#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-০৭
রাতের আঁধার কেটে পুব আকাশের বুক চিরে উদয় হচ্ছে টকটকে লাল সূর্য। কুয়াশার চাদর সরিয়ে আলো ছড়াতে শুরু করছে পথ-ঘাট, মাঠ সব স্থানে। দূর থেকে দূর্বা ঘাসে জমে থাকা শিশির বিন্দু গুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন দূর্বাঘাসে মুক্তার কনা জ্বলজ্বল করছে। শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের উপর পড়ে আছে শিউলিফুল। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে তারাগুলো খসে সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে আছে। সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই সূচনা হলো নতুন দিনের । সেই সাথে শুরু হল মানুষের আনাগোনা আর ব্যস্ততা।
গতকাল রাতে রাশেদের হাতে মার খাওয়ার পরে আজ সকালে ধুম জ্বর ওঠেছে চন্দ্রার। জ্বরের তীব্রতায় শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে ওর। বার দুয়েক অবশ্য বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করেছিল ও কিন্তু পারে নি। তাই বিছানার এক প্রান্তে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে।
এদিকে রাশেদ গতকাল চন্দ্রাকে মারার পর আবারো সায়মার ঘরে চলে গিয়েছিল। আহত চন্দ্রার দিকে ফিরেও তাকায় নি সে । বাকি রাতটুকু সাইমার ঘরেই কাটিয়েছে রাশেদ। কিন্তু সকাল হতে টনক নড়লো ওর। বেলা তখন নয়টা বাজে। চন্দ্রাকে এতক্ষণে উঠতে না দেখে চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠল রাশেদের কপালে। সাধারনত এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না চন্দ্রা।সায়মার হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত চলে গেল নিজ ঘরের দিকে।
ঘরের দখিনা জানালা বরাবর মাঝারি চৌকিতে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে চন্দ্রা । চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। তৃষ্ণায় গলা ফেটে যাচ্ছে ওর কিন্তু বিছানা থেকে উঠে পানি নেবার মত শক্তি নেই ওর গায়ে । ঠিক এমন সময় দরজা ঠেলে আগমন ঘটলো রাশেদের। চন্দ্রকে এখনও বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হলো ওর। তাই দ্রুত পা চালিয়ে চন্দ্রার পাশে এসে দাঁড়াল রাশেদ। অতঃপর নিজের হাত চন্দ্রার কপালে রেখে আঁতকে উঠলো নিজেই। উৎকণ্ঠে বলে উঠলো,
–” জ্বর আইলো কহন তোমার? আমারে ডাহো নাই কেন?”
চন্দ্রা রাশেদের কথা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটার উৎকণ্ঠা দেখেও ওর মনে কোন বোধ হচ্ছে না বরং মনের ভেতর ঘৃনার সৃষ্টি হচ্ছে। চন্দ্রার একবার মনে হল এখন লোকটাকে তিক্ত কোন কথা শোনানো উচিত কিন্তু শরীর ওকে সাঁই দিচ্ছে না । আপাতত তৃষ্ণা নিবারণ করতে হবে ওকে। নইলে তৃষ্ণার যাতনাতেই মারা যাবে ও।
তাই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে রাশেদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–“আমারে একটু পানি খাওয়াতে পারবেন? খুব পানি তৃষ্ণা পাইছে আমার।”
চন্দ্র কথা শুনে রাশেদ আশেপাশে তাকিয়ে দেখল পানি নেই এই ঘরে। তাই ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
–“তুমি এইহানে চুপ-চাপ শুইয়্যা থাহো। আমি তোমার লাইগা পানি আনতাছি।”
কথাগুলো বলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল বাহিরের দিকে। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর জগ আর গ্লাস নিয়ে আবারো আগমন ঘটলো তার। অতঃপর জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে চন্দ্রার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–” লও পানিডা খাইয়া লও।”
রাশেদের কথা শুনে দুর্বল শরীর নিয়ে চন্দ্রা উঠে হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করল। এতক্ষণ ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে পানি পেয়ে এতক্ষনে ওর তৃষ্ণা মিটল।
চন্দ্রার পানি খাওয়া শেষ হতেই ওর উদ্দেশ্য রাশেদ আবারো বলে উঠলো,
–“জ্বর উঠছে কখন থাইকা?”
