#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২১
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ
মিনার ভাইয়ের অসম্পূর্ণ চিঠিটা হাতে রেখেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালাম মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে।চাহনী তার তীক্ষ্ণ।ভ্রু জোড়াও কিঞ্চিৎ কুঁচকে রাখা। আমি কাগজটা উপরে তুলেই বললাম,
” একটা চিঠি।চিঠি তো ব্যাক্তিগত বিষয়াদি। তাই লুকিয়েই রাখছিলাম।”
আমার উত্তরে মেহেরাজ ভাইয়ের চাহনী বদলে গেল।ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
” তোকে কে কে চিঠি লেখে?”
” তেমন কেউ নেই চিঠি লিখার।তবে এই চিঠিটা মিনার ভাই লিখেছেন। ”
মেহেরাজ ভাই আবার ভ্রু উঁচালেন।জিজ্ঞেস করলেন,
” তোকে?”
মৃদুস্বরে বললাম,
” হয়তো।”
মেহেরাজ ভাই এবার আর কোন আগ্রহ দেখালেন না চিঠিটা নিয়ে। পুনরায় কোন প্রশ্নও করলেন না।চোখমুখ থমথমে করে আবারও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।আমি সেদিক পানে তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।মিনার ভাইয়ের লেখা অসম্পূর্ণ চিঠিটা ড্রয়ারের এককোণে তুলে রেখে নিশ্চুপে বসে থাকলাম নিজের ঘরে।হঠাৎ ঘরের বাইরে থেকে আব্বার গলা ভেসে আসল। দরজার কোণ থেকে একনজর তাকিয়ে দেখলাম মেহেরাজ ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আব্বা। গলা ঝেড়ে বলে উঠলেন,
” রাজ,তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।শুনবা?”
মেহেরাজ ভাই শান্তভাবে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন,
” জ্বী চাচা,বলেন। ”
” বসে কথা বলি?চলো আম্মার ঘরেই বসি। কেউ তো নেই বোধহয়। ”
আব্বা বোধহয় জানতেন না আমি ঘরে আছি।ধুপধাপ পা ফেলে দাদীর রুমে গিয়ে বসলেন। মেহেরাজ ভাই কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না।বোধ হয় ঘরে যে আমি আছি এটাই বলতে চেয়েছিলেন।পরমুহুর্তে আব্বার পিছু পিছু এসে দাদীর রুমে ডুকলেন। আব্বা চেয়ার দেখিয়ে বললেন,
” বসো।”
মেহেরাজ ভাই বসলেন চুপচাপ।আব্বা কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে এবার বললেন,
” রাজ? তুমি কি এখনো তোমার চাচাতো বোনকে ভালোবাসো?মানে সামান্তাকে কি এখনো ভালোবাসো?তোমার আর জ্যোতির বিয়েটা তোমাদের ইচ্ছাতে হয়নি বুঝলাম বিষয়টা। কিন্তু এতগুলো দিনেও কি তোমার আর জ্যোতির সম্পর্কটা কি স্বাভাবিক হয়নি?তুমি কি এখনও সামান্তাকে আঁকড়ে আছো?”
আব্বার কথায় মেহেরাজ ভাই মুখ তুলে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন।বললেন,
” মানে? ”
” তোমাদের মাঝে স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কিনা তাই জিজ্ঞেস করছি।গড়ে উঠেছে?”
মেহেরাজ ভাই ভরাট গলায় উত্তর দিলেন,
” না, গড়ে উঠেনি।”
” সামান্তাকে আঁকড়ে আছো এখনো?”
” না।সামান্তা অতীত বলে সে ক্ষনেই মেনে নিয়েছিলাম যে ক্ষনে জ্যোতির সাথে বিয়েটা হয়েছিল।তবে এটা ঠিক, ভালোবাসা অতীত বর্তমান মানে।”
” এখনও ভালোবাসো ওরে?”
