#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৩
#ইসরাত_ইতি
[ভুলে ডিলিট হয়ে গিয়েছিলো তাই রিপোস্ট করা হলো]
পরীক্ষার দেড় মাসও সম্ভবত বাকি নেই। অথচ দোলার কাছে এই সেমিস্টারের সব বই নতুন, একেবারে ঝা চকচকে। হাতে নিয়ে একটি বার দেখেওনি। সিজিপিএ ডাউন হলে ফুপু ফুপারা ঢোল বাজাতে বাজাতে চলে আসবে তাদের বাড়ি নতুন সম্বন্ধ নিয়ে,পাত্র ইতালি প্রবাসী অথবা সদরে বড় কসমেটিকসের দোকান আছে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে নৃত্য করবে মাকসুদা। দবির রহমানের আদরের ছোটোবৌ। দোলাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলবে ,”লেখাপড়া করে কতদূর যেতে পারবে! পাতিলের কালি কপালে না লাগিয়ে পারবে? বাপের অবাধ্য হলে সেই মেয়ের কোনোদিন সুখ আসে না কপালে।”
দোলার বাবাও মিনমিন করে বলবে,”দিয়ার জন্য বাড়িতে প্রস্তাব আসছে,দিয়ার মা চাচ্ছে বিয়েটা দিতে। তুমিও বিয়েতে অমত করো না। ছেলে ভালো,বিয়েটা করে নাও। আমার বয়স বাড়ছে। তোমাদের একটা গতি করে যেতে চাই।”
আরো অনেক অনেক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা হবে দোলাকে। একদিকে বাড়ি থেকে ঘ্যানঘ্যানানি প্যানপ্যানানি,অন্যদিকে জারিফের মায়ের দোলার প্রতি বিতৃষ্ণা। সবকিছুর মধ্যে পরে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হতে হবে দোলাকে।
আচ্ছা দোলা যদি জারিফের সাথে পালিয়ে যায় তাহলে কেমন হয়? লেকের স্বচ্ছ পানিতে নিজের দোদুল্যমান প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রশ্নটি করে সে।
তাহলে কেমন হবে? পরমুহূর্তেই তার হাসি পায়। আচ্ছা সে না হয় পালালো, কিংবা জারিফ তাকে নিয়ে আলাদা হলো,তারা দুজন সুখী হলো আর ঐ মানুষটা? যে জারিফকে দশমাস পেটে ধরেছিলো,সে? তাকে কাঁদিয়ে দোলা আর জারিফ পাবে সুখ? তাকে খুশি করতে হলেও যে দোলাকে কাঁদতে হবে। মোদ্দাকথা একজনকে কাঁদতে হবেই। সেই একজন কে হবে? দোলার সাহস হয়না সেই একজন হতে। বড্ড মায়ায় পরে গিয়েছে ঐ অপদার্থ বেকার নড়বড়ে শিরদাঁড়ার ভীতু ভীতু মানুষটার। তার কিনে দেওয়া ওষুধ পত্র, তার কিনে দেওয়া কাচ্চি তার “দুলি” ডাকটার। সবকিছুর মায়ায় পরে গিয়েছে দোলা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়ায়,”কেনো লাই দিলি! এড়িয়ে গেলিনা কেনো! বুঝ হবার পর থেকে জড়ো হওয়া অনুভূতিদের কেনো বেহায়ার মতো সামনে আনলি। ওরটাও কেনো বুঝে নিয়ে মন বাগানে গোলাপ ফুটালি। এখন কি হবে দোলা? যতটা সাধারণ বলে তুই ভেবেছিলি সমস্যাটা, এখন কেমন ঠেকছে?”
