অটবী সুখ
৩১.
ডাইনিং টেবিলের পরিবেশ কিঞ্চিৎ অস্থির, কোলাহলপূর্ণ। বামপাশে থাকা বৈদ্যুতিক বাতিটা নিভছে-জ্বলছে। চোখে লাগছে খুব। আবার বাতিটা বন্ধ করে দিলে আলো-আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে ঘর। বাধ্য হয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। কোথা থেকে নতুন, ফকফকা সাদা লাইট এনে লাগাতে ব্যস্ত হলো। অটবী তখনো রক্তের বিষয়টা নিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছিল না। হাজারো প্রশ্নে মিইয়ে যাচ্ছিল বারবার। ভেতরে ভেতরে তার অন্তর আত্মা শুকিয়ে চৌচির, ভঙ্গুর, ভীতু। অথচ মুখ গলিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এমন কঠিন জিনিস ত্রিস্তানের কাছে কেন? তাও আবার ফ্রিজে?
ভাবনাগুলো মস্তিষ্কে জট পাকালো। শরীরের কাঁপন নিয়ন্ত্রণে রেখে ত্রিস্তানকে একাধারে দেখে চললো অটবী। আমচকা শুনতে, সরোজ ঠাট্টার সুরে বলছে, “কি অটবী আপু? ভাইরে এত কি দেখ?”
পাশে বসে থাকা তনয়া খাওয়া থামালো। সরোজের দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে অবাক কণ্ঠে বললো, “ওমা! তুমি জানো না কেন তাকায়?”
প্রশ্নের ঢংয়ে মজা পেল সরোজ। জিজ্ঞেস করলো, “কেন তাকায়?”
—“বউ তো তার বরের দিকে তাকাবেই। ওদের নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। ওদের প্রেম প্রেম পায় না?”
কথাটা শোনা মাত্র হু হা করে হেসে ফেললো সরোজ। গা কাঁপিয়ে, অনেক্ষণ! হাসতে হাসতেই আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুমি তো দেহি অনেক প্রেমের ব্যাপারে জানো! তা কয়টা প্রেম করছিলা?”
—“আমি তো প্রেম করিনি। বিয়ে করেছি। কেন? তুমি জানো না? ভাইয়া তোমাকে বিয়েতে দাওয়াত দেয়নি?”
পুতুল নিয়ে খেলতে খেলতে নিষ্পাপ কণ্ঠের বলা কথাটা শুনে থমকালো প্রত্যেকেই। হাসির তোড় বন্ধ হলো। খুকখুক করে কাশলো সরোজ। হাঁসফাঁস করলো। তনয়া যে এমন একটা কথা বলে ফেলবে, ভাবেনি।
ততক্ষণে ত্রিস্তানের বাতি লাগানোও শেষ। বেসিনে হাত ধুয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে সে গাঢ় গলায় ধমক লাগালো, “খাওয়ার সময় এত কথা বলিস কেন, সরোজ? চুপ থাকতে পারিস না?”
অপরাধীর ন্যায় মাথা ঝুঁকিয়ে সরোজ শুধু এটুকুই বললো, “সরি ভাই। আর কথা কইতাম না।”
আনন্দ ঘন মূহুর্তটা ঘন কালো আঁধারে ডুবে গেল যেন। পিনপতন নিরবতায় তনয়ার বকবক ছাড়া অন্য কিছু শোনা যাচ্ছে না। তাকে ত্রিস্তান খাইয়ে দিচ্ছে। খাওয়ানোর মাঝে আড়চোখে দেখছে অটবীকে। অটবী না তাকিয়েও সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অনুমান করছে, জড়োসড়ো হচ্ছে। এবং সেই দৃষ্টির জাল থেকে বাঁচতেই মাথা নুইয়ে একের পর এক লোকমা গিলে চলেছে সে।
অটবীর খাওয়ায় মন নেই। সুস্বাদু খাবারটুকু প্রত্যেকবারই বিষাদ হয়ে গলা বেয়ে নামছে। চোখে অস্পষ্ট ভাবে ভাসছে, থকথকে, গাঢ় লাল বর্ণের প্যাকেট দুটি। জঘন্য অনুভূতি! এহেন জঘন্য অনুভূতি নিয়ে কি আদৌ মানুষ খাবার খেতে পারে? আদৌ সম্ভব? সেই অসম্ভব কাজটিকে আরও একধাপ অসম্ভব করে দিয়ে তনয়া হঠাৎ বিচিত্র কণ্ঠে বলে বসলো, “তোমরা কি জানো, আমার মা কে? আমার মা রুপকথার রাক্ষস। রাক্ষসদের মতোই রক্ত খায়।”
–
—“তুমি যে আমার কত বড় একখান অপকার করছ, সেইটা জানো অটবী আপু?”
