পুনরারম্ভ, পর্ব-১

0
522

পুনরারম্ভ, পর্ব-১
লেখক- ইতি চৌধুরী

ওটি থেকে বের হয়ে আসতেই মায়ের মুখোমুখি পরে ডাক্তার অতুল সিকদার। এমনসময় মাকে এখানে দেখতে পাবে তা চিন্তাও করেননি। সুন্দর মুখশ্রীর জোড়া ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ বাঁকা করে কয়েক কদম এগিয়ে এসে মার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভালো মতো তাকে পর্যবেক্ষণ করে জানতে চান,
‘তুমি এই সময় এখানে!’
‘জলদি কাপড় বদলে নে। আমরা এখনই বের হবো।’
‘মানে কোথায়?’
‘কোথায় মানে আবার কি? গতকাল না বললাম আজ আমরা তোর জন্য পাত্রী দেখতে যাব।’
‘উফ মা! আবার শুরু করলে? আমি তো বলেই দিয়েছি এখনই বিয়ে করার ইচ্ছা নেই আমার। আর কয়টা বছর সময় দাও আমাকে। নিজের ক্যারিয়ারটা আরেকটু মজবুত করি। তারপর না হয় করা যাবে। বিয়ের তো একটা সময় আছে তাই না?’
বাজখাঁই কন্ঠে ছেলেকে ধমকে ওঠেন আনোয়ারা খানম।
‘একদম চুপ। তোর বিয়ের সময় হয়েছে কি হয়নি তা তুই আমার থেকে বেশি বুঝিস? এ্যা বড় ডাক্তার হয়ে সে পন্ডিত হয়ে গেছে। নিকুচি করি আমি তোর ডাক্তারির। তুই আমাকে পেটে ধরিসনি বরং আমি তোকে পেটে ধরেছি। তাই আমি যা বলবো তুই চুপচাপ তাই করবি। জলদি কাপড় বদলে নে, কুইক।’
অসহায় অসহায় মুখোভাব করে অতুল আরেকবার চেষ্টা করে।
‘মা প্লিজ। অনেক বড়ো একটা অপারেশন অ্যাসিস্ট করেছি। আমি ভীষণ ক্লান্ত প্লাস ক্ষুদার্ত।’
‘তুই যদি বাড়তি আর একটা কথাও বলিস।’
অতুলের বুঝা হয়ে যায় কাজ হবে না। পাত্রী তাকে দেখতে যেতে হবেই। সেই সকাল ৮ টায় ওটিতে ডুকেছে এখন ঘড়িতে বাজে বেলা ১২টা। টানা ৪ ঘন্টা ওটি অ্যাসিস্ট করেছে সে। সত্যি ভীষণ ক্লান্ত লাগছে সেই সাথে পেটের ভেতর খুদাও তার অস্বস্তি জানান দিচ্ছে। এই মুহূর্তে সে না তো পারবে বিশ্রাম করতে আর না পারবে কিছু খেতে। দুইটাই বড্ড প্রয়োজন তার। কিন্তু মায়ের আদেশ অমান্য করাও অসম্ভব তার পক্ষে। মা ভক্ত ছেলে বলে কথা। পাত্রী দেখতে যাওয়ার আগ্রহ না থাকলেও যেতে হবে অতুলকে। এমনকি এই মেয়ে যদি তার মায়ের পছন্দ হয়ে যায় তাহলে বলা বাহুল্য বিয়ে তাকে করতেই হবে এবং কি সে করবেও। তার ব্যক্তিগত কোনো পছন্দ নেই। পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে গিয়ে কখনো কোনো মেয়ের দিকে সেভাবে তাকানোর সময় পায়নি বেচারা। তাই তার বউ কে হবে সেই দায়িত্ব সে চোখ বন্ধ করে মার উপর ছেড়ে দিয়েছে। মা যাকে পছন্দ করবে অতুল বিনাবাক্যে তাকেই বিয়ে করে নিজের জীবন সঙ্গী করে নেবে।
ফ্রেস হয়ে কাপড় বদলে পার্কিং এ আসতেই অতুল দেখতে পায় তার গুষ্টির মনে হয় কেউ বাকি নেই। সবাইকে দেখে তার চক্ষু কপালে। বড়ো বোন, বোন জামাই বাবা, মা ছোট ভাই অমর এমনকি বড়ো বোনের মেয়ে টুনটুনিও বাদ পরেনি। সবাইকে দেখে এগিয়ে এসে বিষ্ময় দৃষ্টি নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ঘটনা কি আম্মু? গেতি গুষ্টুির দেখছি কাউকে বাদ রাখোনি। সত্যি করে বলো তো মেয়ে দেখতে যাচ্ছি নাকি সব ফাইনাল করেই রেখেছে আজ আমাকে হালাল করতে এভাবে ধরে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছো।’
ধমকের সুরে আনোয়ারা খানম বলেন,
‘এসব কোন ধরনের কথা। গেতি গুষ্টি পেলি কোথায় তুই? তোর জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি এই কয়জন অন্তত যাব না তা কি হয় নাকি?’
