#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৭)
পাখির কিচিরমিচির শব্দে কান ঝাঁঝিয়ে আসছে প্রিয়তার। রোদের এক ফালি অংশ জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। একে অপরের শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ওরা। কিঞ্চিত দুরত্বও নেই ওদের মাঝে। সুখ নিদ্রায় তলিয়ে আছে প্রহর। প্রিয়তার ঘুম ভেঙেছে। প্রিয়তার উন্মুক্ত দেহের ভাঁজে ভাঁজে প্রহরের দেহের স্পর্শ এখনো অনুভব করছে প্রিয়তা। শ্বাস নেওয়ার কারণে বুক উঠানামা করছে প্রহরের। রোমশপূর্ণ বলিষ্ঠ বুকে জায়গা করে নিয়েছে প্রিয়তা। ঘুমু ঘুমু চোখে প্রহরের পানে নরম ভাবে তাকায় সে। প্রহরের গালে বিচরণ করে প্রিয়তার নরম, মোলায়েম হাত। অতি সুদর্শন লাগে প্রহরকে ঘুমন্ত অবস্থায়। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। স্নিগ্ধ, মুগ্ধকর মুখে অজানা সুখ খুঁজে পায়।
অতি সাবধানে প্রিয়তার স্পর্শে ঘুম ভাঙে প্রহরের। মুচকি হেসে প্রিয়তার স্পর্শকাতর স্থানে হাত বুলায়। চুমু খায় নাকের ডগায়। জড়িয়ে নেয় আরো নিবিড়ভাবে। নেশালো কণ্ঠে বলে,
” ঘুমান।
প্রিয়তা আঁকড়ে ধরে প্রহরের পিঠ। লজ্জায় বশীভূত হয়। বলে ,
” এবার উঠতে হবে। ছাড়ুন।
হাসে প্রহর। ছেড়ে দেয় প্রিয়তাকে। প্রিয়তার অবস্থা নাজুক। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ব্যথা। শিরশির করছে গা। প্রহর মানুষটা গম্ভীর, সহজ আর প্রাণবন্ত হলেও স্ত্রীর নিকট এলে মানুষটা কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। অস্থির, উত্তেজিত দেখায় প্রহরকে। প্রিয়তা গতকাল এক অন্য প্রহরকে দেখেছে। এই প্রহরকে আগে দেখেনি সে। যার মনে-প্রাণে, মস্তিষ্কে প্রিয়তা ব্যতিত অন্য কোনো চিন্তা ছিল না। প্রহরের ভালোবাসার প্রগাঢ়তা প্রিয়তা সহ্য করে নিয়েছে। উপভোগ করেছে ভালোবাসার স্পর্শ গুলো। কালসিটে দাগ পড়েছে প্রিয়তার ঘাড়ে। হাত রাখতেই ব্যথায় টনটন করে উঠল সেথায়। চোখে খিঁচে বন্ধ করে নেয় প্রিয়তা। “উফফ” জাতীয় শব্দ করে। চমকায় প্রহর। চিন্তিত ভঙিতে ভালো করে চোখ মেলে। বলে,
” কি হয়েছে প্রিয়?
প্রিয়তার চোখে অশ্রু। দুঃখের অশ্রু শুকিয়ে গেছে। সুখের অশ্রু গড়াচ্ছে চোখ বেয়ে। প্রহরের চিন্তিত স্বর মোহনীয় লাগে। মুচকি হেসে প্রিয়তা বলে,
” ব্যথা।
প্রহর উঠে বসে। চিন্তিত দেখায় তাকে। প্রেয়সীর আর্তনাদে বক্ষে উন্মাদনা টের পায় প্রহর। জিজ্ঞেস করে,
” শরীর ব্যথা করছে?
