অটবী সুখ
৩০.
—“ছেলেটার পেশা আমার ভালো লাগছে না, অটবী। তুই এটা কি করলি?”
পূব আকাশে সূর্য সবে মাথার ওপর উঠতে শুরু করেছে। ঘুম হয়নি রাতে। সারারাত রেবা বেগমের অজ্ঞাত অভিব্যক্তি জানবার উত্তেজনায় নির্ঘুম ছিল দু’চোখ। ফজরের নামায শেষেই দৌঁড় লাগিয়েছে রেবা বেগমের ঘরে। কিন্তু তিনি সেখানে ছিলেন না। উঠোনে তার হার হামেশা পাতিয়ে রাখা চতুর্ভুজ পাটিতে পানের খিলি নিয়ে বসেছিলেন। অটবী সেখানে গেল নিরবে। মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। কিন্তু দু’জনের কেউ-ই কারো সঙ্গে কথা বলছে না, তাকাচ্ছে না! সর্বশেষে অটবীই ভীতু কণ্ঠে ডাকলো, “আম্মা?”
সঙ্গে সঙ্গে নিজের অসন্তোষ জানেলন তিনি, “ছেলেটার পেশা আমার ভালো লাগছে না, অটবী। তুই এটা কি করলি?”
অটবী সময় নিলো। মনে মনে কথা সাজিয়ে ত্রিস্তানের পক্ষে কিছু বলতে নেওয়ার আগেই রেবা বেগম সুদীর্ঘ হতাশা নিয়ে বললেন, “তোর আব্বার সাথে আমার যখন বিয়ে হয়েছিল আমি তখন ষোলো। কেলাশ আইটে পড়তাম। বিয়ের পর পড়াটড়া সব গোল্লায় গেছে। তোর আব্বার আমাকে পড়ানোর অনেক ইচ্ছা থাকলেও টাকা ছিল না। আমি মানুষের বাসায় টুকটাক কাজ করতাম আর তোর আব্বা ট্রাক চালাতো। সয়সম্পত্তি বলতে এই বাড়ি ছিল বলে সহায়! যখন তুই আমাদের কোল জুড়ে আসলি, তোর আব্বা মনে মনে প্রার্থনা করছিল, তোকে যেমনে পারুক পড়াবে! আমরা যেমন মূর্খ দেখে কষ্ট করছি, তোকে তেমন কষ্ট করতে দিবে না। পড়াইছেও! ভাবছিলাম… তোর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ হবে। উচ্চবংশে তোর বিয়ে দিবো। কিন্তু তোর কপাল সেই আমাদের কাছে এসেই ঠেকেছে! বিয়েটাও এমন ভাবে ভেঙ্গে গেল!”
বুকে চাপা দীর্ঘশ্বাসটা আরেকদফা বেড়িয়ে এলো। রোধ হয়ে আসা কণ্ঠস্বরে আরেকটু শক্তিসামর্থ্য নিয়ে বললেন, “আমি কাল সারারাত অনেক ভেবেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি। ত্রিস্তান ছেলেটার আচার ভালো। কথায় মানুষকে ভোলাতে ভালো পারে। তুই কেন ছেলেটাকে বিয়ে করেছিস, আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছি। কিন্তু আমাকে না বলে নিজে নিজে বিয়ে করে ফেলাটা আমাকে কষ্ট দিয়েছে। ছেলেটা বেকার। জঙ্গলের একটা ভুতুড়ে বাড়িতে থাকে। বোন প্রতিবন্ধী। সারাটা দিন শুধু রহিমদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। পাশের বাসার রাহেলা থেকে শুনেছি, ওদের সাথে মিলে চুরি ডাকাতিও করে নাকি! কি খায়, কিভাবে চলে, কেউ কিচ্ছু জানে না। এমন ছেলের সাথে আমি তোকে কিভাবে মেনে নেই অটবী? তুই-ই বল?”