দোলা পুনরায় ফোঁস শব্দ করে নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বরগুনা নাথপট্টি লেকপাড় হয়ে হেঁটে যাচ্ছে ফার্মেসী পট্টি। স্যানিটারি প্যাড ফুরিয়ে গিয়েছে,নিতে হবে।
হাতের মুঠিতে তার বেতনের টাকা,সাথে বোনাসও। হাঁটতে হাঁটতে সে গার্মেন্টস পট্টিতে এসে থেমে যায়। একবার হাতের টাকা গুলোর দিকে তাকিয়ে আশেপাশে তাকায়। বাড়তি দুই হাজার টাকা দিয়ে তার খুব ইচ্ছে করলো জারিফের জন্য একটা শার্ট নিতে। সবসময় দোলাকে দেয়,দোলা খুব কমই দেয়। বলতে গেলে দেয়ই না। জারিফকে শুধু শুধু অযোগ্য প্রেমিক বলে দোলা, সে নিজে কি? না কখনো উপহার দিয়েছে না দিয়েছে একটা শুকনো চু’মু, যা সব প্রেমিকারাই কালে ভদ্রে দিয়ে থাকে প্রেমিককে। ভাবতে ভাবতে হেসে ফেলে সে।
একটা পরিচিত দোকানে ঢুকেই দোকানদারকে মিডিয়াম সাইজের কটনের শার্ট দেখাতে বলে দোলা। বেশ সময় নিয়ে একটা পছন্দও করে ফেলে। গাঢ় নীল রঙের শার্ট টা। জারিফ এককথায় সুদর্শন, সুদেহী একজন যুবক। না যুবক নয়, পুরুষ। ছাব্বিশ পেরিয়ে সাতাশে পরতে চলেছে বয়স,সে তো পুরুষই। দোলা কল্পনা করে দেখলো তাকে ভীষণ মানিয়েছে শার্টটাতে। তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে জারিফের গায়ে এই শার্ট টা কল্পনা করে।
“দোলা আপু!”
বাচ্চা বাচ্চা পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে দোলা চকিতে ঘুরে তাকায়। জাহিন তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো। জারিফের ছোটোভাই অবিকল জারিফের মতোই দেখতে। তবে তার এখনও গোঁফ ওঠেনি। উঠবো উঠবো করছে। সে ছাত্র এবার ক্লাস সেভেনের। পড়ছে বরগুনা জিলা স্কুলে।
দোলা খুশি হয়ে এগিয়ে যায়। জাহিনকে জরিয়ে ধরে,উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,”কেমন আছিস?”
_আমি ভালো। তুমি?
_আমিও ভীষণ ভালো আছি।
_এখানে কি? সেই তখন থেকে সাইকেলের বেল বাজিয়ে তোমাকে ডেকে যাচ্ছিলাম। তোমার কানেই গেলো না।
দোলা হাসে,জাহিনের গালে হাত বুলিয়ে বলে,”কানে একটু কম শুনছি ইদানিং।”
_তাই নাকি! তবে তো বর জুটবে না।
_তোকে বিয়ে করবো। তুই আছিস তো।
জাহিন হাসে। দোলা দোকানদারকে পছন্দ করা শার্ট টা প্যাক করে দিতে বলে জাহিনের দিকে তাকায়,বলে,”চল তোকে আইসক্রিম খাওয়াই।”
★★★
দোলার বাবা দবির রহমান অতীত জীবনে একজন কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন, পরবর্তীতে ব্যাবসায় লস খেয়ে গৃহস্থী হয়েছেন। যা জমিজমা আছে সব বর্গাচাষীদের দিয়ে বছরটা ভালোয় ভালোয় কেটেই যায়। খুবই শান্ত প্রকৃতির লোক। তার কোনো শত্রু নেই। এতটাই নিরীহ সে। হাটার সময় যদি কোনো ল্যাম্পোস্টের সাথে ধাক্কা খায় তাহলে দাঁড়িয়ে সে সেই ল্যাম্পোস্টের কাছে মাফ চাইবে। এই ধরনের মানুষের কোনো শত্রু থাকতে পারে না। বরং যার ঘরে এতো সুন্দর তিনটি কন্যা রয়েছে তার এলাকায় একটু অন্যরকম মান। বিশেষ করে এলাকার ছোকরা সম্প্রদায়ের কাছে।
বাইরে সে যে কারনেই মান পাক,ঘরে তার মান নেই-ই বলতে গেলে,মানে নিজের স্ত্রীর কাছে। প্রথম জীবনে দোলার মা মিলাও মান দেয়নি, বর্তমান স্ত্রীও সেরকম।
মাকসুদা এক কাপ আদা চা এনে দবির রহমানের সামনে রেখে বলে,”কথা ছিলো।”
_বলো।
_একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে দোলার জন্য।
_নতুন কি। আসতেই পারে। মেয়ে রাজি না,বললো।
_দিয়ার বিয়ে দেবে না?
_দেবো।
মাকসুদা বসে দবিরের দিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ে বলে ওঠে,”তো দোলার বিয়েটা না হলে ওর বিয়েটা কিভাবে দিই?”
