#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৩১(সমাপ্তির প্রথমাংশ)
তাবাসসুম আফরাজ কে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যাগ হাতড়ে সিরিঞ্জ-টা বের করে। চোখে তীব্র নেশা নিয়ে ধীরপায়ে সামনে আগায়। আফরাজ ফোনে হেড-স্যার এর নাম্বারে কল দিচ্ছে। কিন্তু তিনি কল ধরছে না দেখে বারংবার কল দিয়ে যাচ্ছে। তাবাসসুম তার পেছনে এসে ঘাড়ের কাছে সিরিঞ্জ-টা লাগাতে গিয়েও পারল না। তৎক্ষণাৎ গাড়ির পেছনে লুকিয়ে পড়ে। কেননা হেড-স্যার চলে আসেন। তিনি এসে আফরাজ এর সাথে ‘হাই-হ্যালো’ বলে ভেতরে নিয়ে যায়। তাবাসসুম চোখের নেশা নিয়ন্ত্রণ করে সিরিঞ্জ-টা ব্যাগে রেখে দেয়। কিন্তু নিজের সাথে হওয়া অপমানের শোধ তুলতে নতুন ফন্দি আঁটে। শিক্ষক-মণ্ডলীর কাছে নতুন নিয়ম জারি করে। নিয়ম বাস্তবায়নের জন্য সে বাসায় থাকাকালীন কৌশলে নাজীবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তার লেকচার খাতা চুরি করে খাতার কিছু পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলে ছিল। যা নাজীবার অজানা। ক্লাসে নাজীবা মনযোগ সহকারে ফিজিক্স ক্লাস করছে। তখনি ফিজিক্স স্যার পূর্বের লেকচার কপি চেক করতে চাইলেন। নাজীবার দিকে এগিয়ে এসে তার খাতা দেখার আক্ষেপ করেন।
“মিসেস নাজীবা আপনার ফিজিক্স লেকচারের কপি কোথায়?”
স্যারের কথা শুনে হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী নিয়ে ব্যাগ খুলে খাতা বের করলে দেখতে পেল তার খাতার কিছু অংশ ছেঁড়া। ভয় পেল নাজীবা। পুনরায় খাতা উল্টে পাল্টে চোখ বুলাল। নিজের মাথায় জোড় দিয়ে ভেবেও কুল পেল না। স্যার কিছু বলার পূর্বেই ক্লাসরুমে প্রবেশ করলেন মিস তাবাসসুম। অন্য ম্যাম কে দেখে ছাত্র-ছাত্রীগণ কিছুটা উদগ্রীব হয়ে পড়ল। তাবাসসুম মনেমন বেশ খুশি। আজকে অহেতুক রুলস সে ফলেছে টিচার্সের উপর। তাবাসসুম কলিগদের সঙ্গে অন্তমর্মী স্বরূপ আচরণ করে বলে তারা তাকে সম্মান দেয়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) সেই প্রেক্ষিতে তাবাসসুম নোটিশ পড়ে শোনাতে নাজীবার ক্লাসরুমে এসেছে। নাজীবাও স্থীর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। গলা ঝেড়ে তাবাসসুম বলে,
“আজকের নতুন নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সবাইকে স্যার/ ম্যাডামের দেওয়া লেকচারার কপি কালেক্ট করে রাখতে হবে। নাহলে তার উপস্থিতির নামে ক্রস মার্ক করা হবে। এতে স্টুডেন্ট’স এর ১০পাসেন্ট করে মার্কিং করার আদেশ জারি করা হয়েছে। সেই সাথে শাস্তি আবশ্যক। তাই সকল টিচার্স কে অনুরোধ করা হচ্ছে আজ থেকে এ প্রসেস চালু করতে। ধন্যবাদ।”
কথা শেষ করে তাবাসসুম ক্লাসে উপস্থিত তার কলিগের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এখন স্যার আশা করি আপনি আপনার কাজ পরিপূর্ণ ভাবে পালন করবেন। মতের বিরোধ যাবেন না। যে লেকচার কপি দেখাতে পারবে না তাকে অত্যন্ত দশমিনিট কানে হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।”
কথাটুকু বলে তাবাসসুম বাঁকা হেসে নাজীবার দিকে একপলক চেয়ে চলে যায়। নাজীবার খারাপ লাগছে সে উপস্থিত থেকেও তার নামের পাশে ক্রস মার্কিং দেওয়া হয়েছে। স্যার অসহায় দৃষ্টিতে নাজীবার দিকে চাইলেন। তিনিও আদেশের বিরোধ যেতে পারবেন না। নাজীবা কে না চাইতেও শাস্তির দাবি মান্য করতে হলো। কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এতে স্যার লজ্জিত বোধ করলেও কিছু বলতে পারেন না। কিন্তু নাজীবা-র সঙ্গ দেয় কয়েকজন ছেলেমেয়ে। যা দেখে নাজীবা হাসল। কেননা যারা দাঁড়িয়েছে তারা নাজীবা-কে হাসির পাত্রী হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। জানালার বাহির থেকে এ দৃশ্য দেখে রে’গে জ্বলে যাচ্ছে তাবাসসুম। মাটিতে পা’রা মে’রে সেখান থেকে সরে যায়।
