এক মুঠো প্রণয় (সিজন টু)পর্ব ৫

0
129

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০৫
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

যাকে ভালোবাসে তাকে স্বামী হিসেবে পাওয়া যেমনটা বাঁধহারা সুখের বিষয় ঠিক তেমনই যাকে ভালোবাসে তাকে স্বামী হিসেবে না পাওয়ার বেদনাটাও আকাশসম। মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ সেদিন সাঈদের জম্মদিন ছিল বলেই সে, নাবিলা, নুসাইবা, সামান্তা সহ সাঈদের জম্মদিনের আয়োজন করেছিল বাড়ির ছাদে। কিন্তু কে জানত সে ঘটনার জন্য সাঈদ সেদিন রেগে যাবে। পুরোপুরি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে সেদিনের পর।কল,ম্যাসেজ, সোশাইল সাইট সব থেকেই উধাও হয়ে গেল ছেলেটা হঠাৎ। অস্বস্তিতে মেহেরাজকেও জিজ্ঞেস করতে পারেনি সাঈদের কথা। এমনটা নয় যে সাঈদ আর মেহুর মাঝে পাকাপোক্তভাবে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এমনটা ও নয় যে তারা কখনো কাউকে মুখ ফুটো ভালোবাসার কথা বলেছিল। তবুও কোথাও কি কিছুই ছিল না? সাঈদ এভাবে ভুলে বসল মেহুকে? বেদনায় মুখ কালো হয়ে উঠল মেহুর। কিন্তু তার চেয়েও যন্ত্রনার বিষয় হলো অন্য একটা পুরুষকে বিয়ে করা, তার সাথে সংসার করাটা।কে জানত এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তাকে৷ কে জানত গ্রাম ছেড়ে আসার পর নিজ বাসায় উঠার পর তার জন্য এমন কোন বিস্ময় অপেক্ষা করছে?কল্পনায় ভাবল গতকাল বিকালের ঘটনা,

বিকাল হতেই পরিচিত কয়েকটা মুখের দেখা পেল মেহু।তার বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রী।বাকিরা তার চাচা-চাচীরা। এর আগেও অসংখ্যবার মেহুদের বাসায় এসেছেন উনারা। মেহু সালাম দিল।বসতে বলে কিয়ৎক্ষন আলাপও করল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ব্যস্ত হলো নাস্তা বানাতে। মেহেরাজ রান্না ভালো পারে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সেই রান্না করত সবসময়। অন্যদিকে মেহু রান্নায় কাঁচা। ভাইকে পাশে থেকে সাহায্য করা পর্যন্তই তার দৌড়। আজ মেহেরাজ বাসায় উপস্থিত না থাকাতেই তাকে রান্না করতে বেগ পেতে হলো। তড়িঘড়ি করে কাঁচা হাতে কিছু তৈরি করতেই হঠাৎ এক সুন্দর, মুগ্ধময় কন্ঠ ভেসে আসল কানে,

“ একি মিস!রান্নাও পারেন? আমার জানামতে তো পারতেন না আগে।”

মেহু পিঁছু ফিরে চাইল। ছেলেটার মুখটা চেনাচেনা ঠেকল ঠিক তবে চিনে উঠল না তখনই। পরমুহুর্তেই যেন চিনতে পারল। বিড়বিড় করে শুধাল,

“ আপনি? ”

“জ্বী, আমিই!আপনার না হওয়া বর।”

মেহু ছেলেটাকে চেনে। তার বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধুরই ছোট ছেলে।নাম মেঘ।শেষবারের মতো সেই বছর চারেক আগে দেখা হয়েছিল।তখনকার চেনা পরিচিত ছিল বলেই কথাটা মজা হিসেবেই নিল। বলল,

“এতকাল কোথায় ছিলেন? দেখা পাইনি যে আপনার। ”

মেঘ এবার ভ্রু উঁচাল। উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কেন কেন?ভীষণ মিস করেছিলে বুঝি আমায়? ”

মেহু অল্প হাসল। উত্তরে বলল,

“ আরেহ না, আমি ছেলেদের মিস টিস করি না। এতকাল পর দেখা হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”

