#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৭
#ইসরাত_ইতি
দোলা চোখ খুলে না তাকালেও দুহাতে গালে লেপ্টে থাকা নোনাজল মুছে নেয়। দরজা ভাঙার তোরজোর চলছে বাইরে। জারিফ উঠে ধীরপায়ে হেঁটে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে কুঠার,শাবল হাতে দবির আর দবিরের ছোটো ভগ্নিপতি দাঁড়িয়ে। দরজা খোলার সাথে সাথে দবির হাত থেকে কুঠার ফেলে দিয়ে জারিফের কলার চেপে ধরে। চাঁপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে,“জানোয়ার!”
দবিরের ভগ্নপতি সোহেল তালুকদার ছুটে এসে দবিরকে সরিয়ে নিয়ে বলে,“আরে করছেন কি ভাইজান। চেচাবেন না, ছেলেপক্ষ শুনে ফেলবে। শান্ত হোন।”
তারপর সোহেল তালুকদার জারিফের হাত দু’টো ধরে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলে,“বাবা দেখো,তোমার পায়ে ধরতে পারবো না আমরা। দয়া করে চলে যাও, মেয়েটার এতো বড় সর্বনাশ করো না। হাতজোড় করছি।”
দোলা নেত্রদ্বয় বুজিয়ে রেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দুহাতে খামচে ধরে গাঁয়ের বেনারসী। জারিফ সোহেল তালুকদার আর দবির রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে,“ওর বিয়ে হয়ে গেলে চলে যাবো। আমি এখানে বসি।”
ভীষণ অবাক দবির রহমান আর সোহেল তালুকদার। জারিফ ঘরের কোণে একটা কাঠের চেয়ারে বসে পরে, চুপচাপ তাকিয়ে আছে দোলার দিকে। দোলা তখনও চোখ বুজে আছে।
দবির আমতা আমতা করতে থাকে, উচ্চবাচ্য কিছু করতেও পারছে না। তার হাত পা কাঁপছে,সে শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছে। তীরে এসে তরী যেনো না ডোবে!
জারিফ নির্বিকার,নিষ্প্রভ। কিয়ৎক্ষন তার পারুর মুখের দিকে তাকিয়ে দবিরকে বলে,“কাজী নিয়ে আসুন ফুপা।”
দোলাদের বসার ঘরটা বেশ ছোটোখাটো,একসেট ঘুনে ধরা কাঠের সোফা,একটা আলমারি,একটা ছত্রিশ ইঞ্চির বোকা বাক্স আর রয়েছে দুটো ফুলদানি তাতে রয়েছে প্লাস্টিকের ফুল। তবুও পরিচ্ছন্ন এবং গোছালো দেখতে ঘরটা। বসার ঘরে ছেলেপক্ষ থেকে আসা মুরব্বিরা বসে আছে। শেখ বাড়ি থেকে পুরুষরাই এসেছে,কোনো মহিলা আসেনি। তৌসিফের বাবা তৌফিকুল আহমেদ,বড় ভাই তৌকির আহমেদ,মেজো ভাই তন্ময় আহমেদ,তৌসিফের ছোটো দুইবোনের স্বামীরা, তৌসিফের দু’জন চাচা, একজন মামা আর কাজী সাহেব বসে আছে বসার ঘরে। তাদের শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে। তৌসিফকে নিয়ে দোলার ছোটো দুইবোন এবং চাচাতো, ফুপাতো ভাইবোনেরা বসার ঘর সংলগ্ন একটা ছোট কামরায় বসেছে। শেখ তৌসিফ আহমেদ গাঁয়ে চাপিয়েছে একটা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি। শ্যালক শ্যালিকাদের সাথে টুকটাক গল্প করছে সে। দোলার ভাইবোনেরা নতুন জামাইয়ের চেহারা এবং ব্যবহার দেখে মুগ্ধ। ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে পাশের বাড়ির চাচী ভাবীরা উকি দিয়ে নতুন জামাইকে দেখতে ব্যস্ত।
বাড়িতে ঢুকেই দোলার মুমুর্ষ দাদীর কাছে তার নাতনি জামাইকে নিয়ে সাক্ষাৎ করিয়ে আনা হয়েছে, কাজী এখন কাগজ পত্র গোছাতে ব্যস্ত। একটু পরেই বিয়ে পড়ানো হবে। বরপক্ষের সবাই মিলে ঠিক করেছে বিয়ে পরিয়ে রাতের বেলাতেই বৌ নিয়ে শেখ বাড়ি ফিরতে চায় তারা। বাকি যা অনুষ্ঠান হবে ও বাড়ি থেকেই হবে। এ যেনো দবিরের কাছে একটা খুশির খবর! কিছুটা খরচও বাঁচিয়ে দিয়েছে তার। নাহ! পাত্র একটা পেয়েছে বটে মেরুদন্ডহীন দবির রহমান!
