এক মুঠো প্রণয় পর্ব ২

0
179

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_০২
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

” রাজ আর জ্যোতি যদি সত্তই রাইতে একঘরে খারাপ কিছু কইরা থাকে তবে তার লাইগা ব্যবস্থা নেওন হইব।কানাঘেষা না কইরা হগ্গলে চুপ করো।”

দাদীর কঠিন গলায় এতক্ষন সবাই গুনগুন করলেও মুহুর্তেই চুপ হয়ে গেল।এই সাতসকালেই উঠোনে গোল করে চেয়ার পাতানো হলো। আমাদের বাড়ি আর মেহেরাজ ভাইদের বাড়ির সব মুরুব্বিরাই মোটামুটি উপস্থিত হলো সেখানে। আমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে থাকলাম। দুই হাত দূরে মেহেরাজ ভাইও দাঁড়ানো।বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়ানোর পর একপর্যায়ে দাদী গম্ভীর গলায় মেহেরাজ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল,

” রাজ,তোমার কিছু বলার থাকলে বলো।”

মেহেরাজ ভাই মুখ তুলে তাকিয়েই কিছুক্ষন চুপ থাকল। তারপর গমগমে স্বরে স্পষ্ট গলায় বলল,

” জ্যোতির সাথে আমার এমন ঘনিষ্ঠ কোন সম্পর্ক কখনোই ছিল না, নেইও।কাল যেটা চাচী বলেছেন সেটা নিতান্তই একটা দুর্ঘটনা ছিল। অন্ধকারে কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছিলাম।আর যেহেতু সামনে জ্যোতি ছিল।ওর দিকেই হোঁচট খেয়ে পড়তে হলো।আর তাই ও সহ মেঝেতে পড়ে গেলাম।বিষয়টা এতটুকুই।”

মেহেরাজ ভাইয়ের কথা শেষ হতেই উনার চাচা রাগমিশ্রিত গম্ভীর গলায় শুধাল,

” তুমি জ্যোতির কাছে কেন গিয়েছিলে? অন্ধকারে এত রাতে একটা জোয়ান ছেলে হয়ে তোমার কি এত দরকার ছিল ওর কাছে যাওয়ার?বলো।”

” আমি তো সামান্তাকে খুঁজতে এসেছিলাম এ বাড়িতে।এসে দেখি ও কল থেকে মুখ ধুঁয়ে এগিয়ে আসছে।চাচীরা বাইরে কথা বলছিল।সামান্তাকে বলল দাদীর পানের বাটাটা এনে দিতে।সামান্তা তো ছোট থেকে এ বাড়িতে তেমন আসেনি।তাই দাদীর ঘর ও চিনে না।তাই আমাকেই যেতে হলো।বিশ্বাস না হলে জ্যোতির ফুফুকে জিজ্ঞেস করো। উনিই বলেছিল দাদীর রুমে পানার বাটা আছে।”

দাদী এবার ফুফুকে জিজ্ঞেস করলেন।ফুফু ও স্বীকার করল।আমি স্বস্তির শ্বাস ফেললাম কেবল।তবুও স্বস্তি পেলাম না।দাদী এবার সেঝ চাচীর উদ্দেশ্যে বলল,

” সেঝ বউ,তুমি কও এইবার। ”

সেঝ চাচী নরম গলায় বললেন,

“আমি তো আলো জ্বালিয়ে রাজকে খুঁজতে গেলাম।গিয়ে দেখি দুইজন একসাথে জড়াজড়ি অবস্থায়।জ্যোতির শাড়িও তো অগোছাল ছিল।ছিঃ ছিঃ ছিঃ।”

কথাগুলো শুনেই মাটি খি’চে ধরলাম পায়ের নখ দিয়ে।এতগুলো মানুষের সামনে এই কথাটা এইভাবে চাচী বলতে পারল? চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লাম।আরো খারাপ কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলাম।ঠিক সেই মুহুর্তেই মেহেরাজ ভাই বললেন,

” ছিঃ ছিঃ করার মতো কোন কিছু দেখেছেন আপনি?আমি জ্যোতির উপর হেলে পড়ে গিয়েছিলাম।ওর শাড়ি একটু অগোছাল ছিল।এইটুকুই ছিঃ ছিঃ এর কারণ?এটা এক্সিডেন্টলি ঘটতে পারে না?”

