অটবী সুখ
১৯.
নিস্তব্ধ ঘরটাতে হৃদযন্ত্রের ধুকধুক ধ্বনি স্পষ্ট। আলাদা কোনো শব্দ নেই, কথা নেই। ত্রিস্তান তখনো চোখ বুজে রেখেছে। অটবীর গাল ধরে রাখা তার হাত দু’টো স্থির নেই। অসম্ভব কাঁপছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে অটবী দেখলো, ত্রিস্তান তার অতি নিকটে। রুঢ়ভাবে কপাল কুঁচকে আকাশের মতো বিষাদ নিয়ে লেপ্টে আছে। না পাওয়ার এক সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা চারিদিকে মৌ মৌ করে ছড়িয়ে যাচ্ছে যেন। এত বিষাদে ভরা কেন লোকটা? একটু মন খুলে কি হাসতে পারেনা? এত কষ্ট কিসের?
কর্মহীন পরে থাকা হাতটা ত্রিস্তানের হাতের পিঠে আলতো করে রাখলো অটবী। আটকে আসা কণ্ঠে ডাকলো, “ত্রিস্তান?”
ত্রিস্তান শুনলো। শেষ বারের মতো প্রিয়তমাকে অতি নিকট থেকে ছুঁয়ে, দেখে সরে দাঁড়ালো আস্তে আস্তে। বেদনায় নিমজ্জিত মুখটা মুহুর্তেই কঠিন করে অটবীর দিকে দৃষ্টি ফেলতেই খেয়াল করলো, মেয়েটা আশ্চর্য চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। চোখে ভয়। মনে আতঙ্ক। ঠোঁট কাঁপছে কিছু বলার জন্য। ত্রিস্তানের ভ্রু কুঁচকে গেল হঠাৎ করেই। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে?”
ভারী আওয়াজে একটু চমকালো অটবী। দমবন্ধকর গলায় শুধালো, “আপনার কি হয়েছে ত্রিস্তান? আপনি কি সত্যিই অসুস্থ?”
ভ্রুটা যেন আরেকটু বেঁকে গেল। অটবীকে গভীর চোখে দেখতে গিয়ে জিভে এক বিশ্রী নোনতা স্বাদ উপলব্ধি করলো ত্রিস্তান। চট করে নাকের কাছে হাত ছোঁয়ালো। রক্ত! নাক থেকে আবারও রক্ত ঝরছে! হাহ্! বিরক্তিকর এক নিশ্বাস ফেলে টেবিল থেকে রুমাল নিলো ত্রিস্তান। যেমন তেমন করে রক্ত মুছতে মুছতে আদেশের সুরে বললো, “এখান থেকে যাও অটবী। আর কখনো এঘরে আসবে না।”
অটবী চরম অবাধ্য হলো। নিজ জায়গা থেকে এক পাও নড়লো না। জোর গলায় বললো, “উত্তর দিন আগে। আপনি কি অসুস্থ?”
—“হলে? চিকিৎসা খরচ দিয়ে উদ্ধার করবে আমায়?”
নিশ্বাসের গতি কমে নেই হয়ে গেছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বিশ্রীরকমের অনুভূতি লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে অটবী। কিন্তু হচ্ছে না। উদাস এক ব্যর্থতা দুমড়েমুচড়ে নস্যি করে দিচ্ছে প্রতিবার। অটবী কখনো কারো সামনে কাঁদে না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বুঝতে শিখেছে, নিজের দূর্বলতা কাউকে দেখাতে নেই। এই কঠিন নীতি মেনে চলা মেয়েটা সর্বদাই জয়ী, সফল। তবে আজ কি হলো? কান্না কিছুতেই থামাতে পারছে না কেন? চোখের কোণ ঘেঁষে একের পর এক অশ্রুকণা গালের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। অথচ নিজের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দিয়ে ত্রিস্তান একবারও তাকে চেয়ে দেখছে না। কেন দেখছে না?
