#মায়া_মহল (২)#রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
নিমিষেই মায়ার মুদে আসা নয়নকোন ভিজে উঠলো বেদনার অশ্রুতে। কাল কি সত্যিই তার ছোট্ট জীবনের বিদায়ী সুর বাজবে?
আঞ্জুমান আরা পানের বাটা নিয়ে বসলেন শয্যার একপাশে। শাহী পান মসলা দিয়ে আস্ত একটা পান মুখে পুরে দিলেন। চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কিভাবে আমাদের মহলে ঢুকে পড়েছ, তা জানার দরকার নেই আমার। তবে কি কারণে এসেছো তা জানতে চাই। শুনলেইতো কালই তোমার জীবনের অন্তিম দিন।”
পাশ থেকে কোন কথা শুনতে পেলনা আঞ্জুমান। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মায়া ঘুমিয়ে গিয়েছে। আহ! বলে আক্ষেপের ঝড় তুললেন।
আপন মনে বললেন,
গতকাল সূর্য উঠার আগেই মেয়েটির প্রাণনাশ হবে। কোথা হতে এলো, কি হলো তার জীবনে। কিছুই যে জানা হলো না। অজস্র প্রশ্ন আঞ্জুমানের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে মায়াকে নিয়ে।
ঊষালগ্নেই ঘুম ভেঙ্গে যায় মায়ার। দেখতে পেলো জায়নামাজে বসা আঞ্জুমান। তার দুহাত প্রার্থনারত ও দু’চোখ অশ্রুসিক্ত। মায়া মনে মনে বলল,
আমার আম্মারেও দেখতাম খালি নামাজের পাটিতে বসে কাঁদতো। উনিও দেখি কাদঁতেছে। সব আম্মারাই কি নামাজ শেষে মোনাজাতে বসে কাঁদে? কিসের এত লুকানো দুঃখ আম্মাদের? কিসের?
মায়া ওয়াশরুমে গিয়ে শুধু পেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে নিলো। আয়নায় নিজেকে দেখলো। রুমে এসে দাঁড়িয়ে রইলো অবুঝের মতো। ততক্ষণে আঞ্জুমান উঠে গিয়েছে। মায়া বোকা বোকা চোখে রুমের চারপাশ দেখতে লাগল। এত নান্দনিকতার ছোঁয়া, এত দামী দামী আসবাবপত্র থাকতে পারে কেবলমাত্র কোন নারী থাকার রুমে। এ যেন মায়ার জন্য অকল্পনীয়! অবিশ্বাস্য! কোন স্বপ্নপুরীতে চলে এলো নাকি সে।
আঞ্জুমান মায়ার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে,
” ওই যে তাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে নাও। বেতের চেয়ারটায় বসো।”
মায়া মুখ মুছে চেয়ারটিতে বসলো। তার আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে। পালাতে চায় সে এখান থেকে। কিন্তু এত বিশাল বাড়ির কোন পাশে কোন পথ সে কিছুই জানেনা। গেইটে পাহারাদার সার্বক্ষণিক জেগে থাকে মনে হয়। মায়ার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় আঞ্জুমানের কোমল স্বরের ডাকে।
” কি চিন্তা করছ মেয়ে? তোমাকে মেরে ফেলবে। এটা?”
মায়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। পরক্ষণেই অনুনয় করে বলল,
” আমিতো কোন অপরাধ করিনি। ভুল করে আপনাদের বাড়িতে এসে পড়েছি। আমাকে চলে যেতে সাহায্য করুন। আমি আমার আম্মার কাছে চলে যাবো।”
” এটা আমি রাতেই ভেবে রেখেছি। তোমাকে বাঁচাবো আমি। তোমাকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো আমি। তবে তোমার বিষয়ে সব জানার পর। নয়তো মানসিক অশান্তি পোহাতে হবে আমাকে। আচ্ছা তোমার জন্য তোমার পরিবার চিন্তা করছে না?”