দোলাকে দেখে মনে হচ্ছে সে নিঃশ্বাস অবধি নিচ্ছে না,পাথরের মূর্তির মতো দু’চোখ বন্ধ করে বসে আছে। জারিফ শুধু তার দুলিকেই দেখছে। খানিকবাদে দোলার ছোটো ফুপু হুরমুর করে ঘরে ঢুকে একবার আতঙ্কিত মুখ নিয়ে জারিফের দিকে তাকিয়ে দোলার কাছে যায়। দোলার পাশে, বিছানার ওপরে রাখা লাল-সোনালী দোপাট্টা উঠিয়ে দোলার মাথা ঢেকে দেয়। তখনই দোলার ঘরে কাজীকে নিয়ে প্রবেশ করে দবির রহমান,খসরু মাহমুদ এবং সোহেল তালুকদার। তন্ময় আহমেদ আর তানিয়া শেখের স্বামী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আড়াল হয়ে।
কাজী আড়চোখে জারিফের দিকে তাকায়। সোহেল তালুকদার কাজীকে একটা কাঠের চেয়ার টেনে দিয়ে বলে,“দোলার মামাতো ভাই!”
কাজী বিয়ে পড়াতে শুরু করে। দোলা ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে নিজের ভেতর খানিক প্রানের সঞ্চার করার চেষ্টা করছে, কবুল বলতে দম লাগবে তো!
“পাত্র বরগুনা পৌরসভার খারাকান্দা রোড নিবাসী মোহাম্মদ তৌফিকুল আহমেদের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ তৌসিফ আহমেদ তোমাকে নগদ সাত লক্ষ টাকা মোহরানা প্রদান করিয়া বিবাহ করিতে চায়, তোমার যদি এই বিয়েতে সম্মতি থাকে তাহলে কবুল বলো।”
সাত লক্ষ টাকা মোহরানার কথা শুনে দোলার শ্রদ্ধেয় বাপ চাচাদের মুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে, এ তল্লাটে সর্বোচ্চ তিন লক্ষ টাকার উপরে কোনো মেয়েকে মোহরানা দেওয়া হয়নি। তাদের দোলার কপালই বটে।
দোলা নীরব। জারিফের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা, হঠাৎ তার মনে আশা জাগলো তার আশারা জিতে গেলো। কিন্তু না, অত্যল্পকাল পরেই কাজী কোনো শব্দ বলার আগেই দোলা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,“কবুল!”
জারিফ তাকিয়ে আছে, একদৃষ্টে। তার চোখের পাতাও নড়ছে না। এতক্ষণ টানটান হয় চেয়ারে ঠেসে বসে থাকা সুঠাম দেহটা ছেড়ে দেয়,কিছুটা এলিয়ে পরে পেছনে, তবুও সে তাকিয়ে আছে,তার দুলির দিকে, একদৃষ্টে।
কাজী বলতে থাকে,“আবারও বলো মা।”
দোলা বন্ধ দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে তার সমস্ত অনুভূতিদের পালাতে দিয়ে বল,“কবুল। কবুল। কবুল।”
দবির রহমানের ঠোঁটে বিজয়ীর হাসি। কাজী বলে ওঠে,“আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা সবাই শুনেছেন তো?”