অন্যথায়, হেড-স্যার এর সামনে কপালে হাত রেখে বসে আছে আফরাজ। হেড-স্যার ঘামছেন। তিনি ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলেন,
“আসলে আফরাজ বাবা প্রিন্সিপাল স্যার আমার অনুপস্থিতিতে এসে ছিলেন। কিন্তু আমি আসার পর পর চলে যান। আমি তো এসবের কিছুই জানি না।”
“আপনি আমার বাবার বয়সী তাই বয়সের দিকে তাকিয়ে আপনার সঙ্গে বেদম প্রহার করছি না। বরং সতর্ক করছি পরবর্তীতে আমার স্ত্রীর সঙ্গে কোনো প্রকার অশ্লীল কর্ম হয়ে থাকে। তবে আপনার এই ভার্সিটি ভার্সিটি হিসেবে থাকবে কিন্তু আপনি আর হেড-স্যার থাকবেন না। আপনার কুকীর্তি ফাঁস করে দেওয়া আমরা একসেকেন্ড এর ব্যাপার। সো বি কেয়ারফুল স্যার।”
আফরাজ দাঁড়িয়ে যায়। তাকে দেখে হেড-স্যার ও দাঁড়িয়ে বাহির পর্যন্ত ছেড়ে দেয়। হঠাৎ তার মুখোমুখি হলো তাবাসসুম। স্বেচ্ছায় হাত ধরতে গেলে আফরাজ দূরে সরে গেল। হাত গুটিয়ে নিল তাবাসসুম। তবুও দ্বিরুক্তিময় গলায় বলে,
“তোমার প্রথম বউ তো ক্লাসে তাই দ্বিতীয় বউয়ের সাথে আলাপ করতে সমস্যা থাকার কথা নয়। একটুও মন চাই না তোমার প্রথম ভালবাসার…”
তাবাসসুম কে মাঝপথে থামিয়ে আফরাজ নিজেই বলতে লাগল।
“না প্রথম , না দ্বিতীয় আমার ভালোবাসার একমাত্র রমণী হলো আমার বিবিজান। তুমি ছিলে সাময়িক সময়ের মোহজাত প্রডাক্ট। যার মূল্য ছিল মুখের কথায়,যার মূল্য ছিল ভোগের বস্তুতে এবং যার শরীর নিজেই হেয়তায় বিক্রি করেছে। তোমার আর আমার বিবিজান এর মাঝে বিস্তর ফারাক। এই ফারাকের সীমানা কখনো তুমি পেরিয়ে যেতে পারবে না।
সে আমার #অন্যরকম_হৃদয়ের_আঙিনায়_ঘুমন্ত_পরী।
এখনো বলছি সময় আছে শোধরে নাও নিজেকে। নাহলে তুমি আর তোমার মায়ের চেহারা লোকানোর স্থান খোঁজে পাবে না। এই আফরাজ ফাহিম তার কথায় অনড়।”
কথাটুকু বলে আকস্মিক তাবাসসুম এর মুখের কাছে এলো আফরাজ। হিংস্র চাহনি নিয়ে বলে,’দোয়া করো চেয়ারম্যানের যে অবস্থা হয়েছিল সে অবস্থা যেনো তোমাদের সাথে না হোক। বাঁচতে চাইলে রাস্তা অনেক খোলা,মরণ চাইলে সোজা নরকের রাস্তা দেখাবো।’
পকেটে হাত গুঁজে শিস বাজাতে বাজাতে গাড়ির কাছে চলে গেলো। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
তাবাসসুম স্তদ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। ক্ষোভের চেয়েও বেশি তার মনেপ্রাণে হিংসার স্তর পর্যায় বেড়ে চলেছে। যতবার সে আফরাজ এর নিকটে যেতে চেয়েছে ততবার আফরাজ তার অতীতের কথা টেনে নাজীবার সঙ্গে তুলনা করেছে। তার চোখ-মুখে শোধরানোর কোনো ভাবান্তর নেই। বরং সে এবার প্রাণ নিয়েই ছাড়বে। বিরবিরিয়ে আফরাজ এর দিকে চেয়ে বলে,
“হয়ত তুমি স্বেচ্ছায় আমাকে মেনে নেবে নাহয় তোমার নাজীবার এমন অবস্থা করব যাতে সে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে দেয়।”
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে এক মেয়ে কে ডাক দেয়। পুষ্প নামের এক মেয়ে এসে হাজির হলো ক্যান্টিনে। তার আগমনের সহিতে তাবাসসুমও হাজির হলো। সে পুষ্পর হাতে দশ লাখ টাকা দিয়ে বলে,
“তোমাকে নাজীবার পিছু নিতে হবে। ক্লাস শেষে আমি চাই তুমি এক বাচ্চাকে ডেকে তাকে পুকুরপাড়ের দিকে নিয়ে যাবে। তারপর সুযোগ বুঝে তাকে পুকুরপাড়ে ধাক্কা মে’রে পালিয়ে যাবে। আমি কন্ট্রোলার রুমে গিয়ে ক্যামেরার ফুটেজ অফ করে দেবো। কোনো অসুবিধা হবে না। পুকুরের পানি খুব গভীর। আমি চাইছি আজ আমি যেমন অপদস্থ হয়েছি তেমনি নাজীবাও অপমানিত লাঞ্ছিত হোক। তার শরীরের দিকে যেনো শকুনের নজর পড়ুক। বুঝতে পেরেছো কি বলেছি? আর শোনো মুখে ঘোমটা দিয়ে বেশ-ভূষা পরিবর্তন করে যাবা। যেনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। সবচেয়ে বড় কথা তোমাকে রিসোর্টেও যেতে হবে। তার প্ল্যানিং আমি রাতে কলে বুঝিয়ে দেবো। ঐ কাজের পর বাকি দশ-লাখ টাকা পে করব।”