” ঘাড়ে বেশি।
প্রহর এগিয়ে আসে প্রিয়তার নিকটে। ঘাড়ে হাত বুলায়। কামড়ের দাগ পড়ে গিয়েছে। কালচে রঙ দেখা গিয়েছে। প্রহর অধরজোড়া চেপে ধরে ঘাড়ে। কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। প্রহর বারংবার অধর চেপে ব্যথিত কণ্ঠে বলে,
” সরি প্রিয়, আমি এক্ষুণি মেডিসিন নিয়ে আসছি।
প্রিয়তা থামায় প্রহরকে। বলে,
” লাগবে না।
প্রহর শোনে না। দ্রুত বিছানা ছাড়ে সে। গোসল ছেড়ে বের হয়। গায়ে নীল রঙের শার্ট জড়াতে জড়াতে প্রিয়তার কাছে আসে। অতি চমৎকার কণ্ঠে প্রিয়তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
” আপনার মলিনতার সুর,
আমার কাঁপিয়ে তোলে বুক।
_______
ব্যথাতুর স্থানে মলমের প্রলেপ পরতেই হৃদস্পন্দন থামে প্রিয়তার। শাড়ির অর্ধেকাংশ মেঝেতে লুটিয়ে আছে। পিঠের নিচ অংশের শাড়ি সরে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে আছে কোমর। প্রিয়তার ভ্রূক্ষেপ নেই। শাওয়ার নিয়ে আরহামের সাথে সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরে শুতেই চোখটা কেমন লেগে গিয়েছিল। গতরাতের অন্তরঙ্গ মুহুর্তের দৃশ্য চোখের পাতায় আটকে ছিল। প্রহরের শ্বাসরুদ্ধকর উপস্থিতি, হাতের বিচরণ, অধরের ঝড় সবই যেন এক স্বপ্ন। ঘুমের মাঝেই ঘাড়ে শীতল পদার্থের ছোঁয়া পেয়ে অবাক হয় না প্রিয়তা। গা দুলিয়ে হাসে। বলে,
” ব্যথা দেওয়ার সময় মনে ছিল না?
” আপনিও তো আমাকে ব্যথা দিয়েছন প্রিয়তা। পিঠে আঁচড়ে, কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন। দীর্ঘ দিন দূরে থেকে আমাকে যন্ত্রণা বাড়িয়েছেন। অভিযোগ এবার আমি করি?
প্রিয়তা কথা বলে না। প্রহর সময় নিয়ে প্রিয়তার ঘাড়ে মাসাজ করে। ঔষধের প্যাকেট থেকে ঔষধ বের করে প্রিয়তার হাতে গুঁজে দিয়ে পানির গ্লাসটাও এগিয়ে দেয় প্রিয়তার সম্মুখে। প্রিয়তা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
” এত ঔষধ কিসের?
” ভিটামিন, পেইন কিলার, স্পট রিমুভাল মেডিসিন।
প্রহরের কল আসে। কলটা জরুরী হওয়ায় সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। কানে ফোন চেপে চোখের ইশারায় প্রিয়তাকে খেতে বলে ঔষধগুলো। প্রিয়তা গা ব্যথার ঔষধ চিনে। ঔষধ খেতে বরাবরই অসহ্য লাগে তার। সে তো দুর্বল নয় যে ভিটামিন লাগবে। দাগে মলম দেওয়া হয়েছে, ওই ঔষধেরও প্রয়োজন পরবে না। কেবল ব্যথার ঔষধ খেয়ে বাকিগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দিল প্রিয়তা। এত ঔষধ মানুষ কিভাবে খায়?