দরজার বাইরে থেকে শেখ তৌসিফ আহমেদের মেজো ভাই এবং ভগ্নিপতি বলে ওঠে,“জি আমরা শুনতে পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।”
এবার বরের কবুল বলার পালা। কাজীকে নিয়ে সবাই বসার ঘরে যায়। দবির তার ছোটোবোনের দিকে তাকিয়ে বলে,“শিগগির খাওয়ার বন্দোবস্ত কর, উনুন ঘরে গিয়ে তাড়া দে সবাইকে যা।”
শাহিদা চলে যায়। বাইরে থেকে বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড়ের শব্দ ভেসে আসছে। তাদের ধ’ম’কে চুপ করিয়ে দেয় খসরু মাহমুদ। কাজী পাত্রের কাছে গিয়ে বিয়ে পড়াতে থাকে।
শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। কাজী নব দম্পতির জন্য দোয়াপাঠ করতে থাকে। বসার ঘর থেকে ভেসে আসা গুনগুন আওয়াজ জারিফের মস্তিস্কে তীর ছুঁড়ে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে,অথচ জারিফ নির্বিকার। কিছুক্ষণ নিজের সামনে, বিছানায় গুটিসুটি মেরে, চোখ খিচে বন্ধ করে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে বিছানার দিকে এসে বিছানায় বসে। দোলার নাকে জারিফের পারফিউমের সুগন্ধ এসে লাগতেই দোলার বুক ফেটে কান্না আসে। বিছানার চাদর খামচে ধরে সে বসে থাকে। জারিফ নরম গলায় বলে,“দুলি।”
দোলা নিশ্চুপ। জারিফ ম্লান হেসে বলে,“শেখ তৌসিফ আহমেদের বৌ!”
দোলা আরো,আরো শক্ত করে খামচে ধরে বিছানার চাদর। জারিফ বলতে থাকে,“চোখ খুলবি না?”
দোলা ঘনঘন ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেয় সে চোখ খুলবে না। জারিফ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকে,“শেষমেশ আমাকে দেবদাস বানিয়েই ছাড়লি!”
দোলা ভাঙে না তার নীরবতা,মানুষটাকে যে এসব বলতে নিষেধ করবে সেটুকুও পারছে না, সে কি করবে? কান চেপে ধরবে এখন?
জারিফ মৃদু হেসে বলে,“দেবদা তো তার পারুর কপাল ফাটিয়ে দিয়েছিলো। তোকে কি করবো বল। নিষ্কলঙ্ক ছেড়ে দেবো?”
দোলা টলছে। শরীরটা হঠাৎ এলিয়ে পরতে চাইছে বিছানায়। জারিফ দোলার থুতনি ধরে বলে,“এই বদনে আঘাত আমি করতে পারবো না। তুই ভালো থাক। তোর প্রতি আমার রাগ নেই। না মায়ের প্রতি রাগ আছে। হুট করে রাগটা পরে গেলো তোদের উপর থেকে।”
“চলে যাও।”
ক্ষীণ স্বরে দোলা বলে ওঠে।
জারিফ বলে,“তা কেনো? ফুপাতো বোনের বিয়ে হলো। বোনকে বিদায় না দিয়ে কোথায় যাবো!”
দোলা ফুঁপিয়ে ওঠে,তবুও সে তাকাতে পারলো না জারিফের দিকে। বরপক্ষের খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে। এবার মেয়ে বিদায়ের পালা। নিয়মানুসারে শুরু হয়েছে নতুন বৌয়ের মাতৃশ্রেনীর মহিলাদের মরা কান্না, কেউ কাঁদছে নিচু স্বরে,কেউ উঁচু স্বরে,কেউ ভান করে,কেউ জোর করে। না কাঁদলে কেমন দেখায় না? তাই কাঁদছে সবাই।
কাঁদছে না শুধু দোলা। তার ছোটো ফুপু এসে এর মাঝে দু’টো মোটা মোটা স্বর্নের বালা পরিয়ে দিয়ে গিয়েছে দোলার হাতে। এক ঝাক মহিলারা দোলার গায়ে থাকা স্বর্নালংকারের পরিমাণ এবং মূল্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করছে।
জারিফ এসে পুনরায় কাঠের চেয়ারটিতে ঠেসে বসে আছে। তার অধর কোণে উপহাসের হাসি, নিজের প্রতি।
দোলার ছোটো মা কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যাওয়ার ভান ধরলো, তাকে সামলাতে ব্যস্ত প্রতিবেশী চাচিরা।
বড় ফুপি দোলাকে ধ’ম’ক দিয়ে বললো,“কিরে তুই চোখ খুলছিস না কেন? গাড়িতে উঠবি কিভাবে? তোর শশুর বাড়ীর লোক যে অপেক্ষা করছে।”