দবির মাথা তুলে স্ত্রীর দিকে তাকায়। মাকসুদা বলতে থাকে,”আসিফ অনুমতি পেয়েছে বিয়ের। মঞ্জু আপাও আর দেরি করতে চাইছে না। আমাকে বলে দিয়েছে সামনের মাঘে আসিফ ছুটিতে এলেই কাবিন করে রাখবে দিয়া আসিফের। এদিকে তোমার বড় মেয়ে বিয়ে করবে না বলে পণ করেছে। আচ্ছা এখন ওর আগে দিয়ার বিয়ে দিলে সেটা তোমার ভালো লাগবে? লোকে পাঁচ কথা না শুনিয়ে ছেড়ে দেবে?”
দবির শুধু চেয়ে রয় স্ত্রীর দিকে। মাকসুদা বলতেই থাকে,”এমনিতেই সারাবছর শহরে হোস্টেলে পরে থাকে। চরিত্রে দাগ লাগা নিয়ে এখনি কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছে। বড় পুকুর পাড়ে গেলেই শুনতে পাবে। সৎ মা হতে পারি আমি, তবে অতটাও খারাপ না যে এসব শুনলে আমার খুব ভালো লাগে। মেয়েকে বোঝাও। বিয়েটা করে নিক।”
দবির রহমান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন মাকসুদার কথা। মনে হলো তিনি আমলেও নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,”সম্বন্ধ এসেছে বললে! ছেলে কি করে?”
মাকসুদার ঠোঁটে বিজয়ীর হাসি। সে স্বামীর দিকে কিছুটা এগিয়ে যায় পাত্রের নাম ঠিকানা বলার জন্য।
★★★
দশহাজার স্টেপ কম্প্লিট। শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা ঘর্মাক্ত টি শার্ট টা খুলে কাউচের ওপরে রেখে কিছুক্ষণ ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নেয় । ফোনের রিংটোনে তার মনোযোগ বাধাপ্রাপ্ত হতেই সে ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলে,হাতে তুলে নেয় ফোনটা। জরুরি ফোনকল, দুমিনিট হু হা করে কিছু বলে ফোনটা আনলক করে হুট করেই ফটো গ্যালারিতে ঢোকে। এখানে দোলার একটা ছবি আছে। ছবিটা ক্যান্ডিড, ছবিতে দোলার আতঙ্কিত,লালাভ মুখবিবর। কপালের কাছে কিছু অগোছালো চুল।
তৌসিফের ছোটো বোন তারানার পান চিনির দিনে দোলা ইউরাকে পড়াতে এসেছিলো। তৌসিফ তখন তারানার ছবি তুলছিলো। আচমকাই,অজান্তে মাঝখানে চলে এসেছিলো গোলাপী রঙের সুতি সালোয়ার কামিজ পরিহিতা,মাথায় ওড়না টেনে দেয়া ছিমছাম গড়নের মেয়েটি। তৌসিফ ক্যামেরার সামনে কারো অযাচিত আগমনে ভ্রু কুঞ্চিত করলেও মেয়েটার মুখদর্শন করতেই তার কপালের ভাজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ক্ষনকালের জন্য দু’জনের চোখাচোখি হয়, মেয়েটা ঘা’ব’ড়ে যাওয়া শুকনো মুখটা নিয়ে একছুটে ইউরার ঘরে ঢুকে যায়। বেচারী জানতেও পারেনি সে পালাতে পারলেও তার ঐ ঘাবড়ানো রূপীয়সী বদন পালাতে পারেনি,বন্দী হয়েছে ক্যামেরায়,বন্দী হয়েছে শেখ বাড়ির জেদী ছোটো পুত্রের চিত্তে।
তৌসিফ ছবিটা জুম করে দেখতে দেখতে পানির বোতল তুলে পানি খেয়ে নেয়।
শরীরে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। ফোনটা রেখে তোয়ালে উঠিয়ে ওয়াশরুমে যায়। দীর্ঘ সময় নিয়ে শাওয়ার নেয়। এখন সময় বিকাল সাড়ে চারটা। দোলা ইউরাকে পড়াতে এসেছে আড়াইটায়। এখন সম্ভবত বেরোবে।
ধূসর রঙের ট্রাউজার আর কালো রঙের টিশার্টে নিজের সুঠাম তনু গলিয়ে নিয়ে ট্রাউজারের দু পকেটে হাত গুজে রুম থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পরে, ইউরার ঘরের দিকে তাকায়। তারপর নিচে নামে।
