#অনুপম_ভালোবাসা(১২)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
নজরাত টিভিতে ইসলামীক প্রশ্ন উত্তর অনুষ্ঠান দেখছে এমন সময় তাদের বাড়িওয়ালার বউ আসেন। এই মহিলাকে নজরাত এর একদম পছন্দ হয় না। মহিলার কূটনামিতে জুড়ি নেই। আজকে কোন মতলবে তাদের বাসায় এসেছে আল্লাহ জানেন!
এসেই নজরাত কে বললেন,
__” কি নজরাত শ্বশুরবাড়ি থেকে কবে আইলা?
এমন প্রশ্নের কোন মানে হয়? এই নিয়ে বেশ কয়েকবার তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন নজরাত শ্বশুরবাড়ি কবে যাবে? তখন তাকে তরিকা বেগম স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জামাই এর পরীক্ষা শেষ হলে নিয়ে যাবে। কয়েক মাস বা এর বেশিও লাগতে পারে। অথচ এই মহিলা আবারও এসব কথা জিজ্ঞাসা করছেন। যেন উনার ঘরের খাবার খেয়ে শেষ করছে নজরাত।
তরিকা বেগম রান্নাঘর থেকে এসে বললেন,
__” ও ভাবি আপনি এসেছেন বসেন ভাবি।
নজরাত মাকে পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দ্রুত উঠে চলে যেতে নিলে ভদ্রমহিলা নজরাত কে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
__” সোন মেয়ে, দিনকাল যা পড়েছে এভাবে জামাইকে ছেড়ে থাইকো না বেশি দিন। পুরুষের মন বোঝই তো কোন দিক থেকে কোন দিকে চলে যায় তার তো কোন ঠিক নাই। আজকাল বউ পাশে থাইকাই যেই আকাম কুকাম করে পুরুষেরা তাদের কোন বিশ্বাস নেই।
মহিলার কথায় নজরাত খানিকটা বিব্রত বোধ করে বলল,
__” উনার পরীক্ষা চলছে তার মধ্যে আপনি কি সব বলছেন আন্টি! আমি বুঝতে পারলাম, আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইলেন?
ভদ্রমহিলা আফসোস এর সুরে বললেন,
__” বুঝবা বুঝবা যখন আর সামলানোর কিছু থাকব না তখন বুঝবা আমার কথা।
নজরাত আর কিছু বলল না নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে রইল। মনটা ভীষন্নতায় ভরে গেছে তার। রাদ এর উপর পূর্ণ আস্থা আছে তার কিন্তু এই মুহূর্তে কেমন যেন অস্থির লাগছে। মন কে শান্ত করতে রাদ এর সাথে কথা বলা প্রয়োজন তাই কল দিল তাকে। কিন্তু কল রিসিভ করছে না রাদ। নজরাত আর নিজেকে সামলে উঠতে পারলো না কান্না গুলো চোখের পানি হয়ে ঝরে পড়া শুরু করে। শেষে বালিশের উপরে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে।
রাতের খাবার খেতে তরিকা বেগম ডাকলেও দরজা খুলে না। রাত দশটার পর রাদ নজরাত এর ফোন বন্ধ পেয়ে শাশুড়ি মায়ের ফোনে কল করে জানতে চায় নজরাত এর কি হয়েছে ওর ফোন বন্ধ কেন?
তরিকা বেগম কি বলবেন ভেবে পান না তাই বলেন ওর বোধহয় মন খারাপ। তুমি চিন্তা করো না বাবা কিছুক্ষণ পরেই ঠিক হয়ে যাবে।
নজরাত পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন অন করে দেখলো রাদ অনেক বার কল করে করেছিল। অনলাইনে গিয়ে দেখে সেখানে ও অনেক গুলো মেসেজ দিয়ে রাখছে। নজরাত শুধু মেসেজে রিপ্লাই দিল,
“ভালো লাগছিল না তাই ফোন বন্ধ করে রাখছিলাম”।
কিছুক্ষণ পর রাদ কল করে। জিজ্ঞাসা করে নাস্তা করছে কিনা নজরাত? নজরাত বলল করেছে। তারপর স্বাভাবিক কিছু কথা বলে রেখে দেয়।
.