রাশেদের প্রশ্নের চন্দ্রা দুর্বল কন্ঠ বলে উঠল,
–“আপনে জাইন্যা কি করবেন?”
–” কোন কথার কি সোজা উওর দেওন যায় না?”
–” না দেওন যায় না। আপনি আপনার ইচ্ছে মতো অন্যের কথায় নিজের বউরে পিটাইয়া এসব আদেক্ষেতা দেখাইতে আইলে তো এমন বাঁকা কথাই শুনোন লাগবো।”
–” চন্দ্রা তুমি কিন্তু আবার বেশি বেশি কতা কইতাছো। চুপ থাকো তা নাহলে….
রাশেদের কথা শেষ না হতেই চন্দ্রা বলে উঠলো,
–“নাহলে আবারো গতকালের মতো মারবেন তাই তো?”
–“চন্দ্রা।”
চন্দ্রার এমন কথা শুনে আবারো ধমকে ওঠল রাশেদ। কিন্তু চন্দ্রা ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
–” আপন্যার ধমকে আর ভয় পাই না আমি….
চন্দ্রার কথা শেষ না হতেই সেখানে আগমন ঘটল সাইমার। সকাল হতেই রাশেদকে এভাবে চলে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল সায়মার। তাই নিজেও দ্রুত ঘুম থেকে উঠে বিছানা গুছিয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছিল বাহিরের দিকে। বাহিরে গিয়ে রাশেদকে জগ হাতে নিজ ঘরের দিকে যেতে দেখে আবারো ভ্রু গেল ওর। এজন্য রাশেদের পিছু পিছু ও নিজেও চন্দ্রা থেকে ঘরের দিকে চলে এলো। পিছনে চুপিসারে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ । চন্দ্রা আর রাশেদের কথপোকথন শুনছিল ও। কিন্তু চন্দ্রার এমন ত্যাড়া কথা শুনে এখন আর চুপ করে থাকতে পারলো না ও। তাই পিছন থেকে সামনে এসে জোর গলায় বলে উঠলো,
–“গতকালের এত মার খাওয়ানের পরেও তোমার শিক্ষা হইলো না চন্দ্রা?”
সাইমাকে দেখে চন্দ্রা ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল। হেসে হেসে বলল,
–” আপন্যারও তো তৃতীয় পক্ষ হয়ে কথা বলার স্বভাবটা গেলো না ভাবি। ”
–” তৃতীয় পক্ষ কারে কও তুমি? তুমি জানো কে হই আমি ?”
–“আপন্যারে এই মুহূর্তে রক্ষিতা ছাড়া আর কিছুই কইবার পারতাছি না ভাবি।”
চন্দ্রার কথা শুনে যেন সায়মা আরো আক্রোশে ফেটে পরলো। জোর গলায় চেঁচিয়ে বলল,
–“কে কইলা তুমি? এত সাহস তোমার। ”
–“সাহসের এহনো কিছুই দেহো নাই ভাবি।”
সাইমা চন্দ্রার সাথে কথায় পেরে না ওঠে রাশেদের দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে ওঠলো,
–” তুমি ওকে কিছু বলছো না কেন? দেখছো না ও আমাকে রক্ষিতা বলে ডাকছে।”
সাইমার কথা শুনে রাশেদ রেগে বলে ওঠলো,
–“তোমারে আমাগোর মধ্যে কে আইতে কইছিল?”