_ওর চোখ খুলতে হবে না। আমি নিয়ে যাচ্ছি ফুপু।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় বলে জারিফ। ঘরের ভেতরে থাকা প্রত্যেকে চ’ম’কে ওঠে জারিফের কথায়। দবির রহমান এবং তার ভাইয়েরা আতঙ্কিত হয়ে পরে। কিন্তু তাদের হাত পা বাঁধা, উচ্চবাচ্য করলে যদি দোলার শশুর বাড়ীর লোক জেনে যায়? তবে তারা চোখ কান খোলা রাখছে যাতে জারিফ কোনো অঘটন ঘটাতে না পারে।
জারিফ কোনো অঘটন ঘটায় না। শান্ত ভাবে দোলার হাত ধরে টানতে টানতে এনে উঠানে দাড় করায়। বাড়ির সবাই ছুটতে ছুটতে আসছে তাদের পেছন পেছন।
নতুন বৌয়ের হাত অন্য পুরুষের মুঠোবন্দী দেখে শেখ তৌসিফ আহমেদের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। দবির রহমান নতুন জামাইয়ের নারাজ মুখ দেখে চোরের মতো ভাব করছিলো, সোহেল তালুকদার ইনিয়ে বিনিয়ে বরপক্ষকে বলে,“ও দোলার মামাতো ভাই।”
শেখ বাড়ির মুরব্বিরা সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। জানিয়ে দিয়ে যায় আপাতত বৌকে নিয়ে বাড়িতে ফিরবেন তারা। পরবর্তী অনুষ্ঠানের সময়সূচি নিয়ে বৈঠক হবে আগামীকাল।
দোলার লাগেজ ডিকিতে তোলা হচ্ছে। দোলার ফুপুরা এগিয়ে আসে দোলাকে বিদায়ী আলিঙ্গন করবে বলে , জারিফ তাদের কোন সুযোগ না দিয়ে দোলাকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। তৌসিফ একবার সে দৃশ্য দেখে মাথা ঘুরিয়ে দোলার বাড়ির প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকায়। সবার আতঙ্কিত মুখভঙ্গি তার দৃষ্টি গোচর হয়না। কিন্তু পরপর গিয়ে সে গাড়িতে দোলার পাশে বসে।
আঙিনায় দাঁড়িয়ে সবাই কনে বিদায়ের অপেক্ষায়। শেখ বাড়ির দু’টো গাড়ি চলতে শুরু করলে জারিফ ক্লান্ত ভঙ্গিতে এসে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট করে। শেখ বাড়ির গাড়ি দুটো দৃষ্টি সীমার বাইরে যেতেই বিয়ে বাড়ির সবাই হাঁফ ছাড়ল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো জারিফকে, জারিফের এপাচি আরটিআর চলতে শুরু করে বিপরীত রাস্তা ধরে।
★★★
গাড়ি চলতে শুরু করার সাথে সাথেই দোলা দু’চোখ মেলে তাকায়। মাথার দোপাট্টাটা নাক অবধি টানা তার। হাত দিয়ে সেটা টেনে নিজের মুখটাকে খানিকটা উন্মুক্ত করে ঘনঘন নিশ্বাস নেয়।
তার পাশে বসা মানুষটার গা থেকে ভিন্ন পারফিউমের সুগন্ধ তার নাকে গিয়ে লাগছে। কিন্তু এই গন্ধটা দোলার নিঃশ্বাস আটকে দিতে চাইছে যেন। সে হাঁসফাঁস করছে। তৌসিফ আড়চোখে দোলাকে একপলক দেখে গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে দেয়। বাইরে থেকে শীতল বাতাস এসে চেষ্টা করে দোলাকে স্বস্তি দিতে,কিন্তু বিপরীতে দোলার বিরক্ত লাগছে।
তাদের গাড়িতে দোলা আর তৌসিফ ব্যাতীত বসে রয়েছে শেখ তৌকির আহমেদ এবং তানিয়া,তারানার স্বামী সুমন এবং সাঈদ। সুমন বারবার ফোন তুলে তানিয়াকে জানাচ্ছে শেখ বাড়ি পৌঁছাতে তাদের আর কত সময় লাগবে।
তৌসিফ আড়চোখে দোলার দিকে একপলক তাকিয়ে নিজের ফোনে মনোযোগ দেয়। বন্ধু বান্ধবরা সবাই নতুন ভাবীর ছবি দেখবে বলে একের পর এক বার্তা পাঠাচ্ছে। তৌসিফের চোখ মুখ কঠিন হয়ে যায় ঐ বার্তা গুলো দেখে। তার বৌয়ের ছবি অন্যকে কেনো দেখাবে? সে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বন্ধুদেরকে ছোটো করে লিখে পাঠায়,“ছবি দেয়া যাবে না।”
ফোনটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে আনমনে ডান হাতটা পাশে রাখতেই দোলার হাতে স্পর্শ লাগে। দোলা তড়িৎবেগে নিজের হাত সরিয়ে গুটিয়ে যায়।
তৌসিফের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সে মাথা ঘুরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখে।
শেখ তৌকির আহমেদ নীরবতা ভেঙে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বলে ওঠে,“দোলা এখন থেকে ইউরাকে তিনবেলা পড়াতে হবে যে!”
