সুগন্ধি ফুল২ (পর্ব ১)

0
4

ফিজা যে কোম্পানিতে জব করে সেই কোম্পানির মালিকের বড়ো ছেলে আবরাজ খান কে স্বয়ং নিজের পাত্র রূপে দেখে ফিজা আশ্চর্য হলো। পারিবারিক ভাবে বিয়ের কথাবার্তা এগিয়েছে তাদের। তবে সে পাত্র কে আগে দেখে নি। শুনে ছিলো পাত্র দেশে নেই। আর আজই সে প্রথম স্বচক্ষে পাত্র কে দেখলো। দেখাদেখি শেষ হতেই ফিজা নিজের রুমে ফিরে এলো। দীর্ঘ নয় বছর পর আবরাজ খান নিজের জন্মভূমিতে ফিরেছে আজ। ফিজা জানতো আজ আবরাজ খান দেশে আসবে। কিন্তু তার পাত্র হয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হবে, এটা তার কল্পনার বাইরে ছিলো। শুনেছে যখন আবরাজ পড়াশোনার জন্য জার্মানি গিয়ে ছিলো তখন বয়স তার আঠারো শেষ হয়ে উনিশ। আর এখন যুবকের বয়স আটাশ। দেখতে অত্যাধিক পরিমাণের সুদর্শন এই যুবকের নাম শুনলেও ফিজার ভ্রু কুঁচকে আসে। সেখানে এই পুরুষের সঙ্গে সারা জীবন থাকতে হবে? এই ছিলো ভাগ্যে? অজানা কারণেই ফিজার এই যুবক কে পছন্দ নয়। যদিও মানুষ টা কে সে সামনা-সামনি দেখে নি কখনো। ছবিতে দেখেছে। আজ প্রথম দেখলো স্বচক্ষে। তবে খান কোম্পানিতে ফিজা গত বছর নিজের মায়ের পদে জয়েন করেছে। আগে ফিজার মা সেই কোম্পানিতে জব করতো। মায়ের দীর্ঘ দিন খান ফ্যামিলির সাথে চলাচল সাথে নিজে কোম্পানি জয়েন করা সেই থেকে তার বিতৃষ্ণা লেগে গিয়েছে আবরাজ নামক যুবকের ওপর। অফিসে যতগুলো মেয়ে এমপ্লয়ি রয়েছে এরমধ্যে বিবাহিত মহিলারা বাদে প্রায় সব অবিবাহিত মেয়েদের মুখে মুখে আবরাজ খান। সৌন্দর্যের প্রসংশা থেকে শুরু করে এই যুবকের পারসোনালিটি যা যাবতীয় সব নিয়ে প্রতিদিন রিসার্চ হয় অফিসে এই ডেস্কে ওই ডেস্কে। যার জন্য আরও বিরক্ত সে। ফিজা শাড়ির আঁচল মাথা থেকে ফেলে দিয়ে বিছানায় বসে আছে। সামনের মার্বেল টাইলস ফ্লোরে দৃষ্টি স্থির রমণীর। তবে ভাবনায় তার আবরাজ খান কী অদ্ভুত। সে এ-সব ভাবছে কেনো? নিজেই নিজের ওপর যেনো বিরক্ত হচ্ছে ফিজা। তখনই রুমের দরজা টা খট করে খুলে গেলো। ফিজা স্বাভাবিক ভাবে ধরে নিলো নিজের মা কিংবা বোন এসছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো সে সামনে না তাকিয়ে ও অনুভব করলো পারফিউম এর কড়া গন্ধ তাকে জানান দিচ্ছে কক্ষে কোনো মহিলা নয় কোনো পুরুষ প্রবেশ করেছে। সে তৎক্ষনাৎ চোখ তুলে সামনে দৃষ্টিপাত করলো। লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ সুঠাম দেহের আবরাজ খান কে নজরে এলো সঙ্গে সঙ্গে। একটি কালো রঙের ফর্মাল স্যুট পরেছে যা নিখুঁতভাবে পুরুষ টার শরীরের সঙ্গে ফিট করা। তার গলায় রয়েছে একটি কালো টাই। যা তার স্যুটের সঙ্গে মানানসই। টাইয়ের সাথে টাই ক্লিপও লাগানো। এতে করে আরও পরিপাটি ও কর্পোরেট লুকে আছে মানুষ টা। স্যুটের নিচে পরেছে একটি সাদা ড্রেস শার্ট। তার হাতে একটি স্টাইলিশ ও বড়ো ডায়ালের ঘড়ি রয়েছে। স্যুটের কোটের পকেটে একটি পকেট স্কয়ার আছে। স্যুটের সাথে ম্যাচিং ফরমাল প্যান্ট। পুরুষ টার ড্রেসআপ বেশ ক্লাসি প্রফেশনাল এবং এলিগ্যান্ট। চেহারা গভীর মনোযোগী ও ভাবুক। চোখ দুটো গভীর ও আবেগময়। ভ্রুগুলো ঘন ও পরিষ্কারভাবে গঠিত। নাকটি সোজা ও ভারসাম্যপূর্ণ। ঠোঁটের গঠন সুন্দর। মুখে দাড়ির বালাই নেই। ফিজার নাক মুখ কুঁচকে আসে। দাড়ি বিহীন পুরুষ তার ভালো লাগে না।
পুরুষ টার শরীরের ত্বক পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যবান। আলো-ছায়ার খেলায় তার মুখ আরও রহস্যময় ও চলচ্চিত্রীয় লাগছে যেনো। চোখ দু’টো গভীর যেনো যার অতল গহ্বরে তলিয়ে ফিজা নিজের স্থান, কাল, পাত্র ভুলে বসেছে।
তবে তৎক্ষনাৎ পুরুষ টার ঠোঁটের বাঁকা হাসি তাকে সজ্ঞানে আনতে যথেষ্ট ছিলো। সে নিজের কাজে নিজেই বোকাবনে গেলো। কি অদ্ভুত। এই পুরুষের মধ্যে এমন কী আছে যা তার ব্যাক্তিত্ব কে ভুলিয়ে দিয়ে ছিলো একটুর জন্য! আবরাজ দরজা থেকে কয়েক কদম এগিয়ে এসে ফিজার সামনে দাঁড়ালো। ফিজা সঙ্গে সঙ্গে বসা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো। অস্থির হয়ে মাথা ঘোমটা টানার জন্য উদ্যত হতেই বাঁধা প্রধান করলো সামনের পুরুষ। হাত ধরে বলে উঠলো,

