অটবী সুখ পর্ব ১৭

0
119

অটবী সুখ

১৭.
আষাঢ়ের ঘর বাঁধার সময় হয়েছে। পথ-ঘাট বৃষ্টির পানিতে পিচ্ছিল। আকাশ মেঘলা। গাছের ডালপালা, পাতা সতেজতায় মোড়ানো। এসময় কড়া একটা ঘুম দিতে পারলেই জীবনটা ধন্য! অথচ অটবীর সেই সুযোগ নেই। বিকেল চারটার মধ্যে তৈরি হয়ে ছুটতে হচ্ছে টিউশনে। হাতে ছোটখাটো ছাতা। কালো রঙের। বাহিরে বৃষ্টি তেমন না হলেও গুড়িগুড়ি ভাব। অটবীর আবার সমস্যা আছে। বৃষ্টিতে ভিঁজতে পারে না। বৃষ্টির পানি শরীরে একটু লাগতেই জ্বর-কাশি শুরু হয়ে যায়।
সাবধানে কদম ফেলে চলতে চলতে অটবী খেয়াল করলো, মোড়ের রাস্তায় ভয়ানক জটলা বেঁধে আছে। অসংখ্য মানুষ, তুমুল ঝগড়ার চিৎকার-চেঁচামেচি! একটু দূরেই ত্রিস্তান, কাদিন আর সরোজ দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিস্তান ঠিক দাঁড়িয়ে নেই, সবসময়কার মতো বাইকে রাজকীয় ভাবে বসে সিগারেটে একেকটা সুখটান দিচ্ছে। ঝগড়ার ওদিকে বিন্দু মাত্র মন নেই। ভাবখানা এমন, এসব অহেতুক জিনিসের প্রতি আগ্রহ দেখালেই তার মহা মূল্যবান সময় গণহারে পাচার হয়ে যাবে। দেশের অসহায় মানুষ সেই পাচার সইতে না পেরে দুর্ভিক্ষে শহিদ হবে। ত্রিস্তান তো আবার মহা দয়ালু! সে তো আর এ অন্যায়টা করতে পারে না! কিছুতেই না।
কিন্তু পাশের দুটো ছেলে আবার অন্যরকম। কাদিন আর সরোজ ভীষণ উৎসুক দৃষ্টে ঘটনাস্থলে তাকিয়ে আছে। কৌতূহলের চটে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে একেবারে। অটবী ওদেরকে কিছুক্ষণ দেখে সামনে পা বাড়ালো। কাছাকাছি আসতেই সরোজ তাড়াহুড়ো গলায় বললো, “তুমি ওই দিকে কই যাইতেছ, অটবী আপু?”

অটবী দাঁড়ালো। আস্তে করে বললো, “পড়াতে যাচ্ছি।”
“আজকে আর যাইও না। এই ঝগড়া বড় হইবো। পুরা এলাকায়ও ছইড়া যাইতে পারে। ওইযে? রাজু আছে না? ওর লগে বিরাট ঝামেলা হইছে। রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার! আইজকা ঘর থেইকা বাইর না হওয়াই ভালো। তুমিও বাসায় চইলা যাও।”

অটবী এসব কখনই পাত্তা দেয় না। এবারও দিলো না। তাছাড়া ছাত্রের কালকে পরীক্ষা। আজকে না গিয়ে উপায় নেই। যেতেই হবে।
সামনে পা বাড়াতে নিলেই কাদিন এবার বিরক্ত হয়ে বললো, “আরে আশ্চর্য! আপনাকে না ওখানে যেতে মানা করলো? তারপরও যাচ্ছেন কেন?”

