তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব ২০

0
199

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ২০

পারফি, শাফিন আর কিছু গার্ড দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের মাঝে সেই বাড়িটার সামনে যে বাড়িতে পারফি আর ইয়ানাকে আঁটকে রাখা হয়েছিলো।
এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য হলো কোনো ক্লু খুঁজে বের করা। কারা এমন করেছিলো তাদের ধরার জন্য হলেও অন্তত একটা ক্লু তো লাতবেই। জানে এখন এখানে কেউ থাকবে না, সব ক্লু সরিয়ে ফেলবে তবুও আশায় আছে কোনো না কোনো ক্লু খুঁজে পাওয়ার।

সবাই এক সাথে ওই পুরোনো বাড়িটার কাছে গেলো। দরজার সামনে ঝুলে আছে বিশাল এক জং পড়া তালা। দেখে মনে হচ্ছে কয়েক যুগ থেকে এখানে কেউ থাকে না কিন্তু ধারণাটা পুরোটাই ভুল। এখানে সবসময় কেউ যাওয়া আসা করে, যাতে বাহিরের কেউ বুঝতে না পারে তাই এরকম পুরোনো করে রেখেছে জায়গাটা। কেউ যে প্রখর বুদ্ধিমত্তার সাথে এগুলো করছে তা খুব ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শাফিন বললো তুই কি সিওর এটা সেই জায়গা? বাড়িটা দেখে তো মনে হচ্ছে কয়েক যুগ থেকে এটা তালাবদ্ধ।

পারফি শাফিনের দিকে তাকিয়ে বললো জানতাম তুই মাথা মোটা কিন্তু এখন দেখছি তার থেকেও অধম তুই। এটা ওদের গোপন আস্তানা, এখন এখানে কি তোর জন্য সোনা দিয়ে বাধাই করে চকচকে করে রাখবে? গাধা একটা…..

শাফিন ঠোঁট উল্টে বললো এভাবে বলতে পারলি তুই আমাকে? ভালো করে বুঝিয়ে বললেইতো হয়। আমার এই ছোটখাটো সহজসরল মাথাটা এতো পেছগোছ বুঝে না তা জানিস না?

হয়েছে তোর পকপক থামা এবার তালা ভাঙার ব্যবস্থা কর।

শাফিন গার্ডের নির্দেশ দিলো তালা ভাঙতে। তারা তালা ভেঙে দিতে ভিতরে প্রবেশ করলো পারফি আর শাফিন। গার্ডের বলে দিলে বাহিরে পাহাড়া দিতে।

শাফিন আর পারফি ভিতর প্রবেশ করতে দেখলো ধুলোবালিতে পুরো ঘর ভরে আছে এটা যে ইচ্ছাকৃত ভাবেই করেছে তা জানা আছে পারফির কারণ সেদিন এই ঘর পুরো ক্লিন ছিলো।

এদিকে শাফিন মনে মনে ভাবছে পারফি ওকে ভুল জায়গায় নিয়ে এসেছে কারণ এই বাসার যে ছিরি দেখে মনে হচ্ছে কয়েক বছর থেকে কেউ পাও দেয় নি কিন্তু মুখে কিছু বললো না। এখন কিছু বলা মানে পারফির থেকে এতোগুলা কথা শোনা তাই চুপচাপ পারফির পিছু পিছু যেতে লাগলো।

পারফি চারেদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে প্রথমে চলে গেলো সেই রুমে যে রুমে ওদের বেঁধে রাখা হয়েছিলো। সেখানে যেতে দেখতে পেলো সেদিনের সেই চেয়ার দুটো ভেঙেচুরে নিচে পড়ে আছে বুঝলো যে ওদের খুঁজে না পেয়ে কেউ এই চেয়ার দুটোর উপরে নিজের জিদ ঢেলেছে। তারপর কিছুটা দূরে পড়ে আছে কিছু রশি যেগুলো দিয়ে ওদরে বাঁধা হয়েছিলো। এগুলো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না।

