝে ধাবন করলেন’। এটা কি সার্কাস হচ্ছে? মৌপ্রিইয়া কপালের বা পাশের শিরাটি লাফাচ্ছে। কিন্তু সে নিজের সংযম হারালো না। সে বাঙ্গালী নারী, যত যাই হয়ে যাক তার সংযম হারানো সমাজ মোটেই মেনে নিবে না। থু থু করবে। বাবার শিক্ষার উপর আঙ্গুল তুলবে। মৌপ্রিয়া ধীর স্বরে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুম সালাম”
সীমান্ত নামক ব্যাক্তিটি মিহি কন্ঠে সালামের উত্তর দিলো। মৌপ্রিয়া পুনরায় লোকটির আপাদমস্তক চোখ বুলালো, লোকটিকে দেখে নব্বই এর নাটকের লেখক চরিত্রগুলোর মতো লাগছে। যদি স্পেসিফিকভাবে বর্ণনা করতে হয় তবে সে হুমায়ুন স্যারের ‘কবি’ উপন্যাসের আতাহারের জীবন্ত রুপ। যতবার মৌপ্রিয়া উপন্যাসটি পড়ে তার চোখের সামনে এমন একটা চিত্রই ভাসে। যার চোখজোড়ায় থাকবে হাজারো আকাঙ্খা, ব্যার্থতার বেদনা, সমাজের স্বাভাবিক জীবনসজ্জার প্রতি উদাসীনতা। কিন্তু লোকটা আর যাই হোক আতাহার নয়, বরং একটা ঠক, মিথ্যুক এবং অত্যন্ত ধূর্ত একজন ব্যাক্তি। গোলাপী আভার ঠোঁটের কোনায় যে হাসি রয়েছে তা মেকি, সম্পূর্ণ মেকি।
মৌপ্রিয়া ইফতেকার সাহেবের পাশে গিয়ে বসলো। ইফতেকার সাহেব গদগদ গলায় বলতে লাগলেন,
“আমি বিগত তিন মাস ধরে এমন একটা জেন্টালম্যান খুজছিলাম। যে তোমাকে লেখিকা হিসেবে গুড়ে তুলবে। আমরা যেমন শিক্ষার্থীদের ইতিহাস শেখাই, সীমান্ত সেভাবে তোমাকে লিখালিখি শিখাবে।“
“তা এই জেন্টালম্যানের খোঁজ তোমাকে কে দিলো?”
সীমান্তের দিকে সূচালো দৃষ্টি প্রয়োগ করে মৌপ্রিয়া প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। ইফতেকার সাহেব আরও উৎসাহিত গলায় বললেন,
“আমাদের কলেজের নতুন শিক্ষক। বাংলা পড়াবে। ওর ইহজীবনে মোট ১২৬ জন লেখকের বই পড়েছে। এটা কোনো এক্স ফ্যাক্টর নয়। আমি জানি এতে তুই অবাক হবি না। তোকে চমকে দেবার কথাটা এখন বললো, ও নিজেও লেখক। গত তিন বছর যাবৎ ওর বই বই মেলায় প্রকাশ পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ব্যাক টু ব্যাক হিট। মানে পাঠকেরাই বই কিনছে। নট লাইক আস। তাই ওর থেকে পারফেক্ট টিচার কেউ হতেই পারে না।“
“স্যার, আপনি অহেতুক আমার প্রশংসা করছেন।“
বেশ লাজুক স্বরে সীমান্ত নামক মানুষটি বলে উঠলো। মৌপ্রিয়ার দৃষ্টি একেবারে শান্ত। তার মুখে কোনো বিষ্ময় নেই। ইফতেকার সাহেব থামলেন না। তিনি সীমান্তের প্রশংসার পুল বাঁধতে লাগলেন। সীমান্ত লাজুক স্বরে তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। মৌপ্রিয়ার মাথা ব্যাথা করছে। বিগত তিনদিন যাবৎ তার চলমান পান্ডুলিপির একটা জায়গায় ই আটকে আছে তাই। সামনে আগাতে পারছে না। অন্য সিনে ও মনোনিয়োগ করতে পারছে না। শব্দের মেলায় হারিয়ে গেছে সে। ভেবেছিলো একটু জিরিয়ে নেবে, হলো কোথায়। তার বাবার নতুন নতুন সার্কাস তাকে জিরানোর সময়টুকু ও দেয় না। তবে বাবার উপর রাগ করতে পারে না সে, কারণ খুব ভালোবাসে এই মানুষটাকে। গোবেচারা, বলদ মানুষটি তার জীবনের একমাত্র সঙ্গী। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো মৌপ্রিয়ার। উঁঠে দাঁড়ালো সে। ধীর স্বরে বললো,
“আমি আমার রুমে যাচ্ছি, তোমার এই মাস্টার কখন থেকে পড়াবেন?”
