জনম জনমে পর্ব ৫

0
118

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৫
#ইসরাত_ইতি

দোলাকে দেখে বসার ঘরে থাকা শেখ বাড়ির সবাই অবাক হয়ে যায়। তানিয়া আর তারানা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। এই সময়ে দোলার আগমন কারো প্রত্যাশিত ছিলো না। তানিয়া তারানা দোলার কাছে এক গাল হাসি হেসে এগিয়ে যায়। দোলা বিনিময়ে শুকনো হাসি ফিরিয়ে দিয়ে সালাম দিয়ে বলে,“ফারিন ভাবীর সাথে দেখা করতে এসেছি।”

সিঁড়ির দিকে যাওয়ার পথে তৌফিকুল আহমেদ সামনে পরলে দোলা বিনীত হয়ে তাকেও সালাম দেয়। অতঃপর ধীরপায়ে হেঁটে দোতলায় ফারিনের ঘরে যায়।

“ভাবী আসবো!”

আচমকা দোলার গলার আওয়াজে ফারিন, শান্তা, তৌসিফ তিনজনই অবাক হয়।

তিনজন ঘুরে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে দোলা ফারিনের ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। সাদা রঙের একটা সাধারণ সুতি সালোয়ার কামিজ পরনে, মাথায় ওড়না টেনে দেয়া। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। মুখে নেই কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া। বরাবরের মতো সাধারণ তবে আকর্ষণীয়,যে সৌন্দর্য সোজা আ’ঘাত হানে বক্ষপটে।

তৌসিফ কয়েক পলকের ব্যবধানে দোলাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তবে সে ঘর থেকে বেরোয় না,টান টান হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে দৃষ্টি স্থির রেখে চায়ের মগে চুমুক বসায়।

ফারিন অবাক হলেও হাসি মুখে এগিয়ে যায়, দোলার হাত টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে বলে,”ওমাহ! দোলা যে! এসো বসো!”

শান্তা এক পলক তৌসিফের দিকে তাকিয়ে,তৌসিফকে শুনিয়ে শুনিয়ে দোলাকে বলে,”বেশ সুন্দর হয়ে গেছো দোলা আগের থেকেও। আমার তো চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।”

দোলা কোনো ভনিতা না করে শুধুমাত্র ফারিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”কথা ছিলো!”

_কি কথা দোলা।

দোলা হাতের শপিং ব্যাগটা ফারিনের হাতে দিয়ে বলে,”আপনার শাড়িটা,যেটা কলেজের প্রোগ্রামে পরবো বলে নিয়েছিলাম!”

_ওমা। এটা দিতে এই সময়ে আসতে হয়? একটা সামান্য শাড়ি দোলা। এতো রোদে বাইরে বেরিও না এখন,এই রূপ মলিন না হোক!

কথাটা বলে ফারিন ঠোঁট টিপে হাসে। দোলা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে জড়তা কাটিয়ে বলে,”আর হয়তো ইউরাকে পড়াতে পারবো না ভাবী,তাই দিয়ে গেলাম শাড়িটা, কখনো এই বাড়িতে আসা হয় কি না!

তৌসিফের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। চায়ের মগে চুমুক বসাতে গিয়েও বসায় না,তবে তার দৃষ্টি মেঝের দিকে। ফারিন দোলার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

দোলা মাথা নিচু করে কথাটা বলেছিলো। এবার মাথা তুলে একপলক তৌসিফের দিকে তাকিয়ে পুনরায় মাথা নিচু করে ফারিনকে বলে,”আমি বিয়েতে রাজি নই ভাবী । আপনি প্লিজ তৌকির ভাইয়াকে বলবেন উনি যেন বিকেলে বাবার সাথে কথা না বলেন। এটা নিয়ে আর না আগানোর অনুরোধ।”

ফারিন আর শান্তা হতভম্ব হয়ে সাথে সাথে ঘুরে তৌসিফের দিকে তাকায়। তৌসিফ খুবই শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে । নির্বিকার চিত্তে, এবং চুপচাপ চায়ের মগে চুমুক বসায়।

