আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ৫

0
118

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পাঁচ

মাঝরাতে কেউ একজন তামজিদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই ওর ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ বন্ধ করেই বুকের উপর থাকাটা বস্তুটাকে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারলো না। বরং দুটো হাত আরো শক্ত করে ওকে আষ্টেপৃষ্টে ধরল। এবার তামজিদ বিরক্ত হয়ে অন্যপাশে ফেরার জন্য নড়তেই কেউ একজন ঘুম কাতুরে স্বরে বলতে লাগল,
“নানিবু, তুমি এমনে লরো ক্যান বার বার। একটু শান্তি মতোন ঘুমাইতেও পারিনা তোমার লেইগা।”
মেয়েলি কণ্ঠের কথাগুলো তামজিদের কানে যেতেই তামজিদ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে পড়ল। এক প্রকার লাফিয়ে উঠায় তারিনের ঘুমটাও ভেঙে গেলো। আবছা আবছা আলোয় দেখলো কেউ একজন বসে আছে। বোধহয় তারিনের দিকেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। চোখ পিট পিট করে তারিন পুনরায় বলে উঠল,
“নানিবু, তুমি এমনে চাইয়া আছো ক্যান? উইঠা বইয়া আছো। কই যাইবা? বাথরুমে যাইবা?”
তারিনের এসব কথা শুনে তামজিদ ঠিক কি বলবে খুঁজে পেলো না। মেয়েটা কি ভুলে গেছে তার বিয়ে হয়ে গেছে? সে এখন শশুড় বাড়ি আছে। তামজিদ এতসব কিছু চিন্তা করা বাদ দিয়ে শান্ত স্বরেই বলল,
“একটু সরে ঘুমাও। আমার উপরে উঠে যাচ্ছো তো।”
হুট করে পুরুষ কারোর কণ্ঠেস্বরে তারিন হকচকিয়ে উঠল। লাফিয়ে উঠে বসে পড়ল। কাপড় ঠিক করতে করতে বলল,
“আপনে?”
“হ্যাঁ, আমি। একটা মানুষ যে ঘুমালে দিন দুনিয়া ভুলে যায়__সেটা তোমাকে না দেখলে জানতাম না। খালি মুখেই বড় বড় কথা। স্বভাব এখনো বাচ্চাদের মতোই রয়ে গেছে।”
বলেই তামজিদ বালিশটা দূরে সরিয়ে এনে পুনরায় সুয়ে পড়ল। আর তারিন হা করে রইল কিছুক্ষন৷ অতঃপর ওর সব মনে পড়ল। ওর পাশে আজকে নানি না বরং ওর স্বামী ঘুমিয়ে ছিলো। তারমানে নানিকে ভেবে তামজিদকে জড়িয়ে ধরে ছিলো। ভেবেই জিভ কামড় দিয়ে উঠল। খানিকটা লজ্জাও পেয়ে বসল। কপাল চাপড়ে নিজে নিজেই বলে উঠল,
“ওরে তারু, তোর ক্যান ঘুমাইলে হাত পা আয়ত্তে থাকে না? ইশ! এখন কি মনে কইরা বইরা থাকবো, মাস্টার মশাই? ভাববো, বিয়া না হইতেই তার গায়ে পইরা গেছি।”
তামজিদ সবটা শুনে ও চুপ করে আছে। এই মুহূর্তে ওর কথা বলতে ভালো লাগছেনা। তাই ঘুমানোর ভান করে আছে। তারিন কথাটা বলে পুনরায় বলে উঠল,
“ধুরো, কি আবোলতাবোল ভাবতাছি। যা খুশি ভাবুক। আমার কি? আমি কি অন্য পরপুরুষে গায়ে পড়ছি নাকি? হেয় আমার বিয়া করা স্বামী। তারে আমি ধরমু না তো কে ধরবো?”
এবার তামজিদ বিরক্ত হয়ে মুখ খুলল। কিছুটা ধমকে বলে উঠল,
“মাঝ রাতে পাগলের মতো প্রলাপ না করে ঘুমাও। মাথা যন্ত্রণা করছে। তোমার বকবক এই মুহূর্তে অসহ্য লাগছে।”