মিনিট খানেক পরে দোলা আর ফারিন কথা বলতে বলতে সিড়ি বেয়ে নামতে থাকে। তৌসিফ বসার ঘরের বড় সোফাটাতে বসে ছিলো,সেন্টার টেবিলটা মুখোমুখি টেনে তার ওপর ল্যাপটপ রেখেছে। গম্ভীর মুখে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছে ল্যাপটপে।
দোলা নামতেই তৌসিফকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু পরপর সে স্বস্তি পায় এটা দেখে যে তৌসিফ নামের অদ্ভুত চাউনীর লোকটার মনযোগ ল্যাপটপে,তার দিকে নয়। ফারিনের পিছু পিছু সে তৌসিফের সামনে থেকে দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে যায়। তাড়াহুড়ো,সংকোচে সে দেখেনি তৌসিফ দোলার দিকে না তাকালেও একজোড়া রঙিন পাথরের পায়েলে অলংকৃত দোলার ধবধবে ফর্সা সুগঠিত পদযুগলের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিতে কসুর করে নি।
ঐ আশ্চর্য মোহিত করা সুডৌল চরণদ্বয় দৃষ্টি সীমার বাইরে যেতেই তৌসিফ ফিচেল হাসে। পর পর সে হাসি মিলিয়ে যায়, সে কাজে মন দেয়।
★★★
রাত বাড়ছে, দোলা বুঝতে পারছে তার ঘুমানো উচিত কিন্তু তার মধ্যে বিছানায় যাওয়ার কোনো তৎপরতা দেখা যায়া না। একপ্রকার জোর করে চেয়ারে ঠেসে বসে আছে। হাতে তার ফিন্যান্স বইটা। গোটা পাঁচ মাস ফাঁকি দিয়ে দোলা “সময়ের একফোড় অসময়ের দশ ফোড়” কথাটার মর্মার্থ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কিন্তু এখন বুঝে লাভ কি! কোনমতে ফেইল ঠেকাতে পারলেই হলো,সামনে মানোন্নয়ন পরিক্ষা দিয়ে পুষিয়ে নেবে না হয়!
টিউশনি করে নিজের খরচ মেটাতে গিয়ে দোলার ছাত্রীজীবন অধঃপতনে গিয়ে পৌঁছেছে দোলা বুঝতে পারছে।
ফোনের রিংটোনে চোখ থেকে,যেটুকু ঘুম ভাব ছিলো, কে’টে যায়। সোৎসাহে রিসিভ করে আয়েশী ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে,”বলো।”
জারিফ বলে,”ঘুমাচ্ছিস না কেনো। বাতি জ্বেলে এতো রাত অবধি কি করছিস!”
দোলা সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে তার কামরার জানালার কাছে যায়। ব্যস্ত হাতে জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারে পশ্চিমের ল্যাম্পোস্টে। ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলির রাস্তায় পশ্চিম পাশের মরচে ধরা ল্যাম্পোস্টের টিমটিমে আলোর নিচে দাড় করানো নীল রঙের বাইকটাতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ফজিলাতুন্নেসা হোস্টেলের তিনতলার তিনশো চার নাম্বার কক্ষের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা জারিফকে দেখে চোখ জুড়িয়ে নেয় দোলা।
ভাণ করে আপত্তি তুলে বলে ওঠে,”রাত কত গভীর। যাচ্ছো না কেনো! এলে কেনো!”
এমন ভাবে বললো যেন দোলা অতীষ্ঠ হয়ে গিয়েছে জারিফকে দেখে। জারিফ দোলার অভিনয় ধরে ফেলেছে,সে নিরব হেঁসে
বলে,”শার্ট টা পরেছি। কেমন লাগছে!”
_খারাপ না।
_আন্সার ইন পজিটিভ!
_ঠিকঠাক।
দু’জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে কানে ফোন চেপে রেখে। শুনছে কেবল নিঃশ্বাসের শব্দ,আলো আধারিতে আবছা দেখতে পাচ্ছে একে অন্যের মুখটা। মুখাবয়াব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
খনিক বাদে জারিফ নীরবতা তাড়িয়ে বলে,”কাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকেছে,যদি চাকরিটা এখানেই হয়ে যায় তবে আর অপেক্ষা না করে মাকে…..”