” জ্যোতিকে বিয়ে করেছি হিসেবে সামান্তাকে ভালোবাসাটা অযৌক্তিক।তবে সত্যি কথাটা হলো,সামান্তাকে অতীত হিসেবে মেনে নিয়েছি বাস্তবতার কারণে।আজও হয়তো আমার মনে সামান্তার জন্য জায়গাটার পরিবর্তন হয়নি।”
মেহেরাজ ভাইয়ের উত্তরটা এমনকিছুই হবে জানা ছিল। তবুও আমার হঠাৎ কষ্ট হলো। মিথ্যে মায়ায়, মিথ্যে যন্ত্রনায় বুক ভার হয়ে উঠল। বারকয়েক শ্বাস টেনে নিজের কষ্ট আড়াল করে চলে আসতে নিতেই আব্বার গলা শোনা গেল।গলাটা আগের থেকেও গম্ভীর! আব্বা বললেন,
” তোমাকে কিছু কথা বলি রাজ?কথাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ন।বলা যায় আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ তোমায় শেয়ার করতে চাইছি। মন দিয়ে শুনবে। ”
মেহেরাজ ভাই বললেন,
” বলেন চাচা।”
আব্বা কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে গলা ঝেড়ে বলতে লাগলেন,
” জানো রাজ?জ্যোতির আম্মার সাথে আমার পরিচয় বিয়ের পর থেকে নয় বরং বিয়ের অনেক আগ থেকেই ছিল। জ্যোতির আম্মাকে তখন আমি প্রাইভেট পড়াতাম। মনে মনে ভালো লাগত তাকে। পছন্দও করতাম। আমি কিন্তু বিয়ের আগে থেকেই জানতাম যে জ্যোতির আম্মার সাথে চেয়ারম্যানের ছেলে রিয়াদের সম্পর্ক ছিল।তাও যে সে সম্পর্ক নয় সম্পর্কটা ছিল প্রেমের সম্পর্ক।তারা দুইজন আবার সমবয়সী ছিল।আমি ভেবেছিলাম ওটা তাদের সে বয়সের আবেগ হবে। অতোটা সিরিয়াস সম্পর্ক বোধহয় তাদের মাঝে নেই ধরে নিয়েছিলাম।সব জেনেবুঝেই আমি তাকে মন থেকে পছন্দ করতাম, ভালোবাসতে শুরু করলাম।একটা সময় পর স্কুলের চাকরিটাও পেয়ে গেলাম।জ্যোতির আম্মা তখন এসএসসি পাশ করেছে মাত্র।মনে মনে রাখা সে ভালো লাগা, ভালোবাসাটা এবার প্রকাশ করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েই গেলাম আমি।এর আগে তাকে হারানোর ভয় হতো।সে অন্য কাউকে ভালোবাসে জেনেও নিরবে কষ্ট পেতাম। ভেবেছিলাম একবার আমার সাথে বিয়েটা হয়ে গেলে সে ভুলে যাবে তার প্রথম ভালোবাসাকে। মন থেকে উঠে যাবে তার জীবনের প্রথম পুরুষটি।তাকে এতটাই ভালোবাসতাম আমি। তাই চাকিরটা পাওয়া মাত্রই আম্মাকে দিয়ে তাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই। তার মা বাবা প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই রাজি হয়ে গেল।কিন্তু সে রাজি হলো না।তার প্রেমিকসমেত আমার কাছে এসে বিয়েটা ভাঙ্গার অনুরোধ করেছিল। আমি তখন তা পাত্তাই দিই নি।তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর জ্যোতির আম্মার সাথে আমার বিয়েটা হলো।সংসার হলো। একটা সময় পর জ্যোতি জম্মাল, মিথি জম্মাল। আমি ভেবেছিলাম ততগুলো দিনে সে তার জীবনের প্রথম পুরুষকে ভুলে গিয়েছে।ভুলে গিয়েছে তার জীবনের প্রথম অনুভূতিকে।কিন্তু, আমি ভুল ছিলাম রাজ।জ্যোতির আম্মা আমাকে ঠকিয়ে একটা সময় পর ঠিকই ঐ রিয়াদের সাথে পালিয়ে গেল।দুটো বাচ্চা মেয়ের কথাও একবারটি ভাবেনি সে।”
আব্বার ব্যাথাতুর গলায় কথাগুলো শুনে বুকের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করল।আব্বা কি এখনও ততোটুকুই ভালোবাসেন আম্মাকে?এখনো ততোটুকুই অনুভূতি পুষে রেখেছেন হৃদয়ে?হ্যাঁ রেখেছেন।নয়তে আব্বার গলা এতটা ব্যাথাতুর বোধ হতো না।কন্ঠে সবসময় তেজ, ক্ষোভ প্রকাশ করা মানুষটার গলা এতটা নম্র,শান্ত শুনাত না কখনো। আমি আগ্রহ নিয়ে কান খাড়া করলাম আব্বার কন্ঠে আরো কিছু শোনার জন্য।আব্বা আবারও বলে উঠলেন,
” জ্যোতির আম্মাকে আমি এতটাই ভালোবাসতাম যে ওর ঠকানোটা আমি আজ ও মেনে নিতে পারি না।তাকে জড়িত সবকিছুকেই আমি ঘৃণা করি।তাকেও ঘৃণা করি।এমনকি জ্যোতি আর মিথির মধ্যে তার রক্ত আছে বলে জ্যোতি আর মিথিকেও ঘৃণা করে এসেছি। তবে এর আড়ালেও একটা সত্য আছে রাজ।প্রকাশ্যে আমি জ্যোতিকে ঠিক যতটুকু অবহেলা, যতটুকু ক্ষোভ দেখাই আড়ালে আমি ওকে সন্তান হিসেবে ততটুকুই ভালোবাসি।জ্যোতি আমার মেয়ে হওয়া স্বত্ত্বেও ওর সাথে আমার সম্পর্কটা বাকি দশ জন বাবা মেয়ের মতো কোনকালেই ছিল না। তবুও আমি ওর ভালে চাই সবসময়। সবসময়ই ওর মঙ্গল কামনা করি।তাই আমি চাই না, জ্যোতির জীবনের পরিণতিও আমার মতোই হোক।জ্যোতিকেও জীবনে কেউ আমার মতোই ক্রমশ ঠকিয়ে যাক চাই না আমি।যদি আগেই জানতাম তোমার প্রেম সম্বন্ধে তাহলে সেদিন কোনভাবেই অতোটা রাগ, অতোটা ক্ষোভ নিয়ে ওকে বিয়ে করতে জোর করতাম না আমি ।”
এবার কানে আসল মেহেরাজ ভাইয়ের গলা।গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমি কি জ্যোতিকে ঠকিয়ে যাচ্ছি?এটাই বলতে চাইছেন চাচা?”