_____
ইহান ল্যাপটপে মেইল চেইক করছে। তানিয়া বিছানার এক প্রান্তে বসে খাবার খাচ্ছে। আজ রান্না তানিয়া নিজে করেছে। তবে তরকারিতে ঝালের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে। তানিয়ার নিজেরই খেতে গিয়ে জিভ, ঠোঁট পুড়ছে। বাকিরা কিভাবে খাবে ভেবে মন খারাপ হলো তানিয়ার। ভাতের লোকমা মুখে তুলতেই ঝালে ঠোঁটে জ্বলন শুরু হলো। ইহানের সামনে খেতে বসেছে। খাবার কোনোভাবেই ফেলা যাবে না। খাবার অপচয় করা পছন্দ করে না ইহান। অপরদিকে তানিয়া খেতেও পারছে না খাবারটুকু। ঝালে চোখ-মুখ লাল হয়ে আসছে তার। বুক পুড়ছে। ইহান আড়চোখে তাকায় তানিয়ার পানে। তানিয়া বুঝতে পারে। দাঁত কেলিয়ে বোকা হাসে সে। ললাটে ভাঁজ পড়ে ইহানের। বলে,
” হাসো কেন?
থতমত খায় তানিয়া। বলে,
” কই হাসছি?
“এতক্ষণ লাগে খেতে? কখন বসেছো হিসেব আছে? জলদি খেয়ে আমার জন্য খাবার আনো।
তানিয়ার ভয় হয়। এই তরকারি দিয়ে কিভাবে খেতে দিবে ইহানকে। বকে ত্যানাত্যানা করে ফেলবে তাকে। মুখ নত করে তানিয়া বলে,
” খেতে ইচ্ছে করছে না।
” আমাকে খাইয়ে দাও তবে।
হতবাক চোখে তাকায় তানিয়া। বিস্ময় আকাশ ছোঁয়। রক্তিম ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
” আমার এঁটো খাবার খাবেন?
ইহান তানিয়ার দিকে তাকিয়ে দ্রুত নজর সরায়। বলে,
” এক কথা বারবার বলাও কেন?
অগত্যা বাধ্য হয়ে তানিয়া বিছানার মাঝ বরাবর আসে। চশমা ঠিক করে ভাতের লোকমা তুলে দেয় ইহানের মুখে। ভয়ে থিতিয়ে যায় তানিয়ার চোখ। ইহান ঝাল খায় না, খেতে পারে না। ঠোঁটের জ্বলনে দিক্বিদিক হারায় তানিয়া। ভাবে ইহান ধমকাবে, খেতে গিয়ে ঝালে কাহিল হয়ে পড়বে। কিন্তু না! ইহান খাবার চিবিয়ে কোনো অভিব্যক্তি দেখায় না। অবাক হয় তানিয়া। ইহানের অভিব্যক্তি জানতে চায়। নিজ মুখে স্বীকার করে,
” রান্না আমি করেছিলাম। খুব ঝাল হয়েছে। আমিই তো খেতে পারছি না। আপনি..
ইহান ছোট হা করে। তানিয়া বুঝতে পারে আবার ও খাবারটুকু খেতে চাইছে ইহান। তানিয়া সময় ব্যয় করে না পুনরায় তুলে দেয় ভাতের লোকমা। ইহান চিবোয়। কোনোরুপ বাক্য বিনিময় করে না। পরপর কয়েকবার খাবার খেয়ে ঢকঢক করে পানি খায় ইহান। তানিয়া প্লেট নিয়ে বেরিয়ে যায়। ইহানের থানায় যাওয়ার সময় আসে। ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে তৈরী হয় ইহান। রিভলবার পকেটে গুঁজে তানিয়াকে ডাক দেয়। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে তানিয়া। ইহানকে পর্যবেক্ষণ করে। ইহানের ঠোঁট ও লালচে হয়ে গেছে। চোখের শিরা গুলো রক্তিম হয়ে আছে। তানিয়ার মায়া হয়। জিজ্ঞেস করে,
” ডাকছেন?
ইহান পিছু ফিরে। অফিস সরঞ্জাম ফাইলে ভরে তানিয়ার নিকটে এসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
” চুমু দাও, ফাস্ট।
তানিয়া ভড়কায়। বিচলিত নয়নে তাকায় ইহানের পানে। কাঁপা কণ্ঠে বলে,
” আমি? আপনাকে?