এই কাদিন ছেলেটাকে অটবীর একদম পছন্দ না। সরোজ থেকেও চার ডবল বেয়াদব। আজ নিয়ে একমাস হচ্ছে সে কাদিনকে আর পড়ায় না। ইলিয়ানা আন্টি যদিও অনেকবার বলেছিলেন, কিন্তু সে যায়নি। তবুও দেখো! একটুও অপরাধবোধ নেই ছেলেটার মাঝে। কেমন নির্লজ্জের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। অটবী তুচ্ছ শ্বাস ফেললো। একদম না শোনার ভান করে চলে গেল মোড়ের রাস্তার ওপাশে।
সরোজের চিন্তা কমলো না। অন্যমনস্ক ত্রিস্তানকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই, ভাবী যে চইলা গেল? এখন যদি কোনো বিপদ হয়?”

সিগারেট-টা রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে পিসে ফেললো ত্রিস্তান। নির্লিপ্ত গলায় বললো, “বিপদ হলে আর কি… কালকে চকলেট নিয়ে তোর ভাবীকে হাসপাতালে সমবেদনা জানাতে চলে যাস।”

কাদিন বোকার মতো প্রশ্ন করলো, “কি চকলেট নিবো? দামি চকলেট নিতে পারবো না। এক টাকার চকলেট পাঁচটা নিলে হবে না?”

সরোজ চটলো খুব। এ নাকি ক্লাসের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট! জেনেরাল নলেজটুকুও নেই! গোবর ভরা মাথা! ক্ষেপে গিয়ে বললো, “অ্যাঁই! তোর এখানে কি? রহিমের পিছে পিছে এ-না লেগে থাকবি! এনে কি? মধু বিলাইতেছি আমরা? যা তো এন থেইকা!”
কাদিন চোয়াল শক্ত করে তাকালো। ত্রিস্তানকে অভিযোগের সুরে বললো, “ওরে কিছু বলো ত্রিস্তান ভাইয়া। দেখো কিভাবে কথা বলছে! সবসময় এমন করে।”
—“ওই! বিচার দেস কারে? ত্রিস্তান ভাই কি তোর মা লাগে? ‘ওরে কিছু বলো ত্রিস্তান ভাইয়া!’ হুহ্! ঢং!”

কাদিন বেজার মুখে চেয়ে রইলো ত্রিস্তানের পানে। কিন্তু আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে হতাশ হলো খুব। নিঃশব্দে কেটে পরলো ওখান থেকে। সরোজ সময় নিলো না। নির্জন একটু ফাঁকফোঁকর পেতেই আবারও অসমাপ্ত কথাটা শেষ করতে চাইলো, “ভাই! তোমার কিন্তু উচিত ছিল ভাবীরে আটকানো।”
—“তোদের ভাবীকে আটকিয়ে আমার কি লাভ?”
—“কারণ, ভাবী তোমার ভবিষ্যৎ বউ।”

ত্রিস্তান কিভাবে যেন হাসলো। তাচ্ছিল্য, অনীহার রেশ স্পষ্ট। ঠাট্টার সুরে বললো, “আমার বউ না, সে অন্যকারো বউ।”
“ধুর! মনে মনে প্রেম করো, অথচ মুখে শিকার করতে চাও না। এই আবার কেমন প্রেম?”

কপালে গুটিকয়েক বলিরেখা দৃশ্যমান হলো। কণ্ঠে বিস্ময়ের মিছেমিছি রেশ এঁকে ত্রিস্তান সুধালো, “এসব আজগুবি খবর কোথা থেকে শুনে এসেছিস? আমি মনে মনে প্রেম করতে যাবো কেন?”
—“অন্যখান থেইকা শুনতে হইবো ক্যান? আমার কি চোখ নাই? চোখ দিয়া দেখছি।”

ত্রিস্তান প্রথমেই উত্তর দিলো না। মিনিট খানেক নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে কিসের যেন হিসেব মেলালো। লুকোচুরি খেলতে আর ভালো লাগছে না। এই শীতল আবহাওয়াও ভ্যাপসা ঠেকছে। হাঁসফাঁস লাগছে। ভেতর থেকে একটা ছোট্ট শ্বাস ঠেলে আসলো। ত্রিস্তান ভীষণ ঠান্ডা গলায় বললো, “মনে মনে প্রেম, ভালোবাসার কিচ্ছু হয়নি, সরোজ। যেটা আছে, সেটাকে টাইমপাস বলতে পারিস।”