মেঘ এগিয়ে এল। মেহুর দিকে তাকিয়ে শুধাল,

“চিন্তা নেই।এখন থেকে রোজ রোজ দেখা হবে মিস মেহু। ”

“ কেন? রোজ রোজ কেন দেখা হবে? ”

“ কেন? দেখা হলে সমস্যা হবে তোমার? ”

মেহু মিনমিনে চোখে তাকাল। কিছু বলবে সে মুহুর্তেই মেহেরাজ উপস্থিত হলো। মেহুর দিকে তাকিয়েই ব্যস্ত গলায় বলল,

“ একি কি করছিস তুই এখানে? হাত পুড়ে যেত যদি? সর।”

মেহু সরে আসল বাধ্য মেয়ের মতো৷ ভাইয়ের দিকে তাকিয়েই বলল,

“ তুমি তো বাসার বাইরে ছিলে ভাইয়া। হঠাৎ বাসায় এলে যে? ”

মেহেরাজ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

“ তোর সাথে কিছু কথা বলব মেহু। খুব মনোযোগ নিয়ে শুনবি। আর জানবি ভাইয়া তোকে ভালোবাসে। তোর খারাপ চায় না সে। ”

মেহু জানে মেহেরাজ তার খারাপ চায় না। তবে হঠাৎ এই কথা কেন বলল?কিই বা বলবে? মাথা নাড়িয়ে বলল,

“হ্যাঁ বলো, ভাইয়া।”

“ তুই রুমে যা। আমি ততক্ষনে সবার জন্য নাস্তা নিয়ে রেডি করছি। তারপর বলব৷ ”

মেহু এবারেও বাধ্য মেয়ের মতোই মাথা নাড়াল। দ্রুত চলে গেল নিজের ঘরে। ঠিক তখনই মেহেরাজ লম্বাশ্বাস ফেলল। গম্ভীর গলায় শুধাল,

“ ইন্টার্নি শেষে অন্য দেশে চলে যাবে শুনলাম? তুমি ছেলে হিসেবে পার্ফেক্ট হলেও এই দূরত্বের বিষয়টা ভাবাচ্ছে আমায়। ভালো রাখবে তো আমার বোনকে? ও খুব চাপা আর নরম মনের মেয়ে মেঘ।”

মেঘ ঠোঁট এলিয়ে হাসল। আশ্বাস দিয়ে বলল,

“ এটুকু বলব যে আপনার বোনকে খারাপ থাকতে দিব না ভাইয়া। ওর সকল খারাপ আমার হোক এটাই চাইব আমি।”

মেহেরাজ তাকাল। গম্ভীর অথচ শান্ত গলায় শুধাল,

“ ভালোবাসার সংজ্ঞা কি জানোতো মেঘ?যাকে ভালোবাসবে তাকে অবশ্যই ভালো রাখার দায়িত্বটুকুও নিতে হবে। তুমি ভালোবাসো আমার বোনকে এটা আমি অনেক আগেই জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার বোন যদি ভালো না থাকে সেক্ষেত্রে কিন্তু আমি অবশ্যই মত পাল্টাব। ”

মেঘ মাথা নাড়াল। বলল,

“আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি, জানি আপনার সিদ্ধান্ত ভুল হবে না। ”

কথাটা বলেই মেঘ চলে গেল। মেহেরাজও নিজ কাজে ব্যস্ত হলো। কিয়ৎক্ষন পর কাজ সেরে মেহুর ঘরে গেল। ততক্ষনে অবশ্য মেহুর কাছে সবটা জানা। কিছুটা সময় আগেই চাচী এসে বলে গিয়েছেন সবটা। ছোটবেলাতেই নাকি তার বাবা মা তার আর মেঘের বিয়ের বিষয়টা ঠিক করে রেখেছিলেন। দুই পরিবারই সে সিদ্ধান্তে অনেকটা খুশি ছিল। ঠিক করেছিলেন বড় হলেই সবটা জানাবেন ছেলেমেয়েদের। কিন্তু তার আগেই তো মেহেরাজের বাবা-মা একটা এক্সিডেন্টে মারা গেল।কিন্তু এতবছর পরও সবাই চাইছে সে সিদ্ধান্তটাই বাস্তবে পরিপূর্ণ হোক। চাচা-চাচীদের সবাইই রাজি, মেহেরাজের নাকি ছেলেকে খুব পছন্দ হয়েছে। শুধু মেহুর মতটাই নেওয়া বাকি।মেহু কি আসলেই অমত করতে পারবে? বাবা মায়ের পর যে চাচা চাচীরা তাদের অভিভাবক ছিলেন তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলতে পারবে? যে ভাই তাকে বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে দুই হাতে আগলে রেখেছে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অমত করবে? মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টলমল চোখে বলল,