ত্রিস্তানের কাছে এক পা এগিয়ে লোকটার সামনাসামনি দাঁড়ালো অটবী। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বললো, “আমি আপনার থেকে দূরে দূরেই ছিলাম ত্রিস্তান। আপনি কাছে এসেছেন। আমাকে দূর্বল করেছেন। এখন এর দায়ভার নিতে ভয় পাচ্ছেন কেন? আগে মনে ছিল না? কষ্ট কি শুধুই আপনার হয়? আমার নেই?”
ত্রিস্তান দৃষ্টি সরালো না। গভীর চোখে চেয়েই রইলো। ক্ষীণ গলায় উত্তর দিলো, “আমার কষ্ট সহ্য করার অভ্যেস আছে, অটবী। তোমার নেই।”
—“আমি অভ্যেস করে নেব। আপনি শুধু আমাকে সত্যটা বলুন।”
—“তুমি আমাকে ঘৃণা করবে, অটবী। এর চেয়ে আমি তোমাকে নাই-ই পেলাম।”
অটবীর গাল গড়ানো জলগুলো মুছে দেওয়ার বড্ড স্বাদ জাগলো তার। হাত বাড়াতে গিয়েও কি মনে করে আবার গুটিয়ে নিলো। টেবিলের পাশে ডাস্টবিন আছে। সেখানে রক্তে রঞ্জিত টিস্যুটা ফেলে আস্তে করে বললো, “আমার ঘুম পাচ্ছে অটবী। ঘুমাবো। তুমি এখন যাও।”
অটবী গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মনে হলো, ত্রিস্তানের হাঁটু কাঁপছে। সে ধপ করে বসে পরলো বিছানায়। মুহুর্তেই পাশ ড্রয়ার থেকে কি যেন হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলো। দেখা গেল, ছোট্ট একটা কৌটা থেকে কিসের যেন তিনটে ঔষধ নিচ্ছে সে। পানির গ্লাসটা ওঠাতে গেলেই মেঝেতে পরে গেল সেটা। ত্রিস্তান অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। অথচ মুখটা তখনো কঠিন, রুক্ষ।
অটবী দেড়ি করলো না। ছুটে গিয়ে ত্রিস্তানের পাশে বসলো। কাঁধে হাত রেখে উদগ্রীব কণ্ঠে একাধারে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এমন করছেন কেন ত্রিস্তান? বেশি খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকি? শুনুন না! ত্রিস্তান?”
ত্রিস্তান জবাব দিচ্ছে না। একটা হাত কপালে চেপে ঝুঁকে আছে। অটবীর ভয় বাড়ল। দিকবেদিক শূণ্য হয়ে সরোজকে ডাকতে নিলেই থামিয়ে দিলো ত্রিস্তান।
—“পানি খাবো।”
মেঝেতে পরা গ্লাসটা কাঁচের হলেও ভাঙ্গেনি। অটবী সেটা উঠিয়ে আবার পূণরায় পানি ঢাললো। ঔষধ সহ ত্রিস্তান সেটা গিললো মাত্র। কিন্তু তবুও শান্তি মিলছে না। বুক জ্বলছে, চোখ জ্বলছে। বুকের ব্যথাটাই বরং বেশি।
ত্রিস্তানকে কোনোমতে শুইয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো অটবী। লোকটা কিছুতেই শুতে চাইছিল না। ত্যাড়া আচরণ করছিল। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, “এখন কেমন লাগছে? ঠিক আছেন এখন?”