“শুভস্য শীঘ্রম। আজ থেকেই শুরু করে দাও।“
“বেশ, আসুন আমার সাথে।“
সীমান্তের উত্তরের অপেক্ষা করলো না মৌপ্রিয়া। হন হন করে হাঁটা শুরু করলো সে। মনে মনে ফন্দি আটলো, দুদিন থাকুন। আসবে বসবে, চা খাবে, নাস্তা খাবে। তারপর তৃতীয় দিন তাকে বলবে,
“গেট আউট। ইউ আর গুড ফর নাথিং।“
ব্যাপারটা ভেবেই ঠোঁটের কোনায় তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো মৌপ্রিয়ার।
মিনিট বিশেক কেঁটে গেছে। নীলু চা দিয়ে গেছে। সীমান্ত আরাম করে চা খাচ্ছে। তার জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠিক উলটোপাশে বসে আছে মৌপ্রিয়া। মৌপ্রিয়ার লেখার টেবিলটা তার জানালার কাছে। এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যেনো সে প্রকৃতিকে দেখতে দেখতে লিখতে পারে। প্রকৃতি লেখকের সবথেকে বড় উপকরণ। প্রকৃতির বর্ননা ব্যাতীত কোনো লেখাই লেখা মনে হয় না। যেকোনো রোমান্টিক সিন ঘটবে বৃষ্টিতে, যেকোনো হৃদয়বিদারক সিন ঘটবে ডুবন্ত সূর্যের সামনে। ব্যাপারগুলো যেনো চিরন্তন প্রথা। সেই কারণে এই সেট আপ। সীমান্ত শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। তার চোখের পাপড়ি গুলো এখন আরো বেশি লম্বা লাগছে, কোথায় তো পড়েছিলো মৌপ্রিয়া,
“তার দীর্ঘ আঁখি পল্লব সব সময় চোখে ছায়া ফেলে রাখে”
কোন বই এ পড়েছিলো, নাহ মনে পড়ছে না। মৌপ্রিয়া যখন গভীর সাগরে কিছু খুজতে ব্যাস্ত তখন সীমান্ত বলে উঠলো,
“তুমি বই লেখো?”
লোকটির কন্ঠ অতিমাত্রায় শ্রুতিমধুর। যেনো কন্ঠে চিনির শিরা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মৌপ্রিয়ার তার কথা শুনে ভ্রু কুচকে গেলো। অচেনা মানুষের মুখে তুমি টা মোটেই কাম্য নয় তার। লোকটা অবলীলায় তাকে তুমি বলে সম্মোধন করছে। সে কি কোনো কচি খুকি? সে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে। আপনি সম্মোধনটা তার প্রাপ্য। কই সে তো বলে নি,
“তুই একটা মিথ্যুক। মিথ্যে বলে ঘরে ঢুকেছিস।“
কিন্তু মৌপ্রিয়া তো তা করছে না। মৌপ্রিয়া হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠলো,
“অপরিচিত মানুষের মুখে ‘তুমি’ শুনলে আমার গা গুলোয়”
“কিন্তু আমি তোমাকে তুমি বলেই ডাকবো।“
মৌপ্রিয়া অবাক হলো। কত সহজে কথাটা বললো সীমান্ত। তার কন্ঠে নেই কোনো জড়তা, নেই কোনো অস্বস্তি। বরং ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত করে বললো,
“তোমাকে ‘তুমি’ বলার প্রধান কারণ তুমি আমার ছাত্রী। ছাত্রীকে ‘আপনি’ বলা যায় না। ‘তুমি’ বলতে হয়। যদি ছাত্র হতে বলতাম ‘তুই’। আসলে লিঙ্গ পরিবর্তনে সম্মোধনটা পরিবর্তিত হয়। এছাড়া তুমি আমার বয়সে ছোট। তাই ‘তুমি’ বলাটা অযৌক্তিক কিন্তু না।“
মৌপ্রিয়া ভ্রু কুচকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো সীমান্তের দিকে। লোকটাকে শুধু বিরক্তিকর বলা চলবে না, সে অসহ্যময় বিরক্তিকর নির্লজ্জ। সে দাঁতে দাঁত পিসে বললো,
“আমি আপনাকে নিজের শিক্ষক হিসেবে মানি না।“
“কিছুই করার নেই, আমি তোমার শিক্ষক হয়ে গেছি। তোমার বাবা আমাকে নিয়োগ করে।“
“মিথ্যুকের মুখে শিক্ষক শব্দটা মানায় না। আমার বোকা বাবাটাকে পেয়ে একের পর এক ঢপ মেরেছে, ভেবেছেন আমিও তার মতো বোকা? বলুন আপনি মিথ্যে বলেন নি?”