খাওয়ার পর ত্রিস্তান যেন কোথায় গেছে। পুরো বাড়িতে তনয়া, সরোজ আর অটবী। ড্রইংরুমে অভ্যাসমত ছবি এঁকে চলেছে তনয়া। এতক্ষণ তার দিকেই অটবীর দৃষ্টি ছিল। সরোজের কথায় ফিরে তাকালো। সোফায় ঠিক হয়ে বসে, ভ্রু কুঁচকালো, “আমি আবার কি করেছি?”
সরোজ যেন অভিযোগের লিস্ট নিয়ে বসলো এবার। দারুণ দৃঢ়তা নিয়ে বলতে শুরু করলো, “কি কি করো নাই হেইডা জিগাও। প্রত্থমে তো পড়ালেহা নিয়া সারাটা দিন চেইতা থাকতা। আগে কালেভাদ্রে দেখা হইলে বকতা। এহন তো আল্লাহর দিন্না চব্বিশটা ঘন্টা বকতে থাকবা। তারওপর কয়েকদিন ধইরা ত্রিস্তান ভাইয়ের মনে দয়ামায়া জাগছিল। আমারে তার রুমে ঘুমাইতে দিতো। এহন তুমি আহনে আবার এইহানে, এই ছোট্ট সোফাডায় ঘুমাইতে হইবো। আহহারে! আমার জীবন! আমারই আমার জীবনডার লাইগা মায়া লাগে রেহ্..”
কপালের ভাঁজগুলো আরও খানিকটা গাঢ় হলো। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে অটবী প্রশ্ন ছুঁড়লো, “নিজের বাসায় গেলেও তো পারো। এত কষ্ট করে এখানে থাকার দরকার কি?”
সরোজ হাসলো। ভীষণ অর্থপূর্ণ হাসি। গায়ে গামছা এঁটে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, “তা তুমি বুঝতা না। বুঝবার পারলে তো হইতোই।”
সরোজ চলে গেল। এক মিনিট, দু’মিনিট, তিন মিনিট! তার আর দেখা নেই। ওপাশ থেকে পানির তীব্র শব্দ শোনা যাচ্ছে। গোসল করছে নাকি? দ্বিধাদ্বন্দে অটবী উঠে দাঁড়ালো। একপলক তয়নাকে দেখে আস্তে আস্তে ডাইনিং টেবিলের সামনের দেওয়ালে থাকা ত্রিস্তানদের ফ্যামিলি ফটোটার দিকে আগালো। কাছাকাছি হতেই কদম থামালো সে। ফ্রিজে রক্ত দেখার পর থেকেই এই ফ্রেমটা নিয়ে বড় সন্দেহে আছে অটবী। সেদিন এই ফ্রেমের ভেতরে একটা চাবি খুঁজে পেয়েছিল। চাবিটা কি এখনো আছে? সে ভালো করে দেখেনি। তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, চাবিটা কিসের?
দুরুদুরু বুকে সেদিনের মতো আবারও ছবির সেই জায়গায় হাত ছোঁয়ালো অটবী। নাহ্! কিছু হচ্ছে না! অস্থির চিত্তে সে আরেকবার চেষ্টা করতেই হঠাৎ বিকট শব্দে সরে গেল ছবিটা। কালো মতো গুহার সিন্দুকটা আবারও বেড়িয়ে এলো। কিন্তু আফসোস! ভেতরে কিছু নেই। নিঃসন্দেহে সবটা ফাঁকা, খালি! একপাশে অল্প ধুলোবালি জমে আছে মাত্র।
—“তুমি এইহানে কি করতাছো, আপু?”