ত্রিস্তান সে উত্তর দিলো না। অতি গোপনে অটবীর একটা হাত শক্ত করে মুঠোয় পুরে নিলো। ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে কেমন করে যেন বললো, “এই অটবী! আমার কিন্তু তুমি ছাড়া কেউ নেই।”
লোকটা ঘুমিয়ে গেছে। তখনো গভীর করে ধরে রেখেছে তার হাত। অটবীও ছাড়লো না। ধরে রইলো। এরমাঝে অবশ্য সরোজ আর তনয়াও একবার এসেছিল, আওয়াজ শুনে। কিন্তু তাদের এভাবে দেখে তনয়াকে জোড় করে টেনে নিয়ে গেছে সরোজ। আর আসতে দেয়নি।
–
ঘড়িতে একটা বেজে সাত। এ বাড়ির আশেপাশে মসজিদ না থাকলেও সুদূর থেকে আযানের ক্ষীণ সুর কানে ভেসে আসছে। খোলা জানালার বামদিকে দুটো চড়ুই বসে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। মাথা এদিক-ওদিক করে গভীর পর্যবেক্ষণ করছে যেন। অটবী সেখান থেকে দৃষ্টি সরালো। দুঃখ মানব গভীর তন্দ্রায় বিভোর। নিশ্বাসের আনাগোনা প্রচন্ড ধীর, ক্ষীণ। হাতের বাঁধনও আলগা হয়ে গেছে। খুব ক্লান্ত কি? হওয়ারই কথা।
ত্রিস্তানের প্রতি অটবী ঠিক কখন দূর্বল হয়ে পরেছিল, এ প্রশ্নের উত্তর আদৌ তার জানা নেই। হয়তো দূরে দূরে থাকতে গিয়েই ক্রমশ অধঃপতনের দিকে পা বাড়াচ্ছিল। পা বাড়াতে বাড়াতে এখন অনেকটা পথ পেরিয়ে গেছে। ফিরে যাওয়াটা এখন ভীষণ কষ্টকর, প্রায় অসম্ভব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ত্রিস্তানের গাল আলতো করে ছুঁয়ে দেখলো অটবী। ঠান্ডা হয়ে আছে। আঙুলের ছোঁয়াটা গালের সবটুকু জায়গায় ঘোরালো। লোকটার অতীত সম্পর্কে সে অত শত জানে না। যেটুকু জানে, সেটুকু তার বিশ্বাস করতে খুব অবাক লাগে। এ জানার মাঝেও অনেক কিছু লুকানো আছে, আড়ালে আছে। ত্রিস্তান জ্বরের ঘোরেও সেসব কথা মুখে আনেনি।
অটবীর চোখে ভাসে, সেদিন বৃষ্টির রাতে ত্রিস্তানের অবুঝপনা। একদম নিষ্পাপ শিশুটি হয়ে যাওয়া। ত্রিস্তান যেন তখন অন্য মানুষ। কৃত্রিমতার ছিঁটেফোঁটাও নেই। উদাস এক ব্যক্তি হয়ে একমনে চেয়ে ছিল অটবীর মুখপানে। মাদকতা নিয়ে বলেছিল, “তোমাকে আমার বুকে গুঁজে রাখতে ইচ্ছে হয়, অটবী। বুকে আসবে?”
অটবী তখন কিছু বলতে পারেনি। চুপ করে ছিল। এই চুপ করে থাকার সময়টাতেই ত্রিস্তান কতকিছু যে বলেছে! ও-কে নিয়ে, ওর মাকে নিয়ে, ওর বাবাকে নিয়ে। এইযে! এই সুন্দর ছেলেটা আগে প্রচন্ড রকমের খারাপ ছিল। পুরো দিন-রাত নেশায় বুদ হয়ে থাকা ছিল তার একমাত্র কাজ। ঠিকঠাক ভাবে খেতো না, ঘুমাতো না। পড়ালেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। ড্রাগস্-এর নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল ত্রিস্তান। ত্রিস্তানের বাবা তাই ছেলের এ অবস্থা দেখতে পারছিলেন না। তার এত স্বাদের ছেলে! সুস্থ ছেলে! এমন হয়ে গেল কিভাবে? ছেলেকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ত্রিস্তানের বাবা-মায়ের মাঝে ঝগড়া হতো। দুজনেই দুজনকে দোষারোপ করছে, আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে, “তুমি ভুল!”