“ তুমি সবটা জানতে ভাইয়া ? ”

মেহেরাজ ক্লান্তির শ্বাস নিল। এগিয়ে এসেই বোনের দুইহাত হাতে নিয়ে কোমল স্বরে বলল,

“ জানতাম মেহু।বিষয়টা চাচাদের কাছেই শুনেছিলাম কিছুবছর আগে। এমন নয় যে মেঘ ছেলে হিসেবে খারাপ। ছেলেটা তোকে ভালোবাসে। আমার বিশ্বাস সে তোকে ভালো রাখবে। তবে আজ এভাবে হঠাৎ উনারা আসবেন জানা ছিল না আমার। হঠাৎই এভাবে বিয়ের প্রস্তাব
নিয়ে আসাটা কেমন অযৌক্তিক বোধ হলো। আমি তোকে সেদিন এই কারণেই জিজ্ঞেস করেছিলাম কাউকে ভালোবাসিস কিনা, বা পছন্দ আছে কিনা। তুই বলেছিলি কোন পছন্দ নেই। সে হিসেবেই আমি উনাদের প্রস্তাবে মত দিতে চেয়েছি।বাকিটা তুই যা বলবি তাই, তুই না বললে আমি এক পা ও সামনে যাব না মেহু। ”

মেহুর মনে পড়ল সেদিন বাড়ি থেকে ফেরার পর মেহেরাজ জিজ্ঞেস করেছিল সে কাউকে ভালোবাসে কিনা। সংকোচে আসল উত্তরটা না দিয়েই বলেছিল কাউকে ভালোবাসে না সে। কিন্তু বিষয়টা যে এই কারণেই জিজ্ঞেস করেছিল জানা ছিল না তার। অস্ফুট স্বরে বলল,

“কিন্তু..

বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই মেহেরাজ ফের বলল,

“ কাউকে ভালোবাসিস বোন? আবারও জিজ্ঞেস করছি, ভালোবাসিস কাউকে? ”

মেহু বলে দিতে চাইল সাঈদের প্রতি তার অনুভূতিটা। পরমুহুর্তেই আবার চুপ হয়ে গেল। তাদের মাঝে যে সম্পর্কটা পাকাপোক্ত প্রেমের নয়। হতেই পারে সাঈদ বাকি সবার মতোই তার সাথে ফ্লার্ট করেছিল।তাই সত্যটা চাপা রাখল তখনও। ধরা গলায় বলল,

” আমাকে কি কিছুটা সময় দেওয়া যাবে ভাইয়া? আমি কিছু বুঝে উঠছিনা। কিছুই না।অন্তত একটা দিন সময় দাও।”

মেহেরাজে নরম চাহনীতে চাইল। উঠে গিয়ে মেহুর মাথায় হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে শুধাল,

“ যত ইচ্ছে সময় নে মেহু।আমি তোকে জোর করছি না একবারও। তোর মত যা হবে সিদ্ধান্তটা তাই হবে।”

মেহেরাজ এই বলেই বোনের মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করল। পরমহুর্তেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অপরদিকে মেহুর চাহনি নিষ্প্রভ। সেই নিষ্প্রভ চাহনি নিয়েই তাকিয়ে রইল ভাইয়ের যাওয়ার দিকে।

.