.
ভার্সিটিতে এসে একটা ক্লাস এর পর গ্যাপ থাকে তখন নজরাত বান্ধবীরা মিলে লাইব্রেরী বা ক্যান্টিনে বসে গল্প গুজব করে। আজকে লাইব্রেরীতে বসে গল্প করছে তারা। মেয়েদের গল্প গুজবের মধ্যে ফিউচারে বিয়ে নিয়ে আলোচনা থাকেই এটা কমন ব্যাপার। তো অবিবাহিত যারা তাদের স্বপ্ন খুব সুন্দর করে সাজবে বিয়ের দিন। আর বিবাহিত দের কথা, সাজগোজ করতে পারলে বলে কিভাবে সেজেছিল কি জুয়েলারি পড়েছিল আর না করতে পারলে আফসোস করে। এসব আলোচনা শেষে সবাই নজরাত কে ধরল কারণ নজরাত কিছুই বলছে না আনমোনা হয়ে বসে আছে। মারুফা বলল,
__” এই নজরাত তুই তো কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিলি। শুনেছি পরে উঠিয়ে নিবে। তখন কিভাবে সাজবি প্লান করেছিস? আর তখন আমাদের দাওয়াত দিবি তো নাকি আবারো লুকিয়ে শশুর বাড়িতে চলে যাবি?
মারুফার কথায় সবাই হেসে দেয়। আরেকজন বলল,
__” আচ্ছা তোদের তো বিয়ে হয়ে গেছে তা ইয়ে টিয়ে তো হয়ে গেছে তাই না?
এমন কথায় সবাই মুখ চেপে হাসে। এদিকে নজরাত বরকে যায় এমন কথায়। হাতের নোখ খুঁটতে থাকে।শেষে ভেবে বলে,
__” স্বামী স্ত্রীর গোপন কথা কারো কাছে বলতে নিষেধ জানিস না? বেদ্দপ মেয়ে কোথাকার।
মারুফা বলল,
__” আরে বান্ধবীদের কাছে একটু আধটু বললে কিছু হয় না। বল না কি হয়েছে? কে প্রথম কাছে এসেছিস?
নজরাত কোরআন এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলল,
__” সমাজের অনেকেই আছে, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বাহাদুরি প্রকাশ করতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর একান্ত বিষয় কিংবা পারিবারিক গোপনীয় বিষয়াদি তাদের কাছে বলে বেড়ায়। এটা অনুচিত ও খেয়ানতের কাজ। সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে যে আমানতের খেয়ানত সবচেয়ে বড় বলে গণ্য হবে- তা এই যে, কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়, স্ত্রীও স্বামীর সঙ্গে মিলিত হয়, তারপর (স্বামী-স্ত্রীর) একান্ত বিষয়গুলো অন্যদের কাছে প্রকাশ করে দেয়।[১]
স্বামী-স্ত্রীর একান্ত বিষয় অন্যের কাছে প্রকাশ করা গর্হিত অপরাধ। ইসলামি বিধানে শুধু স্বামী-স্ত্রী নয়, পরিবারের যেকোনো সদস্যের এ ধরনের গোপন কথা প্রকাশ করা খুবই অন্যায়। স্বামী-স্ত্রী ও পরিবারের গোপন কথা সংরক্ষিত রাখা ইসলামের অনুপম সৌন্দর্য। তাই এগুলো কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করবি না প্লিজ। আমাদের সকলকেই একদিন মৃ ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই মৃ ত্যুর ভয় রেখে অন্যায় থেকে নিজেকে সংযত করতে হবে আমাদের।
মারুফা এবং অন্যান্য বান্ধবীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তওবা করে বলল। আর কাউকে এগুলো নিয়ে জিজ্ঞাসা করবো না ইনশা আল্লাহ।
.
.