তামজিদের ধমক খেতেই তারিন থেমে গেলো। চুপচাপ সুয়ে পড়ল। আর কথা বাড়ালো না। কিছুক্ষণ চুপ করে সুয়ে থাকলেও ঘুম আসলো না। ভেতরে ভেতরে অশান্তি লাগছে। কেনো এমন লাগছে? তামজিদের খারাপ লাগা শুনে কেনো ওর কষ্ট হবে? বুকের ভেতরটা কেমন হাহা কার করছে। একদিনের পরিচয়ে কারোর জন্য খারাপ লাগা সৃষ্টি হয়ে যায়? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই। মন উত্তর দিলো, এটাই স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন। এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে তারিন ঘুমিয়ে যায় নিজেও টের পায়নি। মসজিদের আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। পাশ ফিরে দেখলো তামজিদ এখনো ঘুমে মগ্ন। নিজেকে ঠিক করে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। ওযু করে এসে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষ করে জায়নামাজের বিছামায় বসে বসে দোয়া পড়ছে আর সব কিছু নিয়ে ভাবছে। জীবনটা যে হঠাৎ করে এত পরিবর্তন হয়ে গেলো, আদৌ কি সব একদিন ঠিক হবে? নাকি জীবনের ছন্দ অন্যদিকে ঘুরে আরো এলোমেলো হয়ে যাবে। হুট করে পাশে কারোর অস্বস্তি টের পেয়ে পাশ ফিরতেই দেখলো তামজিদ দাঁড়িয়ে আছে। তারিনকে তাকাতে দেখেই তামজিদ বলে উঠল,
“আমাকে ডাকলে না কেন?”
তারিনের জবাবের আশায় না থেকে তামজিদ নামাজ শুরু করে দিলো। তারিন উঠে গিয়ে বেলকনির দরজাটা খুলে দিলো। সাথে সাথে একটা স্নিগ্ধ, সতেজ বাতাশ ওর গা ছুঁয়ে দিলো। ফজরের পরে ভোরের নিস্তব্ধতা, সতেজ বাতাশ, চারদিকে পাখির কিচির মিচির আর গ্রামের সুন্দর প্রকৃতি সব মিলিয়ে মনটা নিমিশেই ভালো হয়ে গেলো। বুকের উপর থেকে যেনো ভারী কিছু সরে গেলো। মন, মেজাজ দুটোই ফুড় ফুড়ে হয়ে গেলো। এটাই বুঝি আল্লাহর রহমত! তারিন মন ভরে কিছুক্ষণ শ্বাস নিলো। চুলগুলো ছেড়ে দিলো। দমকা হাওয়ায় উড়তে শুরু করল এক মুহূর্তেই। কী সুন্দর সেই মুহূর্ত! নিস্তব্ধতায় ঘেরা চারদিকে এক ষোড়শী কন্যা মন খুলে নিশ্বাস নিচ্ছে। এভাবেই দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সময়টা বড্ড ভালো লাগছে। নিজেকে সতেজ লাগছে। পুরো একটা দিন পর তারিন আবার মন ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মনে মনে প্রার্থনা করছে এই সময়টা এখানেই থেমে যাক। কি দরকার এত কোলাহল, না পাওয়ার হাহাকার, বেঁচে থাকার লড়াইয়ের?
“হাঁটতে বের হবে?”
হুট করে তামজিদের কণ্ঠে তারিন পেছন ফিরে তাকাল। চুলগুলো খোঁপা করে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল,
“কই যাইমু?”
তামজিদ বলল,
“চলো হেঁটে আসি। কিছু কথা আছে আমার।”
তারিন মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। তারপর দুজনে মিলে বেরিয়ে আসলো বাসা থেকে। তামজিদ বাসা থেকে বের হয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলেই সামনে বিশাল বড় ধানের ক্ষেত। সারি সারি সবুজ ছোট ছোট ধান গাছ দাঁড়িয়ে আছে। হালকা হালকা বাতাশ বইছে চারদিকে। এখনো ভোরের দিকে গ্রামে বেশ শীত পড়ে। তারিন গায়ে জড়ানো কাপড়টা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলো। তামজিদ তা দেখে প্রশ্ন করল,
“শীত লাগছে?”
“না। ভালোই লাগতাছে।”
তামজিদ আর কিছু বলল না। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে বিলের মাঝে এসে দাঁড়ালো। ধানের আইল দিয়ে হাঁটতে তারিন অভ্যস্ত। কিন্তু তামজিদের বড্ড অসুবিধা হচ্ছে। একটা সময় গিয়ে তামজিদ পা পিছলে পড়ে যেতে নিলেই তারিন ধরে ফেলল। সর্তকীকরণ বানীতে বলে উঠল,
“দেইখা হাঁটবেন তো, মাস্টার মশাই। পইড়া যাইতেন এহনেই।”
তামজিদ নিজেকে সামলে নিলো ততক্ষণে। সামনেই ছোট্ট একটা জায়গা খালি। হয়তো এখানে কোনো সবজি বা কিছু বোনা হবে। দুজনে গিয়ে সেখানিটায় দাঁড়াল। তারিনের বেশ ভালো লাগছে এই সময়টা। কিছু সময়ের নিরবতা কাটিয়ে তামজিদ জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কি আর পড়াশোনা করবে না?”