“হুম করছে। আমার আম্মা। আম্মা ছাড়া আমাকে নিয়ে চিন্তা করার আর কেউই নেই।”
রুস্তম মায়াকে নিয়ে যেতে আসে। বাধা দিয়ে আঞ্জুমান তাকে বলে,
” শোন মন দিয়ে, কেবল মহলে প্রবেশ করার জন্য এমন একটি নিষ্পাপ মেয়ের প্রাণ যেতে পারে না। ওকে দুদিন পর গোপনে মহলের বাইরে নিয়ে দিও। তার আগে তোমার কাউকেই কিছু বলতে হবে না। আমিই সব দিক ম্যানেজ করবো। ”
রুস্তম আশ্চর্য হয়ে যায় শুনে। হতভম্ব চাহনিতে বলে,
” কি বলছেন বেগম সাহেবা? ছোট বাবু কোনভাবে জানতে পারলে আমার গলা কা* টা পড়বে যে?”
” বললাম তো আমি সেই ব্যবস্থা করবো। তোমার চিন্তা করতে হবে না। ”
” বেগম সাহেবা, এমনওতো হতে পারে এই মেয়েটা গুপ্তচর।”
” হয়তো। সেটাও আমি দেখছি। তুমি যাও।”
নাস্তার সময় হলে কুমকুম নাস্তা পরিবেশন করে দিয়ে যায় আঞ্জুমান আরাকে। হ্যাংলা গড়নের মায়াকে তার আগেই দরজার পিছনে লুকিয়ে রাখে আঞ্জুমান।
” কুমকুম আরেক প্লেট নাস্তা সাজিয়ে নিয়ে এসো।”
কুমকুম হুকুম পালন করে যায়। কেন লাগবে, তা না জিজ্ঞেস করেই।
আঞ্জুমানের সাথে দামী মার্বেল পাথরের গোল টেবিলে নাস্তা খেয়ে উঠে মায়া। তার মনে হলো এলাচির কথা। নিজেকে দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলল,
” আচ্ছা, এলাচিকে পাওয়া যায়নি? তিনি কে হয় আপনাদের? ”
আঞ্জুমান আরা আলতো হেসে বলে,
” না পেলে খবর পেতাম। ফারসিয়ান এলাচিটা এমন প্রায়ই নিখোঁজ হয়। আবার পাওয়া যায়। ”
“বুঝলাম না?”
” এলাচি আমাদের বিলাইর নাম। বুঝলে।”
“ওহ।আচ্ছা, আপনারা সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে খান না কেন? বাড়িতে আর কে কে আছে? ”
আঞ্জুমান চোখ বড় করে চায় মায়ার দিকে। দৃষ্টিতে কাঠিন্যতার সমারোহ। খানিক বিরক্তিও। মায়া ভয়ের সাথে ইতস্তত বোধ করে। মনে হলো সে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে কথাটি বলেই।
“তুমিতো দেখি সাহসী ও দুরন্ত। বেশ কৌতুহলীও বটে। এত কৌতুহল ভালো না। রুস্তমের আন্দাজ বিফলে যাবে না মনে হয়। তুমি কি গুপ্তচর? মহলের গুপ্তধনের? অবশ্য এটা তুমি এখন স্বীকার যাবে না।এটাই স্বাভাবিক।”
মায়া বেজার মুখে গোল গোল চোখে চাইলো আঞ্জুমানের মুখপানে। তার চাহনি আধভোলা। নিখাদ! মায়াবী! স্নিগ্ধ! ভোরের সতেজ হাওয়ার মতো।
” ক্ষমা করে দিবেন আমাকে। আর এমন কৌতুহল দেখাব না বেগম সাহেবা।”
মায়ার মান্যতা ও অনুগতভাব দেখে সন্তুষ্ট হলো আঞ্জুমান।
” আচ্ছা ঠিকাছে। চুপচাপ থাকবে বাঁচতে চাইলে ও বেরিয়ে যেতে চাইলে।”
মায়া বোবা মুখে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়।
সেদিন মহলের বাইরে উটকো ঝামেলা ঘটায় মায়ার কাহিনী জানতে পারেনি আঞ্জুমান। তারপর সে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এভাবে পার হয় আরো দুদিন। মায়ার দুঃশ্চিন্তা ঘনীভূত হয়। কারণ তার জীবনের গল্প না বলে এখান থেকে মুক্ত হতে পারবে না সে কিছুতেই।
“ছোট বাবু ধোঁয়া উঠা গরম গরম চিকেন স্যুপটি খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।”
মৃদু জ্বর নিয়ে শয্যায় শায়িত ছোট বাবু উঠে বসল বালিশে হেলান দিয়ে। হাত বাড়িয়ে স্যুপের বাটিটি নিলো। স্যুপের বাটি খালি করেই আবেশে দু-চোখ বুঁজে ফেলল সে। শীতের ভেজা সন্ধ্যায় এর চেয়ে আর উত্তম কোন খাবার হতেই পারে না৷ শরীর মন চাঙ্গা হয়ে গেলো তার। খালি বাটি নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিচ্ছিলো মহলের পুরোনো ভৃত্য পরশ চাকলাদার। ডাক পড়লো পিছন হতে।
” চাচা আজকের স্যুপ অন্যদিনের স্যুপের চেয়ে বেশি সুস্বাদু হয়েছে। হেঁশেলে নতুন চাকরানী এসেছে নাকি?”