আব্বা থমথমে গলায় বলে উঠলেন,
” ঠকাচ্ছো নাকি ঠকাচ্ছো না সেটা তো তুমিই খুব ভালো জানো রাজ। তবে এটুকু অনুরোধ জ্যোতিকে মিথ্যে মায়ায় বেঁধে পরে ঠকাবে না দয়া করে।বাবা হিসেবে এটুকু আমি চাইতে পারি বলো।আর যদি ঠকানোর উদ্দেশ্য থেকেই থাকে। তবে আমি বলব, এখনই এ সম্পর্কটা ভেঙ্গে দাও।একসঙ্গে দুইজনার বাস এক হৃদয়ে হয় না।”
মেহেরাজ ভাইয়ের উত্তর আসল একটু পর।বললেন,
” সম্পর্ক ভাঙ্গার হলে আমি ওকে আবার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতাম না। শুরু থেকেই বিয়েটা মেনে চুপ করে থাকতাম না।এমনকি ধীরে ধীরে সামান্তার থেকে দূরে সরার ও চেষ্টা করতাম না চাচা।”
আব্বা তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছুড়লেন,
” কিন্তু সামান্তাকে ভুলেও তো যাওনি? ”
মেহেরাজ ভাই পাল্টা উত্তরে বললেন,
” ভালোবাসা অতো সহজে ভুলা যায় না চাচা।আপনি পেরেছেন চাচীকে ভুলতে?এই যে বলেছেন চাচীকে আপনি ঘৃণা করেন।ঘৃণাটা আসলে ভালোবাসারই অন্য রূপ।আমরা কাউকে ভালো না বেসেই শুরু থেকে ঘৃণা করে আসতে পারি না।”
” কি বলতে চাইছো?”
” আপনার মনে যেমন চাচীর জন্য জায়গাটা সবসময় আছে। তেমনই সামান্তাকে জীবনে প্রথম ভালোবাসা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি বলেই ওর জায়গাটা এখনও মন থেকে একেবারের জন্য মুঁছে দিতে ব্যর্থ আমি।”
মেহেরাজ ভাইয়ের এই কথাটা শোনার পরপরই চোখ বুঝে নিলাম।নিঃশ্বাস ঘন হলো। আবারো টের পেলাম আমি মেহেরাজ ভাইয়ের ঘাড়ে আস্ত এ বোঝা। আমার প্রতি মেহেরাজ ভাইয়ের সমস্ত যত্ন, সমস্ত শাসন শুধু এবং শুধুই দায়িত্ব।শুধু মাত্র একটা মানুষের দায়িত্ব হিসেবে তার ঘাড়ের উপর চেপে থাকাটা কি ভীষণ লজ্জ্বাজনক বিষয় তা এই মুহুর্তে খুব করে টের পেলাম।অপমানে জর্জরিত হলে হৃদয়। চাপা কষ্ট আর আশাহত মন নিয়ে এবার দরজা লাগালাম।খাটে শরীর এলিয়ে চোখ বুঝলাম দ্রুত। চোখের উপর ভেসে উঠল একের পর এক স্মৃতি।
.
মেহেরাজ ভাইের দেখা মিলল আবার রাতে। ফের বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে খাবার খাওয়ার পর কাপড় গুঁছাতে বলতেই আমি বলে উঠলাম,
” মেহেরাজ ভাই? আমি বরাবরই আপনার দায়িত্বে মুগ্ধ হয়ে এসেছি।সত্যিই আপনি একজন দায়িত্ববান পুরুষ। কিন্তু আমি চাইছি না যে দায়িত্বরূপী আমি আপনার জীবনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াই। আমার জন্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেন শুধু শুুধু নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিবেন?একটা সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থাকাটা খুবই লজ্জ্বাজনক!আপনার উচিত আমাকে দয়া না করে আমাকে আমার মতো বাঁচতে দেওয়া।আমি আপনার দয়া চাই না।লোক দেখানো দায়িত্বও পালন করবেন না দয়া করে। এতে আপনি লোকের চোখে মহান হতে পারলেও আমি নিজের কাছে খুব ছোট হয়ে যাব।”
মেহেরাজ ভাই থমথমে গলায় বললেন,
” লোক দেখাচ্ছি আমি এসব করে?”