রাশেদের এমন কথা শুনে সাইমা অবাক হয়ে বলল,
–“কি কইলা তুমি? আজকাল বউয়ের জন্য দেহি খুব দরদ উতলাইয়া ওঠতাছে। তা রাতের আন্ধারে আমার কাছে আহোনের আগে বউ কতা মনে পড়ে নাই।”
–“আহ সাইমা।”
–“খবরদার রাশেদ আমার লগে রাগ দেখাইবা না। আমারে তুমি চন্দ্রা পাও নাই। তুমি যদি আজ চন্দ্রারে শাস্তি না দাও তবে আমি পাড়ার সব লোক ডাইকা তোমার সব কুকীর্তি ফাঁস কইরা দিমু। এহন ভাইবা দেহো কি করবা।”
সাইমার কথা শুনে রাশেদ যেন অকুল পাথারে পরে গেল। সাইমা সম্পর্কে ও আগে থেকেই অবগত। বড় বেশি জেদি সাইমা। এখন যদি ও চন্দ্রাকে না শাস্তি দেয় তবে সত্যি সত্যি সাইমা পাড়ার লোক জড়ো করবে। কিন্তু চন্দ্রার এই অবস্থায় ওকে মারতেও রাশেদের বিবেকে বাঁধছে এখন।
এদিকে রাশেদকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সায়মা আবারও তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
–“কি ব্যাপার চুপ কইরা খাড়াইয়া রইছো ক্যান? কি কইলাম তোমারে হুনো নাই?
–“হুনছি কিন্তু চন্দ্রার আজ শরীর খারাপ। তোমারে খারাপ কতা কওনের শাস্তি পরে দিমু নি ওরে।”
রাশেদের কথা শুনে সায়মা আবারও চেঁচিয়ে ওঠে বলল,
–“পরে দিবা কেন আজকেই দিতে হইব। নইলে……
–“ঠিক আছে। তুমি যাও আমি ওরে শাস্তি দিতাছি।”
–“আমার যাওন লাগবো ক্যান?”
–” আরে বাবা তুমি খাওনের ব্যবস্থা করো আমি ততক্ষনে ওরে পিটাইয়া লই।”
রাশেদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে সাইমা খাবারের যোগাড় করতে গেল । রাশেদ যখন ওরে কইছে তহন চন্দ্রা ওর শাস্তি পাইবোই।
এদিকে সাইমা চলে যেতেই রাশেদ ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে চন্দ্রার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
–“এহন আমি যা কমু হেইডাই শুনবা। কথা বাড়াও না। তোমার ভালোর লাইগাই কইতাছি।”
–“কি কইবেন হুনি।”
–” আমার এই লাঠি দিয়া বিছানায় বাড়ি দেওনের সাথে সাথে তুমি চিল্লাইয়া ওঠবা। বুঝলা?”
–“আজ হঠাৎ এত দরদ আমার লাইগা। ব্যাপার কি কন তো?”
–“এমনিতেই। আজ তোমারে পিটাইতে মন চাইতেছেনা আর তাছাড়াও গতরাতে তোমারে অনেক মারছি আজ যদি আবার মারি তাইলে মারা তাইবা…..
রাশেদের কথা শেষ না হতেই চন্দ্রা বলে ওঠল,
–” আমি মইরা গেলে পুলিশ আপনারে ধইরা লইয়া যাইবো তাই এতো দরদ উতলাইয়া ওঠছে আমার লাইগা তাই তো।”
চন্দ্রার কথা শুনে রাশেদ থমকে বলে উঠলো,
–“এত কতা কও কিল্লাই? যা কইলাম তাই করো।”
কথাগুলো বলে দরজার পাশ থেকে লাঠি নিয়ে বিছানায় মারতে লাগল ও। অতঃপর চন্দ্রাকে ইশারায় কান্না করতে বলল। চন্দ্রা প্রথমে গাইগুই করলেও রাশেদের তোপের মুখে পড়ে জোরে জোরে কান্না করতে লাগলো। যেন রাশেদ ওকে মেরে ফেলছে।
এদিকে চন্দ্রার আর্তনাদ শুনে সাইমা তো বেজায় খুশি। তাই আর অপেক্ষা না করে খুশি মনে রান্না ঘরের দিকে যেতে লাগল কিন্তু দাওয়া পেরোনের আগেই আকলিমা বেগম ও গফুর মিয়াকে বাড়িতে ফিরতে দেখে ভয়ে বুক কেঁপে উঠল ওর। আজ যদি ওনারা সত্যি কথাটা জানতে পারেন তবে সাইমাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিবেন।
এদিকে সাইমাকে ঘরের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু-কুচকে গেল আকলিমা বেগমের। সাইমাকে কিছু বলার আগেই চন্দ্রার আর্তনাদ শুনে ছুটে চলে গেলেন সেদিকে।
চলবে