পুষ্প বাঁকা হেসে মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে যায়। তারা সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে কথা বলেছে বলে কেউ তাদের চিনতে পারল না। পুষ্প নাজীবার ক্লাস রুমের পাশে থাকা চেয়ারে বসে ফোন ঘাঁটছে। ভাব এমন যেনো সে এ ভার্সিটির স্টুডেন্ট। নাজীবা বের হতেই আফরাজ কে গাড়ির ভেতর বসারত দেখতে পাই। মুচকি হেসে এগোতে নিলে কেউ তার বোরকার হাতা ধরে টান দেয়। থেমে যায় নাজীবার কদম। চোখের দৃষ্টি সেই মালিকের দিকে নিলে দেখল এক বাচ্চা তাকে ইঙ্গিতে পুকুর পাড়ের দিকে যেতে ইশারা করছে। ব্যাপারটায় কেমন যেন মনে হলো তার। সেও ইশারায় না বোধক মাথা নেড়ে চলে যেতে গেলে বাচ্চাটা কেঁদে দেয়। এতে সে অস্থির হয়ে ‘ঠিক আছে যাচ্ছি যাচ্ছি’ বলে উল্টো দিকে পা ফেলে পুকুরপাড়ের দিকে পা বাড়ায়। আফরাজ সময় দেখে চোখ ফিরিয়ে দেখল নাজীবা গাড়ির কাছে না এসে অন্য খানে যাচ্ছে। চিন্তিত হলো। তৎক্ষণাৎ গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে নাজীবার পিছু নিতে চাইলে কিছু মেয়েরা হৈচৈ করে তার সামনে এসে পড়ে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) বিরক্ত হলেও শান্ত মনে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। তার চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ নাজীবার দিকে। কিন্তু মেয়েটাও কেমন একটুও পিছু ফিরছে না! মেয়েদের সামলে উঠতে না উঠতে ছাত্রদল কিছু শলাপরামর্শ করতে চলে এলো। আফরাজ পড়ল যেনো মাইঙ্কার চিপায়। কোনো প্রকার গার্ডস আনেনি। এখন লোকগণের সমাহার শেষ হচ্ছে না।
নাজীবাকে পুকুরপাড়ে রেখে বাচ্চাটি কোথায় যেনো পালালো। সে উঁকিঝুঁকি মে’রে দেখার চেষ্টা করে। তবে কাউকেও চোখে পড়েনি তার। না পারতে ফিরে যেতে মুখ ঘোরানোর পূর্বেই তার পিঠে জোরালো ধাক্কা লাগে। পা পিছলে পানির উপর আঁচড়ে পড়ে। পানির গভীরতা অনেক। সে তার শরীরের ভর উপরে রাখার চেষ্টা করে চিল্লিয়ে ‘বাঁচাও প্লিজ’ বলে উঠে। আফরাজ ছাত্রদলের নানান কথার জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত। তার উপর মেয়েদের গ্যাঞ্জাম। ক্যাচাল সহ্য হলো না তার। হঠাৎ ফোনে কল আসায় আফরাজ তাদেরকে হাতের ইশারায় থামতে বলে ফোন রিসিভ করে। অপরপাশ থেকে নাদিম উত্তেজিত গলায় বলে,
“আফরাজ নাজীবা কোথায়? আমি এসে থেকে দেখছি নাজীবা ভার্সিটির ভেতরে নেই।”
বজ্রপাতের ন্যায় শোনালো কথাটা। তৎক্ষণাৎ গা’র্ন বের করে আকাশের দিকে শু’ট করে। শব্দের সমাগম থেমে যায়।ছাত্রদল পেরিয়ে নাজীবার যাওয়ার পথে দৌড় লাগায়। ছাত্রদল বিষয়টা ঘেঁটে দেখতে আগায়। আফরাজ ছুটে এসে দেখে নাজীবা ডুবচ্ছে। ‘নাজীবাআআআ’ চিৎকার করে ডেকে উঠে আফরাজ। পরণের শার্ট খোলে ঠান্ডা পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দেয়। নাজীবার মুখটা পানির ভেতর ডুবে যায়। আফরাজ সাঁতরে নাজীবার কাছে গিয়ে কোলে নেয়। খেয়াল করে দেখল চোখ বন্ধ, জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে মেয়েটা। পুকুরের ধারে গিয়ে ফেলে যাওয়া শার্টটা বিবিজান এর শরীরে জড়িয়ে জোরে জোরে বুকের উপরে চাপ প্রয়োগ করে। প্রচন্ড চাপের ফলে জোরালো তেজে নাজীবা কাশতে লাগে। মুখের থেকে লাগাতার পানি বের হতে থাকে। যা দেখে আফরাজ আলতো হাতে বিবিজান কে জড়িয়ে ধরে স্থীরভাবে মাটির উপরে বসে থাকে। নাজীবা শরীর ঠান্ডায় তড়তড় করে কাঁপছে। আফরাজ বিবিজান কে কোলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসায়। গাড়ির হিটার অন করে দেয়। যার হাওয়ায় মোটামুটি স্বস্তি পায় নাজীবা। আফরাজ বাহিরে ভার্সিটির লোকগণের দিকে গম্ভীর নজরে তাকিয়ে বসে পড়ল। বাক্যহীন গাড়ি চালু করতেই আফরাজ বাসার রাস্তার দিকে গাড়ি ঘোরায়।