দোলা ফারিনকে বলতে থাকে,”বাবাকে বললে বাবা মানবে না,তাই সরাসরি আপনাদেরকেই বলা। আসছি ভাবী,ভালো থাকবেন। মেসেঞ্জারে কথা হবে। ইউরাকে আরেকজন ভালো টিচার দেবো।”

কথাটা বলে দোলা হন্তদন্ত হয়ে চলে যায়। ফারিন আর শান্তা মুখ শুকনো করে একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর তৌসিফকে দেখে। তৌসিফ তখনও চুপচাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো। পরপর গভীর,শান্ত চোখ দু’টো তুলে ভাবীর দিকে তাকায় ‌। ফারিন আমতা আমতা করে বলে,”তৌসিফ,তোমার ভাইয়াকে কি বলবো!”

_ভাইয়াকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
গম্ভীর কিন্তু অস্বাভাবিক শান্ত তৌসিফের কন্ঠস্বর।

_মানে? তোমার ভাইয়া জরুরি কাজ ফেলে দোলার বাবার সাথে বসতে চেয়েছিলো এখন যদি…

_বলেছি তো ভাইয়াকে কিছু বলার দরকার নেই!

উঁচু গলায় বলে ওঠে তৌসিফ। শান্তা আর আর ফারিন দু’জনেই চ’ম’কে ওঠে।

মুহুর্তের ব্যবধানে তৌসিফকে অস্বাভাবিক লাগছে। অস্বাভাবিক ক্রোধান্বিত লাগছে।

ফারিন ই’তস্তত করে,”বললো ও বিয়েতে রাজি না….!”

_ভাইয়া ওর বাবার সাথে কথা বলতে যাবে।
কন্ঠে পুনরায় শান্ত এবং গম্ভীর ভাব ফিরিয়ে এনে স্পষ্ট করে বলে ওঠে তৌসিফ।

ফারিন আর শান্তা হা করে তাকিয়ে আছে তৌসিফের দিকে। তৌসিফ চায়ের মগে শেষ চুমুক বসিয়ে ফারিনের দিকে তাকিয়ে খুবই স্পষ্ট করে বলে,”ওকে লাগবে!”

★★★

রাতের নিস্তব্ধতায় ‌ঢাকা পরেছে পুরো মহল্লা। হাওলাদার ভিলার সামনে দু তিনটে কুকুর তখনও সাংসারিক আলাপ করছে। আজও দেরী জারিফের। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে দোলার সাথে দেখা করেছে, ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলিতে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে ঘন্টাখানেক ফোনালাপ করেছে মশার কামড় খেয়ে। মন ভালো নেই দোলার, জারিফ তার মন ভালো করতে পারেনি,উল্টো নিজেই মনখারাপ নিয়ে ফিরেছে। শেখ তৌসিফ আহমেদের নাম বারবার তাকে যন্ত্রনা দিচ্ছে। দেশে কি আর মেয়ে নেই! তার দুলির দিকে নজর দেয়,কি সাহস!
দোলার উপরও হঠাৎ রাগ ওঠে জারিফের,আজ বোরখা পরে চলাফেরা করলে এমন হতো না! পরপর নিজের ওপর ক্ষেপে যায় জারিফ, মেয়েটাকে শুধু শুধু দুষছে কেনো। দোলা তো ইচ্ছে থাকলেও শ্বাসকষ্ট সমস্যার জন্য বোরখা পরতে পারেনা।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় জারিফের ভেতর থেকে। কেনো অহেতুক একে তাকে দুষছে সে, তার ব্যর্থতা দোলাকে এখনও সে বৌ করতে পারেনি। তার ব্যর্থতাকে ঢাকতে কেনো অন্যদের দোষ দেওয়া?

কলাপসিবল গেট খুলে বাইক উঠিয়ে সিড়ির কাছে দাড় করিয়ে গেট বন্ধ করে সদর দরজার কাছে যায়,হাত বাড়িয়ে কলিং বেল চাপার আগেই দেখে দরজা খোলা। ভ্রু কুঞ্চিত হয় জারিফের। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বসার ঘর পর্যন্ত যেতেই থ’ম’কে দাঁড়িয়ে যায়, জাহিদা আনাম বসার ঘরের সাথে লাগোয়া ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে আছে। মায়ের বিধ্বস্ত মুখটা দেখে জারিফ উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে যায়, নরম গলায় বলে,”কি হয়েছে মা! শরীর খারাপ?”