-“দারুণ লাগছে তোমায়। এভাবে থাকো।”

হঠাৎই পুরুষালী স্পর্শ চমকে উঠলো ফিজা, অস্বস্তি হলো। আবরাজ ততক্ষণে মেয়ে টার হাত ছেড়ে দিয়েছে। কয়েক সেকেন্ড এর জন্য হলে-ও ফিজার শরীর কেঁপে উঠলো। ব্লাউজের গলা টা অতিরিক্ত বড়ো হওয়াতে মেয়ে টার ঘাড় গলা বুকের উপরিভাগ প্রায় উন্মুক্ত। নিজের কর্মে সে আজ নিজের ওপর বিরক্ত। কিভাবে এমন একটা ব্লাউজ সে গায়ে জড়ালো এ-সব ভেবে ভেবে হয়রান হলো। তবে মনস্থির করলো আজই এর একটা বিহিত করবে। কিন্তু সামনের পুরুষের থেকে এমন কমপ্লিমেন্ট মেয়ে টার শরীর কোনো অজানা কারণে কাঁপতে লাগলো। রাগে না-কি লজ্জায় সে অনুভব করতে পারছে না। আবরাজ ওর দিকে আচমকাই ঝুঁকে এলো। গলার দিকে কাঁধে ফু দিয়ে বলে উঠলো,

-“তোমার গলায় কফি কালার তিল টা বেশ আকর্ষণীয়।”

বুকের উপরিভাগে রমণীর রয়েছে একটি লালচে তিল। ফিজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আবরাজের দিকে। আবরাজের ঘোরলাগা হিমশীতল গভীর চাহনি ফিজার সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মিইয়ে এলো। আবরাজ প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে এরপর ঘুরে দাঁড়াল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় মেয়ে টার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

-“ফিজা সিদ্দিকী পুষ্প। নিজের সর্বনাশ করলে তুমি। আর তোমার সর্বনাশ করলো তোমার এই মোহনীয় রূপ, সুগন্ধি ফুল।”

আজকেই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। এরূপ মন্তব্য ফিজা কে যেমন অবাক করলো তেমনই সে মানুষ টার আচরণে হতভম্ব। বিস্ময়ে কিছু বলতে ভুলে গেলো। কথার খেই হারিয়ে সে নিশ্চুপ। প্রথম পরিচয়ে কারোর সঙ্গে এভাবে কথা বলা যায়? ফিজা পারলো না। তবে নিজের ধারালো দৃষ্টিতে আবরাজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
বিদায় নিতে যখন মিসেস ইলা এলো ফিজা হাসি মুখে ওনার সঙ্গে কথা বললো। কেননা মিসেস ইলা নিজের নামের মতোই মিষ্টি, পানির মতো, ভীষণ ভালো মানুষ ফিজার জানামতে৷ কিন্তু এমন ভালো একজন মানুষের ঘরে এমন নির্লজ্জ পুত্র হতে পারে এই আবরাজ খান এর সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলে বোধহয় ফিজার জানাই হতো না।

-“আমার না মেয়ে নেই। একটা মেয়ের খুব শখ আমার। একবার আমার মেয়ে হয়ে দেখো। খুব আদর করবো।”

এমন সহজ সরল উক্তিতে ফিজার মন টা বড্ড চিৎকার করে বলতে চাইলো “আপনি এবং আপনার ব্যবহার এতো চমৎকার, আপনার ছেলে এবং তার কথা কেনো এমন তেঁতো?” তবে বলা হলো না। মোহিতা বেগম ও খুব খুশি। ফিজা শুধু মৃদু হাসলো। কি’বা আর করার আছে? সব রাস্তা যেনো বন্ধ। মা বোন সবাই কত খুশি। সে কিভাবে এই বিয়েতে না করবে? না করার রিজন কী বলবে? মানুষ টা সুন্দর এবং তার কথাবার্তা কিছু টা লাগামহীন এইটাই কী বিয়ে ভাঙার কারণ হতে পারে!