তাবাসসুম বেশ খুশি হলো। নাজীবার পানিতে জুবু-থুবু শরীরের ছবি তুলেছে সে। এই ছবিই সে খদ্দরের কাছে পাঠিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতাবে। খদ্দর চাইলেই লোক লাগিয়ে নাজীবা-কে হাতড়ে খদ্দরের কাছে পাঠাবে। কেননা তার ইচ্ছে করছে না এত সহজে নাজীবা-কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে! সে শোধ তুলবে। এত মাস যাবত হয়ে আসা অপমানের শোধ গুণে গুণে নিতে চাই সে।
____
ঘণ্টাখানেক পর শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো নাজীবা-র। তার পাশে জলপট্টি এনে বসে আফরাজ। বাসার কাউকে ব্যাপারটা জানাল না। হিতে চিন্তায় পড়বে বলে! আকবর এর মাঝে এসে ওষুধপত্র দিয়ে চলে গিয়েছে। নাজীবা-র শরীরের তাপমাত্রা মেপে আস্তেধীরে জলপট্টি দিতে লাগে। রাফি লাগাতার কল-ম্যাসেজ করে যাচ্ছে। এতে আফরাজ অসহায় ভঙ্গিতে ফোনের দিকে একপলকে তাকিয়ে পুনরায় বিবিজান কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যথায়, রাফি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। আকবর স্যারের রুমে প্রবেশ করবে কি করবে না সেটা ভেবে ভীতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের দরজায় কাঁপা হাতে নক করল। আকবর সবেই কুসুমাকে ওষুধ সেবনের জন্য ওষুধ হাতে নিয়ে ছিল। কেউ আসায় কুসুমা উঠতে চাইলে আকবর বারণ করে দিল। সে নিজ দায়িত্বে গিয়ে দরজা খুলল। বাহিরে রাফিকে ঘাবড়ানো নজরে চেয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। রাফির নজর আকবর স্যারের হাতের উপর পড়ে। হাতে সেই ওষুধ দেখে তৎক্ষণাৎ ঢোক গিলে বলে,’স্যার আপনার হাতের ওষুধটা ভুল। এটা তাবাসসুম এর মা পরিবর্তন করে দিয়েছে। আসলটা আমি কিনে এনেছি। হিয়া চুন্নী ম্যামের আসল ওষুধ ফেলে দিয়েছে।’
কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেল আকবর। হাতে থাকা ওষুধ উল্টেপাল্টে দেখে পকেটে ফুরে নেয়। ফামের্সীতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখবে কিসের ওষুধ ঐ ডাইনি মহিলা রেখেছিল? মনেমন কথা ভেবে রাফির হাত থেকে ওষুধ নিয়ে তার পিঠ চাপড়ে সাবাসী দিয়ে যেতে বলল। তৃপ্ত শ্বাস ফেলে দরজা বন্ধ করে কুসুমার কাছে আসে। সে প্রশ্ন করতে চাইলে আকবর তাকে চুপ করিয়ে ওষুধ খাওয়ে দেয়। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ঘুমাতে বলে আকবর। স্বামীর আদেশে মুখ ফুলিয়ে কুসুমাও চোখ বুজে নেয়।
নাজীবা-কে হালকা পাতলা বিস্কুট খাওয়ে ওষুধ সেবন করালো আফরাজ। বালিশে শুয়ে দিয়ে জলপট্টি দিল পুনরায়। প-ট্টি পানিতে ভিজিয়ে নাজীবার কপালে মেলে দেয়। পরণের শার্ট পরিবর্তন করে ফোন হাতে নেয়। রাফির নাম্বারে কল লাগায়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)সে কল রিসিভ করে পুরো ঘটনা খুলে বলল। এমনকি তার বাবা-মায়ের গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নতুন কিনে আগের স্থানে রেখেছে বলে জানায় রাফি। শুনে কপাল বুড়ো আঙুল বুলিয়ে রাফিকে বলে,
“নাদিম ভাইকে বল রিসোর্টে আজ রাতেই যাবো। দেখি এই মেয়ে আর মেয়ের মা দু’জনে কত কান্ড ঘটাতে পারে? নাজীবার সঙ্গে হওয়া ঘটনাটা কোনো দুর্ঘটনা নয় বরং কারো জাল মনে হচ্ছে আমার। এই জালের মূলে যে, তাবাসসুম তা আমি হলফ করে বলতে পারি। দেখি তোকে যা বলছি কাজে লেগে পড়। অন্যান্য মেইডদের সাথে কানাঘুষা করে এই কথা ছড়িয়ে দেয় আমি আর নাজীবা রাতেই রিসোর্টে যাবো। ঠিক মাগরিবের পরপর।”