পারফির সাথে সাথে শাফিন ও সব কিছু পর্যবেক্ষণ করলো। সব কিছু দেখে এবার শাফিনের মনে হচ্ছে ঠিক জায়গায় এই এসেছে। এতক্ষণ নিজের বোকা বোকা ভাবনার জন্য নিজের মাথায় নিজের চাপর মারলো।

ওই রুমে কোনো কিছু খুঁজে না পেয়ে পাশের রুমে চলে গেলো এভাবে এক এক করে সবকয়টা রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো কিন্তু কোনো ক্লু চোখে পড়লো না। সব প্রমাণ যে নিখুঁত ভাবে মুছে দিয়ে গেছে তা বুঝতে পারলো।

শাফিন বললো শালা খুব ধূর্তবাজ কিভাবে সব প্রমাণ একবারে লুট করে দিয়েছে।

তাইতো দেখছি চল এখানে বেশি সময় থাকা ঠিক হবে না ওরা আগে থেকেই জানতো এখানে কেউ আসবে তাই আগে থেকে সব ক্লু সরিয়ে ফেলেছে।

পারফির কথায় শাফিন সম্মতি দিয়ে আশাহত হয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলো। গার্ডদের নির্দেশ দিলো তালাটা আবার লাগিয়ে দিতে আগের মতো। কথানুযায়ী গার্ডরা তাই করতে লাগলো।

পারফি আর শাফিন যেই চলে আসতে যাবে অমনি কিছুর উপরে পারফির চোখ আটকালো। বাসার সামনে শুঁকনো পাতার ফাঁকে একটা সিম পড়ে থাকতে দেখলো। পারফি নুয়ে সিমটা হাতে নিলো তারপর ভালো করে ওই জায়গাটা দেখতে চোখে পড়লো ফোন ভাঙার ছোট ছোট টুকরো যেগুলো গভীর ভাবে না দেখলে চোখে পড়ার মতো না।

পারফি সিমটা এপিট ওপিট করে দেখতে দেখতে বললো মনে হচ্ছে কেউ রাগ দেখিয়ে ফোনটা আছাড় মেরে ভেঙেছে যার দরুন সিমটা ফোন থেকে খুলে পড়ে গেছে। ফোনের টুকরোগুলো সরিয়ে ফেললেও হয়তো এই ছোট সিমটা চোখে পড়ে নি। মনে হচ্ছে এই সিম থেকে কিছু হলেও জানতে পারবো।

শাফিন বললো আমার ও তাই মনে হচ্ছে। তাহলে চল এখন যাওয়া যাক আশা করি এই সিম থেকেই আসল কালপ্রিট এর কাছে পৌঁছাতে পারবো।

পারফি সম্মতি দিয়ে সবাইকে নিয়ে বের হলো ওই জায়গা থেকে। এখন বিকেল হয়ে গেছে এবার ঢাকা ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে যাবে তাই ওখানে আর সময় নষ্ট না করে ঢাকা উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
——————————————-
এদিকে বিকেলে ছাঁদে বসে ইয়ানা, ইমা আর প্রীতি গল্প করছিলো। ইয়ানা সবার সাথে গল্প করলেও ওর মন বসছে না গল্পে। আসার পড় থেকে ইতি বেগমের সাথে দেখা হয় নি। কেনো যেনো একটা বার মায়ের মুখটা দেখার জন্য হাসফাস করতে লাগলো। ইচ্ছে করলো ছুটে যেতে তার কাছে কিন্তু সেদিনের কথা গুলো মনে করতে আর যেতে পারলো না তার কাছে। তাকে আর বিরক্ত করতে চাইলো না।

ইয়ানার গল্পের দিকে মন না দিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে থাকতে দেখে ইমা বললো কি হয়েছে তোর এতো কি ভাবছিস?