মেহু গতকাল বিকালের কথাগুলো কল্পনায় ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল।গতকাল থেকে টানা কল দিয়ে যাচ্ছে সাঈদকে। অথচ ছেলেটা কল তুলেনি। কি হলো ছেলেটার? মেহু চিন্তিতি হলো।দীর্ঘশ্বাস টেনে তাকিয়ে রইল আঁধারে ঘেরা রাতের আকাশের দিকে।আজ কি আকাশেরও মন খারাপ? নয়তো এতো আঁধার কেন? মনের কোণে প্রশ্নগুলো জাগতেই মোবাইলে কল এল।অনেকটা চমকেই গেল সে স্ক্রিনে তাকিয়ে। সাঈদের কল!দেরি করল না সে। দ্রুত কল তুলতেই শোনা গেল সাঈদের গলা,

“ শুভকামনা মেহু। নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা ”

মেহু ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

“নতুন জীবন?সাঈদ ভাইয়া? একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“ করো। ”

“আমায় বিয়ে করবেন? ”

মেহু গম্ভীর স্বরে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলেও সাঈদ উত্তরটা দিল মজার সহিতই। বলল,

“ ধুরর!আমার মতো ছেলেকে বিয়ে করে করবেটা কি? ”

মেহু ফের গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,

“আমাদের মাঝে কি কিছুই ছিল না সাঈদ ভাইয়া?”

সাঈদের গলা এবার সিরিয়াস হলো। উত্তর এল,

“ কি থাকবে?ছিল না, কিছুই না ছিল না। আমার মতো ছেলেদের কারো সাথে কিছু থাকতে পারে না মেহু ”

মেহু বিস্মিত হলো। ঠান্ডা গলায় আবারও জিজ্ঞেস করল,

“ আপনি আমায় ভালোবাসতেন না? ”

সাঈদ লম্বা শ্বাস ফেলল।উত্তরে বলল,

“ না, আমার দ্বারা কোন মেয়েকে ভালোবাসা সম্ভব নয় মেহু। ”

“ কেন? ”

সোজাসাপ্টা জবাব এল,

“ ঘৃণা করি মেয়েজাতিকে। ”

“কিন্তু আমি তো আপনাকে..”

বাকি কথাটা সম্পূর্ণ করতে দিল না সাঈদ। যে সত্য জানলে নিষিদ্ধ মানুষের প্রতি দুর্বলতা বাড়ে সে সত্য না জানাই বোধহয় উত্তম।যে সত্য প্রকাশ করলে নিষিদ্ধ কারোর সাথে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সে সত্য না জানানোই উচিত। তাই সাঈদ সত্যটা প্রকাশও করল না, সত্যটা জানাতেও দিল না। কথার মাঝপথেই বলল,

“ হুরর! কিছু না, ছেলেটা ভালো। অনেকটা ভালো! তোমায় ভালো রাখবে। সবচেয়ে বড় কথা আমার মতো ছন্নছাড়া নয়।বেশ গোছাল আর শান্ত। রাজের মতোই! আমি নিজেই খোঁজ নিয়ে দেখেছি। তার সাথে সুখী হবে তুমি মেহু। বিয়েটা করে নাও। ”

মেহুর গলা আটকে আসল৷ কান্নারা যেন দলা পাকিয়ে আছে। কাল থেকে মেঘের সাথে বিয়ের বিষয়টা নিয়ে যতোটা না কষ্ট হয়েছে তার চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে সাঈদ তাকে ভালোবাসে না ভেবে, সাঈদকে স্বামীরূপে পাবে না বলে, সাঈদ জীবনসঙ্গী হবে না বলে। সবটাই তাহলে একতরফা ছিল? মেহুর কান্না পেল। তবুও ধরে আসা গলায় জিজ্ঞেস করল,

“ আপনার কষ্ট হচ্ছে না?”

সাঈদ বলতে পারল না তারও কষ্ট হচ্ছেে।যন্ত্রনা হচ্ছে বুকের ভেতর! উত্তপ্ত লাভার ন্যায় এই যন্ত্রনাটা ছারখার করে দিচ্ছে তার ভেতরটা! তবুও বলা হলোনা। হাসি নিয়ে বলল,

“ধুররর!কষ্ট কেন হবে? তোমার বিয়েতে জমিয়ে খাবার খেতে হবে না? ”

“এভাবে তো বিয়ে হয় না। ”

“এটা কিন্তু তোমার মৃত বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিল মেহু।মেয়ে হিসেবে কি তোমার দায়িত্ব না বিয়েটা করা?আশা রাখি বিয়েটা হবে৷ আর আমি খুবই আনন্দের সহিত অপেক্ষা করছি তোমার বিয়েটা খাওয়ার জন্য। ”