” তা ছাড়া আর কি হতে পারে? ”
” কিছুই নয়।ব্যাগ গুঁছিয়ে নে। কাল ফিরে যাব।”
আমি শ্বাস টানলাম। মৃদু আওয়াজে বললাম,
” একটা অনুরোধ রাখবেন মেহেরাজ ভাই? আমাকে আর দায়িত্বের বেড়াজালে জড়াবেন না প্লিজ।তবে হ্যাঁ, দায়িত্ব হোক বা দয়া যায় হোক না কেন। এই কয়টা দিন এভাবে আমার পাশে থাকার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি আপনার এইটুকু সহানুভূতি কখনো ভুলব না।তবে নতুন করে আর সহানুভূতি দেখাবেন না দয়া করে।”
মেহেরাজ ভাই চোয়াল শক্ত করে লালাভ চোখে তাকালেন।গমগমে স্বরে বলে উঠলেন,
” তোর অনুরোধটা রাখতে পারছি না।কাল ফিরে যাচ্ছি এইটুকুই শেষ কথা। হোক সেটা দায়িত্বের জন্য বা সহানুভূতির জন্য। ”
” দায়িত্ব, সহানুভূতির থেকে একা থাকা ভালো নয়?”
” এখন তোকে একা ছেড়ে যাওয়াতে মন সায় দিচ্ছে না।যদি কোনদিন সত্যিই প্রয়োজন পড়ে তোকে একা ছাড়ার তখন বাঁধা দিব না।তুই তখন বাঁচতে পারবি নিজের মতো।”
মেহেরাজ ভাই কথাগুলো বলেই বিছানায় সটান শুঁয়ে পড়লেন। আমিও আর দাঁড়ালাম না।দাদীর ঘরে এসে খাটে শরীর এলিয়ে দিলাম।চোখজোড়া মেলে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম নির্বিকারভাবে।কেন জানি না মেহেরাজ ভাইয়ের বলা শেষ কথাগুলো একেবারেই পছন্দ হলো না আমার।
.
সেদিন মেহেরাজ ভাইয়ের মতই অবেশেষে জিতে গেল। আমাকে ফের ফিরে আসতে হলো মেহেরাজ ভাইদের বাসায়। তবে এই এক মাসেও মেহেরাজ ভাই যথেষ্ট যত্ন নিয়েছেন।যথেষ্ট আগলে রেখেছেন অভিভাবকের ন্যায়। আপন মানুষের ন্যায় শাসনও করেছেন।কখনও বা আবার রক্তলাল চোখ দেখিয়ে রাগও দেখিয়েছেন।আমি এখন এসবে অভ্যস্ত!বলা যায় মেহেরাজ ভাই মানুষটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।তবুও নাকে অভ্যাসরূপে মেনে নিতে মন সায় দেয় না।ফের যদি অভ্যাস ভেঙ্গে যায়?ফের যদি মানুষ হারিয়ে যায়?ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভেবেই ফের পা বাড়ালাম বাসার উদ্দেশ্যে।সিঁড়ি বেয়ে বাসায় যেতেই চোখে পড়ল নাফিসার কাঁটা হাত।ফিনিক রক্ত বের হচ্ছে। মেহেরাজ ভাই সেই কাঁটা হাত হাতে নিয়েই রাগ নিয়ে বললেন,
” চুরি ধরতে কে বলেছিল তোমায়?আর ধরবে চুরি?এতটুকু মেয়ের চুরি দিয়ে কি কাজ থাকে?এখন কাঁটল তো হাত? ”
নাফিসা ঠোঁট উল্টে রেখেছে।যেন একটু হলেই কেঁদে দিবে।মেহু আপু পাশে বসেই মুচকি হাসছে।নাফিসা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
” আর ধরব না রাজ ভাইয়া।”
মেহেরাজ ভাই আবারো গম্ভীর গলায় বললেন,
” যদি বেশি কেঁটে যেত কি হতো তাহলে?”
মেহেরাজ ভাইয়ের কথাটা শুনেই মনে পড়ল আমার কাঁটা হাতে মেহেরাজ ভাইয়ের সেই ঔষুধ লাগানোর দৃশ্য।মাঝে মাঝেই এভাবেই সতর্ক করে শাসন করেন মেহেরাজ ভাই। সেই শাসনকেই অস্পষ্ট ভাবে অন্য কিছু ভেবে নিয়েছিলাম আমি।তবে এই যত্নটা মেহেরাজ ভাই সবাইকেই করে থাকেন। যেমন নাফিসাকেও শাসন করলেন।আমি মনে মনে তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।ভালোবাসা না পাওয়া মানুষ গুলে আসলেই অদ্ভুত। অল্প একটু ভালোবাসা পেলেই ভেবে নেয় অনেককিছু। যেমন আমি!ভাবনা গুলো ভেঙ্গেছিল সেদিন আব্বার প্রশ্নের বিনিময়ে মেহেরাজ ভাইয়ের উত্তরে।আজকাল আর এসব যত্ন, শাসন বিশেষ বোধ করি না।এসবে মেহেরাজ ভাইয়ের অন্য অনুভূতি জড়িত আছে এমনটাও ভাবি না।আমি এগিয়ে গেলাম আরো কয়েক পা। নাফিসা নরম গলায় বলল,
” আর ধরব না তো। ”
মেহেরাজ ভাই শুনলেন।তারপর হাতে ঔষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
” আর কখনো ধরবে না চুরি।মনে থাকবে?”