” কই নাতো ছোট বাবু। শুনলামনা তো।”
“ওহ। তাহলে যে এই স্যুপটি বানিয়েছে। তাকে দিয়েই কাল সকালে আবারও এই চিকেন স্যুপটি বানিয়ে নিবেন আমার জন্য।”
” ঠিকাছে ছোট বাবু। মনে থাকবে।”
” তার পরেরদিন সকালে একই রকম স্যুপ খেয়ে অফুরন্ত ভালোলাগায় ভরে যায় ছোট বাবুর মন। মনে মনে নতুন চাকরানীকে দেখার অভিলাষ পোষণ করে।”
সেই ব্যস্ত দুপুরে ছোট বাবু মায়ের রুমে যায় কোন এক কারণে। চাপানো দরজা ঠেলেই সে দেখতে পায় পালংকের চিপায় ঘাপটি মেরে বসে আছে একটি অচেনা মেয়ে।
সে কয়েক পা এগিয়ে যায়। মুরগী ধরার মতো করে খপ করে ধরতে গিয়েও ধরলো না মেয়েটিকে। হুংকার দিয়ে উঠে। সবাই এসে জড়ো হয়। পরশকে আদেশ দেয় রুস্তমকে খবর দিতে। রুস্তম এলে ক্রোধান্বিত হয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে বলে,
“তোর ব্যবস্থা পরে করছি। মহলে গুপ্তচর কিভাবে আম্মার শয়ন কক্ষ পর্যন্ত ঢুকে পড়লো? এই মেয়েটাকে নিয়ে আটকে রাখো। একে টুকরো করবো আজ আমি নিজ হাতে।”
রুস্তম ভয়ে তটস্থ। মায়া ভীতসন্ত্রস্ত চোখে চেয়ে রইলো রুস্তমের দিকে। মায়াকে টেনে হিঁচড়ে মহলের বাইরে নিয়ে গেলো রুস্তম। দাসীরা ভূত দেখার মতো চমকে উঠার ভান করলো ছোট বাবুর সামনে।
সন্ধ্যায় ছোট বাবু আবার সেই একই স্যুপ খেতে চাইলো। জানতে পারলো স্যুপ বানানো মেয়েটিকেই সে দুপুরে বন্দী করেছে। সে বিস্মিত হলো শুনে।
স্যুপ তৈরি করে কোন এক চাকরানী। তবে চাকরানী কেন আম্মার রুমে লুকিয়ে রবে?পরক্ষণেই লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো মহলের অদূরে বাগানের ভিতরে অবস্থিত নির্জন সেই কক্ষে।
শব্দহীনভাবে বাইরে থেকে তালা খুলে ভিতরে ঢুকলো। দেখলো মায়া ঘুমিয়ে আছে। তার বুকে ওড়না নেই। ওড়না বিছিয়ে তার উপরেই সেই ঘুমিয়ে আছে। সে মৃদু পায়ে মায়ার খুউব নিকটে গিয়ে একটি মোড়ায় বসলো। ঘুমন্ত মায়ার মুখচ্ছবিতে সে অবিকল চেয়ে আছে। ভাবছে,
কে এই গুপ্তচর? কি তার পরিচয়? এত লোভনীয় চমৎকার রান্নার হাত তার। কিন্তু…
চলবে…১