কথাগুলো বলেই কল রাখল সাঈদ। মেহু থমকে গেল। চোখ বেয়ে বয়ে গেল কান্নার স্রোত। সত্যিই ভালোবাসত না? কিছুই ছিল না তাদের মাঝে?সবটাই একতরফা ছিল? মেহুর কষ্ট হলো। কান্না পেল। দমবন্ধ হয়ে আসল যেন। ঠিক তখনই মনে পড়ল জ্যোতির কথা৷মোবাইলে উদ্ভ্রান্তের মতো জ্যোতির নাম্বার টা খুঁজে নিয়েই কল লাগাল। ওপাশ থেকে জ্যোতি কল তুলা মাত্রই হুহু করে কেঁদে উঠল নিঃশব্দে। জ্যোতি প্রথম দফায় অবাক হলো। দ্বিতীয় দফায় জিজ্ঞেস করল,

“ মেহু আপু? এই মেহু আপু।তুমি ঠিক আছো? কাঁদছো কেন? ”

মেহু উত্তর দিল না। এবারে শব্দ করেই কেঁদে ফেলল। কাতর স্বরে বলল,

“ একটু সময় হবে তোর জ্যোতি? আমার কেউ একজনকে চাই মনের কথাগুলো খুলে বলার জন্য।দমবন্ধ লাগছে আমার। কাউকে কিছু শেয়ার করতে পারছি না। প্লিজ,প্লিজ, একটু সময় দে!”

জ্যোতি এবারেও অবাক হলো।এসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকা স্বত্তেও বলল,

“ হবে না কেন সময়? বলো মেহু আপু, কি হয়েছে?কেউ কিছু বলেছে তোমায়? ”

“ এভাবে যে পারব না বলতে৷ একবার আসবি আমাদের বাসায়? দমবন্ধ লাগছে জ্যোতি। কান্না থামাতে পারছি না আমি। ”

জ্যোতি থমকাল।ঘড়িতে সময় দেখে বুঝল রাত আটটা। এইসময়ে এভাবে মেহুদের বাসায় ছুটে যাওয়াটা কতোটা যুক্তিযুক্ত? তাও যেখানে মেহেরাজ ভাইয়ের উপস্থিতি আছে! মেহেরাজ যদি আবারও গায়ে পড়া মেয়ে বলে তাকে? আনমনে সেসব একবার ভাবলেও পরমুহুর্তে পাত্তা দিল না। আপাতত মেহুর কান্নাটাই জরুরী বিষয়। মুদু আওয়াজে বলল,

“ আমি তো যাইনি কখনো তোমাদের বাসায়। ঠিকানাটা বলো আপু।”

মেহু ঠিকানা বলল। জ্যোতিও তৈরি হয়ে বের হলো।মাথায় ঘুরছে অনেকগুলো চিন্তা।বিকালে দাদীর কাছে শুনেছিল তার আব্বার নাকি বুকে ব্যাথা উঠেছে।যে সে ব্যাথা নয়। গুরুতর বুকে ব্যাথা।প্রায় সময়ই নাকি এমন বুকে ব্যাথা হয় । তবুও ডাক্তারের কাছে যেতে নারাজ তিনি। কিন্তু বুকে ব্যাথাকে এভাবে অবহেলা করাও তো উচিত নয়।আবার অপরদিকে মেয়ে হিসেবে জোর করারও যে অধিকার নেই তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি। জীবনের সমীকরণগুলো বড্ড কঠিন। কেমন রুক্ষ জীবন তার!এসব ভাবতেই ভাবতেই রিক্সা পেয়ে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে রিক্সায় উঠে বসতে নিতেই ঘটল বিপত্তি। পাশের লোহাটার সাথে টান খেয়ে হাত কেঁটে গেল খানিকটা। অন্ধকারে অবশ্য বোঝা গেল না তা। তবে ব্যাথাটা স্পষ্টই টের পেল জ্যোতি। তবুও বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাল না ব্যাথা পেযে। চুপচাপ বসে থাকল।কিয়ৎক্ষন পর ঠিকানা অনুযায়ী মেহুদের এলাকায় পৌঁছেও গেল।পরে অবশ্য দুয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে নির্ধারিত বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে পৌঁছাল। গেইট পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েই হঠাৎ দেখা মিলল পরিচিত যুবকের।লম্বা চওড়া শরীরে কালো রংয়ের শার্ট আর কালো জিন্স প্যান্ট৷একনজর তাকায়িই নজর সরাল সে।মেহেরাজকে পাশ কাঁটিয়ে যেতে নিতেই কানে এল গম্ভীর গলা,