রাদ এর পরীক্ষা চলছে তিন চার দিন গ্যাপ দিয়ে দিয়ে। এদিকে নজরাত যেন ধৈর্য হারা হয়ে পড়ছে। আশেপাশের মানুষ থেকে শুরু করে বান্ধবীরা পর্যন্ত এসব নিয়ে কথা বলছে, তার এসব সহ্য হচ্ছে না একদম। তাছাড়া বিয়ের কত্ত গুলো মাস পেরিয়ে গেল এখন পর্যন্ত বিয়ে করা স্বামীকে নিজের করে পাওয়া হলো না তার। মাঝে মাঝে মনে হয় সুখের দিন আসার আগেই সে হয়তো ম রে যাবে। মৃ ত্যুর কথা ভাবলে এসব কিছু অর্থহীন মনে হয়। আবার যখন মৃত্যু চিন্তা দূরে সরে যায় তখন আবার না পাওয়ার আফসোস ঘিরে ধরে তাকে।
ইদানিং জিদ ধরে রাদ এর সাথে ঠিক মতো কথা বলে না নজরাত। রাদ এর পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুদিন হলো অথচ নজরাত কে নিয়ে যাওয়ার কথা মুখে ও আনে না। এদিকে বড় ছেলে মা রা যাওয়ার পর শাশুড়ি মা ও তেমন একটা কথা বলেন না তার সাথে। সব মিলিয়ে তার মধ্যে ভয় কাজ করে। ইদানিং কতো বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। ছয় সাত বছর সংসার জীবনেও ডিভোর্স হচ্ছে। সেখানে তাদের সংসার তো শুরু ই হলো না এখনো। এর মধ্যে কিছু হয় তাহলে নজরাত এর পরিবার শেষ হয়ে যাবে।
ব্যালকনির ফ্লোরে বসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে সেসব কথাই ভাবছে নজরাত। রুমে ফোন বেজে চলেছে সেই কখন থেকে উঠে গিয়ে রিসিভ করতে একদম ইচ্ছা করছে না তার।
কয়েক বার কল আসার পর রাফি ফোন নিয়ে এসে বলল,
__” কিরে ভয়রা হয়ে গেছিস নাকি? কল আসতেছে কখন থেকে শুনতে পাস না?
নজরাত ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রাদ কল করেছে। কিন্তু নজরাত আর কল ব্যাক করলো না। ইচ্ছা করছে না তার কথা বলতে। মনে শান্তি না থাকলে কিছুই ভালো লাগে না।
রাতের বেলা রাদ আসে নজরাত এর বাসায়। তরিকা বেগম নুডুলস আর ডিম আর ময়দার মিশ্রণে চমৎকার একটা নাস্তা রেসিপি তৈরি করে দেন। নাস্তা করে নজরাত এর সাথে একান্তে কথা বলতে নজরাত এর রুমের ব্যালকনিতে যায় তারা। নজরাত চুপচাপ বসে থাকলে রাদ জিজ্ঞাসা করে,
__” ইদানিং তোমাকে কেমন মনমরা হয়ে থাকতে দেখি কি হয়েছে তোমার? আমার সাথে ঠিক মতো কথা ও বলো না। তোমার সমস্যা গুলো আমাকে না বললে আমি বুঝবো কিভাবে বলো তো?
নজরাত ধরা গলায় বলল,
__” সব কিছু বলতে হয় না বুঝে নিতে হয়।
__” আচ্ছা আমি বুঝতে পারছি না যেহেতু সেহেতু বলো আমাকে?
নজরাত চুপ করে থাকে। চোখের কোণ পানিতে ভিজে গেছে। বাহিরের আবছা আলোয় সেটা বুঝা যাচ্ছে না। রাদ এবার বলল,
__” তুমি যখন বলবেই না তখন আমার বসে থাকার কোন মানে হয় না। আমি চলে যাচ্ছি ভালো থেকো।
তারপর উঠে চলে যেতে নিলে নজরাত রাদ কে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না করে দেয়। রাদ বিচলিত হয়ে বলে,
__” আরে কান্না করছো কেন? কি হয়েছে বলবে তো?
নজরাত কান্না মিশ্রিত গলায় বলে,
__” আমাকে আপনার করে নিন। আমি আর এভাবে থাকতে পাচ্ছি না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে….
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।
রেফারেন্সঃ
(১)(সহিহ মুসলিম : ১৪৩৭)