‘মেজর ধ্রুব মাহবুব এর বউ বিয়ে থা করে বিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন স্যার!’
কথাটা চিৎকার করে বললো আর্মি অফিসার নিরব আয়মান। কথাটা শুনে অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ধ্রুবর বাবা বিস্মিত হয়ে গেলেন। অবাক চোখে তাকালেন প্রাণপ্রিয় বন্ধুর দিকে। কিন্তু বন্ধুর নিচু মস্তক দেখে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলেন না তিনি।
বিয়ে বাড়ির থমথমে অবস্থা৷ বিয়ে না করে পালিয়ে গেলে একটা কথা ছিল। কিন্তু বিয়ে করে কবুল বলে একজন বউ কিভাবে পালাতে পারে! বিষয়টা অবশ্যই চিন্তার। ধ্রুব মাথার পাগড়ি খুলে ছুড়ে ফেললো অদূরে। রাগে গজগজ করতে করতে নিজের বাবার দিকে তাকালো। প্রথমবারের মতো বাবার সাথে উচ্চ আওয়াজে কথা বললো।
‘আমি শুধুমাত্র তোমার কথাতে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ রেখে বিয়ে করতে চলে এসেছি বাবা। তোমার পছন্দের পাত্রীকে না দেখে বিয়েও করে নিলাম। কিন্তু! তোমার পছন্দের বন্ধুর মেয়ে তো পালিয়ে গেছে। আমার সময় নষ্ট হলো বাবা। আমার ক্যারিয়ারে দাগ লেগে গেলো। সবাই আজ থেকে জানবে মেজর ধ্রুব মাহবুব এর বউ কবুল বলে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে গেছে!’
কন্যার পিতা কন্যার মাতার গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারলেন। জনসম্মুখে বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে বললেন,
‘তোর মেয়ের এতো বড় সাহস। আমার মান সম্মান সব শেষ করে পালিয়ে গেলো। কোন না কোন ছেলের সাথে ভেগেছে। তোর জন্য হয়েছে এসব। তুই কোথায় থাকিস? মাইয়ার খেয়াল রাখিস নাই কেন?’
ধ্রুব বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেলো। ধ্রুবর বাবা অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার ফাহিম মাহবুব হুংকার ছাড়লেন।
‘নিজের বউয়ের সাথে এ কেমন ব্যবহার তোর রমজান? আমি তোকে বন্ধু ভেবে তোর মেয়ের সাথে আমার ছেলের সম্মন্ধ করেছি। কিন্তু আমি জানতাম না তুই এতো কুৎসিত। যদি জানতাম তবে আজ আমাকে এখানে দাড়িয়ে থাকতে হতো না। যে মেয়ের বাবা এমন কুৎসিত আচরণ নিজের স্ত্রীর সাথে করতে পারে, তার মেয়ে ঠিক কিরকম হতে পারে তা সম্পর্কে ধারণা আমার হয়ে গেছে। না নিজে ভালো স্বামী হতে পেরেছিস আর না নিজের মেয়েকে ভালো শিক্ষা দিতে পেরেছিস। আমি যদি তোর এই রুপটা আগে দেখতাম! নিজের ছেলের কাছে আমি আজ ছোট হয়ে গেলাম।’
নিরব পরিস্থিতি সামলাতে বলল,
‘স্যার আমি তো আপনার কথাতে ম্যাডামের ব্যাপারে সব খুঁজ খবর নিয়েছিলাম। তার কোনো বয়ফ্রেন্ড নামক কালসাপ ছিল না। আমার মনে হয় এটা অন্য কেস।’
ধ্রুব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘কি বলতে চাইছো তুমি?’
নিরব অসহায় কন্ঠে বলল,
‘সেটা তো জানি না স্যার। তবে ম্যাম অন্য কারো সাথে পালিয়ে গেছেন সেটা আমি বিশ্বাস করি না। তার কোনো বয়ফ্রেন্ড তো দূরে থাক কোনো ছেলে জাস্ট ফ্রেন্ডও নেই।’
এবার কথা বললেন কনের মা মিথিলা বেগম।
‘আমার মেয়ে কোনো ছেলের সাথে পালিয়ে যেতে পারে না বেয়াইন। এতে অন্য কোনো কারণ আছে। আমি তো মা, ওকে খুব ভালো করেই চিনি।’
ধ্রুব কপাল চেপে ধরলো নিজের। আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্যি সে তার পালিয়ে যাওয়া বউয়ের নামটা জানে না। বিয়ে পড়ানোর সময় বললেও খেয়াল করা হয়নি। মেয়েটিকে সে দেখেওনি। তার বাবা ইমোশনাল ব্রেকমেইল করে রীতিমতো তাকে রাজি করিয়েছেন। নিজের নাম না জানা সদ্য বিবাহিত বউয়ের জন্য ধ্রুবর কৌতূহল হলো কিঞ্চিৎ। তার বউয়ের যদি কোনো বয়ফ্রেন্ড না থাকে তবে পালিয়ে গেলো কেন?’
কথা বলল, নিরব।
‘আমার মনে হয় ম্যাম স্যারকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছেন।’
ধ্রুব গম্ভীর স্বরে বলল,
‘আমাকে ভয় পাবে কেন সে?’
‘আপনাকে দেখলেই তো আমার হাঁটু কাঁপে স্যার। ম্যামের না জানি কি কি কেঁপেছে।’
ধ্রুব চোখমুখ শক্ত করে দাড়িয়ে রইলো। পৃথিবীর ইতিহাসে গেঁথে গেলো প্রথমবারের মতো ‘ বিয়ে থা করে বউ পালিয়ে গেছে তাও তার মেজর স্বামীকে ভয় পেয়ে।’
*
রেলস্টেশনে লাল শাড়ি পরিহিত এক রমনী দাড়িয়ে আছে। হাতে একটি ট্রলি ব্যাগ। স্মার্টফোন বের করে সে বার-বার কাকে যেনো ফোন করছে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
‘আমি পালিয়েছি ইয়ার। এখন ট্রেনে চেপে বসবো। তুই সব ঠিকঠাক করে রেখেছিস তো?’