জাহিদা আনাম ছেলের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। অত্যল্পকাল পেরিয়ে যেতেই সে কন্ঠ খাদে নামিয়ে দৃঢ় ভাবে জিজ্ঞেস করে,“কতদিন ধরে চলছে এসব?”

★★★

দোলার বিয়েতে অমত সেকথা তৌকির আহমেদের কান অবধি পৌঁছায়নি তার স্ত্রী ফারিন। শান্তাও এ ব্যাপারে একটা কথাও বলেনি তৌসিফের বারণ শুনে। এদিকে তৌকির আহমেদ নিজে গিয়ে দোলার বাবার সাথে বিনয়ী হয়ে কথা বলেছে,জানতে চেয়েছে দবির রহমানের মতামত। মেরুদণ্ডহীন দবির রহমান নিজের বাড়িতে স্বয়ং উপজেলা চেয়ারম্যানকে পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন। আশ্বাস দিয়ে দিলেন তিনি বিয়েতে রাজি। কথা আগাবে। আত্মীয়তা হবে। তৌকির আহমেদ আশ্বাস দিলেন দোলাকে পড়তে দেওয়া হবে,চাইলে চাকুরীও করতে দেওয়া হবে। এতো এতো প্রতিশ্রুতি দেওয়া নেওয়া হলো বিকেলে, সবার অজানা রয়ে গেলো বিয়ের পাত্রী এই বিয়েতে রাজী নয়। দবির রহমান একথা জানলেও চেপে গেলেন, তার বিশ্বাস মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বললে বিয়েতে রাজি হবেই। সে ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, বেশি ত্যাড়ামি করলে একটু না হয় চোখের পানি ফেলবে মিছিমিছি। বাড়াবাড়ি করলে দু একটা চ’ড় থাপ্পড়ও মারবে না হয়, মেয়ের ভালোর জন্য সব করবে দবির। একসময় মেয়ে ঠিকই বুঝবে। এতো ভালো পরিবার কি করে হাত ছাড়া করবে সে? সারাজীবন শেখ ট্রেডার্সের মালিকদের প্রতিপত্তির কথা মফস্বলে শুনে এসেছে দবির, আজ সে বাড়ি থেকে প্রস্তাব এসেছে তার মেয়ের জন্য! ভাবা যায়। কোনো ঘটক পাঠিয়ে নয়, শেখ ট্রেডার্সের কর্ণধার তৌফিকুল আহমেদ নিজে এসেছিলেন। নিজের প্রতি বেশ গর্ব হচ্ছে দবিরের হঠাৎ করে। আজ বিকেল থেকে পাড়ায় দোলার বিয়ে নিয়ে বেশ চর্চা হচ্ছে। এই তল্লাটেও কেউ কল্পনা করেছিলো দবিরের মেয়ের বিয়ে এতো বড় ঘরে হবে? যেখানে এই পাড়ার সব মেয়েদের বিয়ে হয়েছে দোকানদার অথবা অর্ধশিক্ষিত প্রবাসী শ্রেনীর ছেলের সাথে। সে তুলনায় দবির পেয়েছে আকাশের চাঁদ।

★★★

কাঁচের পানির জগটা টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পরে আছে। জারিফ একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে। জাহিদা আনাম শাড়ির আঁচল মুখে চে’পে ধরে কাঁদছে। একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর।

জারিফ কিয়ৎক্ষন মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে দৃষ্টি সরিয়ে মাকে দেখে। অসহায়ের মতো বললো,”মা,ছাড়তে পারবো না ওকে!”

জাহিদা আনাম মুখ তুলে তাকায় না ছেলের দিকে, শুধু একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, হন্তদন্ত হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ধপপ করে দরজা লাগিয়ে দেয় ‌। জারিফ ছুটে যায় দরজার কাছে, আকুল হয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে, চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে,”মা ফুপি তোমার সাথে যা করেছে এতে দোলার দোষ কোথায়? তুমি আমাকে এটুকু বোঝাও শুধু। এটুকু বোঝাও!”

