চন্দ্রাণী(০৩)

0
138

#চন্দ্রাণী(০৩)
ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে চন্দ্র।মনটা ভীষণ ফুরফুরে। বাড়িতে যাওয়ার আনন্দে তার চোখ মুখ ঝলমল করছে।
বাড়ি শব্দটা কেমন এক অদ্ভুত মায়াময় ব্যাপার আছে। যত দূরেই যাওয়া হোক,যত দামী আর আরামদায়ক স্থানেই থাকা হোক,বাড়ির কথা মনে হলে সবারই মনে হয় বুকটা কেঁপে ওঠে। বাড়ি শব্দটা মনে হলেই মনে হয় কেমন শান্তিময় একটা স্থান যেখানে মায়ের গায়ের গন্ধ আছে,বাবার আদর আছে,ভাই বোনের আবদার আছে।
চন্দ্র ব্যাগ খুলে এক প্যাকেট আচার নিয়ে খেতে লাগছে।

কুসুমপুর রেলস্টেশনে শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ হলো। হাতে একটা ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কেউ বলে নি তবুও সে জানে আজ বড় আপা আসবে।বড় আপা আসা মানে শুভ্রর জন্য ঈদের মতো ব্যাপার। প্রতিবারই বড় আপা ওর জন্য অনেক রকম খাবার নিয়ে আসে,কাপড় নিয়ে আসে।তখন দুই বোনের আদরে শুভ্রর ইচ্ছে করে সারাজীবন সময়টা ধরে রাখতে।

চন্দ্র স্টেশনে নেমেই দেখে শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে। অবুঝ শিশুর মতো তাকিয়ে রইলো শুভ্র।আপাকে নামতে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। মনের মধ্যে থাকা অস্থিরতা যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো চন্দ্রর।

বাড়িতে আজকেও রান্নাবান্নার তোড়জোড়। বাড়ির বড় মেয়ে আসছে বাড়িতে।শর্মীর মনটা বিষন্ন হয়ে আছে তার। আপার জন্য ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছে, শর্মীর ইলিশের ঘ্রাণ সহ্য হচ্ছে না। পেটের ভেতর কেমন মোচড় দিচ্ছে।
ওড়না নাকে পেঁচিয়ে শর্মী বসলো রান্নাঘরে। সেতারা বানু কচুর লতি কাটছেন বসে।এক ঝলক শর্মীর দিকে তাকিয়ে বললেন,”ওই ছেমরি,নাকে কাপড় বানছস ক্যান? ”

শর্মী মাছ উল্টাতে উল্টাতে বললো, “মাছের গন্ধে আমার নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসবে দাদী। ”

সেতারা বানু অবাক হয়ে বললেন,”পোয়াতি মহিলাগো মতন কথা ছেমরির।ইলিশ মাছের লাইগা পাগল নিজে অথচ এহন নাকি গন্ধ লাগে।”

শর্মী চমকে উঠলো দাদীর কথা শুনে। সর্বনাশ!তার তো এই ব্যাপারটা মাথায় ছিলো না। সে তো ভুলেই গেছে তার মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকা আরেকটা প্রাণের কথা।
কতদিন এভাবে লুকিয়ে রাখবে সে!
বড় আপার এখনো বিয়ে হয় নি,আব্বার কতো স্বপ্ন আপাকে মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর বিয়ে দিবে।আপা কতো জিনিয়াস স্টুডেন্ট সেটা শর্মীর চাইতে ভালো কে জানে!
অথচ তার জন্য আপার ও বদনাম হবে,সে না হয় নিজের জীবন নিজে ধ্বংস করে দিলো কিন্তু আপার জীবন ও তো ধ্বংস হয়ে যাবে।

ভাবতে ভাবতে নিজের দুই চোখ ভিজে উঠলো। কড়াইতে ভাজতে থাকা মাছ পুড়ে যেতে লাগলো।
রেহানা ছুটে এসে দেখে মেয়ে আনমনা হয়ে বসে আছে। তাড়াতাড়ি কড়াই চুলা থেকে নামিয়ে শর্মীর পিঠে চড় লাগালেন।
ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, “মেয়েটা এতো দিন পর আসতেছে আর তুই মাছগুলো পুড়িয়ে ফেললি?”

শর্মী আনমনা হয়ে ভাবতে বসে যাওয়ায় টের পায় নি মাছ পুড়ে গেছে। রেহানা মেয়েকে সরিয়ে মোড়ায় বসলেন।শর্মী ছুটে গিয়ে আরেকটা ইলিশ মাছ ভিজতে দিলো।

রেহানা মেয়ের চলাফেরায় পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন । কি হয়েছে মেয়েটার?
কয়েক দিন ধরেই দেখছেন খাওয়া দাওয়া করছে না।ভীষণ হাঁসফাঁস করে। বুঝতে পারছেন না কিছু তিনি।

চন্দ্র রিকশা থেকে নেমে আগে কাচারি ঘরে ঢুকলো। শাহজাহান তালুকদার থানার ওসির সাথে আলাপ করছেন।চন্দ্র ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। শাহজাহান তালুকদার মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো, “আপনি আসছেন আম্মাজান।আমার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছে আপনারে দেইখা। যান আম্মা,ভেতরে যান আপনার আম্মা তো অস্থির হইয়া আছে।”