মেহেরাজ ভাই কথা গুলো বলার পরই উনার চাচা ধমকে উঠলেন ।চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন,

” আহ রাজ, থামো।মুখে মুখে তর্ক করে বেয়াদবি করো না।এমনিতেই পুরো গ্রাম জানাজানি হয়ে গেছে এই বিষয়টা।সকাল থেকে এইসবই শুনতে হচ্ছে সবার কাছে।আমার সম্মান কতটুকু রইল বুঝতে পারছো?”

মেহেরাজ ভাই আর কিছু বললেন না।এরপর আরো অনেকক্ষন বড়দের মাঝে কথাবার্তা হলো।এই এতটুকু সময়ে আমাকে কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করল না। কিছুই জানতে চাইল না।নিজেকে কেমন ঠুনকো মনে হলো।দোষটা তো আমার নামেই রটানো হলো।অথচ আমার কথা শোনার এইটুকুও প্রয়োজন পড়ল না কারোর?আমি অসহায়ের মতো মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম পুরোটা সময়।তারপর হঠাৎই দাদী আর মেহেরাজ ভাইয়ের চাচা এক কঠিন সিদ্ধান্ত আমাদের জানালেন।আজ দুপুরেই নাকি আমার আর মেহেরাজ ভাইয়ের বিয়ে হবে।আমি চমকালাম। থমকে গিয়ে চোখ তুলে চাইতেই মেহেরাজ ভাইয়ের ক্ষ্রিপ্ত গলা শোনা গেল,

” কি সব বলছেন আপনারা?এতক্ষন ধরে কি বললাম আমি?এটা শুধুই একটা দূর্ঘটনা।আমাদের মাঝে তেমন কিছুই ছিল না।তবুও এই সিদ্ধান্ত আসবে কেন?”

মেহেরাজ ভাইয়ের চাচা রাগে চোখ লাল করলেন।উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষ্রিপ্ত গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

” তোমার কথায় তো আর সব হবে না রাজ।তুমি কিছু করো কিংবা না করো, গ্রামজুড়ে যা রটে গিয়েছে মানুষ তাই সত্যি মনে করছে।বিয়েটা যদি নাই করো তবে আমার থেকে খারাপ কেউই হবে না বলে দিলাম।আর যায় হোক আমি আমার সম্মান নষ্ট হতে দেব না।”

কথাগুলো শুনে মেহেরাজ ভাইয়ের মুখচোখও লাল হলো।রাগে ফোঁসফাঁস শ্বাস ছেড়েই পা ফেলে চলে গেলেন উনি।আমি একপলক চাইলাম শুধুু সেদিকে তাকিয়ে।মেহেরাজ ভাইয়ের প্রতি আমার প্রখর অনুভূতি আছে ঠিক, তবে এমন নয় যে আমি উনাকে পেতে চেয়েছি কখনো।উনাকে স্বামী হিসেবে ভাবতেই আত্নসম্মানে আঘাত হানল। জ্বলন্ত ঘৃণায় দগ্ধ হলো হৃদয়।আমি দাদীর দিকে চাইলাম।সাহস করে মিনমিনে গলায় বললাম,

” দাদী? এই ঘটনায় তো কারোরই দোষ ছিল না।তুমি তো জানো আমি নির্দোষ।তবে এই কঠিন সিদ্ধান্ত কেন?আমি এক্ষুনিই বিয়ে করতে চাই না দাদী।”

আমার কথাটা শেষ হতে না হতেই আব্বা চেয়ার ছেড়ে উঠলেন।রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমার সামনে এগিয়ে এসেই চিৎকার করে বললেন,

” তোরে এত বুঝতে কে বলছে?কেউ তোরে কিছু জিজ্ঞেস করছে?তোর এত কথা বলার সাহস হয় কি করে?মেয়ে মানুষের অতো পড়ালেখার দরকার নেই। যতটুকু দরকার তা যথেষ্ট হয়েছে।আর না করলেও চলবে পড়ালেখা!”