জারিফের চেঁচামেচিতে জাহিনের ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখ ডলতে ডলতে এসে বসার ঘরে দাঁড়িয়ে পরে। জারিফ মায়ের দরজায় অনবরত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। আকুল হয়ে বলছে,”মা দুলি খুব ভালো মেয়ে। ও আমাদের সবাইকে ভালো রাখবে মা। তুমি বিশ্বাস করো!”

দরজার ওপাশে জাহিদা আনাম চুপচাপ বসে আছে। জারিফ পুনরায় বলে ওঠে,”মা ওর অন্যায় কি একটু বলো, কেনো ওকে সহ্য করতে পারো না, একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ বলো,বলো আমাকে।”

নীরবতা ভাঙে জাহিদার,সে খুবই শান্তস্বরে বলে,”ওর দোষ আছে, অবশ্যই আছে। ওর দোষ হচ্ছে ও সেই মহিলার মেয়ে যে মহিলা তোর মাকে তোর বাবার কাছে খারাপ সাজাতে তোর মায়ের ঘরে পরপুরুষ ঢুকিয়েছিলো। আর যে মহিলা আর তার মায়ের কারনে তোদের বাবার সাথে আমার কখনও ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি। আর তোরা দুইভাই, তোরা দুইভাই ভালাবাসা বাসিহীন একটা বৈবাহিক সম্পর্কের ফসল। ঐ মহিলা আর তার মায়ের জন্য আমার বাপকে স্ট্রো’ক করে মরতে হয়েছিলো। ঐ মেয়েটার দোষ এটাই,ও ঐ মহিলার মেয়ে। ভয়াবহ দোষ করেছে তোর প্রেমিকা। ভয়াবহ দোষ!”

জারিফ চুপ হয়ে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে দরজার বাইরে চুপ করে। জাহিদা আনাম হাপাচ্ছে। একটু দম নিয়ে পুনরায় বলে ওঠে,”কি করবি? আমি না মানলে একা একা বিয়ে করে নিবি? নে বাবা। আমার কাজ ছিলো তোকে জন্ম দেওয়া,দিয়েছি, তোকে বড় করা ,করেছি। আমার মায়ের দায়িত্ব শেষ। এছাড়া সন্তানের জীবনে একটা মায়ের কি ভূমিকা? সারাজীবন তোরা সংসার করবি আমি আর ক’দিন বাঁচব। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রাধান্য কেনো দিবি। জীবন তোদের! যা বিয়ে করে আন। যা।”
কথা গুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পরে জাহিদা আনাম।

জারিফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে,জাহিদা দীর্ঘসময় পরে আর্তনাদ থামিয়ে নীরব হয়ে যায়। জাহিন মায়ের ঘরের সামনে মাথা নিচু করে দরজায় হেলান দিয়ে বসে থাকা বড় ভাইকে অবাক চোখে দেখতে থাকে।

★★★

গত একদিন জারিফের সাথে কথা হয়ে ওঠেনি দোলার। ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুত করতে হবে জারিফের নিজেকে,এই সময়ে দোলা নিজের বিষন্নতা দিয়ে লোকটাকে অমনোযোগী করতে চায়নি। শুধু তিনবেলা নিয়ম করে তিনটা মেসেজ পাঠিয়েছে দোলা। যদিও জারিফ জবাব দেয়নি। দোলা ভাবলো,নিজেকে সময় দিচ্ছে সম্ভবত,দিক!