“ তুই? তুই এখানে? ”

জ্যোতি নিভুনিভু চোখে তাকাল। পরমুহুর্তেই মেহেরাজে দৃষ্টি দেখে কি যেন অনুভূত হলো। শিহরন বইল কি হৃদয় জুড়ে? নাকি পরিপক্ব জ্যোতি হঠাৎই নড়বড়ে অনুভব করল নিজের মাঝে? বুঝল না সে। তবে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে উত্তর দিল,

“ আপনাদের বাসাটা দোতালায় না মেহেরাজ ভাই? ”

মেহেরাজ সে প্রশ্নের উত্তর দিল না। বরং গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল,

“ কেন এসেছিস এখানে?”

জ্যোতি এবারে অপমানিত বোধ করল। কারো বাসায় আসলে এভাবে কেউ যদি কেন এসেছে জিজ্ঞেস করে তাহলে অপমানিত বোধ করারই কথা বোধহয়। তাই অপমানে মুখ থমথমে করে পা বাড়াল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার উদ্দেশ্যে৷ ঠিক তখনই ফের শান্ত গলায় বলল মেহেরাজ,

“ দাঁড়া এখানে। ”

জ্যোতি ভ্রু কুঁচকাল। স্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন শুধাল,

“ কেন?”

“ কয়েক মিনিটের মধ্যে আসছি আমি৷ ”

জ্যোতি থমথমে গলায় জবাব দিল,

“ আমি তো আপনার জন্য আসিনি এখানে মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চাপল। শ্বাস টেনে বলল,

“কিন্তু তোর গন্তব্যটা আমাদের বাসাতেই? তাই না? ”

“ তো? ”

“ বল আমাদের বাসা কোনটা?কোন ফ্লোরে?”

জ্যোতি মুখ কালো করল। সে জানে না উত্তর।মেহুর থেকে কেবল ঠিকানাটাই নিয়েছিল। কত তালায় কিংবা কোন বাসাটা জিজ্ঞেস করেনি সে । তাই ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে নিতে নিতেই বলল,

“ মেহু আপুকে কল দিয়ে জেনে নিব। আপনাকে প্রয়োজন পড়বে না।”

“যদি মেহু কল না তুলে? ”

“ তাহলে নাবিলা, সামান্তা আপু কাউকে ফোন করে জিজ্ঞেস করব। ”

মেহেরাজ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“ কেউই না বললে? ”

জ্যোতি এবারে বিরক্ত।চরম বিরক্ত নিয়ে শুধাল,

“ তাহলে দরজায় দরজায় নক দিয়ে দেখব কোনটা কার বাসা। ”

“গুড আইডিয়া!যা জিজ্ঞেস কর গিয়ে। ”

কথাটা বলেই গাছাড়া ভাব নিয়ে পা এগুলো মেহেরাজ।জ্যোতি থমথমে মুখে চাইল। গেইটের দিকে পা এগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়েই কিয়ৎক্ষন থামল। মেহুকে কল করল। আশ্চর্য! মেহু কল তুলল না। একবার, দুইবার, তিনবার কল দিয়েও লাভ হলো না। পরমুহুর্তেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিতেই কোথায় থেকে জানি মেহেরাজ আবারও এসে উপস্থিত হলো। কপাল কুঁচকে বিরক্তির স্বরে বলল,

” এখনও দাঁড়িয়ে আছিস যে এভাবে? আমাকে না জিজ্ঞেস করেও ফলো করে করে আমাদের বাসায় চলে যাবি বলে? ”

জ্যোতি এবারও বিরক্ত হলো। যে মেহেরাজ ভাইয়ের ব্যাক্তিত্বে সে মুগ্ধ ছিল সে মেহেরাজ ভাইয়েরই অতিরিক্ত অহংকার দেখে বিরক্ত হচ্ছে বারবার। সে কি এতোটাই বেহায়া? মেহেরাজ ভাই বারবার তাকে এমনটাই ইঙ্গিত করেন কেন? সেদিনকার চিরকুটটার জন্যই কি? মনে মনে কথাগুলো ভাবলেও উত্তর দিল,

“ না, আপুকে কল দিচ্ছিলাম। ”

“ তো ঠিকাছে,তাহলে আমাকে ফলো না করেই বাসায় পৌঁছাবি। যদি দেখি পেঁছন পেছন আসছিস তাহলে..”

মেহেরাজ বাকিটা বলার আগেই জ্যোতি কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,

“ জানি। তাহলে বলবেন আমি ছেলেদের পেছনে পেঁছনে ঘুরে বেড়াই, ছেলেদের ফলো করি। তাইতো?চিন্তা নেই আমি আপনাকে ফলো করব না।”

কথাটা বলে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল কিয়ৎক্ষন। মেহেরাজ এভাবে জবাব দিল না। জ্যোতিকে রেখেই পা বাড়িয়ে চলে গেল দ্রুত

.

জ্যোতি মেহুদের বাসায় পৌঁছাল আরো মিনট পাঁচ পরে। কলে নাবিলার থেকে জেনেই এসেছে। কলিং বেল বাঁজাতেই দরজা খুলল মেহেরাজ। যেন তার অপেক্ষাতেই দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। জ্যোতি তাকাল না এবারে। এড়িয়ে পা বাড়াতে নিতেই মেহেরাজ বলে উঠল,

“ কি হয়েছে তোর হাতে? ”

জ্যোতি ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

“ কি হবে ? ”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,

“ নাটক করছিস তুই? কেঁটে গিয়েছে তাই জিজ্ঞেস করছি।”

জ্যোতি হাতের দিকে তাকাল। সত্যিই কেঁটে গিয়েছে।বোধহয় রিক্সার সাথে লেগেই কেঁটেছিল।অবশ্য এইটুকু কাঁটা আর কিই? তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

“ ওসব কিছু না মেহেরাজ ভাই। মেহু আপু কোথায় ?আপুর কি হয়েছে? ”

“ কেন? ও কি কিছু বলেছে তোকে? ”

জ্যোতি কিছু বলতে নিয়েও বলল না। উত্তর দিল,

“ উনার ঘরটা কোথায়? ”

মেহেরাজ ছোটশ্বাস ফেলল। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শান্ত গলায় বলল,

“ বলব, সোফায় বস আগে। ”

জ্যোতি ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

“কেন? ”

“মুখে মুখে কথা বলিস খুব তুই।পছন্দ হয় না।”

জ্যোতি ছোট্ট শ্বাস টানল। যেখানে তার আস্ত জীবনটাই তার কাছে অপছন্দের সেখানে কারো কাছে তার কোন একটা অভ্যাস অপছন্দের হলে খারাপ লাগার কথা নয়। বরং ঠোঁট নাড়িয়ে উত্তর দিল,

“জীবনে সবকিছু পছন্দসই হয়না মেহেরাজ ভাই। না চাইলেও আমাদের জীবনে অনেককিছুই অপছন্দ-সই বয়ে বেড়াতে হয়। সারাজীবনই ! ”

মেহেরাজ উত্তর দিল না। নিজ ঘরে যেতে যেতে বাঁকা হাসল। বিড়বিড় করে আপনমনে বলল,

“ ক্ষতি কি? অপছন্দটাই নাহয় সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হোক আমায়। এবং এবং এবং অবশ্যই তোকেও! ”

কথাটা বলেই আনমনে হাসল সে। পরমুহুর্তেই নিজের এহেন কথার জন্য বিস্মিত হলো। তার মতো ব্যাক্তিত্ববান ব্যাক্তি বুঝি শেষ পর্যন্ত এভাবে হ্যাংলার মতো ব্যবহার করছে? ছিঃ ছিঃ ! সব দোষ এই মেয়েটার। শুধুই এই মেয়েটার!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here