আব্বা বেশ শিক্ষিত মানুষ।গ্রামের হাই স্কুলের গণিতের শিক্ষক।অথচ আব্বার মতো শিক্ষিত মানুষও কি সুন্দর বলে দিলেন মেয়েদের অতো পড়ালেখা করা লাগে না।আমি কিছুই বললাম না।শুধু দাদীর দিকে একবার চাইলাম।তারপর আবার মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকাতেই মেহেরাজ ভাইয়ের চাচী এগিয়ে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

” জ্যোতি শোন,মেয়েমানুষের চরিত্র হয় সাদা কাপড়ের মতো।সাদা কাপড়ে যেমন অল্প ময়লা জমলেও বিচ্ছিরি লাগে?মেয়ে মানুষের চরিত্র নিয়েও অল্প একটু কথা উঠলে তা বিশাল রূপ নেয়।মেয়েদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সমাজ ছেড়ে দেয় না মা। নিশ্চয় তুই তোর মায়ের উদাহরণ পেয়ে এতগুলো দিনে বুঝে গিয়েছিস সেটা।বিয়েটা না হলে রাজের কোন ক্ষতি হবে না।রাজ দিব্যি স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচতে পারবে। কিন্তু তুই?তুই পারবি না ওভাবে বাঁচতে।তোর অনেক বড় ক্ষতি হবে।গ্রামের মানুষজন তো চিনিস।বিষয়টাকে খুব খারাপ বানিয়ে ছাড়বে পরে।বিয়েতে রাজি হয়ে যা,হু?তোর সমস্যা পড়ালেখা নিয়ে তো?তোকে পড়াবে এতটুকু নিশ্চায়তা আমি দিচ্ছি। এবার রাজি হয়ে যা মা।”

আমি টলমলে চোখে চেয়ে রইলাম।এবার মেহু আপুও পাশে এসে দাঁড়ালেন।নরম গলায় বললেন,

“আমরা সবাই জানি তুই নির্দোষ।তুই কিছু করিস নি।ভাইয়াও ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুই করে নি।কিন্তু সমাজ যা একবার বিশ্বাস করে নিয়েছে তা কি শুধু মুখের কথায় মুঁছে দেওয়া যাবে?বলবে আমরা বাড়ির সম্মান বাঁচাতে মিথ্যে বলছি।বুঝতে পারছিস তো তুই? ”

আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে পা বাড়িয়ে ঘরে আসলাম।আসার সময় এক সমুদ্র অভিমান নিয়ে দাদীর দিকে আরেক পলক চাইলাম শুধুু।তারপর দ্বিতীয়বার আর ফিরে চাইলাম না।ঘরে এসে দরজা জানালা বন্ধ করে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।যে মানুষটাকে ভালোবাসার অপরাধে সে আমায় এতটা অপমান করেছিল , এতটা উপহাস করেছিল ঘুরেফিরে তার সাথেই নিয়তি আমাকে জুড়ে দিবে? যার বিশালতায় আমার জন্য একমুঠো প্রণয় নেই তার স্ত্রী হিসেবেই বেঁচে থাকতে হবে? স্বামী স্ত্রীর মাঝে প্রণয় ছাড়া সংসার হয়? হয়তো হয়!কিন্তু আত্মসম্মান?যে আত্মসম্মান নিয়ে এতগুলো দিন আমি এড়িয়ে গিয়েছি এই মানুষটাকে,সেই আত্মসম্মানের কোন মূল্য রইল না?এই জঘন্য মানুষটার সাথেই পুরো একটা জীবন কাঁটাতে হবে আমায়?

.

আকাশে কালো মেঘ।ভ্যাপসা গরমে ঘেমে উঠলাম দ্রুত।এখন দুপুর বেলা।তবুও আশপাশে এতটাই আঁধার যে মনে হলো কিয়ৎক্ষন পরই বুঝি সন্ধ্যা নামবে।আমি একপলক জানালা দিয়ে চাইলাম বাইরে।নিস্তব্ধ,থমথমে পরিবেশ।বোধহয় কিছুটা সময় পরই ভারী বৃষ্টিপাত হবে।চারপাশে গুমোট আবহাওয়া অনুভব হতেই মনে পড়ল ছোট্ট মিথির কথা।কল্পনায় মুহুর্তেই ফুঁটে উঠল মিথির প্রানবন্ত হাসি।ইশশ!আজ যদি মিথি থাকত?ও নিশ্চয় আমার পাশে থাকত?আধো আধো গলায় নিশ্চয় বলত,” না, যতি কিছু করেনি।” আমি হাসলাম আনমনে।সঙ্গে সঙ্গে আকাশের কালো মেঘের মতো মন খারাপের কালো মেঘে ছেঁয়ে গেল আমার মন।কষ্টরা তীব্র থেকে তীব্র বোধ হলো হৃদয়ে।নিঃশ্বাসরা যেন নাসারন্ধ্রে আটকে রইল।বিধাতা এতোটাই স্বার্থপর কেন?কেন সব প্রিয় মানুষকে আমার থেকে কেড়ে নিলেন উনি?কি এমন পাপ করেছিলাম আমি?ভাবতে ভাবতেই আমার চোখ বেয়ে টসটসে পানি গড়াল।ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালাতেই ঘরে ডুকল মেহু আপু।আমার দিকে এগিয়ে এসেই হালকা গলায় বলল,