ইয়ানা নিজেকে সামলে বললো না কিছু না।

প্রীতি ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো আমাদের বোকা পেয়েছিস? তুই কিছু না বললি আর বিশ্বাস করে নিলাম। তোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তোর মনে কিছু একটা চলছে, কি হয়েছে সত্যি করে বল।

ইয়ানা কি করবে বুঝতে পারলো না। বলবে কি বলবে না দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলো অবশেষে ওদের জোরাজোরিতে ইয়ানা থেমে থেমে বললো আসলে মাকে এক নজর খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মাতো আমার উপরে বিরক্ত তাই এই বিরক্ত মুখশ্রী নিয়ে তার কাছে যেতে পারলাম না বলতে বলতে চোখজোড়া চিকচিক করে উঠলো ইয়ানার।

ইয়ানার কথায় প্রীতি আর ইমার মন ও খারাপ হয়ে গেলো। ইমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো জানিনা মা এতোদিন কেনো তোর সাথে এমন করতো। কিন্তু তুই যাওয়ার পর থেকে একটাবার এর জন্য রুম থেকে বের হয় নি। বাবা ও রাগ করে মায়ের সাথে কথা বলে নি এখনো। আমি গিয়েছিলাম কয়েকবার কথা বলতে কিন্তু লাভ হয় নি। কোনো কথা বলে নি, কিছু খায় ও নি। কালকে থেকে না খাওয়া।

ইমার কথায় ইয়ানার বুকের ভিতর কামড় মেরে উঠলো। মা যতোই ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করুক না কেনো মাতো মা এই। মায়ের অবস্থা এমন শুনে ইয়ানার মন কেঁদে ইঠলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো আপু আ..আমি কি যাবো একবার মায়ের কাছে?

ইমা ফের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো কথা বলবে কিনা জানিনা, তবে যেয়ে দেখতে পারিস একবার।

ইয়ানা সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বললো তোমরা তাহলে গল্প করো আমি দেখে আসি মাকে এ বলে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছুটে চলে গেলো।

ইয়ানার যাওয়ার পানে প্রীতি তাকিয়ে ভাবলো এতো কিছুর পর ও মেয়েটা মায়ের জন্য কতটা পাগল হয়ে আছে। আন্টি যে কেনো ওর সাথে এমন করে ভাবতেই খারাপ লাগে।

ইয়ানা এক ছুটে ইতি বেগমের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। এবার ভিতরে যাবে কি যাবে না তাই ভাতে লাগলো। অবশেষে হালকা করে নিঃশব্দে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো। পুরো রুম অন্ধকার হয়ে আছে। অন্ধকারের মাঝে চোখে পড়লো ইতি বেগম চুপচাপ শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। ইয়ানা ধীর পায়ে বেডের কাছে এগিয়ে গেলো।

আস্তে করে ডাক দিলো….. মা।

মা ডাকটা শুনে বুকের ভিতর কামড় মেরে উঠলো ইতি বেগমের। বন্ধ করা চোখ খুলে সামনে তাকাতে অন্ধকার রুমে ইয়ানাকে দেখতে পেলো। ইয়ানাকে দেখে অপরাধবোধ টা আরো বেরে গেলো কয়েক গুন। দুটো দিন থেকে অপরাধবোধ তাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। না পারছে কাউকে কিছু বলতে আর না পারছে এই অপরাধে বোঝা বয়ে বেরাতে।

ইতি বেগমকে কোনো কথা না বলতে দেখে ইয়ানা আস্তে করে পাশে বসলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছে মা ভালো নেই তাই কোমল গলায় বললো কাল থেকে কিছু খাও নি নাকি?চলো খাবে এখন।

ইতি বেগম ছলছল চোখে তাকালো ইয়ানার দিকে। এই মেয়েটাকে এতোটা বছর কতোটা অবহেলা করে আসছে আর সেই মেয়েটা এখনো তার কথা ভেবে চলেছে ভাবতেই কষ্টে বুকটা ভারী হয়ে আসছে।

ইতি বেগমকে এবার ও কথা বলতে না দেখে ইয়ানা আস্তে করে ইতি বেগমের হাত ধরে বললো চলো এভাবে না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে।