মায়ের কষ্ট-টা অটবী বুঝে। সেদিন বিয়ে করার পর কোথাও যেন একটু খারাপও লেগেছিল তার। মনে হয়েছিল, আম্মাকে না বলে বিয়ে করাটা উচিত হয়নি। এত তাড়াহুড়ো না করলেও চলতো। কিন্তু সে এ-ও জানে, সেদিন বিয়ে না করলে অটবী হয়তো ত্রিস্তানকে আর কখনো পেত না। হারিয়ে ফেলতো। সে ভয় থেকেই অটবী একটু স্বার্থপর হয়েছে। শুধুমাত্র নিজের চিন্তা করেছে। নিজের ভালোর জন্য, সামান্য সুখের জন্য স্বার্থপর হওয়া কি পাপ?
চোখে ছলছল করা পানিটুকু বহুকষ্টে দমালো অটবী। কেমন করে যেন বললো, “আমি শুধু একটু ভালো থাকতে চেয়েছিলাম, আম্মা। ত্রিস্তানের কাছে আমি সেই ভালো থাকার ভরসা পাই।”
রেবা বেগম যেন একটু চমকালেন। মেয়ের মাসুম চেহারার দিকে চেয়ে রইলেন অনেক্ষণ! এমনিতেও তাকে থাপ্পড় মেরে অপরাধ বোধে ভুগছিলেন তিনি। বাপ মারা যাওয়ার পর মেয়েটা তো তার কম কষ্ট করেনি। বরং তিনিই বেশি অধিকার দেখিয়ে ফেলেছিলেন। মেয়ে বড় হয়েছে, তার নিজস্ব মত আছে, জীবন আছে! তবুও কোথাও যেন সল্প অভিমান আর দুঃখের জট রয়েই যায়।
পানের জিনিসপাতিগুলো একে একে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালেন রেবা বেগম। রান্নাঘরে অনেক কাজ পরে আছে। নাস্তা বানাতে হবে। চলে যেতে যেতে তিনি আবারও বললেন, “ছেলেটাকে একবার আসতে বলিস। বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে, তোকে আর এখানে রাখা উচিত হবে না।”
অটবী থমকালো, ভড়কালো। ভেবে পেল না, তার কি এখন খুশি হওয়া উচিত? প্রচন্ড খুশিতে লাফানো উচিত? কিন্তু সে তো তা পারছে না। ডের বুঝতে পারছে, রেবা বেগম এখনো কষ্টে আছেন, অভিমান করেছেন। মায়ের এহেন বিষাক্ত অভিমানে অটবী কি করে খুশি হবে? আনন্দ করবে? সে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। পাটি মুড়িয়ে গুছিয়ে রাখলো। অন্যমনস্ক হলো। তার জীবনে আনন্দ বলতে কিছু নেই। যা আছে সব কালো কালো ধোঁয়া, স্পষ্ট অন্ধকার!
–
বাবা মারা যাওয়ার পর কখনো বিশেষ কোনো স্বপ্ন দেখা হয়নি অটবীর। কিন্তু ত্রিস্তান যখন তার জীবনে এলো? ভুলেভালে একটা অবাস্তব স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল সে। ভয় পেয়েছিল, তা কখনো সত্য হবে না। অথচ এখন যখন স্বপ্ন পূরণ হলো? এখনো অটবী ভয় পাচ্ছে। প্রচন্ড ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে। কি ভীষণ বিচ্ছিরি ব্যাপার!
ঘড়িতে তখন সকাল এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট। সোফায় বসে ত্রিস্তানকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে অটবী। মেঝেতে এলোমেলো হয়ে পরে আছে বাজারের ব্যাগ। ত্রিস্তান সেটা আরও এলেমেলো করে দিচ্ছে। সবকিছু ঘাটাঘুটি করা শেষে ত্রিস্তানের ছোট্ট প্রশ্ন, “কি খাবে? কি বানাবো?”