ইহানের গাম্ভীর্যপূর্ণ চাহনি তানিয়ার দিকে মেলে। বলে,
” তো অন্য কাউকে দিতে চাও নাকি? চালু করো। সময় নেই।
তানিয়া বাইরে নজর ফেলে। ইলমা বেগম দেখে ফেললে? চশমা ঠিক করে ইহানের নিকটে আসে তানিয়া। চোখ বুজে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে ইহানের গালে চুমু দিতে উদ্যত হলে ইহান বলে ওঠে,
” ঠোঁটে দাও।
অবাক চোখে তাকায় তানিয়া। সুযোগটা ফেলতে চায় না। তানিয়া দু হাত উঠিয়ে ইহানের গালে হাত রাখে। পা উঁচিয়ে ইহানের পায়ে রাখে। ভেজা অধর আলতো করে স্পর্শ করে ইহানের অধরে। ছোট্ট একটি চুমু দিয়ে সরে আসার পূর্বে ইহানের শক্তপোক্ত হাত তানিয়ার পিঠে চাপ প্রয়োগ করে। তানিয়া ঝুঁকে আসে ইহানের দিকে। ইহান অপর হাত রাখে তানিয়ার কানের নিচে। অধরজোড়া পুনরায় চেপে ধরে তানিয়ার অধরে। সময় গড়ায়। চঞ্চল হয় তানিয়া। সরে আসার চেষ্টা করেও পারে না। হাল ছাড়ে। জড়িয়ে নেয় ইহানকে। লজ্জায় চোখ বুজে নেয় অজান্তে।
______
তানিয়া আর ইহান বসে আছে অফিসরুমে। তানিয়ার নত মুখের দিকে তাকিয়ে নিরবে, নিঃশব্দে হাসে ইহান। মেয়েটা কেমন লজ্জায় বুদ হয়ে আছে। কোনো কথাই বলছে না আজ। ইহান তানিয়ার লজ্জাকে বাড়িয়ে দিতে বলল;
” এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? চুমুই তো।
তানিয়া তড়িৎ বেগে মাথা তুলে। আশপাশে মানুষ আছে কিনা দেখে নেয়। ঠোঁটে আঙুল চেপে বলে,
” চুপ। কেউ শুনে ফেলবে।
” শুনুক।
” লজ্জা, সংকোচ কি সব চলে গেছে?
” চলে গেলেই বোধহয় ভালো হতো।
হাসে তানিয়া। কাজে মনোনিবেশ করে। খানিকক্ষণ বাদে প্রহর আসে থানায়। প্রহরকে দেখে উঠে দাঁড়ায় ইহান আর তানিয়া। প্রহরের পাশে প্রিয়তা দেখে খুশি হয় ওরা। মিষ্টি হাসে। সলজ্জ চোখে তানিয়া প্রশ্ন করে,
” কেমন আছেন স্যার? প্রিয়তা, কেমন আছো?
প্রহর হাসে। তানিয়াকে বসতে বলে। চেয়ার ঠিক করে দেয় তানিয়া। প্রিয়তাকে বসতে দেয়। কফি আনতে বলে ওদের জন্য। প্রহর বসতে বসতে তীক্ষ্ম চোখে বলে,
” আমরা ভালো আছি। তোমাদের কি খবর?