সাঈদ আর সুমন হোহো করে হেসে ওঠে। সাঈদ বলে ওঠে,“বেচারী দোলা ভাবী। কি বাজে ভাবে ফেঁসে গিয়েছে!”
দোলা নির্বিকার। সাঈদের কথায় তৌসিফের ঠোঁটে বক্রহাসি ফুটেছে। সে মনে মনে আওড়ায়,“আসলেই ফেঁসে গিয়েছে!”
★★★
আঙিনায় বাইক এসে থেমেছে। জাহিদা বেগম ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে টলছিলেন, বাইকের আওয়াজে মাথা তুলে তাকায়। পর পর কলাপসিবল গেট খোলা এবং বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হয়। জাহিদা ছুটে গিয়ে সদর দরজা খুলে দাড়িয়ে থাকে । জারিফ খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাইকটাকে সিড়ির কাছে দাড় করিয়ে রেখে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকে।
ত্রস্ত পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকে জারিফ ফ্রেশ হয়ে নেয়। একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজারে নিজের শরীর গলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসে বলে,“রেধেছো কি মা?”
জাহিদা আনাম একদৃষ্টে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। জারিফ প্লেটে ভাত তুলে নিতে নিতে বলে,“বলো রেধেছো কি?”
_করলা ভাজি, ডাল আর ইলিশ মাছ ভুনা।
অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় জাহিদা।
জারিফ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,“রাতে করলা ভাজি খেতে ইচ্ছে করছে না। মাছটাও না। একটা ডিমে ভেজে দাও।”
জাহিদা ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চুপচাপ গিয়ে একটা ডিম ভেজে নিয়ে এসে ছেলের পাতে তুলে দেয়। জারিফ বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে। জাহিদা দেখছে ছেলেকে।
খাওয়া শেষ করে বেসিনে গিয়ে হাত ধুতে ধুতে মাকে বলে,“শুয়ে পরো মা । আর হ্যা আমার ঘরের দরজা খোলা রেখে ঘুমাবো কেমন? যাতে তোমার ভয় না হয় তোমার ছেলে সুই’সাই’ড করলো কিনা।”
হেঁটে হেঁটে ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দরজার কপাট একেবারে দেয়ালের সাথে ভিরিয়ে দিয়ে বলে,“এই যে মা। খোলা থাকলো। তুমি ঘুমাও।”
মায়ের দিকে হাসি হাসি মুখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জারিফ বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে।
জাহিদা ডাইনিং রুমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ছেলের ঘরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে।
★★★
নব বর বৌয়ের গাড়ি শেখ বাড়ির গেটে এসে পৌঁছাতেই শেখবাড়ির সব লোক হুরমুর করে গেটে এসে দাঁড়ায়। রাত তখন বারোটা প্রায়। তৌসিফ গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দোলার পাশের দরজাটা খুলে দেয়। দোলা চুপচাপ নেমে পরে। মুরুব্বিরা সবাই বর বৌকে রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে, তারানা তৌসিফ আর দোলাকে দেখে বলে ওঠে,“আরে আরে ভাবী। তুমি হনহন করে ঢুকছো কেন বাড়িতে? তুমি ইউরাকে পড়াতে আসোনি। এসেছো এ বাড়ির বৌ হয়ে। একটু স্বাগতম জানাতে দেবে না আমাদের?”