হোস্টেলে দোলার ঘরের দু’পাশের ঘরে থাকে দোলার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী দুজন। তৃপ্তি এবং আফ্রা। ওদের সাথেই টুকটাক কথা বলে নিজেকে হালকা করেছে দোলা ক্ষনিকের জন্য। নিজের কামরা ছেড়ে তৃপ্তির কামরায় এসে বসেছে দীর্ঘক্ষণ।

তৃপ্তি আর আফ্রা ব্যস্ত মুড়ি মাখাতে। দোলা চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। এখান থেকে দৃষ্টি দিলেই কিছুটা দূরে একটা বিশাল দোতলা বাড়ি। ছাদে দুজন পুরুষ রমনী বৈকালিক আড্ডায় ব্যস্ত। দু’জনের হাতে দুটো চায়ের কাপ সম্ভবত ‌। হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে একে অপরের গায়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছরে পরছে। দোলার অবচেতন মন দেখলো ওখানে দোলা আর জারিফই দাঁড়িয়ে। দোলা একটা লাল রঙের সুতি শাড়ি পরেছে, জারিফ একটা বাটিকের পাঞ্জাবি।

দৃশ্যটা কল্পনা করেই গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দোলা। কখনও কি এমন সুন্দর কল্পিত দৃশ্যটা বাস্তব হয়ে দোলার সামনে আসবে? রোজ বিকেলে জারিফ অফিস থেকে ফিরলে দুজন মিলে ওভাবে ছাদে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে চা পান করবে। ঠিক ঐ যুগলের মতোন।

এদিকে তার ফোন বেজে চলেছে সেই তখন থেকে। দোলা ফোন হাতে তুলে আবার রেখে দেয়। দোলার বড় ফুপু ফোন দিয়েছে। এভাবে একের পর এক ফোন এসেই চলেছে বাড়ি থেকে। ফুপুরা, ফুপারা,চাচারা,চাচীরা,সবাই যেন হঠাৎ করে খুব দায়িত্বশীল অভিভাবক হয়ে উঠেছে দোলার। যারা দোলার জীবন গঠনে কাজ করছে তার বিশিষ্ট মেরুদন্ডহীন বাবা দবির রহমানের আন্ডারে!
দোলা ফুপুর ফোন ধরলো না, তৃপ্তি আর আফ্রার সাথে মুড়ি মাখাও খেলো না। তার ইচ্ছে করছে ছুটে যেতে জারিফের কাছে। ছুটে গিয়ে বলতে,“জারিফ আমাকে তুমি বিয়ে করে নাও,মামী না মানলেও করে নাও।”

“এই তোদের এখানে দোলা এসেছে?”

হোস্টেলের ওয়ার্ডেনের সহকারী এসে তিনশো তিনের দরজায় দাঁড়িয়েছে। দোলার মলিন মুখটা তার নজরে পরতেই বিরক্ত হয়ে বলে,“তুই এখানে দোলা? তোকে পুরো হোস্টেল খুঁজে এলাম। চল আমার সাথে। ওয়ার্ডেন স্যার তোকে ডেকেছে।”

দোলা নিস্তেজ কন্ঠে বলে,“আমাকে? কেনো?”

_তোর সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে।

দোলার ইচ্ছে করছে না বাড়ির কারো সাথে দেখা করতে। একেবারেই ইচ্ছে করছে না।

ওয়ার্ডেনের সহকারী সানজিদা বিরক্তি নিয়েই বলে,“আরে কি হলো কি! চল তোর মামী এসেছে।”

দোলা চ’ম’কে ওঠে। তৃপ্তি আর আফ্রাও সানজিদার মুখের দিকে তাকায়। তারপর ঘুরে দোলার দিকে তাকায়। দোলা আটকে আটকে বলে,“কে এসেছে?”

_তোর মামী। জাহিদা আনাম নাম,কদমতলা হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষিকা।

★★★

সদর রোডের মসজিদে মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে । জানালা থেকে যেটুকো আলো আসছিলো তা এখন নেই। অভিভাবক মিটিং রুমের বাতি নেভানো। জাহিদা আনাম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি দোলার সিঁথির দিকে। যে কিনা তার দু’টো পা জরিয়ে ধরে মেঝেতে বসে আছে। এখন আর কাঁদছে না দোলা,শুধু মাথাটা জাহিদা আনামের হাঁটুতে ঠেকিয়ে রেখেছে।

জাহিদা আনাম খুবই শান্ত ভঙ্গিতে দোলাকে বলে,“পা ছাড়ো দোলা।”

_মামী প্লিজ।
অদ্ভুত শোনাচ্ছে দোলার কন্ঠস্বর, শব্দ দুটো কন্ঠনালী ছিঁড়ে বেরিয়েছে যেন।

জাহিদা আনাম দু’চোখ বন্ধ করে আবারও চোখ মেলে তাকিয়ে বলে,“দোলা পা ছাড়ো।”

_মামী আজীবন আপনার দাসী হয়ে থাকবো!