ইহান বলে,
” ভালো আছি। মিথিলা দেওয়ানকে আনতে পাঠিয়েছি। বোস। চলে আসবে।
অপেক্ষা করে প্রহর। টুকটাক আলোচনা হয় তাদের মাঝে। প্রিয়তা গল্প শুরু করে তানিয়ার সাথে। হাসি মজা করে। প্রিয়তাকে আনা হয়েছে সত্য জানার জন্য। প্রহর চায় প্রিয়তা সব জানুক। সময় গড়ায়। ফোর্স আসে দীপা খন্দকারকে নিয়ে। লেডি কনস্টেবল টেনে আনে দীপাকে। প্রহর আর প্রিয়তাকে দেখে ক্ষেপে যায় দীপা। খেঁকিয়ে ওঠে। বলে,
” আমাকে এখানে এনেছো কেন? তোমাদের সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।
হাসে প্রহর। ভ্রূ চুলকায়। বলে,
” সাহস দেখানো তো সবে শুরু ম্যাম। চুপচাপ এখানে বসুন আর প্রশ্নের উত্তর দিন। নইলে পুলিশ কি করতে পারে তা আপনি হারে হারে টের পাবেন।
প্রিয়তা অবাক হয় দীপাকে এখানে দেখে। প্রশ্ন করতে উদ্যত হতেই তানিয়া থামায়। ইশারায় সবটা শুনতে বলে। দীপা চুপ করে বসে থাকে। চোখ পাকায়। ক্ষোভে ফুঁসে। প্রহর নির্বিকার চিত্তে তাকায়। কথাগুলো নিজ মনে সাজায় এলোমেলো বাক্যগুলো। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” মিসেস দীপা খন্দকার, উপসস সরি। মিথিলা দেওয়ান। আরিফ হোসাইন আপনার কত নম্বর স্বামী বলুন তো?
দীপা হতবাক চোখে তাকায়। থতমত খায়। প্রিয়তার মনেও প্রশ্ন জাগে। প্রহর হাসে। বলে,
” থাক, আপনাকে বলতে হবে না। আমিই বলছি। আরিফ হোসাইন আপনার তিন নম্বর স্বামী। আপনি প্রথম বিয়ে করেছিলেন দু হাজার বারোতে। আপনার প্রথম স্বামী ছিলেন জমির দালাল। জমিজমা নিয়ে ব্যবসা করতেন। টাকা আয় করতেন ভালোই। কিন্তু টাকা জমাতে পারতেন না। সব টাকা বোনদের জন্য ব্যয় করতেন। আপনাকে সেভাবে টাকাপয়সা দিতে পারতেন না বলে আপনি রমিজ আকবরের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাননি। দীর্ঘ পাঁচ বছর সংসার করার পর আপনার মনে হয়েছে রমিজের সংসারে থেকে আপনার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। টাকা-পয়সা কিছুই জমাতে পারছেন না। সব অর্থ ননদদের সংসারে ব্যয় হচ্ছে। খোলাখুলি আলাপ করার পর বুঝতে পারলেন রমিজ আপনাকে নিয়ে চিন্তা করেন না, আপনার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা নেই লোকটার। তাই আপনি মিউচুয়াল ডিভোর্স চাইলেন। কাবিনের টাকা দিতে নাকোচ করলেন রমিজ। তাই আপনি নারী নির্যাতনের মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কাবিনের পুরো টাকা আদায় করলেন। এরপর সেই টাকা নিয়ে আনন্দে কাটালেন অনেকগুলো দিন। কি তাইতো?
বিস্ফোরিত চোখে তাকায় দীপা। প্রহর আবার বলে,
” দ্বিতীয় বিয়ে করলেন সতেরো সালের শেষের দিকে। স্বামী সামিন রহমানের ব্যবসা ছিল। বিয়ে করে দু বছর সংসার করার পর তার সাথেও একই ঘটনা ঘটালেন। শুধু কি তাই? লোকটার সম্পত্তির অর্ধেকাংশ লিখিয়ে নিলেন নিজের নামে। আইন নারীদের ক্ষেত্রে একটু সেনসিটিভ। নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে আইন প্রচণ্ড সহানুভূতিশীল। পুরুষের কথার চেয়ে নারীর কথাকে বেশি প্রায়োরিটি দেয় আইন। এই সুযোগটাই আপনি নিলেন। সম্পত্তি হাতিয়ে চাঁদপুর ছেড়ে ইন্ডিয়ায় গেলেন। ওখানে থাকাকালীন অনেক পুরুষের সাথেই সম্পর্ক ছিল আপনার। আরিফ হোসাইন মানে প্রিয়তার বাবাকে অনলাইনে পেলেন আপনি। সেসময় প্রিয়তার বাবা একটু ডিপ্রেসড ছিলেন। স্ত্রী পরকিয়ায় জড়িয়ে গিয়েছে বলে প্রিয়তার বাবা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আপনি তাই বন্ধুর ন্যায় আচরণ করলেন আরিফ আঙ্কেলের সাথে। প্রেমের সম্পর্ক গড়লেন। আরিফ আঙ্কেলের সাথে যখন সম্পর্ক ছিল তখনও আপনি আরো কয়েকজনের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন। সব শেষে বিয়ে বসলেন আরিফ আঙ্কেলের সাথেই।
এতটকু বলে থামল প্রহর। প্রিয়তার চোখে পানি। তার বাবাকে ঠকিয়েছে সবাই। ঠকিয়ে নিজেদের মতো চালিয়ে গেছে। দীপার বায়োডাটা শুনে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তার। দীপা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,
” ভুল বলছো তোমরা। পারিবারিক শত্রুতা এখানে টেনে আনছো।
ইহান বলে,
” সব প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। আপনার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট এসেছিল অনেক আগে। আপনাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি কারণ আপনি দেশের বাইরে ছিলেন। প্রমাণ হাতে নিয়েই আপনাকে ধরতে গিয়েছি।
প্রহর এবার আসল কথা টানে। দৃঢ় চোখে তাকিয়ে বলে,
” আঙ্কেলকে আপনি খু”ন করেছেন। ইনজেকশন পুশ করে। এর শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে।
কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। প্রহরের কাছে এসে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,
” আব্বু তো স্ট্রোক করে মারা গিয়েছে। আমরা তো আব্বুকে হসপিটালে দেখলাম। আপনি কি বলছেন?
প্রহর প্রিয়তার মাথায় হাত রাখে। প্রিয়তার উত্তেজিত কণ্ঠ প্রহরের নিকট অত্যন্ত ব্যথিত ঠেকে। প্রিয়তার জীবন নিয়ে ভাবতে গেলেই মায়া হয় মেয়েটার প্রতি। খারাপ লাগে খুব। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে প্রহর বলে ওঠে,
” আপনার আব্বু খুন হয়েছে প্রিয়তা। উনি স্ট্রোক করেছিলেন ঠিকই, স্ট্রোক করার পর বেঁচেও গিয়েছিলেন। আপনার সৎ মা উনাকে বাঁচতে দেননি। আমি সেদিন আপনার আব্বুকে দেখতে চেয়েছিলাম মনে আছে? দীপা আন্টি আমাকে মৃত দেহ দেখতে দেননি। তবুও আমি দেখে ফেলেছিলাম। আপনার আব্বুর ঘাড়ে তিল আছে। সেই ঘাড়ের তিলের মাঝখানটা নীলাভ রঙ ধারণ করেছিল। তিল নীলাভ রঙের হতেই পারে তবুও আমার একটা খটকা লেগৈছিল। ইহানকে বলেছিলাম লাশ দাফন না করতে। আপনার আব্বুকে দাফন করা হয়নি সেদিন। ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল উনাকে। আপনি যদি জানতে পারতেন আপনার আব্বুকে দুদিন বরফে রেখে টেস্ট করা হয়েছে, কবর দেওয়া হয়নি, তাহলে আপনি খুব কষ্ট পেতেন। এজন্য আপনাকে বলিনি। আপনার আব্বু আপনাকে শেষ সময়ে এসে খুব মিস করেছেন প্রিয়তা। হসপিটালের বেডে বারবার আপনার নাম জপেছেন। সেজন্য দীপা আন্টি না পেরে বাধ্য হয়ে আমাদের ফোন করে যেতে বলেছিলেন। মারা যাওয়ার পর আমরা যাতে উনাকে সন্দেহ না করি সেজন্য ফোন করে মৃত সংবাদ টাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু লাভ নেই। উনি ধরা পড়ে গিয়েছেন। বিষের প্রতিক্রিয়ায় মারা গেছেন। আঙ্কেল প্রমাণ আছে আমাদের হাতে।
প্রিয়তার চোখে পানি। বরফের ন্যায় জমে গিয়েছে সে। নিশ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। সত্য জানতে পেরে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মাথা ভনভন করছে। হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তার। শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে নিজেকে। নিজেকে সংযত করতে পারে না প্রিয়তা। কেঁদে ফেলে শব্দ করে। উন্মাদের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দীপার গায়ে। দীপার হাতে চাপ প্রয়োগ করে শক্ত কণ্ঠে বলে,
” আপনি, খারাপ, মনুষ্যত্বহীন, নিচ। আপনি আমার আব্বুকে খুন করেছেন। আমাকে এতিম করেছেন। তোকে আমি মেরেই ফেলবো। মেরে জেলে যাবো। লোভী কোথাকার।
প্রিয়তা পরপর ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় দেয় দীপার গালে। দাগ বসে দীপার ফর্সা গালে। দীপাও খেঁকিয়ে ওঠে। প্রিয়তার গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হতেই লেডি কনস্টেবল আটকায়। প্রহর আটকায় প্রিয়তাকে। নিজের কাছে টানে। বলে,
” আইন নিজের হাতে তুলতে হবে না আপনাকে। উনার ফাঁ”সিই হবে। একটি খুন, দুজনকে ব্ল্যাকমেইল করে সম্পত্তি আদায়, আমাদের মেরে ফেলার চেষ্টা করা। সব মিলিয়ে উনি আজন্ম থেকে যাবেন জেলে। নয়তো ফাঁ”সি।
ইহান হকচকিয়ে বলে ওঠে,
” তোদের মে”রে ফেলার চেষ্টা করেছে ও?
প্রহর থেমে বলে,
” হ্যাঁ। আরহামের অ্যাক্সি”ডেন্ট উনিই করিয়েছিলেন। আসলে আঙ্কেল অনেক আগে থেকেই চাইছিলেন আরহামকে কিছু সম্পত্তি লিখে দিতে। দীপা আন্টি এটা মানতে পারেননি। আরহামকে সম্পত্তি গ্রহণে অক্ষম বানাতে চেয়েছিলেন। উনি আমাদের খোঁজ খবর রাখতেন। উনিও জাফরের মতো ভেবেছিলেন প্রিয়তার সাথে আমার সম্পর্ক আছে। তাই আমাদের সম্পর্ক ভা”ঙা আর আরহামের ক্ষতি দুটোই একসাথে করতে চেয়েছিলেন উনি। লোক দিয়ে প্রিয়তাকে কল করে বলেছিলেন আমার শত্রুরাই আরহামের অ্যাক্সি”ডেন্টের কারণ। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে এসেছে। আগের ঘটনাগুলোর সত্যতা জানতে পেরেছি এখন।
প্রিয়তার নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে। আব্বুর জন্য পড়ান পুড়ে প্রিয়তার। জ্বলে ওঠে বক্ষস্থল। ক্ষত-বিক্ষত হয় হৃদয়। সে তো আরিফের ক্ষতি চায়নি। চায়নি এভাবে উনি মারা যান। তবে কেন প্রিয়তার সাথেই এমন হয়? কেন সুখ এত দ্রুত ফুরিয়ে যায়?
চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
[ আরো টুইস্ট রাখতে পারতাম। এক পর্বে কি লিখবো বুঝে উঠতে পারিনি। অগোছালো লেগেছে সব। আগামী পর্বেই শেষ হবে গল্পটি। রি চেইক দেওয়া হয়নি। ভুল ত্রুটি সংশোধন যোগ্য]