#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১৬
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)
আর কতদূর? আর এভাবে কতক্ষন আমার চোখ ধরে রাখবেন?
চুপ করে থাকো সানাত। গেলেই দেখতে পাবে। বলতে বলতেই অন্তিম সানাতের চোখ দুটো ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো।
কাঙ্ক্ষিত জায়গাটির সামনে এসে দাঁড়াতেই অন্তিম বললো,
সানাত আর ইউ রেডী?
হ্যাঁ একদম। আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষায় আছি এবার চোখ ছাড়ুন।
ওকে। রেডি থ্রি, টু, ওয়ান, সারপ্রাইজ! বলেই চোখ থেকে হাত সরালো অন্তিম। সানাত চোখ খুলে তাকাতেই অবাক। সে এই মুহূর্তে দাড়িয়ে আছে একটা দীঘির পাড়ে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় দীঘির জলের সৌন্দর্য্য আজ যেনো দশগুন বেড়ে গেছে। কিনারেই নৌকা নিয়ে মাঝি দাড়িয়ে আছে। পুরো নৌকাটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।
কি কেমন লাগলো সারপ্রাইজটা?
সানাত সামনের দিকে তাকিয়েই বললো,
খুউবব সুন্দর!
চলো নৌকায় গিয়ে উঠি। আজ তোমাকে নিয়ে পূর্ণিমা রাতে নৌকায় ঘুরবো আর জোৎস্না বিলাস করবো। বলেই সানাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। সানাত মিষ্টি হাসলো। তারপর অন্তিমের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা নিঃসংকোচে আকড়ে ধরে নৌকায় উঠলো। অন্তিম মাঝির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
চাচা আপনি নৌকা বাইতে থাকুন।
আইচ্ছা আব্বা। তয় এ কি পেমিকা নাকি বউ হয়?
আমার বউ চাচা।
মাশাআল্লাহ চেহারাখান খুব মায়াবী বাজান।
অন্তিম হাসলো। আর এদিকে সানাত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অন্তিমের দিকে। তার কানে বারবার বাজছে অন্তিমের বলা সেই একটা কথাই “আমার বৌ”। ইস্ এই দুটো শব্দ এমন মাদকের মতো কেনো মনে হচ্ছে যেনো ঘোর লেগে যাচ্ছে তার। আচ্ছা সত্যিই কি অন্তিম বলেছে এই কথা? নাকি তার কান ভুলভাল শুনেছে? সানাতের ভাবনার মাঝেই খেয়াল হলো তার হাতটা অন্তিম মুঠোয় পুরে নিয়ে কি যেনো করছে। সানাত সেদিকে নজর দিতেই দেখলো অন্তিম খুব যত্ন সহকারে তার হাতে গাজরা পরিয়ে দিচ্ছে। সানাত সেদিকেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্তিম বলে উঠলো,
দেখি ওদিকে ঘোরো।
কেনো?
ঘুরতে বলেছি ঘোরো।
সানাত ঘুরে বসলো। অন্তিম সানাতের পিঠের ওপরে ছেড়ে দেওয়া কেশরাশি গুলোকে এক পাশে সরিয়ে একটা কাঁচা ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিলো। তারপরে একটা গোলাপি রঙের জারবেরা ফুল কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে সানাতকে তার দিকে ঘুরিয়ে বলে উঠলো,
“শাড়ি পড়া এক চোখ, মাটিতে তুমি
ফুলগুলো গেছে নেই, তবুও জন্ম নেবো আমি।”
লজ্জায় সানাত মাথা নুইয়ে ফেললো। সবটা কেমন যেনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে তার কাছে। বিশ্বাসই হচ্ছেনা এই এতো সুন্দর মুহূর্তটা তার আর অন্তিমের শুধুমাত্র তাদের একান্ত, ব্যক্তিগত কিছু মুহূর্ত যা সানাত মুঠোয় পুরে নিতে চায়। অন্তিম বলে উঠলো,
তোমাকে আজ খুব অদ্ভুত সুন্দর লাগছে সানাত। এই জোৎস্না রাতে কোনো শ্যামবতী রমণী শাড়ি পরে, গায়ে কাঁচা ফুলের গয়না জড়িয়ে, চোখে কাজল দিয়ে নদীর মাঝে বসে জোৎস্না বিলাস করছে। পূর্ণিমার চাঁদের আলো আজ ফিকে পড়ে গেছে শ্যাম বর্ণের কাছে।
সানাত চোখ তুলে তাকালো। তারপর হেসে বললো,
কালোকে শ্যাম বলে চালিয়ে দিচ্ছেন! কালো কিন্তু কলঙ্কের রং। আর আমার সাথে পূর্ণিমার চাঁদের তুলনা দিচ্ছেন! আমি যে অমাবস্যা।
আমার কাছে কালো কলঙ্ক নয় পবিত্রতার রঙ। আর বাকি রইলো পূর্ণিমা আর অমাবশ্যার কথা। বেশ সবাই তো পূর্নিমার চাঁদের পেছনেই ঘোরে আমি না হয় অমাবশ্যার চাঁদকেই চাইলাম। তাতে ক্ষতি কি?
কিন্তু অমাবশ্যাতো অন্ধকার।
কে বলেছে আমি তো অমাবশ্যার মাঝেও পবিত্র নূরের আলো খুঁজে পেয়েছি।
সান্তনা দিচ্ছেন? মন রাখতে এসব কথা সবাই বলে।
অন্তিম সানাতের হাতের ওপরে হাত রেখে ওই গভীর চোখে নিজের প্রখর দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো,
এই চাঁদ তারা এনে দেওয়ার কথা তো সবাই বলে আর তার সবই মিথ্যে।
তবে তুমি চাইলে আমি তোমাকে সম্মান আর অফুরন্ত ভালোবাসা দিতে পারি।
সানাত জানেনা এই দুটো লাইনের মাঝে ঠিক কি ছিলো তবে সে আবারও প্রখর ভাবে প্রেমে পড়লো তার সামনে থাকা এই প্রেমিক পুরুষটির ওপর।
সানাত!
হুঁ!
অন্তিম বলে উঠলো,
পা টা দেও।
সানাত চমকে উঠে বলে উঠলো,
কেনো?
অন্তিম আর কোনো অপেক্ষা না করে নিজেই পায়ে হাত দিলো। মুহূর্তেই সানাত বলে উঠলো,
একি পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?
কেনো পায়ে হাত দিতে কি মানা? নাকি সোনায় বাঁধানো পা তোমার?
না মানে অস্বস্তি হয়।
চুপচাপ অস্বস্তি চেপে বসে থাকো। বলেই সে একটা পায়েল নিয়ে পরিয়ে দিলো সানাতের পায়ে। সানাত তাকিয়ে আছে। তারপর অবাক হয়ে বলে উঠলো,
আপনি এটা…
পছন্দ হয়েছে?
সানাত কিছুই বললোনা শুধু তার চোখ দুটো মুহূর্তেই টইটুম্বুর হয়ে উঠলো। তারপর নোনাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই অন্তিম হাত পেতে তা ধরে ফেললো। তারপর বলে উঠলো,
তুমি এইটুকুতেই কাদঁছো সানাত! এখনো যে আরো একটা জিনিস বাকি!
আরো কি বাকি আছে?
আছে। বলেই সানাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠলো,
শুভ জন্মদিন শ্যামবতী।
সানাত নিজেই নিজের জন্মদিন ভুলে বসেছিল বাবার মৃত্যুর শোকে। হঠাৎ কি হলো সানাত জানেনা মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়লো অন্তিমের বুকে। তারপর কেঁদে ফেললো। অন্তিম সানাতকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
একি সানাত এতো কিছু করলাম যাতে তোমার মন ভালো হয় আর তুমি কিনা আমার সব পরিশ্রমে পানি ঢেলে কাদঁছো?
সানাত নাক টেনে বললো,
আমি খুবব খুশি হয়েছি। আপনি জানেন না এই প্রথম কেউ এতটা যত্ন নিয়ে আমার জন্মদিনে কিছু করেছে। আমি সত্যিই এতোটা আশা রাখিনি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে এতো সুন্দর একটা রাত উপহার দেওয়ার জন্য। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু মুহূর্তের তালিকায় এই মুহূর্তটাও আজীবন থাকবে।
আর আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ কিছু উপহারের মাঝে তুমি অন্যতম একটি উপহার হয়ে থাকবে। যা আমায় উপরওয়ালা নিজে দিয়েছেন। আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো ওনার কাছে।
সানাত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আর মনে মনে শুধু একটাই কামনা করলো তার এই সুখের মাঝে যেনো কোনো ভাঙন না আসে।
.
.