অতুল কিছু বলার আগে তার একমাত্র বোন জামাই শরিফ বলেন,
‘শালাবাবু মনে হয় খুশি হয়নি আমরা আসায়। অনু চলো আমরা বরং ফিরে যাই।’
এবার অতুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অনু মানে অনামিকা অতুলের বোন বলে,
‘এমন কথা বলতে পারলি তুই অতুল? আমরা কি তোর পর?’
‘ওমা আমি কখন তোদের পর বললাম আপু?’
‘এই তো মাত্রই বললি গেতি গুষ্টি।’
‘গেতি গুষ্টি কি পর হয় নাকি?’
‘থাক থাক আর বলা লাগবে না। আমরা বরং চলেই যাই আম্মু তোমরা গিয়ে মেয়ে দেখে আসো। চলো টুনটুনি আমরা বাসায় চলে যাই।’
‘হইছে আমার বইন। মাফ কর। আমারই ভুল হইছে। তোদের ছাড়া কি আমি পাত্রী দেখতে যাইতে পারি বল। তোরা না গেলে তো আমি বিয়েই করব না।’
এতক্ষণে অমর মুখ খুলে বলে,
‘ভাইয়া তুমিও না পারো বটে। এখন কি তোমরা দুইজন এখানে দাঁড়ায় দাঁড়ায় নাটক করবা না আমরা আসল কাজটা করতে যাব?’
এতক্ষণ আনোয়ারা খানমও ছেলে মেয়ের কান্ড দেখলেও এখন তার টনক নড়ে। তাড়া দিয়ে বলেন,
‘অনেক হইছে সবাই গাড়িতে উঠো জলদি। দুপুরের দাওয়াত আমাদের। এখানেই তো ১ টা বাজতে চলল। আমরা কি বিকালে গিয়ে পৌছাবো নাকি?’
মায়ের তাড়ায় আর কেউ কথা বাড়ায় না। এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের জন্য আনোয়ারা খানমের কথাই শেষ কথা। তাকে সবাই ভীষণ সমিহ করে চলে। এমনকি আলতাফ সিকদারও বউয়ের কথার পরে আর কথা বলেন না। বউকেই তিনি সংসারের প্রধানের দায়িত্ব দিয়ে দিব্যি আছেন। বউয়ের উপর সংসার, সন্তানদের ভার ছেড়ে দিয়েছেন তার প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস থেকেই। আলতাফ সাহেব জানেন বউ তার ঠিক ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবে। তার সংসারটাকেও সুখে ভরিয়ে রাখবে। হয়েছেও তাই। অনামিকা, অমর, টুনটুনি, শরিফসহ তার গাড়িতে উঠেছে। আর বাবা মাকে নিয়ে নিজের গাড়িতে উঠেছে অতুল। গাড়িতে উঠে বসতেই আনোয়ারা খানম ছেলের হাতে একটা ছোট বক্স ধরিয়ে দেন। তিনি ভালো করেই জানেন দীর্ঘ সময় অপারেশন থিয়েটারে থাকার পর ছেলে তার যতটা ক্লান্ত ততটাই ক্ষুদার্ত। তাই আসার সময় ছেলের জন্য একবক্স ফ্রুট সালাদ বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। মাকে তো সন্তানের প্রয়োজন, অপ্রয়োজন সব বুঝতে হয়।

ক্লাস শেষ হতে না হতেই তড়িগড়ি করে বেরিয়ে পরার জন্য পা বাড়ায় সেহের। ইউনিভার্সিটির মেইন গেইট পর্যন্ত আসতে না আসতেই পেছন থেকে কেউ একজন তার হাত ধরে ফেলে। থেমে গিয়ে পেছন ঘুরে মাহিরকে দেখে কান থেকে ফোন নামিয়ে সেহের বলে,
‘তোমার ফোন অফ কেন? কতবার ফোন দিচ্ছি জানো?’
‘ফোনে চার্জ নেই তাই বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘রাতে চার্জ দাও নাই? এতক্ষণ কই ছিলা তুমি? ক্লাসে আসো নাই কেন?’