——-

রাত সাড়ে দশ টা। ফিজার মা একটু আগেই ফিজার রুম থেকে গিয়েছে। কথাবার্তা মায়ের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ হয়েছে। কিন্তু সে মায়ের মুখে যে আত্মসম্মানবোধ, বোনের মুখে যে খুশি, তা সে কিছুতেই মাটি করতে চাইছে না। একটা সুযোগ তো নিজের জীবন কে দেওয়াই যায়। বাবা ছাড়া পৃথিবীতে মা এবং ছোট বোনই তার দুনিয়া। তাদের খুশি রাখার চেষ্টা সে সর্বদা করে। মা যাওয়ার পরই ফিজা বিছানায় বসলো। মেহরিন পাশে ঘুমিয়ে আছে। মেয়ে টা চুপচাপ আর ঘুমকাতুরে। যদিও সে-ও ঘুমকাতুরে। তবে আজ তার ঘুম চোখে ধরা দিচ্ছে না। রাগ ভেতরে এতো সময় মায়ের কথায় চেপে রাখলেও আবারও এটা বিকেলের কথা ভেবে দাউ দাউ করে জ্বলছে। সন্ধ্যায় নিজের গা থেকে খুলে রাখা শাড়ী সোফার ওপর থেকে তুলে নিলো। ব্লাউজ টা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সে প্রথমে রান্না ঘরে গেলো। সেখান থেকে দেশলাই নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। উঠোনে এসে ব্লাউজ টায় আগুন জ্বালিয়ে দিলো। মূহুর্তের মধ্যে সুতির কাপড়ে জ্বলতে শুরু করলো। মাটিতে ফেলে ফিজা সেই আগুনের দিকে তাকিয়ে রইলো। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা ব্লাউট দেখে যতোটা তৃপ্তি সে পাচ্ছে ঠিক এভাবেই হয়তো আবরাজ খানের মুখের মধ্যে আগুন লাগাতে পারলে শান্তি পেতো। তবে তা সম্ভব নয়৷ কিন্তু যার কারণে এই কাহিনি তাকেই শেষ করে দেওয়া যাক। ফিজা বাঁকা হেঁসে বাড়ির ভেতরের যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। যেতে যেতে বললো,

-“নিজের চোখের হেফাজত নেই অসভ্য পুরুষ। অশ্লীল মন্তব্য করে আবার।”

—–

অফিস থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছে আবরাজ। পাত্রী দেখে সে সোজা অফিসে এসেছিলো জরুরি কাজে। এখন রাত সাড়ে এগারো টা। সাথে আছে এসিস্ট্যান্ট সাব্বির। সাব্বির গাড়ির দরজা খুলতেই আবরাজ বসে গেলো গাড়িতে। সাব্বির নিজেও সামনের সিটে বসলো। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলেন। সাব্বির বললো,

-“স্যার আপনি কিছুদিন রেস্ট করতে পারেন। ঘুরাঘুরি। অফিস স্যার এবং আমি সামলে নেবো।”

আবরাজ গলার টাই আলগা করতে করতে রাশভারী কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,

-“বিয়ের পর বউ নিয়ে ঘুরাঘুরি হবে সাব্বির। সেই ব্যবস্থা করো।”

-“বাট বিয়ের তো এখনো ডেট ফিক্সড হয় নি স্যার!”

আবরাজ নিজের ফোন বের করে কিছু সময় চুপচাপ কিছু দেখলো। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোনের স্ক্রিনে। কেমন জ্বলজ্বল করছে চোখের তাঁরা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আচমকাই আবরাজ বলে উঠলো,

-“আবরাজ খান কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। বিয়ের ডেট লাগবে না। বাবা-র সাথে কথা বলো। আর কালই বিয়ের ব্যবস্থা করো। ইট’স মাই অর্ডার।”

সাব্বির হতভম্ব তো হয়েছে। তবে কিছু বললো না। কী বলবে? সে যে কিছু বুঝতে পারছে না। তবে সে তৎক্ষনাৎ ফোন বের করে কাউ কে কল দিলো।
আবরাজের ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি। ফিসফিস স্বরে সে বললো,

-“ইউ ইগনাইট দ্য ফায়ার উইদিন মি। ইউ আর নট জাস্ট ইন মাই হার্ট, ইউ আর দ্য ভেরি ওয়েভস দ্যাট স্টার মাই সোল, ❝সুগন্ধি ফুল❞।”

#চলবে……

#সুগন্ধি_ফুল_২
#সূচনা_পর্ব_
#জান্নাত_সুলতানা

[সিজন টু লিখার কোনো রকম চিন্তাভাবনা ছিলো না। অনেকেই হয়তো জেনে থাকবেন সিজন টু লিখার রিজন টা। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ।]

#জান্নাত_সুলতানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here