—“আপনি এখব রান্না করবেন?”
ত্রিস্তান হঠাৎ একটু এগিয়ে এলো। গালে লেগে থাকা হালকা অশ্রুর দাগ বুড়ো আঙুলের চাপে মুছতে চাইলো যেন। পরপরই আচমকা গালে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে সরে দাঁড়ালো সে। তড়িৎ স্পর্শ! অথচ স্পর্শের রেশ দীর্ঘ। হতভম্ব অটবী অবাক নয়নে ঝটপট তাকালো। অথচ ত্রিস্তান তখনো নির্বিকার, নির্লিপ্ত!
—“যে এনার্জি নিয়ে কাঁদছিলে! এতক্ষণে তো ক্ষুধা লেগে যাওয়ার কথা। ক্ষুধা লাগেনি?”
বলতে বলতে বাজারের ব্যাগ থেকে ডিমগুলো আলাদা করে রাখতে লাগলো ত্রিস্তান। আবারও বললো, “এভাবে কাঁদছিলে কেন, অটবী? মনে তো হচ্ছিল গলা ফাঁটিয়ে এক্ষুণি বলবে, আমাকে দিয়ে আসুন তো ত্রিস্তান! বিয়ে-টিয়ে বাদ। আমি আপনার সাথে থাকতে পারবো না।”
চুমুর রেশটুকু কাটাতে অল্প সময় নিলো অটবী। ধাতস্থ হলো। ত্রিস্তানের বলার ঢং দেখে ভ্রু কুঁচকে সুধালো, “বিদায়ের বেলাতে সব মেয়েরাই কাঁদে। সেটা এভাবে বলার কি আছে?”
—“বিদায়ের বেলাতে মেয়েরা মা-বাবা, ভাই-বোন যত গুষ্টির মানুষ আছে ওদের ধরে ধরে কাঁদে। তোমার মা বোনের সামনে তো তোমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি বেরোলো না! পুরো রাস্তাতেও চুপচাপ ছিলে। কেঁদেছ এই জঙ্গলে, আমার বুক ভাসিয়ে। নতুন ইস্ত্রি করা শার্ট অটবী! কি করলে বলো তো?”
অটবী আশ্চর্য হলো। বড়োবড়ো চোখে চেয়ে অভিযোগ জানালো, “আপনি তখনো শার্ট নিয়ে আমাকে একশটা কথা শুনিয়েছিলেন! এখনো আপনি সেই শার্ট নিয়েই পরে আছেন? সমস্যা কি ত্রিস্তান? শার্টটা কিন্তু আমি একদম ছিঁড়ে ফেলব!”
—“No Your Highness, you’ll be in big trouble if you tear up my shirt when I’m still wearing it.”
মাছি তাড়ানোর মতো করে চলে গেল ত্রিস্তান, রান্নাঘরে। কি বানাবে কে জানে! কয়েকটা ডিম আর ডাল নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেছে। পাঁচ মিনিট গড়ালো, দশ মিনিট গড়ালো! লোকটার আর দেখা পাওয়া গেল না। বসে বসে অলস সময়টাতে আরেকদফা ঘরের আনাচে কানাচে দেখতে লাগলো অটবী। একটু দূরে তার জামাকাপড়ের ব্যাগ পরে আছে। এগুলো সে কোথায় রাখবে? ত্রিস্তানকে জিজ্ঞেস করা দরকার।
দৈবাৎ, সরোজের কণ্ঠ শোনা গেল, “আরেহ্! অটবী আপু যে? এক্কেবারে চইলা আসছেন নাকি?”
অটবী নজর ফেরালো। ত্রিস্তানের ঘর থেকে মাত্র ঘুম শেষে উঠে এসেছে সরোজ। চোখে মুখে এখনো তন্দ্রা স্পষ্ট! পরনে ঢিলাঢালা প্যান্ট, গেঞ্জি। সরোজকে দেখেই অটবী একটু বিরক্ত হলো, “ক’টা বাজে, সরোজ? এত বেলা পর্যন্ত কেউ ঘুমায়?”