“হ আলবাত করুম। আমি অনেক পড়াশোনা করুম। চাকরি করুম।”
“কি হওয়ার ইচ্ছে আছে?”
“আমি ডাক্তার হইমু, মাস্টার মশাই। আমার ছোডকালের থেকে এই একটাই স্বপ্ন আছে। ডাক্তারের কি দাম দেহেন না? আমাগো গ্রামের যারা অসহায় আছে তারা টাকার অভাবে রোগ হইলেও ডাক্তারের কাছে যাইতে পারে না। ৫০০/১০০০ টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার দেহাইতে হয়। এত টাকা দিয়ে কি সবাই ডাক্তার দেহাইতে পারে নাকি? তাই আমার আব্বায় কইতো, ‘আম্মাজান, তোরে আমি ডাক্তার বানামু। তুই বড় হইয়া অনেক বড় ডাক্তার হইবি। গ্রামের হক্কলের সেবা করবি’।”
বলেই তারিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তামজিদ পুনরায় প্রশ্ন করল,
“তাহলে বিয়ে দিলো কেনো এত তাড়াতাড়ি?”
তারিন এবার তামজিদের দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আপনের আব্বার লেইগা।”
তামজিদের ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো এবার। বলল,
“আমার বাবার জন্য মানে?”
তারিন শান্ত বাক্যেই এবার উত্তর দিলো,
“হ। আপনের আব্বার লেইগাই। আপনের আব্বার আমারে নাকি ম্যালা পছন্দ হইছে। আমার আব্বার কাছে প্রস্তাব দেওনের পর ফিরায় দিছিলো। আপনের মায়ের অসুস্থতার কথা কইয়া আমার আব্বারে রাজি করাইছে। আপনের মার নাকি আমারেই পছন্দ। আমারেই হের পোলার বউ হিসাবে দেখতে চায়। তারপর আমার বাপে আর ফিরাইয়া দিতে পারে নাই।”
তামজিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে উঠল,
“তুমি এভাবে কেনো কথা বলো সবসময়? কালকেই তো কত সুন্দর করে কথা বললা।”
তারিন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
“আমাগো গ্রামের আঞ্চলিক ভাষা এইডা। আমি এমনেই কথা কইয়া শান্তি পাই। আঞ্চলিক ভাষা কইতে আবার লজ্জা কিসের? আঞ্চলিক ভাষায় কথা কইয়া যেই শান্তি পাওয়া যায়। আপনেগো শুদ্ধ ভাষায় ওই শান্তি আমি পাইনা। তাই আমি এই ভাষাতেই কথা কমু। যেই সময় শুদ্ধ ভাষার দরকার পড়ব। হেই সময় শুদ্ধ ভাষাতেই কথা কমু। বুঝছেন?”
তামজিদ এইসব প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বলল,
“তোমাকে একটা অনুরোধ করব?”
“করেন।”
“দিশাকে আর কিছু বলো না, প্লিজ। আমি জানি তুমি তোমার জায়গায় ঠিক। কিন্তু দিশার অবস্থাটাও একটু বুঝো। দিশার তো এখানে কোনো দোষ নেই। তাহলে ও কেন শুধু শুধু অপমানিত হবে? যত যা অপমান করার আছে আমাকে করো। আমি দোষী। আমার দোষের শাস্তি আমাকেই দিও। দিশাকে না, প্লিজ।”
তারিন কিছু বলল না। চুপ করেই রইল। তামজিদ একটু থেমে পুনরায় বলতে লাগল,
“তুমি আমার স্ত্রী। আমি একটা মেয়ের জীবন এলোমেলো করেছি ঠিকই। কিন্তু তোমার জীবন এলোমেলো করবো না। আমি তোমার জীবন সুন্দর করে সাজিয়ে তুলব। তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করব। ঢাকা নিয়ে তোমাকে ভালো কলেজে ভর্তি করাবো। স্বামী হিসেবে আমার যা যা দায়িত্ব, কতব্য রয়েছে সব পালন করব। তোমার সব পরিস্থিতিতে আমি তোমার পাশে থাকব। ছায়া হয়ে আগলে রাখব৷ তোমাকে কখনো সামান্য কষ্টটুকু পেতে দিবো না। শুধু…।”
“শুধু ভালোবাসতে পারবেন না এই তো?”

#চলবে

(রিচেক দেইনি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here