ইতি বেগম এবার নিজেকে একটু সামলে ভাঙা গলায় বললো পড়ে খেয়ে নিবো আমি এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।

ইতি বেগমের এমন ভাঙা গলা শুনে ইয়ানা চমকে গেলো। তারমানে সত্যি মা ঠিক নেই, ইয়ানা তারাতাড়ি রুমের লাইট জ্বালিয়ে ইতি বেগমের দিকে তাকাতে থমকে গেলো। চোখনামুখ ফুলে আছে, চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে৷ মাকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ইয়ানা দ্রুত ইতি বেগমের কাছে যেয়ে তার দু গালে হাত রেখে বিচলিত হয়ে বললো এ কি হাল করেছো নিজের? কি হয়েছে মা তোমার? আমাকে বলো। বাবা রাগ করেছে দেখে কি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? আমি এখনি বাবাকে বলছি তোমার সাথে কথা বলতে প্লিজ আর কষ্ট পেও না। তোমার…

আর কিছু বলার আগে ইতি বেগম ইয়ানাকে ঝাপটে ধরে ডুকরে কান্না করে উঠলো।

মায়ের এমন কান্না দেখে ইয়ানা ও কান্না করে দিলো। মায়ের এতো কষ্টে ও নিজেও কষ্ট পাচ্ছে।কিভাবে মাকে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারলো না।

তখন ইতি বেগম কান্না করতে করতে বলে উঠলো আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। এতো বছর তোর সাথে অনেক বেশি অন্যায় করে ফেলেছি আমি। জানি আমার অন্যায়ের ক্ষমা হয় না। আমি তোকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিয়ে এসেছি যার অনুশোচনায় আজ আমি দগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।

ইয়ানাও ইতি বেগমকে ঝাপটে ধরে কান্না করতে লাগলো। এক পর্যায়ে নিজেকে একটু সামলে ইতি বেগমের চোখে পানি মুছে দিতে দিতে বললো পুরোনো সব কথা ভুলে যাও মা। আমি ওসব কিছু মনে রাখি নি, এখন মা হয়ে মেয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে প্লিজ ছোট করবে না। আমরা মা মেয়ে মিলে আবার নতুন করে একটা জীবন শুরু করবো। পুরোনো সব অতীত পিছে ফেলে দিবো বুঝলে?

ইতি বেগম ইয়ানাকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে ফুপিয়ে কান্না করতে লাগলো।

ইয়ানা কিছুক্ষণ ওভাবে চুপ থেকে ইতি বেগমের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ইতি বেগমের হাত ধরে টেনে নিতে নিতে বললো অনেক হয়েছে কান্না এবার চলো কিছু খেয়ে নিবে এ বলে ইতি বেগমকে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে খাবার বেরে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো।

আজ ইয়ানা খুব খুব খুশি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। অনেক অপেক্ষার পর আজ মাকে আপন করে পেয়েছে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু আছে?

ইতি বেগম ইয়ানার দিকে ছলছল করে তাকিয়ে রইলো শুধু।

এদিকে ড্রয়িংরুমে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে ইয়ানা আর ইতি বেগমকে দেখছে প্রীতি, ইমা ও ইসহাক আহমেদ। ব্যপারটা যেনো কারো হজম হচ্ছে না। এটা কি সত্যি নাকি স্বপ্ন দেখছে তাও বুঝতে পারছে।

ইমা এটা সত্যি নাকি স্বপ্ন দেখছে তা বোঝার জন্য প্রীতিকে বললো প্রীতি আমাকে একটু চিমটি কাটতো, আমি কি চোখে ঠিক দেখছি নাকি স্বপ্ন দেখছি?

প্রীতি বেখেয়ালি ভাবে ইমার হাতে চিমটি কেটে বললো আমার ওতো একি অবস্থা আপু। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুলছে না।

এদিকে ইসহাক আহমেদ থম মেরে বসে রইলেন। সত্যি নিজের চোখকে কেনো যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। বিষয়টা হজম করতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার কাছে।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here