“ওকে স্যার আপনার কথামত কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে।”
আফরাজ কল রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরোলো। তখন নাজীবার শুকনো কাঁশির শব্দে এগিয়ে গিয়ে রুমাল দিয়ে নাক মুছে দেয়। পানি খাওয়ে পুনরায় বালিশে মাথা হেলিয়ে দেয় নাজীবার। জ্বরে কাবু হয়ে আছে মেয়েটা। তড়তড় করে কাঁপা বিবিজান এর ছোট শরীরে উষ্ণতার ছোঁয়া দিতে আফরাজ কম্বলের ভেতর ঢুকে বিবিজান-কে আঁকড়ে ধরে। উষ্ণ পুরুষেলী শরীরের লোমশ বুকে নাজীবা-র শরীরও কেঁপে উঠে। জ্বরের ঘোরেও স্বামীকে পরম আনন্দে উষ্ণতা অনুভব করার লোভে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। আফরাজ তার বিবিজান এর কান্ডে মৃদু হাসল। চোখের উপর চলে আসা ছোট চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দেয়। কপালে গভীর চুম্বন দিয়ে কম্বলটা ভালো করে মোড়ে নেয়। যেনো তার উষ্ণতা শুধু তার বিবিজান অনুভব করে যায়।
চলবে……
(কালকে ইন শা আল্লাহ শেষ পর্ব দেওয়া হবে।)
#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৩২( সমাপ্তির দ্বিতীয়াংশ)
তাবাসসুম পাগল পাগল হয়ে গেল। পায়চারী করে একের পর এক রুম চেক করছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিগণকে পেলো না। মনে হচ্ছে পুরো বাসা খালি। হিয়া দেয়ান বুঝতে পেরেছে ফাহিম পরিবারের সবাই তাদের ধোঁকা দিয়েছে। তিনি মেয়ের দিকে ক্ষোভ-মিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে বলেন,
“আমার মনে হচ্ছে তারা আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রিসোর্টে চলে গেছে। এখনি আমাদের বের হওয়া উচিৎ চল।”
দাঁতে দাঁত চেপে তৎক্ষণাৎ মা-কে নিয়ে বাসার থেকে বেরিয়ে যায় তাবাসসুম। তাদের কান্ড আড়াল থেকে নিশ্চুপে পরখ করছিল রাফি। মা-বেটিকে যেতে দেখে নিজের মালিককে রিমাইন্ডার দিয়ে দেয়। এক ভ্যানের মধ্যে পুরো পরিবার বসে আছে। রিসোর্টের প্রায় কাছেই চলে এসেছে তারা। পরিকল্পনা করে সবাই রিসোর্টের জন্য বেরিয়েছে। রাফির রিমাইন্ডার পেয়ে বাঁকা হাসল আফরাজ। নাজীবা জানালার বাহিরে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এতো বড় রিসোর্টে তারা থাকবে। বীচ-সাইড রিসোর্ট। নিজের কেবিনের জানালা থেকে ভ্যান গাড়ি ঢুকতে দেখে নাদিম উত্তেজিত হলো। তার বোন-কে কত বছর পর বুকে নিতে পারবে। সেই আশায় তার বুক ধড়ফড় করছে। নাদিমের এরূপ দশা দেখে তার পিএ কাজল ভ্রু কুঁচকাল। মুখ বাঁকিয়ে বিরবিরিয়ে বলে,’লুচ্চু ছেলে খালি মেয়েদের দিকে তাকাবে। আমার মত সুন্দরী-রে কি তোর চোখে পড়ে না? নাকি আমার মুখে কালি মাখা আছে। ধুর তোর চোখেই ছানা পড়ছে। হা’রা’মজা’দা বস একখানা।’
নাদিম ফিসফিস শুনে বিরক্ত চোখে একপলক কাজলের দিকে তাকিয়ে বলে,’দেখো তোমার ফিসফাস করতে মন চাইলে এ কেবিন থেকে বের হও। শুধু শুধু আমার মাথার পোকা কে রাগিও না। নাহলে পরের বার তোমার ঠোঁটের উপর অত্যাচার চালাবো। আগেরবার প্রথম ছিল বলে চোখের উপর ঠোঁট বসিয়ে ছিলাম।’
কথাগুলো বলে বাঁকা হাসল। বসের কথায় কাজল জমে যায়। আমতা আমতা করে রুমের থেকে বেরিয়ে গেলো। নাদিম তার লজ্জাবতীর লাজ দেখে তৃপ্তি পেলো। এইতো এক রমণী যাকে ছাড়া তার জীবনে আর কেউ ছিল না। সেদিন পথের ফকির হয়ে ঘুরার বদলে এই রমণীর একজোড়া হাতের মুঠোয় নিজের হাত রাখতেই পুরোটা জীবন তার সঙ্গে পারাপার হওয়া। কখনো ভাবেওনি নাদিম তার মনের জগতে এই রমণী এতটা জায়গা করে নেবে। তাইত প্রতিমুহূর্তে এই রমণীকে তার চাই,চাই মানে চাইই। নাদিম দরজার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে পুনরায় বাহিরের দিকে তাকায়। ঐ যে তার বোন,কত বড় হয়ে গেলো মেয়েটা। সে তো নিজ হাতে পুতুল এনে দিতো। এখনো মনে হয় ভাইকে দেখলেই এসে বায়না ধরবে ভাইয়া আজকে কিন্তু তুমি চকলেট আনোনি। আমি খুব লাগ করছি। ছোট বোনটার তোতলা কথা শুনে সে কতই না হেসে বায়নাগুলো পূর্ণ করতো। ছোটবেলার কথা মনে পড়ায় তার চোখের কোণে কবে পানি জমালো টেরও পেলো না। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)চোখ মুছে পরণে কোট জড়িয়ে নেয়। নিজস্ব সত্তাকে স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টা মাত্র। তখন ফোনে কল আসার শব্দে নিজেকে ধাতস্থ করে ফোনটি রিসিভ করে। অপরপাশ থেকে ‘শা’লা’ কথাটি শুনে মৃদু হাসল।
‘শা’লা’ আমার বউয়ের দিকে কু’নজর দেওয়া বন্ধ কর। নাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।’
‘জনাব আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন। যাহাকে আপনি বউ বলিয়াছেন তাহা আমার রক্তের বোন লাগিয়াছে। আমি বলিলেই আমার বোন আমার কাছে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠিবে। তাই সাবধানে কথা বলিবেন।’
‘তুই তো শা’লা সুবিধার না। আমার বউকে ভাগিয়ে নিজের কাছে রাখার প্ল্যান করছিস। তোর পরিচয় গোপন রাখব। বলতাম না আমার কোনো শা’লা টা’লা আছে। তুই তোর বউয়ের আঁচলের নিচে গিয়ে মর। আমার বউয়ের আঁচল ধরে আমি ঘাপ্টে মে’রে বসে থাকব। দেখি কোন বাপের সাহস কত বড়? আমার বউকে ভাগানোর হুহ্।’
‘চুপ ব্যাডা নিচে থাক আমি আসতেছি।’
নাদিম ফোন রেখে আবেগী মনকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো। কেবিনের দরজা পেরিয়ে নিচের ফ্লোরে এগিয়ে গেলো। সানন্দের সহিতে ফাহিম পরিবারের সদস্যদের আপ্যয়ন করা হচ্ছে। কাজল একের পর এক ফুল বিতরণ করছে। নাজীবা-র বিষয়টা বেশ আনন্দের লাগল। ফুলটা শুঁকে আফরাজ এর গালে কামড়ে দেয়। যা দেখে আফরাজ চোখ সরু করে তাকালো। নাজীবা পোচ দেওয়ার মত মুখ করে তার ফোনের ক্যামেরায় ক্যাপচার করে নিলো। আকবর তো তার বউকে নকশার কারুকাজ করা স্থানে দাঁড় করিয়ে একেক এঙ্গেলে ছবি তুলছে। জনাব ইসমাইল আর মিসেস ফেরদৌসী পরিবেশটা উপভোগ করছেন। রিসোর্ট এর ঠিক বিপরীতে রয়েছে নেভাল বীচ। আজ রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় নেভাল বীচের দিকে যাবে না বলে ভেবে রাখলো। হঠাৎ কারো আগমনে তাদের সকলের দৃষ্টি সেই মানুষটির দিকে পড়ে। কাজল বসকে দেখেই সকলের দৃষ্টিকার্ষণে ডেকে উঠে। আফরাজ আর আকবর ব্যতীত সকলের চোখে মানুষটি নতুন। তার চেয়ে বড় কথা পরিচয় হলো এই রিসোর্টটি তার। ‘টুরিস্ট অফ নেভাল’ রিসোর্টটি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি চোখ ধাঁধানো পরিবেশের মুগ্ধতা বিরাজ করে।
কাজল পরিচয় করিয়ে দেয়। এতেও নাজীবার ভ্রুক্ষেপ নেই। তার চোখের দৃষ্টি স্থির। শরীরটা ঝংকার দিয়ে উঠেছে বোধহয়। ঢোক গিলে আফরাজ এর হাতের উপর থেকে হাত সরিয়ে নাকিব মুনসিফ নামক লোকটির নিকট এগিয়ে গেলো। নাকিব মুনসিফ নামটা অন্যরকম হলেও নাদিম তো তার আসল নাম। নাদিম এর ইচ্ছে করছে তার বোনটাকে ঝাপ্টে ধরতে। কিন্তু ফাজিলের হাড্ডি ফাজিল আফরাজ তার ব্যাপারে কোনো কথাও তুলছে না। রা’গ পেলেও আফরাজ এর লুকানো শ’য়’তানি হাসি দেখে মনেমন কয়েকটা গা’লি ছুঁড়ে মা’রল। মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখা তার পক্ষে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে পড়ছে। নাজীবা অচেনা মানুষটির মুখোমুখি হলো। তার মুখের আদলে সে কিছু একটা খোঁজে চলেছে। এমন আচরণ তো সে একজনের সাথেই করতো। কাঁপা হাতে চোখ বুজে তার হাতের স্পর্শ নাকিব নামক লোকটির গালে ছুঁয়ে দেয়। জনাব ইসমাইল, মিসেস ফেরদৌসী আর কুসুমা অবাক চোখে চেয়ে আছে। তাদের কাছে দৃষ্টিকটু মনে হলেও আফরাজ আর আকবর ভাবলেশহীন। দু’জনের মতিগতি দেখে তারাও প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছে না। নাজীবা-র গলা পাকিয়ে কান্না আসছে। চোখ বুজে থাকা অবস্থায় চোখের কোণা দিয়ে পানি পড়ছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে নাদিম চট করে নাজীবাকে বুকে আগলে নেয়। কাজলের দৃষ্টিদ্বয় শীতল হয়ে গেলো। তার বুকের মধ্যে অজানা হারানোর বেদনা গ্রাস করছে। নাকিব কেনো এই মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো? সে তো অন্যের স্ত্রী। তবে কি তার প্রাক্তন প্রেমিকা? কথাটা মাথায় আসতেই তার শরীর-মন ক্রোধে কেঁপে উঠে। বাক্যহীন তৎক্ষণাৎ নাদিম এর শরীর থেকে হিচড়ে টান দিয়ে দূরে ধাক্কা দেয় নাজীবা-কে। ভাগ্য ভালো বিধেয় আফরাজ কিছুটা আঁচ করতে পেরে তৎক্ষণাৎ তার বিবিজান কে আগলে নেয়। নাদিম এর মেজাজ তুঙ্গে উঠলো। মেয়েটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। নাজীবা-র স্থানে অন্য নারী হলে এ কাজ করলে সে মেনে নিতো। কিন্তু তার বোন-কে এভাবে আলাদা করা। মানতে পারল না মোটেও। দাঁত চেপে কাজলের বাহু চেপে নিজের দিকে ফিরিয়ে জোরেসরে চ’ড় বসালো। চ’ড়ের প্রতিঘাতে কাজল ব্যালেন্স হারিয়ে ফ্লোরের উপর পড়ে যায়। নাদিম চিৎকার করে বলে উঠে।
“তোর সাহস কেমনে হলো আমার বোন-কে আমার বুকের ভেতর থেকে দূরে সরানোর? খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস না। শোন কালকে থেকে যেনো তোকে অফিসের ধারেকাছেও না দেখি। লো ক্লাস গার্ল লো ক্লাস পজিশনেই থাকবি।”
নিজের মেয়ের উপর ঘাত হওয়া দেখে জনাব কাশেম এর চোখে পানি চলে এলো। তিনি তৎক্ষণাৎ তার মালিকের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলো। কাশেম মিয়াকে দেখে নিজের রা’গ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল নাদিম। কপালে হাত রেখে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলে,’আপনি আপনার মেয়ে কে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যান। তাকে আমি এমুহুর্তে আর চোখের সামনে দেখতে চাইছি না।’
কাজলের গাল ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তবুও টু শব্দ অব্দি করল না। একটু নাহয় বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। তার মানে এই নয় সকলের চোখের সামনে তাকে অপদস্থ করবে। তার আত্মসম্মান বলতে কিছু তো আছে। চোখ মুছে বাবার হাত ধরে বলে,’থ্যাংকিউ স্যার আমার রাস্তা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে।’
বাবাকে নিয়ে আর অপেক্ষা করল না। রাতের আঁধারে বেরিয়ে যায়। রাত হলেও রিসোর্টের আশপাশ জুড়ে হৈচৈ লাইটিং করা। তাই তারা নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যেতে পারবে। এতটুকু ধারণা করে তপ্ত-শ্বাস ফেলল নাদিম। তার রা’গ নিয়ন্ত্রণ থাকত কিন্তু কাজল অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করায় সে হাত উঠিয়ে ফেলেছে। নাজীবা বোবার মত চেয়ে রইল। আফরাজ আমতা আমতা করে নাদিম এর পিঠে চা’প’ড় মে’রে বলে,
“সরি রে দোস্ত আমার উচিৎ ছিল সবাইকে তোর সত্য পরিচয় জানানো। নাহলে আজ এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। তুইও কম কিসে মামা? হবু ভাবী গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে বসে আছিস। আগে বললে তোর ভাগেরটারেও জানিয়ে দিতাম। এই না বলার ভুলটা কিন্তু তোর মামা। এই দোষ মোটেও আমি আমার মাথায় নেবো না নেভার এভার।”
“ব’দমা’ই’শ ব্যাডা ফাঁদে ফেলে এখন শান্ত্বনা না দিয়ে উল্টো টিটকারী মারছিস। ভুলে যাস না বোনটা কিন্তু আমার।”
“তো তাতে কি নিয়ে যাহ। বোনের ভাই নিয়ে যেতেই পারিস। আমি কি তাতে মানা করবো নাকি?”