ঝগড়ার একপর্যায়ে ভালোবাসাটা যেন কোথাও লুকিয়ে গেল। দূরত্ব বাড়লো। অভিমান বাড়লো। ত্রিস্তানের বাবা আলাদা রুমে শুতে লাগলেন। কিন্তু তখনো ত্রিস্তান তার মতো। নির্বিকার। চোখের সামনে বাবা-মায়ের ঝগড়াটাও যেন তার বিবেক নাড়াতে পারছিল না।
ত্রিস্তানের মা, ডায়না আলবার্ট। বিয়ের পর হলেন ডালিয়া হোসাইন। ভীষণ দূর্বল, প্রিয়জন প্রিয় মানুষ। সম্পর্কের এই তিক্ততা, জটিলতা মেনে নিতে পারেননি। এক মধ্যরাত্রিতে ঝগড়ার মাঝখানে হাতের রগ কেটে ফেলেছিলেন। ভালোবাসায় যেন তখনই টান অনুভব হলো। ত্রিস্তানের বাবার সম্বিৎ ফিরলো। স্ত্রীকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। কিন্তু তারপর… তারপর পরিস্থিতি পুরো পালটে গেল। কার এক্সিডেন্টে আহত-নিহত হলেন ত্রিস্তানের বাবা-মা। ত্রিস্তান যখন এ খবর শুনেছে, তখন রাত পেরিয়ে সকাল। নেশায় বুদ হয়ে পরেছিল বিছানার একপাশে। তনয়া আট মাসের ভরা পেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ডাকছিল ভাইকে। ত্রিস্তান উঠছিল না। তার চোখে যে তখন কি ঘুম! এত ঘুম পাচ্ছিল কেন? রাতে বেশি নেশা করে ফেলেছিল বলে?
ত্রিস্তানের চোখের কালো দাগে হাত বুলালো অটবী। পরক্ষণেই কি মনে করে দ্রুত ড্রয়ারটা টান দিয়ে খুললো। ত্রিস্তান যে ঔষধগুলো খেয়েছিল তার কৌটা সাদা রঙের। সামনে-পেছনে-উপরে-নিচে কোথাও সামান্য লেখা নেই। সম্পূর্ণ ফাঁকা। ড্রয়ারে যদি কিছু থাকে! তবে আফসোস! তন্য তন্য করে খুঁজেও তেমনে কিছু পেল না অটবী। শুধু এক ডায়েরি ছাড়া। ডায়েরির আগাগোড়ায় কয়েকটা কবিতা লেখা। কবিতার একদম শেষে অচেনা নামও উল্লেখ করা। ‘সৈয়দ শাহ্জাহান!’ এটা কে হতে পারে? অটবী অতসবে গেল না। এক এক করে সব পৃষ্ঠা দেখতে লাগলো। সর্বশেষ পৃষ্ঠাটায় গুটিগুটি করে লিখা,
“প্রিয় অরণ্য, আমার কেন যেন মনে হয়, তুমি সুখী হবে। কোনো এক সুখী মানুষের সাথে ঘর বাঁধবে। সেই ঘরের নাম দেবে ‘অটবী সুখ’। সেই ঘরের কোথাও আমি থাকবো না। আমার অস্তিত্ব থাকবে না। অথচ তোমাকে চোখের আড়ালও হতে দেবো না। তুমি যখন ফুটপাত দিয়ে প্রিয় মানুষটার হাত ধরে হাঁটবে, আমি দূরে দাঁড়িয়ে তোমায় দেখবো। তোমার হাসিটুকু দেখে নিজেও হাসবো…
এই অটবী! এই মানুষটা অন্যের জেনেও তাকে ভালোবাসা কি পাপ হবে? আমি কি আজীবন পাপী হয়ে থাকবো?”
স্তব্ধ অটবী খামচে ধরলো ডায়েরিটা। হাত, পা কাঁপছে। ভেতরটা নিদারুণ নিষ্ঠুরতায় তিরতির করছে। টলমলে চোখদুটো ত্রিস্তানের পানে স্থির হতেই মস্তিষ্কে টান লাগলো, ত্রিস্তান বলছে, “আমি আমার বাবা-মায়ের মতো হতে চাইনি, অটবী। আমি তাকে রুমে আটকে রাখতে চাইনি।”
সেদিনের মতো। সেদিনের সেই বৃষ্টির রাতের মতো ত্রিস্তান আবারও একই কথা বলছে।
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা