#বলবো_বলবো_করে_বলা_হয়নি
#পর্ব_০৩
#অনন্যা_অসমি
পাশাপাশি সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মাধুর্য এবং তটিনী। হঠাৎ মাধুর্য তার গতি বাড়িয়ে দিল ফলে সে তটিনীর থেকে বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে গেল। সাইকেল চালানো অবস্থায় মাধুর্য ভাব নিয়ে বলল, ” ইশ… এতো ধীর গতিতে সাইকেল চালান আপনি। এরকম করে চলতে থাকলে আমাকে কখনোই ধরতে পারবেন না। আমার গতির সাথে মিলানোর সাধ্যই নেই আপনার।”
ক্ষেপে গেল তটিনী৷ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ” আপনি কতটুকু জানেন আমার দক্ষতা সম্পর্কে? আমি এর চেয়েও দ্রুত চালাতে পারি। সেটা তো আপনি ধীরে চালাচ্ছিলেন বলে আমিও ধীরে চালাচ্ছিলাম যেন একসাথে থাকি।”
” হয়েছে হয়েছে আর বাহানা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।”
মাধুর্যের কথা তটিনীর বেশ আত্মসম্মানে লাগাল। অনেক দ্রুত প্যাডেল ঘুরিয়ে গতি বাড়াল সে। একসময় মাধুর্যকে ছাড়িয়ে গেল। সাইকেল চালাতে চালাতে পেছনে ঘাড় গুঁড়িয়ে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বলল, ” দেখলেন কার দৌড় কতদূর? এই তটিনী এতোটাও গাধা নই।”
” আরে সামনে দেখে চালান।”
” এখন কেন সামনে দেখতে বলছেন? নিজের কথা ভূল প্রমাণিত হয়েছে বলে খুব লাগছে না।” হাসতে হাসতে বলল সে।
” আরে বোকা মেয়ে হয় সাইকেল থামিয়ে কথা বলুন না হয় সামনে তাকিয়ে চালান। একসাথে দু’টো কাজ করবেন না।” পেছন থেকে উচ্চস্বরে সাবধানী কন্ঠে বলল মাধুর্য৷ কিন্তু তটিনী তার কথাকে ভূল প্রমাণিত করতে পেরে এটাই খুশি যে আশেপাশে তার খেয়ালই নেই।
” আ….” ব্যথার কারণে আপনাআপনি তটিনীর মুখশ্রী হতে চিৎকার বেড়িয়ে এলো। সাইকেলটা রাস্তায় উল্টে পড়ে আছে৷ মাধুর্য দ্রুত তার কাছে এগিয়ে এলো৷ নিজের সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে তটিনীর সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসল।
” আপনি ঠিক আছেন? দেখি কতটা লেগেছে?” চিন্তিত কন্ঠে বলল সে৷ কনুইতে বেশ কিছুটা কেটে গিয়েছে, রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তা থেকে। দ্রুত নিজের পকেট হাতড়ে রুমাল বের করে তা ক্ষত স্থানে বেঁধে দিল৷ খানিকটা রাগী কন্ঠে বলল, ” সবসময় এতো পাকনামি ভালো নয়। বলেছিলাম তো পেছনে তাকিয়ে সাইকেল না চালাতে।”
” আমি কি জানতাম নাকি সামনে অসমতল উঁচু জায়গা আছে।” কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল সে।
” চোখ পেছনে থাকলে জানবেন কি করে? দেখি এবার উঠুন, দাঁড়াতে পারছেন কিনা দেখি।”
মাধুর্যের সাহায্যে উঠে দাঁড়াল সে। দাঁড়ানোর পর বুঝল হাঁটুতে জ্বালা করছে। বুঝতে বাকি নেই সেখানেও হয়ত ছিঁড়ে গিয়েছে। একটু নিচু হয়ে দেখল সেখানে খানিকটা কাপড়ও ছিঁড়ে গিয়েছে।
” কি হলো পায়ে লেগেছে?”