সরোজের কণ্ঠ!
মুহুর্তেই অজানা আতঙ্কে শিরা-উপশিরায় বিদ্যুৎ খেলে গেল অটবীর। কাঁপলো ক্ষীণ। দ্রুত পেছনে ফিরলো। সরোজ তার ঠিক দু’হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চুল ভেঁজা নেই। আগের কাপড় পরনে। তারমানে সে গোসল করতে যায়নি? হতাশায় চাপা তপ্ত নিশ্বাস ঘুরপাক খেল। উদাস হলো এই ভেবে, সে এত বোকা কেন? পরপরই সামান্য হেসে বলতে চাইলো, “ছবি, ছবি দেখছিলাম। হা-হাত লেগে কিভাবে যেন কি হয়ে গেল। কি অদ্ভুত, না?”
অথচ ওপাশ থেকে উত্তর নেই। সরোজ কেমন করে যেন ওকে দেখছে। অনাকাঙ্ক্ষিত লুকোচুরি খেলতে গিয়েও থমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। চোখ তার বড্ড শান্ত, নিরব, নিশ্চুপ!
–
ঘড়িতে তখন কতই-বা বাজে? রাতের সাত কি আট? ত্রিস্তান বেড়িয়েছিল দুপুর দুটোয়। এইমাত্র এলো। এসেই বিরাট এক সাদা খাম অটবীকে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “নাও, তোমার জন্য।”
অটবী তখন বিছানায় বসে বসে গল্পের বই পড়ছিল। একেবারে কাঁথা কম্বল মুড়ি দিয়ে। ত্রিস্তানের এত এত বই! কোনটা রেখে কোনটা পড়বে সেই দ্বিধাতেই তার নাস্তানাবুদ অবস্থা। এরমাঝে ত্রিস্তানের হঠাৎ আগমন তাকে একটু চমকেই দিলো বটে। খামটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে সুধালো, “কি এটা?”
ত্রিস্তানের নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর, “সেলারি।”
—“সেলারি? কিসের সেলারি?” বলতে বলতে অল্পসল্প ভাবুক হলো সে। এরপর কিছু একটা মনে পরতেই সূক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপনি আবারও রহিমদের সাথে মিলে চুরি করেছেন, ত্রিস্তান?”
—“আমি কখনোই চুরি করিনি।”
—“মাস্টারমাইন্ড তো আপনিই ছিলেন। চুরি করা আর চুরির বুদ্ধি দেওয়া একই ব্যাপার।”
বুকশেলফের নিচের ড্রয়ার গুলোর একটাতে কি যেন খুঁজছে ত্রিস্তান। খুটখুট শব্দে। পেয়ে যেতেই গাঢ় কণ্ঠে বললো, “ওসব ছেড়ে দিয়েছি। টিউশন নিয়েছি দুটো। এক মাস হলো।”
আশ্চর্য অটবী আরেকদফা আশ্চর্য হলো। তড়িৎ গতিতে খাম খুললো। ভেতরে একহাজার টাকার আট-টে নোট। সে টাকাগুলো বের করলো না। রেখে দিলো। আগের সেই বাঘিনী রুপটায় শত শত পানি ঢেলে বললো, “টিউশন কেন? চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন না কেন?”
—“কারো গোলামি করতে আমার ভালো লাগে না।”
অটবী হতবাক হলো, “চাকরি করা গোলামি? তাহলে টিউশন কি?”
—“টিউশন ইজ নট সো লাইক গোলামি। যখন ইচ্ছে ছেড়ে দিতে পারবো। ফর এক্সেমপল, টাকা পেয়ে এখন আর আমার টিউশন দুটো করাতে ইচ্ছে করছে না। কালকে থেকে আর যাবো না আমি।”
এবার যেন বিমূঢ়তার শেষ সীমানা অতিক্রম হলো। কণ্ঠস্বর গলিয়ে কিয়ৎক্ষণ কথাই বলতে পারলো না অটবী। অথচ ওপাশের লোকটা তখনো নির্বিকার, নির্লিপ্ত, নিজের কাজে ব্যস্ত!