নাদিম চোখ রাঙালে আফরাজ হাত উঁচিয়ে বুঝছি বোঝায়। সকলের দিকে তাকিয়ে বিশেষত নাজীবা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এই হলো নাদিম মুসাররাত মোবারক আলী আর মেহজাবিন সিরাত এর বড় পুত্র আর আমার বিবিজান এর পরম মিত্র ভাই। এক বোনের স্পর্শের মর্ম এক বোনই বুঝে কেননা ভাই তো তারই।”
কথাটা বলার পরপর নাজীবা পুনরায় নাদিম-কে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ কান্না করতে লাগে। নাদিম ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বোনটা বড় হলে কি হবে এখনো ছোট রয়ে গেলো! বোনকে সোফায় বসিয়ে চোখজোড়া মুছে দিয়ে টিটকারী-র সুরে বলে,’দোস্ত বোন তো আমার বাচ্চা রয়ে গেলো। তুই ওর সাথে উল্টাপাল্টা কিছু ভুলেও করবি না। নাহলে আমি তোর এপারওপার করে দেবো।’
আফরাজ মুখ বাঁকিয়ে বলে,’এ্যাহ আসলো আমার কোথাকার কোন মেলায় হারিয়ে যাওয়া শা’লা। তোর বোন আমার বিবিজান। শুধু উল্টাপাল্টা করব না বরং তোর কোলে উল্টা নয়-দশটা বাচ্চা দিয়ে পূর্ণ করে দেবো দেখিস।’
খুব ভাব নিলো কথাটা বলে। নাজীবার তো কান্না বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু আফরাজ এর কথায় বিড়ম্বনায় পড়ে গেল। নাদিম গলা ঝেড়ে অন্যদিক চোখের দৃষ্টি ফেলল। নাজীবা মুখ ফুলিয়ে চোখ রাঙায়। এতে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিল না আফরাজ। নাদিম সেসবে খেয়াল না দিয়ে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তোর কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো আফরাজদের সাথে? আমার সাথে তোর খুব অভিমান তাই না? আমাকে মাফ করে দিস-রে বোন। তোর খারাপ সময়ে তোকে সামলানোর জন্য আমিও ততটা সবল ছিলাম না । তাইত আমাদের উপরে আল্লাহ মেহেরবান হয়েছিলেন। তোকে তোর নিজের আসল স্থানে পাঠিয়ে দিলেন। তোর কাছে অটুট বন্ধন রক্ষাকারী একজন এলো। আফরাজ তোকে খুশি সুখি রাখবে আমি জানি। রাগারাগী হবে স্বাভাবিক আর আমি জানি তুই মানিয়ে নিবি। এই ভাইটার কাছেও কয়েকদিন পারলে থেকে শ্বশুরবাড়ি যাইস। জানিস তোর জন্য আমি তোর পছন্দমত রুম সাজিয়েছি। আমার বড় বাংলো আছে।”
“ভাইয়া ব্যস করো। আমি থাকব তোমার এখানে। আমি রাগও আর রাখিনি মনে। কিন্তু একটা বিষয়ে খারাপ লাগছে। আমার কারণে তুমি মেয়েটার সাথে খুব খারাপ আচরণ করে ফেললে। এতটা রাগ হওয়া তোমার উচিৎ হয়নি। তুমি চাইলেই পারতে বুঝিয়ে বলতে। তা না করে হাত উঠিয়ে পুরুষত্বদেখালে? আমি এতে খুব খারাপ বোধ করছি। মেয়েটার চোখে তোমার প্রতি ভালোবাসা দেখেছি আমি।”
কথার পিঠে কি বলল নাজীবা বুঝতে পেরে থ বনে গেলো। চোখ পাকিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,’ওয়েট ভালোবাসা আচ্ছা তাহলে এই কাহিনী! বলো কাহিনী কি হুম?’
নাদিম মাথা চুলকে বলে,’অনেক বড় কাহিনী। তোর বাচ্চা হলে তখন মামা হিসেবে কাহিনীটা শোনাবো। আপাতত তোকে সারাংশটা জানিয়ে দেয়। তোদের ছেড়ে পথের মিসকিন হওয়ার পর ঐ মেয়েটাই ছিল আমার একমাত্র আশ্রয়। তার বাবা আমার এই রিসোর্টের দারোয়ান। আমি লুকিয়ে আমাদের বাবার কাছ থেকে পেয়ে ছিলাম ব্যবসার দলিলপত্র। তার তদারকি করতে নিজের নাম বদলে নাকিব মুনসিফ রেখে ব্যবসা চালু করি। তাইত দাহাব এহসান আমাকে ঘুণাক্ষরেও চিনতে পারেনি। বরং তার কাছে আমাকে সোনার হাঁস মনে হয়ে ছিল। আমিও তার মুখে টাকা ছুঁড়ে বাবার জমির টাকায় ব্যবসা চালাতে পেরেছিলাম। ঐ মেয়েটা আমার মনের ক্ষুধার্ত জীবনের একমাত্র চিহ্ন। আজকে একটু বাড়তি রা’গ দেখিয়েছি। বাট ডোন্ট ওয়ারি তোর ভাই প্রেমিক হিসেবে বেশ রোমান্টিক। দেখবি কালকেই তোর হবু ভাবীকে সামনে হাজির করে দেবো।’
দু’ভাইবোন আপনাআপনি হেসে ফেলল। আফরাজ দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখে চোখ মুছল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)তারও তো একটা বোন থাকার কথা ছিল। কিন্তু আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ছেড়েই চলে গেল। ‘আফরিন’ নামটা মায়ের মুখে আর এলবাম-এ কয়েকবার ছবি দেখে ছিল। বোন নামক মানুষটির সাথে তারও খুব লাঘব থাকার কথা ছিল! হায় আফসোস! জীবনটা বড়ই অদ্ভুত।মিসেস ফেরদৌসী ছেলের মনোভাব বুঝতে পেরে ছেলের নিকট এগিয়ে যান। আফরাজ মা-কে দেখে বোনের ব্যাপার মাথা থেকে ঝেড়ে মা-কে জড়িয়ে ধরে। জনাব ইসমাইল খুশি হলেন অনাথ মেয়েটার বর্তমান পরিচয় বহনকারী একজন পেলো। তারা তো আছেই। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির চেয়ে বাপের বাড়ির মায়া মমতা এক মেয়ে কখনো ভুলতে পারেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানের দিকে চেয়ে তিনি মনেমন দোয়া পাঠ করলেন। যেনো কোনো কুনজর তাদের পরিবারের উপর না পড়ে।
চলবে…….