সানাত আর অন্তিম বাড়ি ফিরেছে বারোটার পর। সানাত ফ্রেশ হয়ে নিজের বিছানায় বসে বসে ফোনে তাদের আজকের কিছু বিশেষ মুহূর্তের ছবি গুলো দেখছে। এই ছবিগুলো অন্তিমের কিছু বন্ধু তুলেছে পাশের নৌকা থেকে। এছাড়াও আরো অনেক ছবি আছে। অন্তিম গেছে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে। সানাত ছবি গুলো জুম করে উল্টে পাল্টে দেখছে আর হাসছে। এই যেমন এখন সে যে ছবিটা দেখছে তাতে সানাত লজ্জায় মাথা নিচু করে হাসছে আর অন্তিম গালে এক হাত দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইস্ এই ছবিটা যেনো একটু বেশীই সুন্দর হয়েছে। সানাত মুহূর্তেই ভেবে ফেললো এই ছবিটা সে বাঁধিয়ে তাদের রুমের দেয়ালে টাঙ্গাবে। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে ভাবতে লাগলো আসলেই তো আজ তার মতো কালো মেয়েকে সত্যিই হঠাৎ খুব সুন্দর লাগছে। সে নিজেই নিজের থেকে চোখ ফেরাতে পারছেনা। হঠাৎ এই সৌন্দর্যের কারণ কি? তারপর আবার ভাবতে লাগলো ইস্ ওহীকে তো বলাই হলোনা আজকের সব ঘটনা। গাধাটা আজ এতো আগে আগেই ঘুমিয়ে পড়লো! আর কেমন বেঈমান তাকে ম্যাসেজে উইশ করে ঘুমিয়ে গেলো! কোনো ব্যাপার না একবার শুধু কালকের সকালটা হোক তারপর ওকে বসিয়ে সব বলবে। সানাতের ভাবনার মাঝেই অন্তিমের ফোন বেজে উঠলো। সানাত ঘুরে তাকালো। তারপর অন্তিমের উদ্দেশ্যে জোরে বললো,
অন্তিম আপনার ফোনে বাজছে!
ওপাশ থেকে শাওয়ারের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না। ফোনটা কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আবারও বেজে উঠলো। সানাত আবার বললো,
অন্তিম! আপনার ফোন বাজছে!
ওয়াশরুম থেকে অন্তিম বলে উঠলো,
একটু রিসিভ করো।
আচ্ছা।
সানাত ফোন হাতে নিতেই দেখলো কোনো নাম নেই। সানাত রিসিভ করে বললো,
হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
ওপাশ থেকে নিরব, কোনো কথা বলছেনা। সানাত আবার বললো,
হ্যালো কে বলছেন? হ্যালো?
ওপাশে ব্যক্তিটি এবারও নিরব। সানাত ভ্রু কুঁচকে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। এরমধ্যে অন্তিমও বের হয়ে এসেছে। তারপর সানাতের উদ্দেশ্যে বললো,
কি হয়েছে কে ফোন করেছে?
জানিনা কোনো কথা বলছেনা।
কই আমার কাছে দেও তো। বলেই ফোন টা হাতে নিয়ে বললো,
হ্যালো কে?
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ নিরব থেকে তারপর বলে উঠলো,
অন্তিম!
অন্তিম মুহূর্তেই থমকে গেলো। কন্ঠটা খুব পরিচিত মনে হলো। যেনো এর আগেও সে শুনেছে। তারপর সে কিছু বলতে যাবে এর আগেই ওপাশের ব্যক্তি কল কেটে দিলো। এরপর অন্তিম চেষ্টা করলেও সুইচস্টপ বলছে। সানাত জিজ্ঞাসা করলো,
কি হয়েছে কে ফোন করেছিলো?
জানিনা। শুধু আমার নামটা ডাকলো একবার।
আপনার নাম? আপনার পরিচিত কেউ?
কি জানি? কন্ঠটা কেমন খুব পরিচিত মনে হলো।
সানাতের মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেলো এক অজানা ভয়ের শীতল স্রোত। কেনো যেনো মনটা বারবার অশনি সংকেত দিচ্ছে। কেনো মনে হচ্ছে এই সুখ বোধয় বেশি দিন সইবেনা তার কপালে। কোনো এক তুফান এসে সব কেড়ে নিয়ে যাবে আর সে আবারও একা একেবারে শূন্য হয়ে যাবে। অন্তিম হঠাৎ সানাতের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
কি হয়েছে সানাত? তুমি এভাবে ঘামছো কেনো?
না কিছুনা এমনি।
#চলবে