ফারিন হেসে তৌসিফকে বলে,“বৌকে কোলে নিয়ে দাদীর ঘরে নিয়ে যাও। দু’জনে দোয়া নেবে ওনার থেকে। রাত অনেক হয়েছে। আজ দোলা ইউরার ঘরে থাকবে। কাল গাঁয়ে হলুদ দেবো দু’জনের, তারপর বৌকে তার নিজের ঘরে পাঠাবো, ঠিকাছে?”
তৌসিফ নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে ছিলো। তানিয়া তারানা তাড়া দিলে সে দোলার দিকে এগিয়ে যায়। তুলে নেয় দোলাকে পাঁজাকোলা করে। দোলা দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিঃশ্বাস অবধি নিতে ইচ্ছে করলো না তার যেন। মিনিট তিনেক যেতে সে টের পায় তাকে কোথাও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। চোখ খুলে দেখে সে গুলবাহার বেগমের ঘরে। তার পাশে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে তার স্বামী নামের মানুষটা।
★★★
জাহিদা আনাম ডাইনিং রুমের মেঝেতে চুপচাপ বসে আছে। তাকিয়ে আছে জারিফের ঘরের খোলা দরজার দিকে।
জারিফ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে বসে। দু ঘন্টা চেষ্টা করেও ব্যর্থ সে। ঘুম আসছে না তার চোখে, অথচ ঘুমটা তার খুব খুব খুব দরকার নয়তো অঘটন ঘটে যাবে আজ, লজ্জায় মাথা কাটা যাবে জারিফের, একজন পুরুষ হয়ে এই লজ্জায় সে পরতে চায়না, একেবারেই না।
চোখে ঘুম না আসলেও তার গলায় কিছু একটা এসেছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার। পেশীবহুল দুহাতে নিজের গলা নিজে চেপে ধরে গলায় আটকে থাকা জিনিসটাকে পিষে ফেলতে চায়। কিন্তু পারলো না, ঐ জিনিসটা বেশ আটঘাট বেঁধে এসেছে। জারিফ দ্রুত উপুড় হয়ে বালিশের নিচে মাথা ঢুকিয়ে নেয়। হাতরে আরো একটা বালিশ উঠিয়ে দু’টো বালিশ দিয়ে নিজের মাথাটা চেপে রেখে বিকট চিৎকার করে ওঠে। পুরুষ হয়ে লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো কাজটা জারিফ করেই ফেলে শেষমেশ।
জাহিদা আনাম কেঁপে ওঠে সেই চিৎকারে। রাতের নিস্তব্ধতায় ভয়ংকর শোনায় চিৎকারের শব্দ। সে উঠে দাড়িয়ে ছুটে যায় ছেলের ঘরের দিকে,দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পরে।
জারিফ প্রানপন চেষ্টা করছে তার কান্নার আওয়াজ চাপা দিতে। বালিশ দু’টো দিয়ে নিজের মাথাটাকে চেপে রেখেছে প্রচন্ড শক্তি নিয়ে। তবুও সে ব্যর্থ।
গোঙানির আওয়াজে জাহিনের ঘুম ভেঙে যায়, কি ভয়ংকর লাগছে শব্দটা। জাহিনের বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছে শব্দটা শুনে। তার কাছে মনে হচ্ছে কাউকে মেরে ফেলা হচ্ছে। জাহিন ঘুম ঘুম চোখে,মস্তিষ্কে তখনও টের পায়নি আজ কাউকে আসলেই মেরে ফেলা হয়েছে!
চলমান……
#নোটবার্তা: দেবো না দেবো না করেও দিলাম আরেকটা পর্ব। তবে হ্যা কাল সত্যিই পাচ্ছেন না।
আর হ্যা, যাদের গল্পটা পীড়া দিচ্ছে তাদের এককথায় বলবো গল্পটা এড়িয়ে যান। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটা পর্ব হ্যাপি হ্যাপি চাইলে এই গল্পটা আপনাদের কাছে বিষ। লেখিকা বিষ না খাওয়ার অনুরোধ করলো আপনাদের। গল্প মন মতো হচ্ছে না অথচ ঠিকই পড়ে দু’টো কটু কথা লিখে দিতে হাত নিশপিশ করছে,লাইক সিরিয়াসলি! এতে আমি আমার ভেবে রাখা থিম চেঞ্জ করে ফেলবো?