#চন্দ্রাণী (০২)
ছাদের খোলা দরজা দিয়ে নিয়াজ নিচে নেমে এলো। অন্ধকার সিড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে এক ছুটে খোলা দরজা দিয়ে শর্মীর রুমে।নিয়াজ শর্মীর রুমে ঢুকতেই সদর দরজার পর্দার পাশ থেকে একটা কালো ছায়া নীরবে সরে গেলো।
দরজা বন্ধ করে নিয়াজ শর্মীকে জড়িয়ে ধরলো। উত্তেজনায় কাঁপছে শর্মী।ঠিক যেদিন নিয়াজ কে বিয়ে করলো সবাইকে লুকিয়ে সেদিনের মতো বুক ঢিপঢিপ করছে তার।
নিয়াজ রুমে ঢুকেই শর্মীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। শর্মী নিয়াজের খোলা বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বললো, “এভাবে আর কত দিন? আমার এমনটা ভালো লাগে না নিয়াজ।কবে সবাইকে জানাবে তুমি? ”
নিয়াজ শর্মীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার অনেক কিছু।
বেশ খানিকক্ষণ দুজন অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর পর নিয়াজ শর্মীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। তারপর পকেট থেকে একটা প্রেগন্যান্সি টেস্ট কীট শর্মীর হাতে দিয়ে বললো, “চেক করে আসো তো শর্মী।”
নিয়াজের বুকের ভেতর দামামা বাজছে।এবার তাহলে সব প্ল্যানমাফিক হবে।
গত কয়েকদিন ধরেই শর্মী বলছিলো তার শরীর ভালো লাগছে না।কেমন অস্বস্তি লাগছে খাবার খেতে। নিয়াজ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে অপেক্ষা করছে শর্মী ফিরে আসার।
একটু পর শর্মী ফিরে এলো।লাজুক হেসে নিয়াজের দিকে কীটটা এগিয়ে দিলো।নিয়াজ যখন দেখলো পজিটিভ তখনই নিজের আসল রূপে ফিরে গেলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, “এখন কি হবে শর্মী।এই অবস্থায় কিছুতেই জানানো যাবে না কাউকে আমাদের বিয়ের কথা। এখন নির্বাচন সামনে। আবার নির্বাচনের পর আমার বাপ হারুক অথবা তোমার বাপ, তখন তো মাথা এমনিতেই গরম থাকবো ওনাদের।আরো ৫-৬ মাস সময় লাগবে আমাদের। ”
শর্মীর চেহারা থমথমে হয়ে গেলো। চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, “মাথা ঠিক আছে তোমার? ৫-৬ মাস এর আগেই তো সবাই বুঝে যাবে আমি প্রেগন্যান্ট। ”
নিয়াজ বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি কি করবো বল আমাকে?তাইলে চল এবোরশন করিয়ে ফেলো।”
শর্মীর মাথায় যেনো বাঁজ পড়লো।এবোরশন!
শর্মী করাবে এবোরশন!যেই শর্মী মায়ের মতো মমতা দিয়ে ভাইকে বড় করেছে, বাচ্চা দেখলে যেই শর্মী কোলে তুলে নেয় সে কি-না নিজের সন্তানকে হত্যা করবে!
নিয়াজের শার্টের কলার চেপে ধরে শর্মী বললো, “কি বললা তুমি? আবার যদি এই শব্দ উচ্চারণ কর তাহলে খুব খারাপ হবে।”
নিয়াজ শর্মীর হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে বের হয়ে গেলো দরজা খুলে। শর্মী হতভম্ব হয়ে বিছানায় বসে রইলো।
দুই চোখ দিয়ে আপনাতেই পানি পড়ছে শর্মীর।নিয়াজ এসব কি বলছে!
শর্মী নিজেকে শান্ত করে নিয়াজকে কল দিলো। এখন রাগারাগি করার সময় না।নিয়াজকে ঠান্ডা মাথায় বুঝাতে হবে।
নিয়াজ শর্মীর বাসা থেকে বের হয়ে বাজারে চলে গেলো। মগার দোকানের পেছনে বসেছে নেশার আড্ডা।ইয়াবা,মদ,সিগারেট নিয়ে বসেছে কয়েকজন।
একটা বেঞ্চিতে চিৎ হয়ে শুয়ে টগর সিগারেট টানছে।এই মাত্র একটা বোতল খালি করেছে সে।নিয়াজ এসে সেই আসরে বসে গেলো।
ফোন বাজতেই নিয়াজ বিরক্ত হয়ে ফোন তুললো। তারপর সরে এলো একপাশে জঙ্গলের পাশে।
রিসিভ করে বললো, “কল দিছস ক্যান?তেজ দেখাইছস না আমারে?এখন ক্যান কল দিলি?”
শর্মী হতভম্ব হয়ে গেলো নিয়াজের মুখে এরকম কথা শুনে। এসব কি নিয়াজ বলছে তাকে?একটা মানুষের মুখের ভাষা এতো জঘন্য!
টগর টলতে টলতে জঙ্গলের এক পাশে প্রস্রাব করতে বসলো। তারপর মাথা ঘুরে সেখানেই ধপ করে পড়ে গেলো।
নিয়াজ সেদিকে এক নজর তাকিয়ে এক দলা থুথু ফেললো। শালার অভারলোড হয়ে গেছে।
শর্মী যথেষ্ট শান্তভাবে বললো, “নিয়াজ,তোমার সবাইকে জানাতে হবে আমাদের বিয়ের কথা। ”
নিয়াজ আবারও এক দলা থুথু ফেলে বললো, “কিসের বিয়ে? কার বিয়ে?”
শর্মীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কি বলছে নিয়াজ এসব?