নাফিসা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়াল।তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।আমি একনজর তাকিয়ে নিজের রুমে গিয়েই ড্রয়ার খুললাম।মেহেরাজ ভাই এই কয়েকদিন চাকরীর পরীক্ষার জন্য অনেক ব্যস্ত ছিলেন।তাই উনাকে সামনাসামনি পাওয়া হয় নি বলেই আব্বার পাঠানো হাত খরচের টাকাটা আর দেওয়া হয়নি।এর আগেরবার যখন একমাস থেকেছিলাম এই বাসায় তখন হাতখরচের টাকাটা দেওয়ার কথা মাথায়ই আসেনি৷ তবে এবার মাথায় এসেছে।এবার টাকাটা না দিতে পারলে আস্ত এক বোঝা বোধ হবে নিজেকে।নিজের কাছে নিজেরই অস্বস্তি লাগবে এভাবে এই বাসায় পড়ে থাকতে। হাত বাড়িয়ে আব্বার পাঠানো টাকাটা নিয়ে দ্রুত মেহেরাজ ভাইয়ের সামনে দাঁড়ালাম।ততক্ষনে মেহু আপু নিজের রুমে চলে গিয়েছে।আমি টাকাটা এগিয়ে দিয়ে ইতস্থত করে বললাম,
” মেহেরাজ ভাই? আব্বা প্রতিমাসেই আমার জন্য কিছু টাকা দেয়। সেই ছোটকাল থেকেই।তখন টাকাটা দাদীকে দিতাম কারণ আমার দায়িত্ব পুরোপুরি ভাবে দাদীর উপরই ছিল।এখন এই টাকাটা আপনাকে দেওয়া উচিত।কারণ আমার খাওয়া, পড়ানো সবটা তো আপনিই দেখছেন।তাই টাকাটা নিন।”
মেহেরাজ ভাই শান্ত হয়ে সবটা শুনলেন।ভ্রু জোড়া কুঁচকে শান্তস্বরে বললেন,
” তুই আমায় টাকা দেখাচ্ছিস?”
মৃদু আওয়াজে বললাম,
” না।তবে এমনভাবে আপনাদের ঘাড়ের উপর বসে খাওয়াতে আমার নিজেরই খারাপ লাগবে মেহেরাজ ভাই।দায়িত্ব পালন করছেন ভালো।তবে এতোটা বোঝা হিসেবে অন্যের ঘাড়ে পরে থাকাটা আমাকে স্বস্তি দিবে না।আব্বা টাকাটা আমার থাকা খাওয়ার জন্যই দিতেন।থাকা, খাওয়াটা যেহেতু আপনাদের এখানেই হচ্ছে তাই ভাবলাম আপনাকেই টাকাটা দেওয়া উচিত
এডমিশনের জন্য তো আবার নাবিলার সাথে কোচিংয়েও ভর্তি করিয়েছেন।সেখানেও অনেক টাকা লেগেছে জানি।আপনি আবার এমন ভাববেন না যে, আমি আপনাকে ছোট করছি মেহেরাজ ভাই।”
মেহেরাজ ভাই মুখ চোখ কঠিন করলেন।চোয়াল শক্ত করে বললেন,
” আমি বেকার বলে তুই আমায় এখন এসব বলছিস?তোর কি মনে হচ্ছে বেকার বলে বউ খাওয়ানোর ক্ষমতা নেই আমার?এখন তোর বাবার টাকা নিতে হবে আমায়?শোন, বাসা ভাড়া আর টিউশনি মিলিয়ে যথেষ্ট চলে আমাদের।তোর থেকে টাকা নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না আমার।”
কথাটা থমথমে মুখে বলে দিয়েই মেহেরাজ ভাই চলে গেলেন। আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকলাম।ভুল কিছু করেছি?উনি স্বামী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঠিক আছে কিন্তু দায়িত্ব দিয়ে কি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হয়? এভাবে দায়িত্ব হিসেবে থাকাটাও যে ব্যাপক অস্বস্তির!