মৌপ্রিয়া ভেবেছিলো তার ঝাঁঝালো কন্ঠে লোকটা ভড়কে যাবে। ভয়ে আকুতি মিনতি করবে। কিন্তু সীমান্ত তাকেই চমকে দিয়ে হেসে উঠলো। হাসি মুখে বললো,
“তুমি খুব বুদ্ধিমান মেয়ে। তুমি সঠিক ধরেছো। যাকে বলে দশে দশ। আমি লেখক টেখক নই। তোমাকে শিখাবার মতো কোনো গুন আমার নেই। আমি তোমার বাবাকে মিথ্যে কথা বলেছি। আসলে উনি বলেছিলেন, আমাকে দশহাজার টাকা দিবেন তোমার শিক্ষক হিসেবে। টাকাটার বড্ড প্রয়োজন ছিলো আমার। তাই আমি মিথ্যে বলেছি।“
“টাকার জন্য আপনি এতো বড় মিথ্যে বলেছেন?”
“ওই যে বললাম, টাকার খুব প্রয়োজন আমার।“
“আমি এখনি বাবাকে সব সত্যি বলে দিবো। তারপর দেখবো আপনি আস্ত কিভাবে থাকেন!”
“লাভ নেই, উনি তোমার কথা বিশ্বাস করবেন না। আসলে মানুষ শ্রবণ থেকে দৃষ্টিকে বেশি বিশ্বাস করে। এই যে বই টা দেখছো এটায় আমার নাম আছে। উনি এটা দেখেই আমাকে বিশ্বাস করেছেন।“
মৌপ্রিয়ার চোখ জ্বলজ্বল করছে। রাগে শরীর কাঁপছে। মিথ্যে কথা একেবারেই সহ্য হয় না তার। তার কাছে মনে হয় মিথ্যে বলা খুন করা থেকেও অধিক অপরাধের। খুন করলে তো একটা মানুষের প্রাণ চলে যায়, কিন্তু মিথ্যে মানুষের বিশ্বাসকে চুরমার করে দেয়। একবার বিশ্বাস ভেঙ্গে গেলে তা জোড়া লাগে না, তখন সেই মানুষটি বেঁচে থেকেও মৃতপ্রায় হয়ে যায়। তার জীবনের কোনো মর্ম থাকে না। মৌপ্রিয়া তীব্র কন্ঠে বললো,
“আমি জানতাম আপনি কোনো লেখক নন। একজন মিথ্যাবাদী কখনো লেখক হতে পারে না। আপনি একজন মিথ্যাবাদী, প্রতারক।“
“তুমি রেগে যাচ্ছো কেনো মৌপ্রিয়া? অবশ্য রাগলে তোমাকে ভয়ংকর লাগার বদলে আরোও মায়াবতী লাগে। এ মায়ায় তো যে কেউ নিজেকে সমর্পণ করতে চাইবে”
সীমান্তের হাস্যজ্জ্বল মুখে এমন কথা শুনে বেকুব বলে গেলো মৌপ্রিয়া। এ কি পাগল নাকি? কোনো কথাই যেনো লোকটির গায়ে লাগছে না। উলটো তাকে জিজ্ঞেস করছে ““তুমি রেগে যাচ্ছো কেনো মৌপ্রিয়া?” রাগবে না তো কি তাকে তুলোধনা করবে? মৌপ্রিয়ার সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। গলার স্বর নামিয়ে দাঁতে দাঁত পিসে বললো,
“মশকরা করছেন?”
এবার কিঞ্চিত চিন্তিত হয়ে গেলো সীমান্ত। তার হাস্যজ্জ্বল মুখখানা মিয়ে গেলো। গাঢ় ভ্রুযুগল কুচকে আসলো। কপালে পড়লো ভাঁজ। থুতনিতে হাত দিয়ে কিছু সময় কিছু একটা ভাবলো সে। এর পর গম্ভীর মুখে বলল,
“সকল লেখকেরা ভুল……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি