প্রিয়তার প্রহর (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ৩

0
157

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)

[ অন্যত্র কপি কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। চাইলে শেয়ার করতে পারেন ]

৩.
ভোর চারটা বেজে পনেরো মিনিট। অন্ধকারে নিমজ্জিত লোকালয়। ভয়ঙ্কর, নিস্তব্ধ পরিবেশ। অতিতের রেশ কাটেনা বোধহয় কখনো। সর্বদা সেসব তাড়া করে বেড়ায়। ক্ষণে ক্ষণে যন্ত্রণা দিয়ে নিঃশেষ করে। প্রহরের কথা মস্তিষ্কে প্রহার হলো প্রিয়তার। হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ভূকম্পনের ন্যায় তীব্র কাঁপুনি অনুভব করল। প্রহরকে নিয়ে ভাবতে বসলেই এই দশা হয়।
গরমে হাঁসফাঁস করছে প্রিয়তা। হাত পাখা দিয়ে ধীরে ধীরে হাওয়া দিচ্ছে প্রাণপ্রিয় ভাইকে। হাত ব্যথা করছে কিছুটা। পাখা কয়েক মিনিট ঘুরিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হাত থামিয়ে দিচ্ছে প্রিয়তা। পুনরায় পাখা ঘুরিয়ে যাচ্ছে। কারেন্ট আসার নামগন্ধ নেই। রাত বারো টার দিকে সেই যে গেল এখনো আসেনি। প্রিয়তা আরহামের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা তাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে মুখ নাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তা হাসল একটু। সময় গড়াল। আরহাম মাথায় হাত রেখে চোখমুখ কুঁচকে পিটপিট করে চাইল। জিজ্ঞেস করল,

” নড়ছো কেন?

” মাথায় ব্যথা আপু। যন্ত্রণা হচ্ছে।

” বড়দের কথা না শুনলে কি হয় দেখলে? সেদিন বারবার বলেছিলাম দোকানে যেও না। অ্যাক্সিডেন্ট করে মাথা ফাটালে। তোমার কিছু হলে আমার কি হতো?

” এখন তো সব কথা শুনি।

” উঠছো কেন?

” কারেন্ট আসেনি?

” না। বাতাস তো দিচ্ছি।

” লাগবে না। তুমিও ঘুমাও। তোমার ঘুম পায় না?

” তুমি ঘুমাও।

আরহামের সজল চাহনি। প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে রাখে মায়ায়। অন্ধকারেও উজ্জল দেখায় আরহামের গোলাকার চোখ। শব্দের দারিদ্রতায় মিইয়ে যায় প্রিয়তা। সদা কাঠকাঠ স্পষ্ট বাচনভঙ্গি, অকপটে জবাব হারিয়ে যায়। ফিসফিস করে আরহামের প্রশ্নের জবাব দেয়।

” একটু পরই রান্না করতে উঠতে হবে। এখন ঘুমাবো না। আটটায় তোমার ক্লাস। ঘুমাও। ক্লাসে গিয়ে নইলে ঝিমিয়ে থাকবে।

” রান্না করো না। আমরা বাইরে খাবো।

ঘুমুঘুমু কণ্ঠে কথাটা বললো আরহাম। হাসল প্রিয়তা। মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে ধরল। আরহামের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিল। বোনের এহেন আদরে নবজাতক শিশুদের ন্যায় উৎফুল্ল হলো আরহাম। আরহামের এই প্রগাঢ় উচ্ছলতাকে বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হলো প্রিয়তার। চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। আরহামের ঘন ঘন শ্বাস ফেলার শব্দ ভেসে আসল কানে। নির্জীব আঁখির আভরণে বাঁকা হাসল প্রিয়তা। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,

” প্রহরের সাথে গতকাল আমার দেখা হয়েছে আরহাম।

এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ড করে কয়েক সেকেন্ড পার হতেই আরহাম সজাগ হলো। শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে তড়িঘড়ি করে বসে পরল। এই অন্ধকারেও প্রিয়তা স্পষ্ট আরহামের অভিব্যক্তি বুঝতে পারল। আরহামের উত্তেজনা উপলব্ধি করতে পারল। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েসয়ে আরহাম জিজ্ঞেস করলো,

” ভাইয়া? এখানে? কেমন আছে ভাইয়া? আমার সাথে দেখা হলো না কেন? আমার কথা প্রহর ভাইয়া জিজ্ঞেস করেনি তোমাকে?

” করেছে।

‘ কি বলেছে?

আরহামের কণ্ঠ গাঢ় হচ্ছে। অর্থাৎ ছেলেটার উত্তেজনা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না আরহাম। পরিচিত, প্রিয় মানুষের খবর পেয়ে আনন্দে গদগদ হয়ে আছে। প্রিয়তা সে ভাষা বুঝল। বললো,

” তুমি কেমন আছো জিজ্ঞেস করলো। বললো তোমার সাথে দেখা করতে চায়।

” আমিও তো চাই। কবে দেখা করবে?

” সেসব কিছু বলেনি।

” তুমি ভাইয়ার সাথে কথা বললে?

” বললাম তো।

” তাহলে এতদিন কেন আমায় কষ্ট দিলে? কেন যোগাযোগ করতে দিলে না ভাইয়ার সাথে?

প্রিয়তা আর কথা বললো না। চুপ করে শুয়ে রইল। প্রহরের কথাগুলো ভাবতে লাগল। ভাবতে লাগল চার মাস আগের কথা। আরহাম তখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। ডাক্তাররা কোনো প্রকার আশা দিতে পারছিল না। ভেঙে পরেছিল প্রিয়তা। নিরাশ হয়েছিল। হাউমাউ করে কেঁদেছিল। রাগে দিক্বিদিক হারিয়েছিল প্রিয়তা। সব কিছুর জন্য প্রহরকে দায়ী মনে হয়েছিল। অমন একটা পরিস্থিতিতে প্রিয়তা বেরিয়ে এসেছিল হাসপাতাল থেকে। উদ্দেশ্য ছিল প্রহরকে শেষ করে দেওয়া, আরহামের ক্ষতি যার জন্য হয়েছিল তাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া। প্রহর যেই স্থানে ছিল সেখানেই ছুটে গিয়েছিল প্রিয়তা। কৌশলে প্রহরের কোমর থেকে রিভলবার বের করে এনেছিল। হাতের মুঠোয় রিভলবার চেপে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। কিন্তু গুলিটা ছোঁড়ার আগ মুহূর্তে জ্ঞান ফিরে প্রিয়তার। নিজের ভুল বুঝতে পারে। কত বড় পাপ করতে বসেছিল বুঝতে পেরে অনুতপ্ততা গ্রাস করে তাকে। চঞ্চলা হৃদয় মুহূর্তেই ছেয়ে যায় মলিনতায়। আশপাশে নজর বুলায় প্রিয়তা। ঠিক তখনই প্রহরের পেছনে একজনকে দেখতে পায় সে। ললাটে ভাঁজ পরে। লোকটাকে চিনে না প্রিয়তা। ইনফ্যাক্ট লোকটা কে ছিল তা এখনো জানে না সে। দেয়ালের আড়াল থেকে প্রহরকে দেখছিল লোকটা। লোকটার বয়স কম। সুদর্শন, বলিষ্ঠ গায়ের গড়ন। তীক্ষ্ম, ধারালো চোখ। কপোলে ক্ষুদ্র দাগ। লোকটার হাতে বোমা জাতীয় বস্তু দেখতে পেয়েছিল প্রিয়তা। ঘাবড়ে গিয়েছিল প্রচন্ড। প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাড়া করেছিল। প্রহর তখন চোখ বুজে রেখেছে। প্রহর বুঝে নিয়েছিল আজ প্রিয়তার হাতেই তার মৃত্যু হবে। তাই তো চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করছিল। লোকটা যেই না দেয়ালের আড়াল থেকে একটু বেরিয়ে এসে বোমা ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই প্রিয়তার হাতে থাকা রিভলবার নিশানা পরিবর্তন করে প্রহরের পরিবর্তে অচেনা লোকটার পায়ে গুলি করে। সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার থেকে শক্ত গুলি ছুঁড়ে আঘাত করে লোকটাকে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে লোকটা। রিভলবার থেকে উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হয়। খানিক সময় নিয়ে চোখ খুলে প্রহর। নিজের কিছু হয়নি দেখে আশপাশে তাকিয়ে লোকটাকে ধরে ফেলে। প্রিয়তা ততক্ষণে রিভলবার রেখেই পালিয়েছে।

________

রান্না শেষ হয়েছে মাত্র। গরমের কারণে রান্নাঘরে পা ফেলতে ইচ্ছে হয় না প্রিয়তার। অলসতা লাগে খুব। মন চায় বাহির থেকে খাবার এনে খেতে। কিন্তু টাকার অংকটা পরিমাপ করলে সে ইচ্ছে গায়েব হয়ে যায়। প্রিয়তার বয়স বিশ। এই বিশ বছরের জীবনে সে কি কি পেয়েছে আর কি কি পায়নি তার ছক কষতে গেলে ভালোবাসার অভাবটা বোধহয় সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হবে। এই বয়সটা ঘুড়ে বেড়ানোর, চঞ্চলা কিশোরী হৃদয়ে উড়ে বেড়ানোর, বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানোর। কিন্তু সেসব মোটেও হচ্ছে না। দিনের পর দিন একই নিয়মে চলছে সে। জীবনটা একদম একঘেয়ে লাগছে। তিক্ততা, বিষাদে তেতো হয়ে গিয়েছে অন্তঃস্থল। দায়িত্বের ভাড়ে নিজেকে বড় হচ্ছে না মনে হচ্ছে।

প্রিয়তা ঘন ঘন শ্বাস ফেলল। আরহামকে উঠিয়ে খাইয়ে দিল। শার্ট আর প্যান্ট পড়িয়ে চুল আচরে দিল অতি যত্নে। আরহামের মুখে হাসি হাসি ভাব। প্রহরের খবর পেয়ে ছেলেটা অনেক কিছু পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে। প্রিয়তা হাসল। ছোট্ট ব্যাগটাতে বই খাতা গুছিয়ে রেখে আরহামের কাঁধে চাপিয়ে দিল। দরজায় খটখট শব্দ পরায় প্রিয়তা টিফিনটা দ্রুত আরহামের ব্যাগে রেখে দরজা খুলল। দরজার অপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে দেখে গম্ভীর হলো প্রিয়তা। বললো,

” এত সকালে আজ?

মহিলার নাম মনোয়ারা। স্বামী গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। এক ছেলে আর এক মেয়ে উনার। বড় ছেলেটা সৌদিতে থাকে। ছোট মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। ছেলের বউ আর নাতনি নিয়ে মহিলার সংসার। প্রিয়তা যেই বাড়িতে থাকে সে বাড়ির প্রত্যেকটা দেয়াল সিমেন্ট আর ইটের হলেও উপরের ছাদটা টিনের। সম্প্রতি ভবনের বাড়িটির খানিক অংশ দু ভবন বিশিষ্ট বাড়িতে তৈরী করা হয়েছে। উপরের ঘরগুলোতে বাড়িওয়ালি তার ছেলের বউকে নিয়ে থাকে। নিচের ঘরগুলোতে ভাড়াটিয়াদের বাস। মাস শুরু হতে না হতেই মহিলা প্রত্যেকটা ঘরে গিয়ে ঘরভাড়া চাইতে ভুলেন না। আজ মাসের সাত তারিখ। ভাড়া চাইতে এসেছেন উনি। প্রিয়তার প্রশ্নে বলে উঠলেন,

” সকাল বেলায় একটু হাঁটতে বের হই। সবার একটু খোঁজ-খবর নেই এই।

” আমাদের খোঁজ নিতে এসেছেন বলে তো মনে হচ্ছে না আন্টি। টাকা চাই তাই তো?

” তুমি এমন ব্যবহার করো ক্যান সবসময়? ভালো কইরা কথা কইতে পারো না? আমি তোমার ছোট নাকি? সম্মান দিয়া কথা কইতে পারো না?

” আপনি আমার ঘরে আসুন। আমার কেমন ব্যবহার করা উচিত আপনি বুঝে যাবেন। আসুন একটু চা খেয়ে যান। দুটো গল্প করি বসে। ভাড়াটা দিচ্ছি। আসুন।

মহিলার ললাটে ভাঁজ পরল। রাগান্বিত হলো চেহারা। ত্যাছড়া হেসে প্রিয়তার ঘরে ঢুকলেন তিনি। প্রিয়তা চেয়ার টেনে বসতে দিল মনোয়ারে খানমকে। আরহামকে বিস্কিট বের করে দিতে বললো। অতঃপর হাসিমুখে বললো,
” ভাড়াটা এখনই নিবেন?

” এখন দিলে তো ভালোই হয়। আমাগো আমার খুব সমস্যা হইতাছে। পোলায় টাকা পাঠায় না।

” টাকাটা যে দিবো, ঘরের অবস্থা দেখেছেন? বৃষ্টি পরলে ঘর ভেসে যায়। তোষক থেকে ভেজা ভোটকা গন্ধ বের হয়। যেখানে যেখানে টিনে ফুঁটো, সেখানে হাঁড়ি-পাতিল রেখে দিতে হয়। সারা রাত আমরা ভাই-বোন এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকি। আমি ভাড়া দিবো না তা নয়। অবশ্যই ভাড়া দিবো। কিন্তু আমি আটশো টাকা কম দিবো। পুরোটা দিবো না।

‘ কি কউ? আমি তো কইছি আমার পোলা আসলে টিন বদলাই দিবো।

” ততদিন আমি ভাড়াটাও কম দিবো। এইভাবে কি থাকা যায়? মাসের ভাড়া আমি মাসেই দিই। সবার মতো বাকি রাখি না। এত কষ্ট করে থাকবো কেন?

” ভাড়া আমি কমই রাহি।

” এর চেয়েও কম দিবো। ঘর ভাড়া আগামীকাল পেয়ে যাবেন। এবার আপনি আসুন আন্টি। আমি আরহামকে স্কুলে দিতে যাবো।

মহিলা চোখ পাকিয়ে অহংকারি, দাম্ভিক ভঙ্গিতে জুতোর খটখট শব্দ করে চলে গেলেন। প্রিয়তা হাসল খানিক। মনোয়ারা খানমের স্বভাব ভালো নয়। একজনের কথা আরেকজনের কানে লাগায়। তিলকে মুহুর্তেই তাল বানিয়ে ফেলে। কোন বাড়ির ছেলে-মেয়ে কি করল এসব নিয়ে গবেষণা করেন। যত রকম কূটকচালি করা যায় সবেতেই তিনি আছেন। প্রিয়তার সামনে প্রিয়তার গুণগান গেয়ে বেড়ান। অথচ অন্যদের কাছে প্রিয়তাকে নিয়ে নিন্দে করেন। সবই প্রিয়তার কানে আসে। কিচ্ছু বলে না সে। চুপ থাকে। নাগালে পেলে কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হলেও নিজেকে সামলে নেয়। নিজের বদনাম শুনে প্রিয়তা রাগ করে না। তাকে নিয়ে অন্যরা ভাবছে এটা ভাবতেই ভালো লাগে।

প্রিয়তা নিজেও তৈরী হয়ে আরহামকে নিয়ে বের হলো। আরহামকে স্কুলে রেখে টিউশনিতে যাবে সে। প্রিয়তার কপালে আজ ছোট্ট কালো টিপ। কালো রঙের কামিজের সাথে ম্যাচিং সালোয়ার আর ওড়না। কানে ক্ষুদ্র দুল। নাকে থাকা নোস পিন রোদে জ্বলজ্বল করছে। নিজের সৌন্দর্যে আজকাল গর্ববোধ করে প্রিয়তা। সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়।

_______

গুণী মানুষজন ঠিকই বলেন। পৃথিবী থেকে একজন হারিয়ে গেলে সেই মৃত লোকটির জন্য মানুষ একদিন কাঁদে, দু-দিন কাঁদে অতঃপর তিনদিনের দিন মৃত ব্যক্তির আপনজন নিজেদের শক্ত করে ফেলেন।
জীবনের পথে ধীরে ধীরে চলতে আরম্ভ করেন। কান্নাকাটি বন্ধ করে নৈমিত্তিক কাজকর্মে মনোনিবেশ করেন। সামলে নেয় নিজেদের। ইহানের আব্বার মৃত্যুর দুটো দিন পেরিয়ে গিয়েছে খুব নিখুঁত ভাবে। ইহানদের বাড়িটির নাম সবাই দিয়েছে “মরা বাড়ি”, “মৃত মহল”। লোকে এসে এসে দেখে যাচ্ছে ইলমা বেগমকে। হা-হুতাশ করে যাচ্ছে। ইহান নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। ইহানের সিলেটে ফেরার সময় হয়েছে। এখানে তার আর থাকা সম্ভব নয়। তানিয়াও এ দুদিন থানায় যায়নি। ইহানের সাথে গাজিপুরেই থেকেছে। ইহানের আম্মার দেখভাল করেছে তানিয়া। রান্নাবান্না করে খাইয়েছে সবাইকে। ইলমা বেগমের কাছাকাছি থেকেছে সবটা সময়।

ইহান তার আম্মাকে ছেড়ে সিলেটে যাবে না। ইলমা বেগমকে সে নিজের সাথেই নিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু ইলমা বেগম এতে নারাজ। কোনোমতেই ঘর-বাড়ি আর স্বামীর শেষ আশ্রয় টুকু ছেড়ে যাবেন না তিনি। এই নিয়ে নানারকম কথাবার্তা চলছে। আলাপ আলোচনা বিভ্রান্তি হচ্ছে। মা ছেলের এই দ্বন্দ্বের মাঝে না চেয়েও ঢুকে পরল তানিয়া। বললো,

” ইহান স্যার তো ওখানে একা থাকে আন্টি। আপনি গেলে উনার ভালো লাগবে। আর আপনারও তো হাওয়া পরিবর্তন করা দরকার। সিলেট থেকে ঘুরে আসুন। মাসে না হয় দু-বার এখানে এসে আঙ্কেলের কবর দেখে যাবেন।

ইলমা বেগমের করুণ মুখ। আঁচল দ্বারা মুখ ঢাকলেন তিনি। নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিলেন। বললেন,

” ও এখানে শুয়ে থাকবে। আমি এত দূরে যাই কিভাবে?

তানিয়া এগিয়ে এলো। ইলমা বেগমের কাঁধে হাত রাখল। তানিয়ার খারাপ লাগছে। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা সে বোঝে। মৃত বাড়িতে থাকতে চাওয়ার মন-মানসিকতা কেমন হয় সেসব সে জানে। ক্লান্ত চোখে তানিয়া বললো,

” মৃত মানুষ কখনো ফিরে আসে না আন্টি। মৃত মানুষের সাথে সুখ-দুঃখের আলাপ করা যায় না, কষ্ট ভাগাভাগি করা যায় না। আবার মৃত মানুষের পাশে পাশে থেকে তার মুহুর্ত গুলোকেও আনন্দদায়ক করা যায় না। কিন্তু জীবিত ব্যক্তিদের সাথে থাকা যায়, দুঃখ-কষ্ট ভাগ করা যায়, খেয়াল রাখা যায়। আপনার উচিত যে বেঁচে আছে তাকে সময় দেওয়া, তার খেয়াল রাখা। কিছু স্মরণীয় মুহুর্ত বন্দী করে রাখা। ইহানে স্যারের সাথে আপনার থাকা উচিত।

” ওখানে গিয়ে আমি কিভাবে থাকি বলো?

” প্রথম প্রথম কষ্ট হবে। কিন্তু আমরা তো মানুষ আন্টি। মানিয়ে নেওয়াই আমাদের ধর্ম। ছেলের সাথে থাকলে কষ্ট আপনার কমই হবে। ইহান স্যার নিজে বাড়ির কাজ করেন, বাইরের কাজ করেন। সবটা সামলাতে হিমশিম খান। আপনি উনার সাথে থাকলে উনি দিন শেষে বাড়ি ফিরে শান্তিতে ঘরে বসতে পারবেন। আপনার পাশে বসে সারাদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভাগাভাগি করতে পারবেন। এর চেয়ে সুখের মুহুর্ত আর কি হতে পারে বলুন?

ইলমা বেগম তাকিয়ে রইলেন তানিয়ার দিকে। তানিয়ার মাথায় হাত রাখলেন। সবটা শুনে রয়েসয়ে চেয়ার থেকে উঠলেন। নিজের ঘরে গিয়ে লাগেজ বের করলেন। আস্তে আস্তে আলমারির দিকে এগিয়ে এসে স্বামীর আর নিজের জামাকাপড় ঠাসাঠাসি করে ভরলেন ব্যাগে। স্বামীর ছবি বুকে আঁকড়ে ধরে বসে রইলেন খানিকক্ষণ। আশপাশে চুখ বুলালেন সময় নিয়ে। ঘরের বাইরে বুকে দু হাত গুঁজে সবটাই দেখল ইহান। কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করছিল সে। আজ বোধহয় শূন্যতা হারাবে। আম্মাজানকে নিয়ে এক সাথে থাকবে ভেবেই আনন্দ হচ্ছে ইহানের। এই দুটো দিন কেমন অদ্ভুত লেগেছে। আনন্দ নেই, কাজের প্রতি দায়বোধ নেই, কোথাও ফেরার তাড়া নেই। আপন জন হারানোর নিষ্ঠর ব্যথাই শুধু বক্ষস্থলে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। হাহাকারে ভঙ্গ হচ্ছে হৃৎপিণ্ড।

তানিয়া ইহানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বুঝতে চাইছে ইহানের অভিব্যক্তি। ইহান তানিয়ার দিকে চেয়ে রইল। তানিয়ার চোখে ইহানের আম্মার জন্য গভীর ভালোবাসা দেখতে পেল সে। বরাবরই ইহান ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের। খুব ছোট বেলা থেকেই সে চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। দশ কথা বললে এক কথার উত্তর দেওয়ার মতো মানুষ ইহান। পড়াশোনাতে সবসময় এগিয়ে থাকতো ইহান। কলেজ আর ভার্সিটি লাইফে হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছিল। সময়ের রেশ ধরে এখন কারোই সাথেই তেমন পরিচয় নেই। একেকজন একেক দিকে হারিয়েছে। কারো সাথে অতিরিক্ত কথাও হয় না ইহানের। প্রয়োজনের খাতিরে যেটুকু দরকার সেটুকু বলতে পারলেই বেঁচে যায়। অস্বাভাবিক রকমের রাগের কারণে অনেকেই আড়ালে ইহানের নামে বদনাম রটায়। আবার অনেকে ইহানকে প্রচণ্ড বুঝদার, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ বলেই জানে। ইহানের ভার্সিটির সব বন্ধুবান্ধব বিয়ে করে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘুরছে। এদিকে ইহানের এসব নিয়ে ভাবনাই নেই। সব ভাবনাতে কেউ একন জল ঢেলে দিয়েছে বোধহয়। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতাসূচক মুচকি হাসল ইহান। বলল,

” তোমাকে ধন্যবাদ তানিয়া।

তানিয়ার আঁখি অশ্রুতে টইটম্বুর। মোহনীয় ফর্সা মুখের আদল। হাসলে তানিয়ার চোখ ও হেসে উঠে। মুক্তোর ন্যায় দাঁত গুলো ঝিলিক দিয়ে উঠে। তানিয়া মৃদু হাসল। বলল,
” আপনি তো খুব একটা কথা বলার ঝামেলা নিতে চান না। তাই আপনার হয়ে কথা বলার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হচ্ছে। সবাইকে আপনার হয়ে সামলাতে হচ্ছে। কিন্তু এসব তো আপনার করার কথা ইহান। আর কবে মন খুলে কথা বলতে শিখবেন? কবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে শিখবেন?

ইহানের কণ্ঠ জোরাল। শ্যামলা গরণের অবয়বে মাধুর্যতা। গম্ভীরতা বিদ্যমান ছেলেটার শিরায় শিরায়। অন্তরে অগ্নিশিখা জ্বললেও বাহিরের আবরণ গোছালো। নাকের পাটা ফুলিয়ে সে বলে উঠল,
” আমি এমনই। আমার মনে হয় যে বোঝার সে এমনিতেই বুঝবে। আমার কাজে, আমার আচরণেই বুঝবে। আমাকে মুখ ফুটে বলতে হবে কেন আমি তাকে আমার কাছে কাছে চাই। কেন বলতে হবে তার প্রতি আমার অনুভূতিটা ভালোবাসার, বিশ্বাসের, মর্যাদার?

” বলতে হয় ইহান। সবাই সব কথা বুঝে না। তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে হয়। দেখুন কোনোদিন এমন না হয়, আপনার এই অতিরিক্ত ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার কারণে আপনার প্রিয় মানুষজন আপনার থেকে হারিয়ে যায়। দূরে সরে যায়। আপনি একাকীত্বে ভুগেন।

ইহান শুনল। ঘরে ফিরে শার্ট বদলে নিল। ফোনে থানার লোকদের সাথে কিছু জরুরী কথা বলে নিল। অতঃপর তানিয়াকে ফেরার জন্য তাড়া দিল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ইহান ফোন বের করল। প্রহরের নম্বল ডায়াল করল। ওপাশ থেকে ফোন তুললো প্রহর। ইহান কিছুটা ঘাবড়াল। কপাল চুলকে বললো,

” কি করছিস?

” বসে আছি। তুই?

” কিছু করছি না। এখন ফ্রি আছিস?

” হ্যাঁ বল না। কেমন চলছে দিনকাল?

” আমি আর তানিয়া গাজিপুরে এসেছি?

প্রহর অবাক হয়। বসা থেকে বোধহয় উঠে দাঁড়ায়। বলে,

” পরিবারের কাছে এসেছিস? এখানে আয়। বেশি দূর না তো। দেখা করে যা।

সময় নেয় ইহান। গাঢ় শ্বাস ফেলে। বলে,
” আব্বা দুদিন হলো মারা গিয়েছে। আব্বাকে কবর দিয়ে আম্মাকে নিয়ে সিলেটে ফিরছি প্রহর। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে তোর সাথে দেখা করতাম।

মূর্তির ন্যায় জমে যায় প্রহর। শোকাহত হলো খুব। খারাপ লাগল ভিষণ। ইহান ভালো ছেলে। কষ্ট সবসময় চেপে রাখতে ভালো বাসে। ছেলেটাকে দেখে বোঝা যাবে না এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার জীবনে। প্রহর কি বলবে বুঝতে পারে না। বলে,

” আমাকে একবার ও জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না? এতটাই পর হয়ে গিয়েছি আমি? আঙ্কেলকে শেষবারের মতো দেখতেও দিলি না আমাকে? বললে কি হতো হ্যাঁ?

হাঁসফাঁস করে ইহান। সামনাসামনি থাকলে প্রহর হয়তো ইহানের অভিব্যক্তি দেখে তার মনের কথা বুঝতে পারতো। এখন কিভাবে ছেলেটাকে বোঝাবে পরিস্থিতি? ভেবে পায় না ইহান। দমে যায়। তানিয়ার নিকট চলে আসে হন্তদন্ত হয়ে। তানিয়া তখন ইলমা বেগমের শাড়ি ভাঁজ করতে ব্যস্ত। ইহানকে এভাবে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে তানিয়া। কিছু বোঝার আগেই ইহান ফোনটা তানিয়ার কানে মেলে ধরে। স্ক্রিনে থাকা নাম দেখে কথা বলতে আরম্ভ করে তানিয়া।

” আসসালামু ওয়ালাইকুম স্যার।

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এসব কি শুনছি আমি তানিয়া? আঙ্কেল মারা গেছে তোমরা একবার ও আমাকে জানাওনি? ইহান না হয় জানাতে ভুলে গিয়েছিল। পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল বলে বলার সুযোগ পায়নি। তুমি কেন জানালে না?

তানিয়া এইবার বুঝল আসল বিষয়। বলল,
‘ কাকে রেখে কাকে সামলাবো সেটাই বুঝতে পারিনি স্যার। আপনি চিন্তা করবেন, কষ্ট পাবেন, ছুটে আসবেন ভেবে আপনাকে বলিনি। আজই জানাতাম আমি। আঙ্কেল মারা গিয়েছেন সকালে। আমরা পৌছেছি রাতে। মৃত মানুষের শরীর দেখার মতো ভয়ঙ্কর অনুভূতি আপনি অনেক পেয়েছেন স্যার। চাইনি পরিচিত মানুষের এমন অচেতন রুপ আপনি দেখুন। আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। আপনাকে জানিয়ে কষ্ট দিতে চাইনি। আমরা এদিকটা সামলে নিয়েছি। দু দিন থানায় যাইনি। আজ ফিরতেই হবে। নইলে আপনার ওখানে যেতাম।

” বেশ। যাও তবে। আঙ্কেলের জন্য আমার দোয়া রইল। ইহানকে সামলে রেখো। কি থেকে কি করবে ঠিক নেই।

” আমি আছি স্যার।

ইহানের দিকে তাকিয়ে কথাটুকু বলে ফোন কেটে দিল তানিয়া। ফোনটা ছো মেরে কেড়ে নিয়ে ঘর ছাড়ল ইহান।

________

সন্ধ্যা হয়েছে। আকাশে উজ্জল তারা গুলো জ্বলজ্বল করছে। গাছের পাতা দুলে উঠছে বারংবার। প্রিয়তাদের বাড়ির পাশেই বিশালাকার কয়েকটি মাঠ। মাঠের সাথেই একটি স্কুল। স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিকেল হলেই খেলতে আসে মাঠে। হৈ হুল্লোরে কান ধাঁধিয়ে যায়। ক্রিকেট, ফুটবল, দৌঁড়াদৌড়ি চলতেই থাকে মাঠটিতে। এ বাড়ি ও বাড়ির বয়স্ক মানুষজন বিকেল হলে মাঠে এসে বসে গালগল্প করেন। সন্ধ্যায় বিদ্যুত চলে গেলে পাটি, মাদুর বিছিয়ে অনেকেই শুয়ে থাকেন মাঠে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় মাঠের আশপাশ। পেয়ারা গাছে কিছু ছেলেপিলে উঠে বসে থাকে। আরহামকে নিয়ে মাঝেসাঝেই মাঠে চলে যায় প্রিয়তা। প্রকৃতির মৃদু হাওয়া গায়ে লাগায়। মুহূর্তটা উপভোগ করে দু ভাইবোন। অতিতের গল্প গুলো পুনরায় বলে চলে। আরহাম পিটপিট করে তাক্য় বোনের পানে। আম্মুর জন্য আরহামের বুক পুড়ে। আব্বুর সুশীতল বুকে মুখ গুঁজে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় আরহামের। বুঝতে পারে সেই বাড়ি আর তাদের বাড়ি নেই। সে বাড়িতে অন্যদের বসবাস। বিন্দুমাত্র ভালোবাসার ছিটেফোঁটা ও বাড়িতে নেই।

পাউরুটি মুখে তুলে নিল আরহাম। পাউরুটির প্যাকেটে থাকা জেলি ছোট্ট আঙ্গুলের মাথায় নিয়ে রুটিতে মাখিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে কামড় দিল সে। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা জেলিটুকু জিভ দ্বারা চেটে নিয়ে বোনের পানে তাকাল। প্রিয়তা খাতা দেখতে ব্যস্ত তখন। স্টুডেন্টদের খাতা দেখতে দেখতে আড়চোখে দেখছে ভাইকে। প্রিয়তা যে দোকানে কাজ করে সেই দোকানের নাম “বিউটি শপ”। দোকানের মালিকের কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আজকে পুরো দোকানটাই সন্ধ্যের মধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে। আগামীকাল একই সময়ে দোকান চলবে বলে নোটিশ দিয়েছেন মালিক কর্তৃপক্ষ। প্রিয়তার খুশি আর ধরে না। রোজ রাত করে বাড়ি ফিরতে ভালো লাগে না মোটেই। আরহামকেও সময় দেওয়া হয় না। আজ সময় পেয়ে বাচ্চাদের পরিক্ষা নিয়েছে। সেই খাতাই সময় নিয়ে দেখতে বসেছে। আরহাম খেয়ে হাত ধুয়ে প্রিয়তার গা ঘেঁষে বসল। বললো,

” গলির মাঠে না মেলা বসেছে। জানো?

প্রিয়তার ললাটে ভাঁজ পরল। চোখে বাঁকিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। পুনরায় খাতা দেখায় মন দিয়ে বললো,

” জানি না। কখন বসেছে?

” সকালে। আসার পথে দেখোনি?

” অন্য রাস্তা দিয়ে এসেছি। দেখিনি।

‘ যাবে না?

” ক-দিন থাকবে?

” শুধু আজই থাকবে। আর বসবে না।

” যেতে হবে না। গেলেই খুব খরচ।

” চলো না আপু যাই। আমি শুধু ঘুরে ঘুরে দেখবো। কিচ্ছু চাইবো না।

প্রিয়তা নিষ্পলক চোখে আরহামকে পর্যবেক্ষণ করল। প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে খাতা দেখায় ব্যস্ত হলো। আরহাম আরো ঘেঁষে বসল। প্রিয়তার সান্নিধ্যে এসে মলিন মুখে বসে রইল। ফোনের রিংটোন বাজল। প্রিয়তা ফোনের দিকে আড়চোখে তাকাল। নম্বরটা ভিষণ চেনা প্রিয়তার। সিমের মালিকের মুখটা ভেসে উঠল চোখের পাতায়। প্রিয়তা ফোন ধরে বলে উঠল,

” আসসালামু ওয়া আলাইকুম।

ওপাশের ব্যক্তিটি সালামের উত্তর নিল বোধহয়। পরক্ষণে কিছু একটা বলে উঠল। সেসব স্পষ্ট শুনতে পেল না আরহাম। শুধু চেয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। আরো দু কথা বলে ফোন রাখল প্রিয়তা। অতঃপর হাসল আরহামের দিকে তাকিয়ে। খাতা কলম সরিয়ে আরহামকে কোলে নিল সন্তপর্ণে। আগলে নিল বক্ষপিঞ্জরে। আরহামের গায়ে আলাদা এক ঘ্রাণ মিশে আছে। সেই ঘ্রাণ প্রিয়তার নাসিকারন্ধ্রে প্রবেশ করল। মৃদু হেসে আরহামের মুখটা চেপে ধরল খুবই আলতো ভাবে। চোখের পাতায় সশব্দে চুমু খেয়ে বললো,

” মেইন গেটে কেউ একজন এসেছে। দেখে এসো তো। দেখো তো চিনতে পারো কি না।

” কে এসেছে আপু? আরহামের কৌতুহলী চোখে উজ্জলতা। গোলাকার দুটি চোখে উপচে পরা বিস্ময়।

গত চারমাসে কেউ প্রিয়তাদের বাড়ি আসেনি। এত রাতে দেখা করতে আসার মতো তেমন কেউই নেই তাদের। সন্ধ্যে হলে আরহামকে একা একা কোথাও যেতে দেয় না প্রিয়তা। আজ নিজে থেকে বাইরে যেতে বলছে? বিষয়টা অদ্ভুত ঠেকল আরহামের নিকট। চোখ ছোট ছোট করে ফেলল সে। প্রিয়তা ছেলেটার নাক টেনে বলল,

” দেখেই আসো না। হয়তো বাইরে কোনো সারপ্রাইজ আছে। যাও যাও।

____

খেতে বসেছে আরিফ। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দীপা। মুখে তার এক চিলতে হাসি। স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে মিষ্টি রঙের ফিনফিনে জর্জেট শাড়িতে দীপাকে আবেদনময়ী লাগছে। ভারী মেকআপে রাঙিয়ে রেখেছে নিজেকে। গরুর মাংসের কালা ভুনা রেঁধেছে সে। মাংসের কয়েক টুকরো তুলে দিল স্বামীর প্লেটে। হাসিমুখে বললো,

” খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে রান্নাটা?

আরিফ হেসে ভাতের সাথে তরকারিটুকু নেড়ে মুখে নিল। বলল,

” বাহ্। ভালো হয়েছে তো। এত ভালো রান্না কিভাবে করলে? তুমি তো রাঁধতে পারো না।

” মন দিয়ে করেছি। ভালো হবে না? খাও খাও।

আবার ও ভাত নেড়ে খাবার মুখে তুলতে তুলতে আরিফ বলল,
” প্রিয়তা গরুর কালা ভুনা খেতে খুব ভালোবাসতো। প্রীতি রান্না করলে মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পরতো। পুরো এক বাটি রেখে দিতে হতো প্রিয়তার জন্য। চেটেপুটে খেতো একদম। প্রায় এই ডিশ রান্না হতো বাড়িতে। সে কি আয়োজন আর আনন্দ।

সলজ্জ চোখে কথাটুকু বলে থমকে গেল আরিফ। ভাতের অংশ আটকে গেল গলায়। প্রিয়তার আর আরহামের কথা মনে পরল কেন? প্রিয়তা কেমন আছে এখন? খেতে পাচ্ছে এমন খাবার? হুট করে প্রিয়তার নামটা কেমন বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। হয়তো চায়নি কথাটা বের হোক। তবুও বেরিয়েই এলো। মন খারাপ হলো।

দীপা রেগে গেল প্রিয়তার নাম শুনে। এই নামটা সহ্য হয় না তার। চেঁচিয়ে বলে উঠল,
” ওদের নাম মুখে আনতে না করেছি না? মুখ থেকে বেরিয়ে যায় তাইনা? খাও সব। ছেলে-মেয়েকে দিয়ে খাওয়াও। যত্তসব ন্যাকামি।

কথাটুকু বলে হনহন করে ঘরে গিয়ে ঘরের দরজা শব্দ করে আটকে দিল দীপা। আরিফ তাকিয়ে রইল তরকারির দিকে। চোখ ছলছল করে উঠল।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here