ড্রইংরুম থেকে অটবীর কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে এসেছে ত্রিস্তান। নিজেই এক এক করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখছে সেগুলো। অটবী মানা করেছিল, লোকটা শোনেনি। অটবীকে বিছানা থেকেই নামতে দিচ্ছে না সে! পরাজিত অটবী তখন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল ত্রিস্তানকে। আনমনে, কিঞ্চিৎ মন খারাপ নিয়ে। এইযে, লোকটা? সুখনীল ত্রিস্তান? আজন্মকাল তাকে বলে বেড়ালো, সে অরণ্য। তার মাঝে শত শত রহস্য লুকানো। কিন্তু কই? সে তো নিজের মাঝে কোনো রহস্য খুঁজে পায়নি। বরং উদ্ভট গোলকধাঁধায় লোকটায় নিজেই আটক। নিঃশব্দ হাহাকারে সেই ধাঁধা থেকে বেরতে চায়, মুক্তি চায়। একেকটা চিৎকারে কাঁপিয়ে তোলে তার নিজস্ব কাল্পনিক পৃথিবী। কিন্তু কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করে না। অটবী সেই হাহাকার বুঝতে পারে বলেই এখনো সাথে আছে, চুপ আছে। এত কিছু বুঝে, শুনে, দেখেও ধৈর্য হারা হচ্ছে না।
যন্ত্রণাময় দীর্ঘ নিশ্বাসটুকু আস্তে আস্তে বেড়িয়ে এলো। ঢোক গিলে অটবী উঁচু কণ্ঠে ডাকলো, “আপনাকে এসব করতে মানা করেছি, ত্রিস্তান! আপনি এদিকে আসুন।”
অদ্ভুত ভাবে ত্রিস্তান এবার আর ত্যাড়ামো করলো না। দিরুক্তিহীন কাছে আসলো। অটবীর পাশে এসে বসলো। অতএব অটবীর আরেকদফা আদেশ, “চোখ বন্ধ করুন।”
কপালে গুটিকয়েক বলিরেখা দেখা দিলো। কয়েক পলক অটবীকে আগাগোড়া পরখ করে চোখ বুঝলো ত্রিস্তান। বলতে চাইলো, “তুমি কি করতে চাইছো, অটবী?”
কণ্ঠস্বর শব্দ হারালো তক্ষুণি, যখন অটবীর কোমল হাতের স্পর্শ নিজের গালে অনুভব করলো সে। ভেবে রাখা প্রশ্নটাও থেমে গেল কণ্ঠনালিতেই। অটবী তার সারা মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। ভ্রু যুগল, চোখ, চোখের পাতা, পাঁপড়ি! এই মেয়েটার হলো কি হঠাৎ?
—“আমি সবসময় আপনার পাশে থাকবো, ত্রিস্তান। আপনি ভয় পাবেন না।”
ত্রিস্তান চোখ খুললো না। নড়লো না। অটবীর স্পর্শ ডোরে আটকে থেকেই বললো, “আমি কেন ভয় পাবো? তুমি সবসময় আমার পাশে থাকবে, আমি জানি।”
—“আপনি ভয় পান, ত্রিস্তান। আপনিও মানুষ। রোবট নন। কেন বুঝেন না?”
কথার তোড়ে ত্রিস্তান তাকাতে চাইলো, কিন্তু অটবী দিলো না। বাঁধা দিয়ে বললো, “চোখ খুলছেন কেন? আমি চোখ খুলতে বলেছি?”
ত্রিস্তান শুনলো। অবাধ্য হলো না। ঢিমে যাওয়া কণ্ঠে কেমন করে যেন বললো, “আমি তোমাকে মানা করেছিলাম অটবী, আমার সঙ্গে না জড়াতে।”
—“আমি কখনো আপনার মানা শুনিনি।”
গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির শেষ প্রান্তে এসে হাত থমকালো অটবী। চাপা নিশ্বাসগুলো তখনো ঘুরঘুর করছে, দুজনেরই। আমচকাই তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। অধরে অধর ছুঁয়ে গেল। সময় গড়ালো। কারো খেয়াল থাকলো না, সে সর্বপ্রথম এগিয়ে এসেছিল?
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা