#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১৩
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)
এই এক সপ্তাহ ভীষণ ব্যস্ততার মাঝে পার করেছে সানাত। ভার্সিটি,টিউশন সামলাতে গিয়ে সে হাপিয়ে উঠেছে। অবশ্য এই সবকিছুর মাঝে এই পরিবারটার অবদান কোনো অংশে কম নয়। সানাত জানেনা অন্য কোনো শ্বশুরবাড়িতে বাড়ির বউকে ঠিক এতোটা স্বাধীনতা দেওয়া হয় কিনা। তবে সে সত্যিই খুব ভাগ্যবতী যে এমন একটা পরিবার পেয়েছে যেখানে তাকে বাড়ির বউয়ের নজরে নয় বরং ওহীর মতোই এ বাড়ির মেয়ের মতো দেখা হয়। তাই তো এখন অব্দি বিয়ের পরে সংসার ঠিক কি তা এখনো জানেনা সানাত। পুরোটাই অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম নিজেই খুশি মনে এক হাতে সামলে নিচ্ছেন। গত দু দিন ধরে সানাতের বাবার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছেনা। কাল সকালে উঠেই ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাঠাতে হবে। আগামী দুইদিন ভার্সিটি বন্ধ ভাবতেই সানাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সব ভাবনা চিন্তা ফেলে বালিশটা ঠিক করে অন্তিমের পাশেই শুয়ে পড়লো সানাত।
.
রাত তখন তিনটা। আচমকা সানাতের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ধরফরিয়ে উঠে বসলো। হঠাৎ করেই তার খুব অস্থির লাগছে। কেনো লাগছে বুঝতে পারছে না। সেই মুহূর্তে অন্তিমেরও ঘুম ভেঙে গেলো। সানাতকে ওরকম হাপাতে দেখে সে নিজেও তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। সানাত তখনো জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তারপর সানাতের কাধে হাত রেখে বললো,
সানাত, আর ইউ ওকে? খারাপ লাগছে? আমাকে বলো।
আমার খুব অস্থির লাগছে অন্তিম। কেনো লাগছে জানিনা। কিন্তু আমার ভেতরে খুব অশান্তি লাগছে।
অন্তিম সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,
পানিটা খাও। সানাত আই থিঙ্ক তুমি প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে ছিলে। ক্লান্ত তাই এমন হচ্ছে।
সানাত পানিটা খেয়ে বসে আছে। কেনো যেনো মনটা খুব অস্থির লাগছে। অন্তিম আবারও বললো,
সানাত আস্তে করে শুয়ে পরো। ঘুমানোর চেষ্টা করো।
আমি আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছিনা আমার ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে। আমার তো কখনো এমন হয়না। আজ হঠাৎ এমন কেনো লাগছে। শুধু কেমন যেনো একটা শূন্যতা অনুভব করছি।
অন্তিম কিছু বলতে যাবে তার আগেই সানাতের বালিশের পাশে ফোনটা বেজে উঠলো। সানাত ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো শাকিলের ফোন। সানাতের ভেতরটা যেনো তখনই মোচড় দিয়ে উঠলো এক অজানা ভয়ে। ফোনটা রিসিভ করে স্পিকারে দিতেই ও পাশ থেকে শাকিল বলে উঠলো,
হ্যালো আপু!
হ..হ্যালো শাকিল। তুই এতো রাতে ফোন কেনো করেছিস! বাবা ঠিকা আছে?
আপু তুই রওনা হয়ে চলে আয় যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।
হুট করেই সানাতের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা নোনতা জল। কোনরকমে নিজেকে সামলে বললো,
বাবার কি অবস্থা খুব খারাপ? তাহলে হাসপাতাল নে । আমি টাকা নিয়ে আসছি।
টাকা আনতে হবেনা আপু। তুমি শুধু চলে আসো। বলেই কল কেটে দিলো শাকিল। সানাতের চোখ বেয়ে শুধু গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। পাশ থেকে অন্তিম সানাতের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠলো,
তাড়াতাড়ি রেডি হও সানাত। আমরা এখনি বের হবো। কান্নাকাটি করো না প্লীজ। আমি আছি।বলেই নিজেও তৈরি হতে চলে গেলো।
🌻
ভোর পাঁচটার টিকেটের বাসে উঠেছে সানাত আর অন্তিম। সকাল সাড়ে ছয়টার ট্রেনে আসছে অন্তিমের বাবা ওয়ালিদ আহসান। সানাত কোনো মতে সালওয়ার কামিজ পাল্টে একটা হালকা বেগুনি রঙের সুতি শাড়ি পরে একটা খোঁপা করেই চলে এসেছে। সানাত জানালার ধারের সিটে বসে আছে। অন্তিম তার পাশেই চুপচাপ বসে আছে। সে উঠে এসে জানালা লাগিয়ে দিয়ে বললো,
বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। ঠান্ডা লেগে যাবে।
.
.
দুপুর একটা। সানাত আর অন্তিম সিএনজি তে বসে আছে। পুরো রাস্তায় সানাত একটা কথাও বলেনি। কিছু সময় পর সিএনজি এসে থামলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে। অন্তিম আর সানাত নেমে দাড়ালো। বাড়িটার সামনে আজ প্রচন্ড ভীড়। গ্রামের মানুষ জন আসছে যাচ্ছে। সানাত আর অন্তিম কারোরই বুঝতে বাকি নেই ভেতরে আজ কি হয়েছে। অন্তিম ভাড়া মিটিয়ে সানাতের দিকে তাকাতেই দেখলো সে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তিমও সানাতের পিছু পিছু এগিয়ে গেলো। খোলা উঠোনে আজ মানুষের ভীড় জমেছে। ভেতর থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ ভেসে আসছে। সানাত ভীড় ঠেলে উঠোনের যথাস্থানে পা রাখতেই রক্তশূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের খাটিয়াতে রাখা সাদা কাফনে ঢাকা লাশের দিকে। আজ বাবার চিকিৎসার তাগিদে সানাতের ক্রমশ সংগ্রাম করার লড়াইটা থেমে গেলো। সানাতকে দেখেই ছুটে আসলো ছোটো ভাই শাকিল। সানাত ভাইয়ের মাথায় হাত রেখে বললো,
কখন হলো এসব?
শাকিল অসহায় বোনের নিষ্প্রাণ চোখ দুটো দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। তারপর বললো,
রাত আড়াইটায়।
ওহ।
বলেই সানাত এগিয়ে গিয়ে খাটিয়াটা ধরে ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে। তারপর কাপা কাপা হাতে মুখের ওপর থেকে ঢেকে রাখা কাপড়টা সরিয়ে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো জন্মদাতা পিতার সেই সুন্দর মুখখানার পানে। যে বাবাকে ঘিরে তার শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা, যার কাছে শৈশবের সকল বায়না, আবদার, যে ছিলো তার কাছে তার সুপার ম্যান, একটা ভরসার জায়গা, যতো যাই হোক না কেনো বাবা আছে সেই বিশ্বাসের জায়গা, তার মাথার ওপরে থাকা বটগাছ, যার ছায়াতলে সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যেতো, সব থেকে নিরাপদ একটা আশ্রয়, এমন একটা মানুষ যে কিনা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছিলো আজ সে মানুষটাও এতো মায়া ছেড়ে একলা ফেলে স্বার্থপরের মতো চলে গেলো। একটা বারও পিছু ফিরে দেখলো না তার সানাতটা ঠিক কতোটা অসহায়! কাল রাত অব্দি বাবা ছিলো তবে আজ আর নেই। এই নেই কথাটা মানতে যেনো সানাতের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার বয়সী মেয়েরা তো এই বয়সে বাবা মায়ের আদরে আহ্লাদে ভরপুর থাকে, তাদের পুরো পৃথিবীটা জুড়েই থাকে তাদের বাবা মা। বাবা মা কে চাইলেই জড়িয়ে ধরতে পারে, মনের কথা বলতে পারে। কতো সুখী তারা! এই যেমন ওহী।অথচ এই বয়সেই সানাত মা বাবা হারা এতিম মেয়ে। জীবনের শুরুতেই সে এতিম। কেনো তার জীবনটা আর পাঁচটা মেয়ের মত স্বাভাবিক হলোনা? জীবনটা কেনো এতো জটিল হয়ে গেলো? বেঁচে থাকাটাই যেনো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তিম সানাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে আজকের সানাতকে দেখে অবাক না হয়ে পারছেনা। কারণ যে সানাত কথায় কথায় কেঁদে ফেলে সেই সানাত আজ এতটা শক্ত কি করে? সানাতের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করাতেই যেনো অন্তিমের দম বন্ধ হয়ে আসে। তাহলে সানাত কি করে এতো শক্ত হয়ে আছে? ঘরের ভেতর থেকে সানাতের সৎ মা রুমানা বেগম বের হয়ে এসে দাঁড়ালেন। তারপর সেই মুহূর্তেও তিনি সানাতকে খোটা দিতে বলে উঠলেন,
আইলি ক্যান তুই? নাই আইতি। যহন ট্যাকা পাঠানোর কতা তহন তুই পাঠাইবার পারছ নাই। তইলে অহন আইছস ক্যান? বাপের লইগা দরদ দ্যাহাইতে আইছস? তোর লইগা আমি বিদুবা হইছি, আমার পুলাপান এতিম হইছে। অলক্ষ্মী, সর্বনাশী।
সানাত কিছুই বললো না। শুধু শুনে গেলো। কারণ এসব কিছু তার কাছে নতুন নয়, অভ্যস্থ সে এসবে। কিন্তু অন্তিম সহ্য করতে পারলোনা। সে বলে উঠলো,
এসব কোন ব্যবহার করছেন আপনি ওর সাথে? এরকম একটা সময়েও আপনি ওকে কথা শোনাতে ছাড়ছেন না!