#চলবে…
#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২২
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ
সেদিনকার মিনার ভাইয়ের চিঠিটা মেহেরাজ ভাই দেখতে পেল আরো মাস কয়েক পরে।ততদিনে ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলো। ভাগ্যক্রমে ভালো সাবজেক্ট সমেত নাম এল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে । অবশেষে ভর্তি হতে হলে সুদূর চট্টগ্রামে। এতদিনের বসবাস ছেড়ে হুট করেই নতুন শহরে পাড়ি জমানো, নতুন পরিবেশে মানানো নিয়ে অল্প সংকোচ থাকলেও তখন আমার চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিনই ছাদের কার্নিশ ঘেষে মেহেরাজ ভাই আর সামান্তা আপুকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলাম আমি।শুধু যে দাঁড়ানো ছিল এমন নয়, মেহেরাজ ভাইয়ের হাতটাও সামান্তা আপুর হাতের মুঠোয় ছিল।প্রেমিক প্রেমিকা হিসেবে বিষয়টা বোধহয় তাদের ক্ষেত্রে অতি স্বাভাবিক! কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয়টাই আমি স্থির দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পারলাম না বেশিক্ষন।এক দৌড়ে আবারও সিঁড়ি বেয়ে নিচে এলাম তৎক্ষনাৎ।উনাদের মাঝে কি কথা হলো, পরে আর উনাদের মাঝে কি ঘটল কিছুই আর দেখার ইচ্ছা জাগল না।চোখে উপর ভাসল কেবল সামান্তা আপুর হাতের মুঠোয় থাকা মেহেরাজ ভাইের হাতটা। কেন জানি না, আমার মন মেহেরাজ ভাইয়ের থেকে এরূপ আচরণ আশা করেনি। মেনেও নিতে পারল না এরূপ আচরণ।মনে মনে ভাবলাম, চট্টগ্রামে চলে যাওয়াটাই একমাত্র মুক্তি!একটা সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হিসেবে ঝুলে থাকার অপমান থেকে মুক্তি মিলবে অন্তত।এসব ভাবতে ভাবতেই দুপুর কেঁটে সন্ধ্যে হলো। আমি বসার ঘরে মেহু আপুর সাথে বসে কথা বলছিলাম।সেসময় মেহেরাজ ভাই উপস্থিত হলেন তার টানটান বদন নিয়ে। খেয়াল করলাম উনার মুখচোখ লাল হয়ে আছেন।রেগে থাকলে যেমনটা হয় সাধারণত। তবে উনার রাগের কারণটা বুঝে উঠলাম না আমি।মেহেরাজ ভাই বুকে হাত গুঁজে বলে উঠলেন আমায়,
” জ্যোতি? উঠ।তোর সাথে কিছু কথা আছে আমার।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।আমার সাথে বিশেষভাবে কথাবলার মতো কিছুই নেই উনার।তবুও বললাম,
” বলুন মেহেরাজ ভাই। ”
মেহেরাজ ভাই কপাল কুঁচকালেন।ভ্রু উঁচিয়ে রাগ নিয়ে বলে উঠলেন,
” উঠতে বললাম না?”
আমি উঠলাম।ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বললাম,
” উঠেছি।কি বলবেন?”
মেহেরাজ ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,
” আমার পিছু পিছু আয়।”
এই বলে মেহেরাজ ভাই নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন।পিছু পিছু গেলাম আমিও।মেহেরাজ ভাই নিজের ঘরে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলেন এবার।চোখমুখ গম্ভীর করে প্রশ্ন ছুড়লেন,
” তুই কি মিনারকে ভালোবাসিস? তোদের মাঝে কি সম্পর্ক আছে জ্যোতি?”
আকস্মিক এমন একটা প্রশ্ন শুনে হতবিহ্বল হয়ে তাকালাম আমি। মেহেরাজ ভাই ফের তাড়া দেখিয়ে বলে উঠলেন দাঁতে দাঁত চেপে,
” কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি তোকে।উত্তর না দিয়ে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ”
আমি তাকালাম স্থির হয়ে।বললাম,
” প্রশ্নটা আবার করুন।”
মেহেরাজ ভাই সরু চাহনী তাকালেন।হাতজোড়া বুকে গুঁজে নিয়ে মুখ টানটান করলেন।বলে উঠলেন গম্ভীর স্বরে,
” তোর আর মিনারের রিলেশন চলছে?নাকি আগে রিলেশন ছিল?”
মেহেরাজ ভাইয়ের থেকে পুনরায় এরূপ প্রশ্ন শুনে মনে মনে রাগ অনুভব হলো। বিয়ের পর সামান্তা আপুকে প্রকাশ্যে বহুবার মেহেরাজ ভাইকে জড়িয়ে ধরতে দেখেছি। আমি তো কখনো মেহেরাজ ভাইয়ের বিষয়ে এভাবে প্রশ্ন ছুড়িনি। এই যে, আজও এতগুলো মাস পরও মেহেরাজ ভাই ছাদে দাঁড়িযে সামান্তা আপুর হাত ধরে গল্প করছিলেন। একবারও তো একটা প্রশ্ন করিনি। তাহলে উনি কেন এভাবে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করছেন?মিনার ভাইকে ছোটবেলা থেকে সরল নজরে দেখে এসেছি। ভাই হিসেবে আপন ভেবেছি৷ এখও ভাবি।কিন্তু তাই বলে মিনার ভাইকে প্রেমিক হিসেবে ভালোবাসব এই প্রশ্নটা উদ্ভট নয়?কাঠ কাঠ গলায় উত্তর দিলাম,
” যদি রিলেশন থেকে থাকেও, কি করবেন?”
মেহেরাজ ভাই ভ্রু উঁচালেন।বললেন,
“তার মানে কি বলতে চাইছিস? রিলেশন আছে তোদের?”
দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলাম,
” ধরে নিন আছে।কি করবেন?”