” জ্যোতি?ঘন্টাখানেক পর বোধহয় বিয়ে পড়াবে।ডাকবে। তৈরি হতে হবে তো?”

আমি মেহু আপুর দিকে চাইলাম।অস্ফুট স্বরে বললাম,

” তৈরি হবো মানে?”

” শাড়ি, শাড়ি পরতে হবে না?এভাবেই বিয়েতে বসবি?দাদী বললেন তোকে শাড়ী পরিয়ে তৈরি করতে। ”

আমি কিয়ৎক্ষন চুপ থাকলাম।তারপর বললাম,

” শাড়ি পরতে হবে না আপু।এভাবেই যাব। বাইরে তে মানুষজন নেই তেমন।সবাই তো আরমান ভাইয়ের বিয়েতে গেছে, তাই না?”

মেহু আপু ইতস্থত বোধ করে আবারো বললেন,

” তবুও।দাদীও বললেন তোকে শাড়ি পরাতে।”

“দাদীকে আমি বলব আপু।”

মেহু কাছে আসলেন।নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

” আচ্ছা, কিন্তু কান্না করছিলি কেন?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।মস্তিষ্কে প্রশ্নটা ঘুরতে সঠিক কোন উত্তর পেলাম না।আসলেই তো,কান্না কেন করছি?মিথির জন্য?মিথির সাথে তো প্রায় প্রতিদিনই কবরের সামনে কথা হয়।তবে?ভাগ্যের জন্য?ভাগ্যে যা আছে তা তো ঘটবেই।ভাগ্যের জন্য কান্না করে বিশেষ লাভ হয় নাকি? তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উত্তর দিলাম,

” তেমন কিছু নয় মেহু আপু।তুমি একবার দাদীকে ডেকে দেবে আপু?”

মেহু আপু ডেকে দিলেন না।আমার দিকে এগিয়ে এসে হাতে হাতে রাখলেন।তারপর নরম গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,

” জ্যোতি শোন, ভাইয়া একটু রাগী, একটু জেদী।ভাইয়া সামান্তাকে ভালোবাসে এটাও সঠিক।কিন্তু ভাইয়া অতোটাও খারাপ নয় জ্যোতি।তোর সাথে ভাইয়ার বিয়ে হলে আমি এইটুকু নিশ্চায়তা দিতে পারি যে, তুই ঠকে যাবি না। ভাইয়া ভীষণ দায়িত্ববান আর যত্নশীল।তুই দেখিস ভাইয়া নিজের দিক থেকে সবসময়ই সঠিক থাকবে।কোনদিকে অভিযোগ রাখতে দিবে না মিলিয়ে নিস।যদি তোর কান্নার কারণ ভাইয়ার সাথে বিয়েটাই হয়। তবে আমি এটা বলব যে, এই বিয়েটাই একদিন তোর চোখে অশ্রু আসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে।”

আমি শুনলাম সবগুলো কথা।কিন্তু বিনিময়ে কিছু বললাম না।মেহু আপু পরক্ষনে উঠে চলে গেল।তার কিয়ৎক্ষন পর দাদী আসল।দাদী আজ কঠোরতা দেখাল না।শাসনও করল না।শাড়ি পরার জন্য গলা উঁচিয়ে জোরও করল না।শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল।ভরাট গলায় বলল,

” একবার কি মিথির লগে কথা কইয়া আইবি বিয়ার আগে?”