এভাবে অস্বীকার করছে কেনো সে শর্মীকে?
নিয়াজ বললো, “দেখো শর্মী,আমার এখনো বিয়ের বয়সই হয় নি,বাচ্চাকাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া তো পরের কথা।তাই তুমি আমার সাথে যদি থাকতে চাও তবে তোমার এবোরশন করতে হবে।তা না হলে আমি জানি না।”
শর্মী বিড়বিড় করে বললো, “জানোয়ারের ঘরে জানোয়ারই হয়।তোকে বিশ্বাস করা আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।”
নিয়াজ হেসে বললো, “থ্যাংকস ডার্লিং। ”
কল কেটে শর্মী আছড়ে ভেঙে ফেললো ফোনটা।মথার ভেতর কেমন দপদপ করছে।
কি করবে এখন সে!
সামনে বাবার নির্বাচন, এই সময় এসব জানাজানি হলে তো!
ভাবতে পারছে না কি করবে।বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে উপরের দিকে তাকাতেই ফ্যানের দিকে নজর গেলো তার।
তখনই বুদ্ধি মাথায় এলো।
চন্দ্র ক্লাস শেষে ভার্সিটির লাইব্রেরিতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। শরীর ভীষণ ক্লান্ত তার।তার উপর আজকে সবগুলো ক্লাস করতে হবে।দুই ঘন্টা পর খোকন স্যারের ক্লাস।ক্লাসে এটেন্ড না করলে মনে হয় মিসাইল ছুঁড়বেন তিনি তার উপর।
কে জানে কেনো এই বদখত লোকটা তাকে ভীষণ অপছন্দ করে।
দুই ঘন্টার জন্য চন্দ্র আর হলে গেলো না।
লাইব্রেরিতে গিয়ে নিজের নোট রেডি করতে বসলো। এতে করে সময় দ্রুত কেটে যাবে।
লিমন এসে চন্দ্রর পাশে বসে ফিসফিস করে বললো, “কি রে,তুই না-কি এবারের ট্যুরে যাচ্ছিস না?”
চন্দ্র মাথা নেড়ে বললো, “হ্যাঁ যাচ্ছি না। ”
লিমন ফিসফিস করে বললো, “দূর! তুই না গেলে মজা হবে না।চল না দোস্ত।আমাদের গ্যাংটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তোকে ছাড়া।”
চন্দ্র ফিসফিস করে বললো, “আব্বার ইলেকশন আছে।আমাকে গ্রামে যেতে হবে ১০-১২ দিন পর। ট্যুর কোনো ভাবেই আমি দিতে পারবো না। ”
লিমন ব্যথিত হলো খুব।ভেবেছিলো এবার ট্যুরে গেলে সবার সামনে নীলগিরিতে উঠে চন্দ্রকে সে প্রপোজ করবে।ইউটিউব দেখে অনেকগুলো কৌশল ও শিখেছে লিমন।
চন্দ্র না গেলে কিভাবে হবে!
লিমন আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু চন্দ্রর সামনে বসা ছেলেটার বিরক্তি প্রকাশ দেখে চুপ করে রইলো সে।
চন্দ্র ফোন বের করলো টাইম দেখার জন্য। এখনো একঘন্টার মতো বাকি আছে। পেটের মধ্যে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। চন্দ্র উঠে গেলো ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে।
লিমনের খপ্পর থেকে রেহাই পেয়ে স্বস্তি পেলো চন্দ্র।কয়েকদিন ধরে লিমনের ভাবভঙ্গি ওর ভালো লাগছে না।এই যে অতিরিক্ত যত্ন করা ব্যাপারটা, চন্দ্র অনুভব করে এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে। সে লিমনকে সেই সুযোগ দিতে চায় না।
এক কাপ চা আর দুটো সিঙ্গারা নিয়ে চন্দ্র বসলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। আজকেও একটা চিঠি পেয়েছে সে।চিঠি পড়ার পর থেকে চন্দ্রর মনটা অস্থির হয়ে আছে।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চন্দ্র ক্লাসে গেলো।পরবর্তী সময়টা চন্দ্রর জন্য ভীষণ বিরক্তিকর কাটলো।
সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে চন্দ্র শুয়ে পড়লো তখন কল এলো। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখে আব্বা কল দিছে।আপনাতেই চন্দ্রর মুখ হাসিহাসি হয়ে গেলো, সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো।
চন্দ্র কল রিসিভ করতেই তার বাবা সালাম দিয়ে বললো, “আমার আম্মাজান কি আইজ বেশি ব্যস্ত আছিলো? ”
চন্দ্র যেদিন বাড়িতে কথা বলে না দিনে,রাত হলেই তার বাবা কল দেয় তাকে।সারাদিন এতো ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও মেয়ে যে কল দেয় নি সেই ব্যাপারটা বাবা মাথায় রাখে বলেই চন্দ্রর বুক আনন্দে ভরে উঠে।
বাবা বললেই যেমনটা মনে ভেসে উঠে তার বাবা ঠিক তেমনই।
শাহজাহান তালুকদার ভেজা কণ্ঠে বললো, “আম্মা এইবার কিন্তু ৪ মাস হইছে আপনে আসেন নাই।”
চন্দ্র হেসে বললো, “আব্বা,আমি আগামীকালই আসবো।ভাবছিলাম আরো ১০-১২ দিন পর যাবো কিন্তু এখন আপনার কথা শুনে আর ভালো লাগছে না।”
আনন্দিত হয়ে শাহজাহান তালুকদার বললো, “ঠিক আছে আম্ম,আমি লোক পাঠাই রাখমু স্টেশন। ”
বাড়িতে যাবার আনন্দ নিয়ে চন্দ্র শুয়ে পড়লো।
চলবে……