সরোজ মাথা চুলকালো, “তনয়া আপুও তো ঘুমায়।”
—“ও ঘুমাতেই পারে। ওর কি তোমার মতো পড়ালেখা আছে?”
আরেকদফা মাথা চুলকালো সরোজ। বোকা হেসে আবারও একই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এক্কেবারে চইলা আসছেন আপু? সাথে কাউরে আনেন নাই?”
—“কাকে আনবো? তুমি কি নলীকে এক্সপেক্ট করছিলে?” প্রশ্নটা একটু গাঢ় কণ্ঠে শুধাতেই মাথা নাড়ালো সরোজ। এদিক-ওদিক, লাগাতার! দাঁত দিয়ে ভিজ কামড়ে দৃঢ়তা নিয়ে বললো, “না, না! তা করমু ক্যান? এমনিই কইতেছিলাম, যদি কাউরে আনেন। হে হে।”
সরোজ আর দাঁড়ালো না। ছুট লাগালো সেই রান্নাঘরেই।
–
ঘণ্টাখানেক যেতে না যেতেই খিচুরি নিয়ে হাজির হলো ত্রিস্তান। এটুকু সময়ে অটবী বসে বসে গল্পের বই পড়ছিল। সরোজ দিয়ে গেছে। খাবার আসতেই খিচুরির মন ভোলানো ঘ্রাণে মনটা আনন্দে ভরে উঠলো অটবীর। বই রেখে ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। খিচুড়ির সাথে ডিম ভাঁজা, বেগুন ভাঁজা আর আচারও আছে। সরোজ তখন তনয়াকে ঘুম থেকে ডাকতে চলে গেছে। অটবী বললো, “সব কাজ কি আপনারা ছেলেরাই করবেন? আমাকেও কিছু করতে দিন। আমার এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”
ত্রিস্তান সবার প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছিল। অটবীর কথায় একপলক তাকালো। হেসে বললো, “তোমার এখন কাজও করতে ইচ্ছে হয়?”
—“আমি মজা করছি না, ত্রিস্তান!”
—“আচ্ছা! লেবু নিয়ে আসো তবে। রান্নাঘরে ভুলে রেখে এসেছি।”
অটবী দেড়ি করলো না। একছুট লাগালো রান্নাঘরে। ফ্রিজ খুলতে খুলতে শুনতে পেল, ডাইনিং থেকে ত্রিস্তান বলছে, “লেবু কিন্তু চুলার পাশে রাখা আছে, অটবী।”
ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। অটবী ফ্রিজ খুলে ফেলেছে, থমকেছে। চোখের একদম সামনাসামনি দুটো লাল তরলের ব্যাগ! দৃশ্যমান। অটবী যেন ক্ষীণ কেঁপে উঠলো। জাদুজালে আটক রমণীর ন্যায় ওগুলো ছুঁতে চাইলো। ওমনি ত্রিস্তানের হাঁক, “কই অটবী? পাওনি?”
সঙ্গে সঙ্গে আবারও হাত গুটিয়ে নিলো অটবী। একপলক তরল রক্তগুলোকে দেখে নিঃশব্দে ফ্রিজ বন্ধ করলো। ঢোক গিলে কোনোমতে উত্তর দিলো, “পেয়েছি। আনছি।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
প্রিয় পাঠক, আমার যে একটা ই-বুক বের হয়েছে তা জানেন কি? প্রথম ই-বুক, তা নিয়ে একটু চিন্তিত। আপনাদের পাশে থাকাটা অন্তর থেকে কামনা করছি। ই-বুক লিংকটা কমেন্টে আছে। এবং অবশ্যই, সবাইকে ভালোবাসা❤