এবার দোলা ডুকরে ওঠে। সে কাঁদছে,বাঁধ ভাঙা কান্না। জাহিদা আনাম ভাবলেশহীন। দোলা আরো শক্ত করে জাহিদা আনামের পা জরিয়ে ধরে, আকুল হয়ে বলতে থাকে,“দয়া চাইছি মামী!”

জাহিদা আনাম এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে আশেপাশে তাকায়, তারপর কিছুটা ঝুঁকে জোর করে দোলার হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়। দোলা মেঝেতে ওভাবেই পরে থাকে। বিধ্বস্ত হয়ে, উচ্ছিষ্টের মতোন।

★★★

তৃপ্তি আফ্রা দোলাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। একঘন্টা হয়েছে প্রায়, এখনও কামরায় ফেরেনি দেখে দু’জনেই খুঁজতে নেমেছে তাকে। পুরো হোস্টেল খুঁজে অবশেষে এক সিনিয়র আপুর থেকে জানতে পারলো দোলা অভিভাবক মিটিং রুমে আছে। দোতলা থেকে সিড়ি বেয়ে লবি ধরে নাক বরাবর হাঁটতে থাকে দ্রুত পায়ে। নিচতলার স্টোর রুমের কাছে এসে ডানে ঘুরতেই পা থ’ম’কে যায় আফ্রা তৃপ্তির। দোলা বিধ্বস্ত হয়ে দেয়াল ধরে ধরে হাঁটছে।

বি’কট চিৎকার দিয়ে তৃপ্তি এগিয়ে যায়। দু’জনে দুপাশ থেকে ধরে দোলাকে। উৎকণ্ঠা নিয়ে তৃপ্তি বলে,“একি হাল তোর ‌। কি হয়েছে? বুকে ব্যাথা করছে?”

দোলা জবাব দেয়না, দিতে পারেনা। তবে ওরা দুজন এটুকু বুঝলো দোলার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বাড়তি প্রশ্ন না করে ধরে ধরে দোলাকে তিনশো চারে এনে বিছানায় বসায়। তৃপ্তি দোলার গা থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলে। পেছন থেকে কামিজের ভেতর হাত ঢুকিয়ে পিঠে মাসাজ করতে থাকে। আফ্রা ছুটে গিয়ে দোলার ড্রয়ার থেকে ইনহেলার এনে দোলাকে দেয়।
নিস্তেজ,নিস্প্রান,মরা মাছের মতো তৃপ্তির গায়ে পিঠ এলিয়ে পরে আছে দোলা। ওরা দুজন দোলার থেকে জানতে চায়না কি হয়েছিলো এই এক ঘন্টায়। সহানুভূতি মাখা হাতে দোলাকে আকরে ধরে বসে থাকে। শুধু দোলার ফোন বেজে উঠলে আফ্রা ফোনটা হাতে নিয়ে দোলার দিকে তাকিয়ে বলে,“আংকেল কল দিয়েছে। কেটে দেই?”

_রিসিভ কর।
ক্ষীণ স্বরে বলে দোলা।

আফ্রা কলটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে রেখে দেয়, ওপাশ থেকে দবির রহমান তেতে ওঠে,“এসব কি বেয়াদবি দোলা। চাচা ফুপুদের ফোন ধরছো না! কি শুরু করেছো কি তুমি,আমার স্ট্রো’ক না করিয়ে তোমার শান্তি…”

_আব্বু।

দোলার অসুস্থ কন্ঠস্বর দবিরকে থামিয়ে দেয়। খানিকটা বিচলিত হয়ে বলে,“ঠিক আছো তুমি! কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো।”

দোলা সেসব কিছুর জবাব না দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,“আমি বিয়েতে রাজি আব্বু।”

চলমান…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here