মেহেরাজ ভাই এবার রাগে মাথা চেপে ধরলেন নিজের।চোখজোড়া বুঝে ঘনঘন শ্বাস ফেললেন দ্রুত। পরমুহুর্তেই একদম শান্ত, শীতল, লালাভ চাহনীতে তাকালেন।আমি তাকিয়ে অবাক হলাম। কি ভীষণ লাল দেখাচ্ছে উনার চোখজোড়া।চেহারা শান্ত দেখালেও জ্বলন্ত রাগের উপস্থিতি স্পষ্ট! উনি শান্ত কন্ঠে একরাশ ক্রোধ নিয়ে বলে উঠলেন,
” খু’ন করব।প্রথমে তোকে তারপর তোর মিনার ভাইকে। আমি তোর আব্বার মতো অতোটা সহজ সরল নই যে স্ত্রীকে চোখের সামনে অন্য একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াতে দেখব চুপচাপ।”
মেহেরাজ ভাইয়ের এই কথাটাতে স্পষ্ট অথবা স্পষ্টভাবে আম্মার সাথে আমার তুলনা পেয়েই তিক্ত এক অনুভূতি হলো।আম্মার চলে যাওয়া নিয়ে সারাজীবন সবার থেকে কথা শুনে আসলেও মেহেরাজ ভাই ও যে আম্মার মতোই আমাকে চরিত্রহীন ভেবে কথা বলবেন ভাবিনি আমি।বারকয়েক নিঃশ্বাস ফেলে মনের ভেতর জড়ো হওয়া সকল রাগ জেদ নিয়ে বলে উঠলাম এবার,
” আমি কখনো আপনার মতো বিয়ে করে স্বামীর দায়িত্ব পালন করে সবার সামনে মহান সেজে প্রেমিকাকে বুকে জড়িয়ে রাখিনি স্ত্রীর সামনে। আমি কখনো প্রেমিকার হাত ধরে ছাদে গল্পও করিনি মেহেরাজ ভাই।আপনি আমায় চরিত্রহীন বললেন কোন কারণে?আর শুনুন, আমার সাথে কিন্তু মিনার ভাইয়ের তেমন কোন নোংরা সম্পর্ক নেই যেমনটা আম্মার ছিল ঐ লোকটার সাথে।একটা বিষয়ে না জেনেশুনে কথা বলবেন না।”
আকস্মিক আমার রাগ নিয়ে বলা কথাগুলোতে বোধ হয় মেহেরাজ ভাই কিঞ্চিৎ অবাক হলেন।চেহারায় রাগ রাগ ভাবটা কিঞ্চিৎ মিইয়ে গেল।কিয়ৎক্ষন আমার দিকে স্থির চেয়ে থেকে শীতল কন্ঠে বললেন,
“ভালোবাসা কখনো নোংরা হয় না।আমি তোদের সম্পর্কটাকে নোংরা বলিনি।আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু তোকে চরিত্রহীন ও বলিনি জ্যোতি।”
তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে উঠলাম,
” চরিত্রবান ও তো বলেননি। হ্যাঁ, আমার আম্মা অন্য পুরুষের সাথে পালিয়ে গেছেন আমায় রেখে।এই নিয়ে আমি সবসময়ই কথা শুনে এসেছি।সবসময়ই অবহেলা পেয়েছি সবার থেকে।তার মানে এই নয় যে আমি আমার আম্মার মতোই চরিত্রহীন হবো।আপনি কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমার আম্মার তুলনাটাই এনেছেন মেহেরাজ ভাই।”
মেহেরাজ ভাই উত্তরে কিছু বললেন না এবার।কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে হাতের দুই আঙ্গুলে কপালে নাড়াতে লাগলেন।তারপর হঠাৎ বললেন,
” মিনার তোকে চিঠি কেন লিখে? তোকেও অনেকবার ওর সাথে কথা বলতে দেখেছি আমি।আবার সাঈদের কথানুযায়ী তুই বইতে লাভ এঁকে তার মধ্যে এম লিখেছিলি।মিনারের নামের প্রথম অক্ষরও এম। এই সবকিছু যা বুঝাচ্ছে, আর আমি এতদিন যা ভেবে এসেছি তা সম্পূর্ণ ভিন্ন!সত্যিটা জানতে চাইছি কেবল৷ মিনার তোকে ভালোবাসে তা জানি, তুইও কি ভালোবাসিস ওকে?তোদের মাঝে সম্পর্ক..”
মেহরাজ ভাই দ্বিতীয়বার সেই একই প্রশ্নটা ছুড়ার আগেই উত্তর দিলাম,
” মিনার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক সে ছোটবেলা থেকে। আমি তাকে তখন থেকেই ভীষণ আপন ভাবতাম,এবং এখনও ভাবি।সবসময় বড় ভাইয়ের মতোই দেখে এসেছি তাকে।আর কিছু?”
মেহেরাজ ভাই হাসলেন এবার।উঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁট চওড়া করে বললেন,
“গুড!এটাই জানতে চেয়েছিলাম।সমস্যা হলো, মিনার তোকে বোনের মতো দেখে না। এই চিঠিতে তা স্পষ্ট লেখা আছে।”
মেহেরাজ ভাই চিঠিটা এগিয়ে ধরলেন। আমি সরু চাহনীতে তাকিয়ে থেকে দেখলাম মিনার ভাইয়ের সে চিঠিটাই এটা। সে মাস কয়েক আগেই একবার পড়েছিলাম। তারপর যে কোথায় রেখেছিলাম নিজেরও খেয়াল ছিল না। মেহেরাজ ভাই কি করে ফেলেন চিঠিটা তা নিয়ে ভেবেই বললাম,
” চিঠিটা আপনার কাছে কি করে মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ ভাই ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,
” কেন?চিঠি ব্যাক্তিগত বিষয়াদি বলে দেখা উচিত হয়নি?”
শক্ত গলায় বল উঠলাম আমি,
” যদি বলি উচিত হয়নি?”