“কি কইলা?” সরোজের যেন বিশ্বাস হলো না। তার এত বছরের চতুর চোখ! ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া অটবীর জন্য ত্রিস্তানের তাকানোর ধরণ তো সে কথা বলে না! একদমই না! এনিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল সরোজ। ত্রিস্তান চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, জানা নেই। তাকে যে সাথে নিবে না, তা সরোজ ভালো করেই জানে। আপাতত জরুরি যেটা, সেটা হচ্ছে অটবীর নিরাপত্তা।

সরোজ একরোখা কণ্ঠে তৎক্ষণাৎ বললো, “তুমি এভাবে যাইতে পারো না, ত্রিস্তান ভাই। অটবী আপুরে অনতত বাঁচাও।”

বাইকটা স্টার্ট দিয়ে সরোজের চিন্তিত মুখটা একবার দেখে নিলো ত্রিস্তান। অনেকটা অতৃপ্ত গলায় বললো, “তোর এত চিন্তা হলে তুই যা, ওকে বাঁচা। তারওপরও যদি বাঁচাতে না পারিস আমি আসবো কালকে, হাসপাতালে? তোরা কি চকলেট খাবি, আমাকে এসএমএস করে দিস।”

রাস্তায় বিশ্রী জ্যাম এঁটে আছে। জ্যামের ভেতর খুঁজে খুঁজেও একটা খালি রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না৷ তুমুল বর্ষণে শহরের অবস্থা জুবুথুবু। কারেন্ট আসছে-যাচ্ছে। রাত ক’টা বাজে, অটবীর জানা নেই। হাতঘড়ি পানি লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। ফোনে চার্জ নেই। তবুও কয়েকবার পাওয়ার বাটন চেপে দেখলো সে। নাহ্! চালু হচ্ছে না। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে চারপাশটায় নজর বুলালো অটবী। সে আপাতত কোনো এক দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় একঘণ্টা যাবত। ছাত্রের বাসা থেকে বেরোনোর আগে শেষ সময় দেখেছিল। দেওয়াল ঘড়িতে ন’টা বাজছিল তখন। এখন নিশ্চই আরও রাত হয়েছে? মা বোধহয় এতক্ষণে চিন্তা করে করে প্রেসার হাই করে ফেলেছেন। মায়ের কথা মাথায় আসতেই বৃষ্টিকে আর পরোয়া করতে মন চাইলো না অটবীর। অনেক হয়েছে। আর কত? আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?

দৈবাৎ, বামদিক থেকে কে যেন ছুটে এলো অটবীর কাছে। লম্বা, সুঠাম ধরণের লোক। পরনের কালো শার্ট কনুই অব্দি গোটানো। হাঁটুর ওপর দু’হাত ভর দিয়ে একাধারে নিশ্বাস ফেলছে, নিচ্ছে। নিশ্বাসের আওয়াজ সুস্পষ্ট। গুটি কয়েক চুল ঢেকে রেখেছে সমস্ত কপাল।
অটবী আড়চোখে একবার তাকালো। সঙ্গে সঙ্গেই আঁতকে উঠলো সে। বিমূঢ়তা সামলাতে না পেরে অজান্তেই বললো, “ত্রিস্তান?”

বুকের ভেতরটা বিষাদ যন্ত্রণায় নিমজ্জিত। সারা রাস্তা হন্নের মতো দৌঁড়ে আসায় শরীর ক্লান্ত, মন বেজার। বার কয়েক জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। ঠিক অটবীর পাশে।

—“আপনি এখানে কি করছেন?” প্রশ্নটা অটবীর। সে করতে চায়নি। কিন্তু না করেও শান্তি পাচ্ছিল না। সে যেখানে যায় ঠিক সেখানেই লোকটা এসে হাজির হয়। প্রতিবার তো বিষয়টা কাকতালীয় হবার নয়।
ত্রিস্তান সময় নিলো না। ত্যাড়া কণ্ঠে উত্তর দিলো, “খেতে এসেছি।”
—“কি?”
—“তোমাকে। অনেকদিন মানুষ খাওয়া হয় না।”