” আব… মাধুর্য আজ বাড়ি ফিরে যাওয়াটাই ভালো হবে৷ আমার শরীর ভালো লাগছেনা।”
মাধুর্য বুঝল তটিনী পায়েও লেগেছে। একটা রিকশা ডাকল সে। সাবধানে তাতে তটিনীকে উঠিয়ে দিয়ে বলল, ” আপনি যান, আমি পেছন পেছন আসছি।”
নিজের সাইকেলটা সেখানে এক দোকানের সামনে বেঁধে রেখে তটিনীর সাইকেল চালিয়ে পেছন পেছন এলো সে৷ সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় প্রথমে ভেবেছিল তাকে কোলে তুলে নেবে কিন্তু হঠাৎ তার স্পর্শে তটিনীর অস্বস্তি হতে পারে ভেবে এই ভাবনা বাদ দিল। যত্ন সহকারে একপাশে ধরে তাকে উপরে তুলল। মিসেস শায়লা তো মেয়ের অবস্থা দেখে ভীষণ রকমের বকা দিলেন।
” আন্টি আর রাগ করবেন না। রাস্তায় বের হলে এরকম ছোটখাটো দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। এখানে কিছু ওষুধ আছে, আপনি ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিন।”
” তুমি বাবা কিছু মনে করো না। ওর সাথে সময় কাটাবে ভেবে এসেছিল কিন্তু তোমাকে ঝামেলা পড়তে হলো।”
” কোন সমস্যা নেই আন্টি৷ তটিনী আমি আসছি, সাবধানে থাকবেন।”
সোফায় বসে মাধুর্যের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল সে। মনে মনে বলল, ” যখনই তার সাথে দেখা হবে তখনই কোন লজ্জাজনক কিংবা অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হবেই। না জানি আবার আমাকে নিয়ে কি ভাবল। যদি ভাবে এতোবড় মেয়ে ঠিক মতো রাস্তায় চলাচল করতে পারে না! ইশ… কি লজ্জা!”
.
.
টিউশন শেষে রিকশার জন্য দাঁড়িয়েছিল তটিনী। রিংটোনের শব্দে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল মাধুর্য ফোন করেছে। হৃদস্পন্দন আপনাআপনি বেড়ে গেল। আজ দু’দিন হয়ে গিয়েছে তাদের দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ একদম বিচ্ছিন্ন। যদিও বা মাধুর্যের সাথে তার মায়ের কথা হয়েছিল তিনি তটিনীকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন সে বলতে আগ্রহী কিনা তবে তটিনী মায়ের সাথে এমন ভাব করল যেন তার কোন আগ্রহই নেই৷ তবে মনে মনে সে ঠিকই বিপরীতটা চেয়েছিল।
ভাবনার মাঝে কল কেটে গিয়েছে। পুনরায় বেজে উঠতেই দ্রুত রিসিভ করল সে।
” হ্যালো।”
” আবারো কোন ভাবনায় মগ্ন ছিলেন ম্যাডাম?” মাধুর্যের কথা শুনে দাঁত দিয়ে জিহ্বা কাটল তটিনী। তবে স্বীকার করল না।
” কে বলেছে আপনাকে? বায়োস্কোপ দিয়ে দেখেছেন নাকি?”
” না ড্রোন দিয়ে দেখছি।”
” কি কারণে ফোন দিয়েছেন তা বলুন। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে ভয় লাগে। কখন না জানি ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।”
” যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। আমি আসছি, বাই।”
” আমি আসছি মানে? আপনি কোথায় আসছেন? আরে হ্যালো? মাধুর্য? যা কেটে দিল।”
অতঃপর হাজারো চিন্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
” কারো জন্য অপেক্ষা করছেন বুঝি?”
কেঁপে উঠল তটিনী৷ ঘাবড়ে গিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে এলো সে। তার প্রতিক্রিয়া দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠল মাধুর্য৷
তটিনী ঈষৎ রাগ নিয়ে বলল, ” ছোট বাচ্চা নাকি আপনি? এধরণের মজা কেউ এই সন্ধ্যাবেলা করে?”