চন্দ্র ভেতরে গেলো।মুহুর্তেই রেহানার কান্নার রোল পড়ে গেলো। প্রতিবার চন্দ্র যেদিন আসে আর যেদিন যায় রেহানা এমন কান্নাকাটি শুরু করে।
চন্দ্র রুমে গিয়ে শর্মীকে খুঁজতে লাগলো। বাথরুমে ঢুকে শর্মী তখন বমি করছে।
গত রাতে একবার ঠিক করেছে সকালে উঠে সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবে যেখানে কেউ তাকে চেনে না।
সেই মতো সকালে ঘুম থেকে উঠে যায় তাড়াতাড়ি। উঠে দেখে মা রান্নাঘরে।
অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারে আপা আসবে।
মনটা আর মানলো না।কতদিন আপাকে দেখে নি,আপাকে এক নজর দেখে পরের দিন যাবে বলে ঠিক করে নিলো।

চন্দ্র বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো, “সারাদিন কি বাথরুমেই কাটিয়ে দিবি না-কি শর্মী?”
শর্মী বাথরুমে ফ্ল্যাশ করে স্প্রে করে দেয়।তারপর হাতমুখ ধুয়ে মাথায় পানি দিয়ে বের হয়ে আসে।

চন্দ্র শক্ত করে বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আহ,শান্তি এবার।এতক্ষণ কেমন অসম্পূর্ণ লাগছিলো তোকে দেখতে না পেয়ে।”

শর্মী আলগোছে চোখ মুছলো।মনে মনে বললো, “আপা, আমাকে ক্ষমা করে দিস তুই।আমি যে পারবো না থাকতে তোদের মধ্যে। ”

চন্দ্র ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি বের করে বললো, “এই দেখ,তোর না একটা গাদোয়াল শাড়ির শখ ছিলো।দেখ আমাদের ম্যাচিং শাড়ি।কোনটা নিবি?গোলাপি নাকি মেরুন?”

শর্মী ফ্যাকাসে হেসে বললো, “তুই একটা সিলেক্ট করে দে আপা।”

চন্দ্র বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, “আপসেট কোনো কিছু নিয়ে? মাছ পুড়িয়ে ফেলায় কি রেহানা বেগম এক ডোজ দিয়েছে তোকে?”

শর্মী হাসলো।মা এমন কোনো কথা নেই যা আপাকে বলে না। বাড়ির পোষা কুকুর লালু দিনে কতবার ঘেউঘেউ করে মা তা-ও বোধহয় আপাকে জানায়।
আপার প্রতি মায়ের যেই টান,বাবার যেই আদর সেটা থেকে তাদের বাকি দুই ভাই বোনের জন্য একটু কম আছে।অবশ্য এর জন্য তাদের আক্ষেপ নেই,বরং ভালোবাসা সমান সমান হলে বোধহয় আপার প্রতি অন্যায় হতো। আপার মতো শান্ত আর ভদ্র মেয়ে পুরো গ্রামে কেউ পাবে না খুঁজে।

শর্মী বললো, “তুই বোস আপা,আমি লেবু শরবত করেছি তোর জন্য , ফ্রিজে রাখা আছে নিয়ে আসি।”

শর্মী যেতেই চন্দ্র একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। বিড়বিড় করে বললো, “আমি সব জানি বোন।তুই ভয় পাস না,তোর আপা সব ঠিক করে দিবে।”

গতকালই চন্দ্র জানতে পেরেছে বোনের সাথে নিয়াজের সম্পর্কের কথা। বোকা মেয়ে বুঝলো না নিয়াজ তাকে ব্যবহার করতে চাইছে। তবে সে বুঝেছে।আর এর ব্যবস্থা ও চন্দ্রর জানা আছে।

দুপুরে সবাই মিলে একসাথে খেতে বসলো। শর্মী খাচ্ছে আর প্লেটে চোখের জল ফেলছে।দুই চোখ কোনো বাঁধা মানছে না তার।
এটাই হয়তো বাবা মা ভাই বোনের সাথে শেষ খাওয়া।

————–

টগর বসে আছে কাদের খাঁনের কাচারিতে। হাতে কতগুলো লিফলেট। মাথার উপরে ফ্যামটা ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছে।অথচ বাতাস গায়ে লাগছে না।টগরের পরনের নীল শার্ট ময়লা জমতে জমতে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
নিয়াজ একটা বোতল টগরের হাতে দিয়ে বললো, “যা কাম লেগে যা।সবার বাড়ি বাড়ি যাবি।”

টগর হাসিমুখে বোতলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার আজকের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। শার্টের ভেতরে বোতলটা লুকিয়ে টগর বেরিয়ে গেলো লিফলেট বিলি করতে।
নিয়াজ টগরের গমনপথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “শালার কপাল।একটা ভদ্র,শিক্ষিত পোলা এমন কইরা নষ্ট হইবো কেউ কি ভাবছে কোনো দিন?”

পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে টগর সিগারেটে আগুন ধরালো।টগরের বাবা মারা যান টগরের জন্মের ৪ বছর পর আর মা মারা যায় টগর অনার্স ফাইনাল ইয়ারে থাকার সময়। তারপর থেকেই ছেলেটা কেমন যেনো হয়ে গেছে। আগে মা সহ শহরেই ছিলো। গ্রামে ফিরে এসেছে বছর তিনেক হলো।
এক মাথা লম্বা চুল, মুখভর্তি খোঁচাখোঁচা দাড়ি।পরনে একটা ট্রাউজার আর শার্ট।

বিকেলে তিন ভাইবোন রাস্তায় হাটতে বের হয়েছিলো।শর্মীর মন ভালো করতেই বের হয়েছে তিনজন। টগর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তেই চন্দ্রর নাকে লাগে গন্ধ।

বিরক্ত হয়ে চন্দ্র দাঁড়িয়ে বললো, “মাতাল না-কি লোকটা?এভাবে হাটছে কেনো? ”

টগর পেছন থেকে যেতে যেতে বললো, “জি ম্যাডাম,মাতাল।তবে জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক আছি।”

শুভ্র বোনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো।শর্মী আবারও বমি করছে।

চলবে….
রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here