‘এক ফ্রেন্ডের সাথে একটা কাজে বিজি ছিলাম।’
‘কী কাজ?’
‘ঐ আছে একটা কাজ তুমি বুঝবা না। এসব বাদ দাও আগে বলো তুমি কই যাইতেছ? ক্লাস তো শেষ হয় নাই এখনো।’
‘শেষ হয় নাই জানি কিন্তু আজ জলদি বাসায় ফিরতে হবে। তাই আজ আর পরের ক্লাসটা করতে পারব না।’
‘কেন?’
‘তা জানি না। আব্বু জলদি বাসায় ফিরতে বলছে।’
হাত ঘুড়িয়ে ঘড়ি দেখে নিয়ে মাহির বলে,
‘সবে বারোটা বাজে। আজ না তোমার আমাকে সময় দেয়ার কথা?’
‘সরি জান একটু বুঝার চেষ্টা করো। আব্বু প্যারা না দিলে আমি একদমই যাইতাম না। কিন্তু আব্বুর কথা অমান্য করা অসম্ভব আমার পক্ষে। জানোই তো আমি আব্বুকে কত ভয় পাই।’
‘আচ্ছা বুঝতে পারছি। চলো আগায় দেই তাহলে।’
এগিয়ে এসে একটা রিকশা ঠিক করে দেয় মাহির মোহাম্মদপুর সলিমুল্লাহ রোডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সেহের রিকশায় উঠে বসতেই মাহিরও তার পাশে উঠে বসে। আচমকা তাকে উঠে বসতে দেখে কিঞ্চিৎ চমকে গিয়ে সেহের জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি উঠলা যে?’
‘তোমাকে দিয়ে আসি। আজ তো আমাদের সারাদিন একসাথে থাকার কথা ছিল। সেটা যেহেতু হচ্ছে না তাই এতটুকু সময় না হয় পাশাপাশি থাকি।’
কথাটা বলতে বলতেই মাহিরের মুখটা মলিন হয়ে যায়। তা দেখে সেহের তার গালটা পরম ভালোবাসার স্পর্শে টেনে দিয়ে বলে,
‘রাগ করে না জানপাখি। আজ হয়নি তো কি হয়েছে? কাল আমরা সারাদিন ঘুরবো ঠিকছে?’
‘সত্যি?’
‘এর চাইতে বড়ো কোনো সত্যি নাই আমার জীবনে।’
সেহেরের কথায় ফিক করে হেসে ফেলে মাহির। তাকে হাসতে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেহের। এই হাসির জন্য সব করতে পারে সে। এই মানুষটাকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসে, প্রচন্ড রকম। পাগল করা ভালোবাসা ভালোবাসে সেহের মাহিরকে। ইউনিভার্সিটির প্রথম দিন থেকে শুরু এই ভালোবাসার।
সেহেরকে প্রথমদিন দেখেই তার প্রেমে পরে গিয়েছিল মাহির। প্রেম পরতে যতটুকু দেরি হয়েছে কিন্তু বলতে কিঞ্চিৎ পরিমানও সময় ব্যয় করেনি মাহির। সেহেররও মাহিরকে পছন্দ হয়নি তা নয়। বরং বেশ ভালো লেগেছিল প্রথম দেখায়। তাই মাহির তাকে মনের কথা জানানোর পর সামান্য দোনোমোনো করলেও বেশি সময় না নিয়েই দু’জনের প্রেমের অধ্যায়ের শুরু। তাদের প্রেম নিয়ে বন্ধুমহলে বেশ আলোচিত তারা। ভার্সিটির প্রথম সেমিস্টারে শুরু হয় তাদের প্রেম। বর্তমানে তারা ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। এই সেমিস্টারের পর আর একটা সেমিস্টার বাকি তাদের বিবিএব শেষ হতে। দু’জনেই ঠিক করে রেখেছে বিবিএ শেষ করেই নিজ নিজ পরিবারে তাদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে দিবে। তারপর পরিবারের সম্মতি নিয়েই বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে একে অপরকে আবদ্ধ করবে দু’জন চিরদিনের জন্য।
রিকশা ধানমন্ডি থেকে মোহাম্মদপুরের উদ্দেশ্য আগাতে থাকে। শংকরের কাছাকাছি আসতেই মাহিরকে আনমনা দেখে সেহের জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার মন খারাপ?’
কিঞ্চিৎ আমতা আমতা করে মাহির বলে,
‘ননা তো।’
‘কি হইছে আমাকে বলবা না?’
‘না মানে আসলে…’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here