_থামো, বলো না। এতো পরিকল্পনার কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে না, বর্তমানটাকে একটু উপভোগ করতে দাও। অনিশ্চিত দিনের কথা বর্তমানে টেনে এনে যন্ত্রনা দ্বিগুণ করো না।
জারিফ চুপ হয়ে যায়। দোলাও চুপ। কে’টে যায় আরো কিছুক্ষণ সময়। গলির সরু রাস্তা থেকে শেষ দু’টো রিক্সা চলে গেলো ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে। উত্তর পাশে শেফা ফার্মেসির সামনে হঠাৎ দু তিনটে কুকুর ডেকে উঠতেই দোলা আর জারিফ দু’জনেই চ’ম’কে ওঠে।
জারিফ এদিক ওদিক খুজে একটা ইটের টুকরা তুলে কুকুর গুলোকে তাড়িয়ে দোলাকে বলে,”ঘুমিয়ে পর।”
ফোন কাটে। জানালার পর্দা টেনে জানালা লাগিয়েও দেয় দোলা, জারিফ তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। দোলা ঘরের বাতি নিভিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে বাইক স্টার্ট হয়। আওয়াজ তুলে ছুটে যায় নীল রঙের এপাচি আরটিআর।
★★★
জাহিদা আনাম ডিভানে বসে নবম শ্রেণীর অর্ধবার্ষিক পরিক্ষার বাংলা খাতা দেখছিলেন। চোখে তার সোনালী ফ্রেমের চশমা।
জাহিন হাই তুলতে তুলতে মায়ের পাশে এসে বসে মায়ের গায়ে ঢলে পরে। জাহিদা খাতা থেকে চোখ না সরিয়ে বলে,”দেড়টা বাজে প্রায়। ঘুমাচ্ছো না কেন! সকালে স্কুল মিস যাবে!”
জাহিন জবাব না দিয়ে গুটিসুটি মে’রে বসে থাকে। এতক্ষণ কম্পিউটারে গেমস খেলছিলো,এখন বেশ খিদে পেয়েছে। মাকে বললেই মা বলবে,”ভাত খাও।”
কিন্তু জাহিনের এখন চাউমিন খেতে ইচ্ছে করছে,মাকে বলার সাহস হচ্ছে না।
বাইরের আঙ্গিনায় বাইক থামে,পর পর কলাপসিবল গেট খোলার আওয়াজ হয়। জারিফ বাইক উঠিয়ে,গেট বন্ধ করে সদর দরজার সামনে এসে কলিং বেল চাপার আগেই দরজা খুলে যায়। জারিফ লজ্জিত ভঙ্গিতে হেঁসে বলে,”সরি মা! সিয়ামের মা ছাড়তে চাচ্ছিলো না।”
_বয়স ছাব্বিশ টা মায়ের বকুনি খাওয়ার বয়স না,তাই সেরকম চলবে।
জারিফ ঘা’ড় কাত করে, ঘা’ড়ের কাছে ট্রিম করা চুলে হাত বুলিয়ে বসার ঘরে পা রাখে। জাহিদা আনাম গিয়ে তার খাতা দেখতে বসে। জাহিন ভাইকে দেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসে। কিছুক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলে,”নতুন শার্ট!”
জারিফ ই’তস্তত করে বলে,”হু। আজ নিলাম।”
জাহিন কয়েক মুহূর্ত কিছু মনে করার চেষ্টা করে বলে,”আরেহ! কি আশ্চর্য। ভাইয়া জানিস গতকাল গার্মেন্টস পট্টিতে দোলা আপুর সাথে দেখা হয়েছিলো, সেও জেন্টস পয়েন্ট থেকে হুবহু এরকম একটা শার্ট নিয়েছে। একেবারে সেইম!”
জাহিদা ছাত্রের খাতায় প্রাপ্ত নাম্বার লিখতে যাচ্ছিলো,ছোটো ছেলের কথায় তার হাত থেমে যায়।
জারিফ এক প্রকার হোঁচট খেয়ে সরাসরি মায়ের দিকে তাকায়। দেখতে পায় মা তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে।
জাহিন বকবক করে যাচ্ছে গতকাল দোলা আপুর সাথে দেখা হবার পরে কি কি হয়েছে। সেকথা জাহিদা আনাম আর তার বড়ছেলের কানে পৌঁছায় না। দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে। একজনের দৃষ্টিতে ধরা পরার আতঙ্ক আরেকজন তাকিয়ে আছে অবাক চোখে, হতবাক হয়ে।
চলমান….