মেহেরাজ ভাই অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন,
” আমি মনে করছি উচিত হয়েছে।আর কিছু?”
আমি বিনিময়ে উত্তর না দিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে তাকলাম। মেহেরাজ ভাই নরম গলায় আবার বললেন,
“তোর ব্যাক্তিগত চিঠি পড়ে নেওয়ার জন্য রাগ করেছিস? নাকি কষ্ট পেয়েছিস? কোনটা?”
আমি উত্তর দিলাম না।কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বললাম,
” আমি কিন্তু কখনো আপনার বিষয়ে প্রশ্ন করিনি মেহেরাজ ভাই। আপনার কিংবা সামান্তা আপুকে এতকাল চোখের সামনে দেখেও কোন নোংরা ইঙ্গিত করিনি।”
কথাটা বলেই আর দাঁড়ানোর ইচ্ছা হলো না আমার।দ্রুত চলে এলাম নিজের ঘরে।
.
একে একে ডায়েরীর প্রত্যেকটা পাতা পড়েই তপ্তশ্বাস ফেলল মেহেরাজ। ডায়েরীর পরের পৃষ্ঠাগুলো খালি।এই পর্যন্ত লিখে হয়তো ডায়েরীটাতে আর লেখা হয়ে উঠেনি জ্যোতির। মেহেরাজ গাঢ় শ্বাস ফেলে আরো একবার কালচে রাঙ্গা ডায়েরীর পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়ে বিছানার একপাশে রাখল।ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে দেখল সকাল দশটা।পুরো একটা নির্ঘুম রাত কেঁটে গেল তার। শুধুমাত্র একটা ডায়েরী পড়তে গিয়ে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সে জ্যোতির ব্যাক্তিগত ডায়েরী পড়েছে।প্রথমবার পড়েছিল যখন জ্যোতি কিশোরী!প্রথম প্রণয়ের আবেগ, অনুভূতি সম্পুর্ণটাই সেবার সে ডায়েরীতে রাঙ্গিয়ে তুলেছিল সে। দ্বিতীয় বার পড়ল আজ।যে ডায়েরীটাতে তার আর জ্যোতির আকস্মিক বিয়ে হতে প্রায় বছর খানেকর গল্প সাঁজানো।তবে সে গল্পটায় তাদের দুইজনের প্রণয় নেই, ভালোবাসা নেই।মেহেরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বেলকনিতে গিয়ে গ্রিল ধরে ভাবতে লাগল এক মায়াবী প্রতিচ্ছবিকে।ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানা, মুখে তীব্র রাগ কিংব জেদ আর চোখজোড়ার ধারালো স্পষ্ট চাহনী।মুহুর্তেই বুকের ভেতর ছিনছিন করে উঠল কেমন। প্রতিচ্ছবিটা অবশ্য আর কারো নয়।জ্যোতিরই প্রতিচ্ছবি।যার প্রতি শুরু থেকেই কেবল সম্পূর্ণটা দিয়ে দায়িত্ব পালনে আগ্রহী ছিল মেহেরাজ৷ দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে করতেই একটা সময় এল, যখন মেয়েটা পৃথিবীতে সম্পূর্ণ নিঃস হয়ে গেল!সম্পূর্ণ একা হয়ে পাথরের মতো জমে গেল।মেয়েটার সবথেকে কাছের মানুষ, সবথেকে প্রিয় মানুষ যে সে হলো মেয়েটার দাদী। সে দাদীকেই মেয়েটা চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলল।মেহেরাজ সেইবার দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে প্রথমবার অনুভব করল মেয়েটার প্রতি তার মায়া জম্মেছে। দাদী চলে যাওয়ার সে মুহুর্তে মেয়েটাকে ওভাবে নিস্তেজ আর কঠোর দেখেই বুকের ভেতর চাপা কষ্ট অনুভব করল সে।অস্থিরতায় ছটফট করল নিরবে।সে অস্থিরতা আড়ালে রেখেই সেদিন থেকে মেয়েটাকে আগলে নিতে চেষ্টা চালাল সে। মেয়েটার আপন মানুষ হয়ে উঠার চেষ্টা করল প্রাণপনভাবে। মেয়েটাকে সবসময়ের জন্য সঙ্গ দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করল।সে যে সূচনা হলো মায়ায় জড়ানোর তার আর সমাপ্তি খুঁজে পাওয়া গেল না৷ ক্রমশ সে মায়ার জালে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল। ছিন্নভিন্ন হলো মেয়েটার ধারালো ব্যাক্তিত্বে। ধারালো চাহনী, স্পষ্ট জবাব আর একরাশ জেদ!সেসব ভেবেই আনমনে হাসল মেহেরাজ। বুকের বা পশে হাত চেপে মৃদু স্বরে বলল,
” এতকাল ধরে এক তিক্ত অনুভুতি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি নিজের ভেতর।আজ সে অনুভূতির তিক্ততা দশগুণ হলো তোর ডায়েরী পড়ে।এতকাল তুই আমায় স্বার্থপর বললেও আজ আমি বলব, তুই স্বার্থপর জ্যোতি।অপর পাশের লোকটাকে বুঝার চেষ্টাই করিস নি কখনো।”
#চলবে
[