মাধুর্য হাসতে হাসতেই বলল, ” তো আপনি ছোট বাচ্চা নাকি যে এভাবে ভয় পেয়েছন।”
কপাল কুচকে তটিনী মনে মনে বলল, ” আগে ভেবেছিলাম এই ছেলে হয়ত অনেক ম্যাচিউর, গম্ভীর কিন্তু তার সাথে মেশার পর তো দেখছি পুরো উল্টো।”
তটিনীর সামনে তুড়ি বাজল মাধুর্য।
” কি ম্যাডাম তটিনী এতো কী ভাবছেন?”
” কিছু না। আপনি এখানে কি করছেন? আমাকেই বা কেন অপেক্ষা করতে বলেছেন?”
” আরে শান্ত হোন। একসাথে এতোগুলা প্রশ্ন করলে কিভাবে উওর দেবো? আপনার কি কোন তাড়া আছে?”
” না সেরকম কিছু নয়। তাও কারণটাতো জানা প্রয়োজন।”
” যদি বলি আপনার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছিল তবে?”
চুপ হয়ে গেল তটিনী। কথা গুলিয়ে গেল তার। চেয়ে দেখল মাধুর্য মিটিমিটি হাসছে৷
” রিলেক্স। আপনাকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল তাই এলাম৷ ভাবলাম জিনিস দেওয়ার পাশাপাশি আপনার সাথে কিছু সময় কাটালাম। যদি কিছু মনে না করেন আমরা হাঁটতে পারি?”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল তটিনী৷ পাশাপাশি হাঁটছে দু’জনে। নীরবতা কাটিয়ে মাধুর্য বলল,
” তটিনী।”
মাধুর্য এতোটা কোমল স্বর তার নাম উচ্চারণ করল যে তটিনীর হৃদয়ে ঝড় বয়ে গেল। পছন্দের মানুষ থেকে নিজের নাম এতোটা কোমল স্বরে শোনার অনুভূতিটাই যেন অন্যরকম।
” যদি কিছু মনে না করেন কিছু কথা জিজ্ঞেস করি?”
” বলুন।”
” আমার মধ্যে কি এখনো পর্যন্ত কোন খুঁত খুঁজে পেয়েছেন বা কোন দোষ?”
মাথা নাড়িয়ে না জানাল তটিনী।
” তাহলে কেন রাজি হচ্ছেন না?” তটিনী স্পষ্ট অনুভব করতে পারল মাধুর্যের কথায় মিশে থাকা হতাশার রেশটা। বলতে চেয়েও কিছু বলতে পারল না সে। চুপচাপ হাঁটতে লাগল। একসময় থেমে গেল মাধুর্য। তার দেখাদেখি তটিনীও দাঁড়িয়ে গেল। একটা প্যাকেট তটিনীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” এই জামাটা মা আপনার জন্য পাঠিয়ে৷ ওনার নাকি এটা দেখে মনে হয়েছে আপনাকে বেশ মানাবে। তাই উপহার হিসেবে দিয়েছেন। ফিরিয়ে দিলে মা অনেক কষ্ট পাবে।”
হাসিমুখে উপহার গ্রহণ করল তটিনী।
” আন্টিকে ধন্যবাদ জানাবেন।”
” আজ তাহলে আসি। সাবধানে থাকবেন।”
” এতোটা পথ এসে বাড়িতে যাবেন না? আর কিছুটা পথই তো বাকি।”
” না আজ নয়, অন্যকোন দিন।”
যেতে গিয়েও ফিরে এলো মাধুর্য। কিছুসময় চুপ থেকে তটিনী চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার জীবনসঙ্গীর জায়গাটা শুধু আপনার জন্য বরাদ্দ তটিনী৷ আমার এই জীবনে একমাত্র আপনিই সেই রমণী যাকে দেখে আমার হৃদয় গহীনে থাকা অনুভূতি সাড়া দিয়েছিল, জানান দিয়েছে এই রমণীই পারবে আমার জীবনকে পরিপূর্ণতা দান করতে। একমাস হোক কিংবা একযুগ আপনি এই মাধুর্যেরই অর্ধাঙ্গিনী হবেন।”
চলে গেল মাধুর্য। তার যাওয়ার পানে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তটিনী মৃদুস্বরে বলল,
” আমিও চাই আপনার অর্ধাঙ্গিনী হতে। চিন্তা করবেন না, এই তটিনী শুধু মাধুর্যের।”
চলবে……