আমার কান্নার বেগ এবার বেড়ে গেল।এই মানুষটা এত কেন বুঝে আমায়?মুহুর্তেই চোখজোড়া দিয়ে স্রোত নামল।মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে কেবল বুঝালাম, ” হ্যাঁ, মিথির সাথে কথা বলাটা খুব বেশি দরকার। ” দাদী নিষেধ করল না।যাওয়ার জন্য অনুমতি দিয়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে।তবে অল্প সময়ের জন্য। আমি আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালাম না।মাথায় ঘোমটা টেনে ঘর ছেড়ে বের হলাম দ্রুত।উঠোনে তেমন মানুষজন নেই।থাকার কথাও নয়।সবাই এখন আরমান ভাইয়ের বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে গিয়েছে।আমি পা বাড়িয়ে পুকুর পাড়ের বিপরীতে হাঁটলাম।মিনিট পাঁচ হাঁটতেই নিস্তব্ধ কবরস্থান চোখে পড়ল।এখানে মেহেরাজ ভাই আর আমাদের বাড়ির অনেকেরই কবর।আমি চোখ মেলে এদিক ওদিক চাইলাম।মুহুর্তেই কাঙ্ক্ষিত কবরটায় চোখ গেল।ইশশ!তাকাতেই মনে হলো আমার মিথিটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।কল্পনায় ভেসে উঠল মিথির আধো আধো পায়ে হাঁটা, মাঝেমাঝেই চঞ্চল হাসিতে মেতে লাফিয়ে উঠা, কিংবা কখনো হুট করেই পেছন থেকে এসে আমার চোখে হাত রাখা ।মিথি বড্ড চঞ্চল আর ছটফটে ছিল।ঘুম বাদে ওকে কখনো স্থির থাকতে দেখা যেত না। আর সেই মিথিই এখন চিরতরে স্থির হয়ে শুঁয়ে আছে।আমার কষ্ট হলো ঠিক। তবে কাঁদলাম না।মিথির সামনে কখনোই কাঁদি না আমি।মন খুলে কথা বলি।পুরোটা দিনে কি কি করেছি, কি কি ঘটেছে সব বলি।মিথিও বেশ মনোযোগ নিয়ে শোনে সেসব।আমি হেসে পা বাড়ালাম।হাঁটু ঘেষে বসেই বললাম,

” এই মিথি?চারদিক কি অন্ধকার! বৃষ্টি নামবে বোধহয় এক্ষুনিই।দাদীর থেকে এইটুকু সময় নিয়েই তোর কাছে আসলাম।আজ বোধহয় বেশি গল্প করা হবে না, বুঝলি?”

মিথি জবাবে কিছু বলল না।আমি জানি ও কিছুই বলবে না।তবুও উত্তরের আশায় কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে বসে রইলাম।তারপর আবারও বললাম,

” মিথি?আমার বিয়ে আজ।কার সাথে জানিস?ঐ যে তুই ‘ লাজ’ নামে ডাকতি একটা ছেলেকে?ঐ ছেলেটার সাথেই। চিকন হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা?মনে আছে তোর?এখন কিন্তু অনেক বদল হয়েছে বুঝলি?একদম লম্বা চওড়া যুবক।তুই নির্ঘাত এখন দেখলে আর চিনবি তোর লাজকে।”

বলেই খিলখিলিয়ে হাসলাম।পরমুহুর্তেই কানে আসল শুকনো পাতার মড়মড়ে শব্দ।কারো পায়ের আওয়াজের প্রতিধ্বনি।তৎক্ষনাৎ মুখ ফিরিয়ে চাইলাম।চোখে পড়ল মেহেরাজ ভাইকে।উনার বাবা মায়ের কবরও এখানেই। বোধহয় উনার বাবা- মায়ের জন্যই এসেছেন।আমি একপলক তাকালাম তার গম্ভীর মুখ,অগোছাল চুল, আর লালচে চোখজোড়ার দিকে।মেহেরাজ ভাইও কি কেঁদেছেন?চোখজোড়া এত লাল কেন তবে?মস্তিষ্ক উত্তর পাঠাল, জানে না।আমি আর ভাবলাম না।ঝুঁকে মিথির কবরে নিজের কোমল ঠোঁট ছোঁয়ালাম।নরম গলায় বললাম,

” আজ আসি রে মিথি।”

কথাটা বলেই উঠলাম।পা বাড়িয়ে মেহেরাজ ভাইকে কাঁটিয়ে বেরিয়ে এলাম খুব দ্রুত।

#চলবে….

[ ভুলত্রুটি ক্ষমাস্বরূপ দেখার অনুরোধ।কোথাও ভুল হলে জানাবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here