আননি কেডায়? আর অর হয় কতা কইতাছেন ক্যান?
আমি সানাতের স্বামী। তাই আমার স্ত্রীর সাথে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি যা নয় তাই বলে অপমান করবেন সেটা আমি মোটেও সহ্য করবো না। বিয়ের আগে কি করেছেন না করেছেন আমি জানিনা। তবে এখন সানাত শুধুমাত্র এই বাড়ির মেয়ে নয় তাঁর আরেকটা পরিচয় আছে সে আমার বিয়ে করা স্ত্রী। তাই ভদ্র ভাবে কথা বলবেন।
রুমানা বেগম দমে গেলেন অন্তিমের হুমকিতে। আর দেখেও বুঝতে পেরেছেন কোনো বড়লোক বাড়ির ছেলে তাই আর কথা বাড়ালেন না। সানাতের পাশেই দাড়িয়ে আছে তাঁর ছোটো চাচা শাহআলম। তিনি বেশ শিক্ষিত একজন ভদ্রলোক। অন্তিমের কথায় তিনিও সহমত পোষণ করেছেন। সানাত তার চাচা শাহআলমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
জানাজা কয়টায় চাচা?
যোহরের নামাজের পর মা।
ওহ। একটু অপেক্ষা করতে পারবেন আমার শশুর আসছেন।
কতক্ষন লাগবে বলতে পারবি?
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চলে আসবে চাচা।
আচ্ছা মা।
.
.
অন্তিমের বাবা এসে উপস্থিত হয়েছেন। জানাজার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে এখন। সানাত খাটিয়ার পাশে ঠায় বসে আছে। মেয়েটা এক ফোঁটাও কাঁদেনি। সানাতের চাচা শাহআলম সানাতকে ধরে বললেন,
এবার ছাড় মা। নিয়ে যেতে হবে আমাদের। সময় হয়ে গেছে অনেক।
সানাত নিস্তেজ গলায় বললো,
নিয়ে যাবেন এখনি?
হ্যাঁ মা। এবার বাবাকে ছাড় মা।
আমার বাবাকে আরেকটু রাখা যায়না চাচা? এতো তাড়া কেনো? আরেকটু থাকুক না নিজের বাড়ির উঠোনে আলো বাতাসের মাঝে, আমার সাথে। একটু পর তো ওই অন্ধকার কবরেই থাকবে।
এরকম বোকার মতো কথা তো তোকে সাজে না মা। আমার জানা মতে তুই তো খুব স্ট্রং মেয়ে। তাহলে এমন বোকার মতো কথা কেনো বলছিস বলো। বাবাকে যেতে দে।
আমার বাবাকে কোথায় কবর দেবেন চাচা? আমার মায়ের পাশে?
তোর মায়ের কবর তো তোর নানার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে। সেখান কি করে দেই? তাই আমাদের এখানেই দেবো।
ওহ্।
এবার তাহলে নিয়ে যেতে দে।
নিয়ে যান। বলেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। সানাতের সৎ বোন সাবাও কাদঁছে বাবার খাটিয়া ধরে। নিয়ে যাওয়ার সময় অন্তিমও কাধে নিলো খাটিয়া। আর সানাত নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো বাবার শেষ যাত্রার দিকে। ঠিক যতদূর পর্যন্ত দেখা গেলো সে তাকিয়ে থাকলো। তার কারণ এরপর ইহকালে আর এই বাবার দেখা পাবেনা কখনো।
.
.
দাফনের কাজ শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। সানাত উঠোনে একটা চেয়ারে বসে আছে। অন্তিম এসে পাশে বসলো। সানাতকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তার কাছে নেই। তবে যেভাবেই হোক সানাতকে তার স্বাভাবিক করতে হবে নাহলে সানাত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে। সানাতের বড় চাচী মানসুরা বেগম এসে বললেন,
সানাত ঘরে যা মা। কতক্ষন ধইরা এইনো বইয়া রইছস। ঘরে যাইয়া একটু ব। এমনে থাকলে অসুস্থ হইয়া পড়বি। যা।
সানাতের ছোটো চাঁচা শাহআলম তিনিও এসে বললেন,
হ্যাঁ যা মা ঘরে যা। সকালে ভাইয়ের মিলাদ নিয়ে আলোচনা করবো।
আমি সকালে থাকবো না চাচা।
সানাতের এমন কথায় অবাক হয়ে গেলো উপস্থিত সকলে এমনকি অন্তিম নিজেও।
#চলবে