ওপাশ থেকে একটি মিষ্টি গলা শুনা গেলো।
‘চিন্তা করিস না। সব ঠিক করে রেখেছি। তুই ট্রেনে করে সোজা ইন্ডিয়া চলে আয়। আমি স্টেশনে তোকে রিসিভ করবো।’
কথা শুনে রমনীটি স্বস্তির শ্বাস নিলো।
‘ সিমটা বন্ধ করে দিতে হবে। তোর সাথে দেখা করে তারপর নতুন সিম কিনবো ইন্ডিয়ার। থ্যাংক ইউ সুমিত্রা।’
সুমিত্রিা ‘ঈশ্বর তোর সহায় হোন’ বলে ফোন রেখে দিলো।’
তীব্র সাহস নিয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে আসা মেয়েটি চেপে বসলো ভারত’গামী ট্রেনে।
–
দ্রুত বেগে গাড়ি ড্রাইভ করছে ধ্রুব। রাগে মাথা ধপধপ করছে তার। তার বউ তাকে ভয় পেয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু তার পিতা সেটা বিশ্বাস করেছেন। তার মতে তার ছেলের গোমড়ামুখো ও দজ্জালের মতো চেহারা দেখে তার একমাত্র বউমা পালিয়ে গেছে।
ধ্রুব ড্রাইভ করতে করতে স্টেশনে চলে এসেছে। তার বিবাহিত বউয়ের ফোনের লোকেশন লাস্ট এখানেই দেখা গেছে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। ধ্রুব দাড়িয়ে দেখলো ট্রেনটি ধীরে ধীরে ছুটে চলে যাচ্ছে নিজের গন্তব্যের দিকে। তন্মধ্যে ট্রেনের জানলা দিয়ে লাল শাড়ি পড়া কাউকে দেখতে পেলো। মুখটা অস্পষ্ট। তার কেন যেনো মনে হলো এটাই তার বউ। ধ্রুব চিৎকার করলো,
‘এই মেয়ে। ‘
ধ্রুবর চিৎকার শুনলো না কেউ। ট্রেন ছুটে চলে গেছে ততোক্ষণে বহুদূর।
বলিষ্ঠ শরীর থেকে শেরওয়ানি খুলে ছুড়ে মারলো পেছনের সিটে। গায়ের সেন্টু গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে চুপেচুপে হয়ে আছে। ধ্রুব সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেললো। তার বউ তার সামনে দিয়ে চলে গেলো সে আটকাতে পারলো না। নিজেকে এ-ই মূহুর্তে তার সহ্য হচ্ছে না। লজ্জায় নাক মুখ লাল তার। যতোবার মনে হচ্ছে তার বউ তাকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে ততোবারই তার লজ্জা লাগছে। জীবনের এ পর্যন্ত সে শুনে এসেছে হাজারো রমনীর ঘুম উধাও করার ক্ষমতা আছে তার। কিন্তু আজ এসে শুনলো বউও উধাও করার ক্ষমতা আছে।
ফাহিম মাহবুব একের পর এক ফোন দিচ্ছেন। ধ্রুব সেটা রিসিভ করলো না। বরং দ্রুত টাইপ করলো,
‘তোমার গুনধর বউমা সম্ভবত ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে ফেলেছেন। আমি যাওয়ার আগেই ট্রেন স্টেশন ত্যাগ করেছে। আর তাছাড়া ও আমি তাকে ঠিকঠাক চিনতে পারিনি। যাকে দেখেছি সে আধও তোমার বউমা কিনা আমি নিশ্চিত নই।’
ফাহিম মাহবুব থমথমে কন্ঠে বললেন,
‘নিজের বউকে চিনতে পারোনি কেমন স্বামী তুমি?’
ধ্রুব অকপটে জবাব দিলো,
‘তাকে আমি এই জনমে এখন পর্যন্ত দেখিনি যে দেখলেই চিনতে পারবো। ধেই ধেই করে জিজ্ঞেস করবো, ‘আপনি আমার বউ? ও মাই গড আপনি আমার বউ!
ফাহিম মাহবুব কল কেটে দিলেন। তার জল্লাদ ছেলে আপাতত বউ হারানোর সুখে উল্টাপাল্টা বকছে বলে ধারণা তার। ছেলেটা সবসময়ই মেয়েদের থেকে দূরত্ব রেখে এসেছে। তিনিই একটা গতি করতে এতো চেষ্টা করলেন। শেষে তীরে এসে তরী ডুবে তার একমাত্র ছেলের বউ পালিয়ে গেলো। এখন কিভাবে তিনি কি করবেন। ছেলেটা নিশ্চিত এবার নিরুদ্দেশ হবে। এমনিতেও বছরে একবার বাড়িতে পা ফেলে কি না সন্দেহ। তার উপর ছেলের মা দেশের বাহিরে। তাকে না জানিয়ে তিনি এতোসব করে ফেলেছেন। এসে যদি শুনেন তাহলে তাকে আস্তে রাখবেন না। সাথে দোষ তার ঘাড়ে পড়বে। তিনি কেমন মেয়ে পছন্দ করলেন যে কি না বিয়ে করে পালিয়ে গেলো! ফাহিম মাহবুবের মনে হলো ‘বিয়ে থা’র মতো গুরুতর সমস্যা জগৎসংসারে দুটো হতে পারে না।’
(চলব)
#সূচনা_পর্ব
#বিয়ে_থা
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