ত্রিস্তান যতটা নির্বিকার হয়ে বললো, ততটা সহজ ভাবে নিতে পারলো না অটবী। তৎক্ষণাৎ চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো। আশ্চর্য কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপনার দ্বারা কি একটুও স্বাভাবিক আচরণ হয় না?”
ত্রিস্তান নজর ফেরালো। চোখেচোখ রাখলো। হীম শীতল চাহনি। নিগূঢ় কণ্ঠ, “হয়, অটবী।”

কথাটায় কি যেন ছিল। অটবী আর একটা কথাও বলতে পারলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এক মিনিট, দুই মিনিট, এক ঘণ্টা! মিনিটের কাঁটা ঘুরে ঘণ্টায় ঠেকে গেছে। বৃষ্টি তখনো কমেনি। দোকানপাট বন্ধ করে অনেকেই এই বৃষ্টির ভেতর ভিঁজে ভিঁজে চলে গেছে। মানুষহীন, যানবাহন ছাড়া রাস্তা। বৃষ্টির তীব্র ঝরঝরে শব্দ ছাড়া কানে আর কিচ্ছু আসছে না। পা দুটো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ব্যথায় টনটন করে উঠছে। যেন বলছে, “মাফ চাই, ভাই। আর কতক্ষণ আমাকে এভাবে কষ্ট দিবি? একটু তো কোথাও গিয়ে বয়? এই অসহায়ের ওপর দয়া কর?”

নাহ্! সত্যিই আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। অটবীর শেষ ধৈর্যটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। আর কতক্ষণ? এ বৃষ্টি আজ আর থামবে না। থামার হলে আগেই থামতো। অটবী মনে মনে ভেবে নিলো, এই বৃষ্টির মাঝেই সে বাড়ি ফিরবে। পরে যা হওয়ার হবে। ভিঁজলে ভিঁজবে। জ্বর হলে হবে। এসব পরোয়া করার সময় তার আর নেই।
পলিথিনে মোড়ানো ছাতা বের করে অটবী যেই না এক পা বাড়াবে! ওমনি ওর হাত খপ করে ধরে ফেললো ত্রিস্তান। গাঢ় গলায় বললো, “কোথায় যাচ্ছো?”

অটবী হাতের বাঁধনের দিকে একপলক তাকালো, “বাসায় যাচ্ছি। আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো?”
—“এখন যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আরেকটু অপেক্ষা করো। বৃষ্টি কমে যাবে।”

মিথ্যে কথা। বৃষ্টির যে তীব্রতা, তিন ঘণ্টার আগে এই বৃষ্টি কমবে কি-না সন্দেহ। শুধু শুধু আশায় বসে থাকার কোনো মানে আছে?
ত্রিস্তান থেকে হাত ছাড়িয়ে অটবী বললো, “কমলে কমবে। আমার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না।”
—“তাহলে বসে থাকো। ক্ষুধা লাগলে বলো, কিছু আনার ব্যবস্থা করছি৷ কিন্তু তুমি এখান থেকে যেতে পারবে না।”

বলতে বলতে ত্রিস্তান আবারও অটবীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছে। চোখের দৃঢ়তা স্পষ্ট বলছে, সে কিছুতেই অটবীকে এখান থেকে যেতে দিবে না।
সহসা, অটবী তিক্ত নিশ্বাস ফেললো। কণ্ঠ নমনীয় করে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি চাইছেনটা কি?”
—“বেশি কিছু না। একটু সাথে থাকো।”

ত্রিস্তানের কি দৃষ্টি বদলেছে? চোখের চাহনি? কই? নাতো! সবসময়কার মতো অদৃশ্য কঠিনতাই তো দেখতে পাচ্ছে অটবী। তাহলে হঠাৎ এভাবে কথা বলছে কেন? এখনকার ত্রিস্তানকে বড্ড অপরিচির মনে হলো তার। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো, দোকানের সামনে একটা পুরাতন বেঞ্চ পরে আছে। ছোটখাটো। ভেঁজা। ভেঁজা দেখে এতক্ষণ সে সেখানে বসেনি। কিন্তু ত্রিস্তান খুব অনায়াসে সেখানে পা ছড়িয়ে বসে পরলো। অটবীকে ডাকলো, “তোমার না পা ব্যথা করছে? এটা চোখে দেখোনি? এখানে এসে বসো। আসো!”
অটবী কথা শুনলো। অবাধ্য হলো না। ত্রিস্তানের পাশে চুপটি করে বসলো। তার পা ব্যথায় অবশ হয়ে গেছে। তার ২৩ বছরের জীবনে সে কখনো এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেনি।

ত্রিস্তান অটবীর দিকে একটা কিটক্যাট এগিয়ে দিয়ে বললো, “খাও।”
সে নিলো। মানা করলো না। ত্রিস্তান যেন অবাকই হলো। মেয়েটা জেদি স্বভাবের। সবকিছুতেই আগে ‘না’ শব্দটা উচ্চারণ করে। আজকে হঠাৎ এত ভালো হয়ে গেল কিভাবে? কপাল কুঁচকে একটু করে দেখে নিলো অটবীকে। আদুরে লাগছে। মাথায় ওড়না নেই। সরে গেছে। জামার একপাশ ভেঁজা৷ ঠান্ডা হয়তো একেবারেই সহ্য করতে পারেনা। ঠোট আদ্র, নাক লাল টকটকে!
ত্রিস্তান আস্তে করে শুধালো, “পানি আনবো? পানি খাবে অটবী?”
—“এসময় পানি পাবেন কোথায়? দোকান তো সব বন্ধ।”
—“বৃষ্টির পানি আছে না? দু’হাত ভরে এনে দেবো। তুমি সেখান থেকে খেতে পারবে না?”

কথাটা বলে ত্রিস্তান হাসলো। নিঃশব্দ হাসি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। শীত লাগছে। ভেঁজা শরীরে থাকার কারণে কি? হয়তো! সেও ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। আবার হয়তো পারেও। এইযে, এখন যেমন ঠায় বসে আছে। ভদ্র ছেলের মতো। কিন্তু আসলে সে ঠিক নেই। গায়ে উত্তাপ ওঠা জ্বর। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। অথচ পাশের মানুষটা সেটা বুঝতেই পারছে না!
ঠোঁটের প্রস্থ বাড়িয়ে ত্রিস্তান আচমকা বললো, “তুমি ভয়ানক সুন্দর, অটবী।”

অটবী যেন বুঝলো না। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “জি?”
অটবীর দিকে শাহাদাত আঙুল তাক করলো ত্রিস্তান। কিঞ্চিৎ ঘাড় বাঁকিয়ে হেসে হেসেই আবার বললো, “তুমি, তুমি মেয়েটা এত সুন্দর কেন?”

বাতাসে বাতাসে ত্রিস্তানের শার্ট, প্যান্ট, চুল শুকিয়ে গেছে। চোখের সাদা অংশ ক্রমশ রক্তে ভরে যাচ্ছে। মুখ লাল। মুখাবয়ব অসন্ন কিছুর ইঙ্গিত বরাবরই দিচ্ছে। অটবী কি মনে করে ত্রিস্তানের কপালে হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলো ভীষণ, “আপনার শরীর তো জ্বরে পুরে যাচ্ছে। এই জ্বর নিয়ে বসে আছেন কিভাবে? ত্রিস্তান?”

ত্রিস্তান চুপ। কপাল থেকে হাতটা খুব আস্তে করে নিজের কাছে নিয়ে অবাঞ্ছিত এক চুমু এঁকে দিলো। এতেও যেন মন ভরলো না। কাছে এগিয়ে অটবীর কপালেও অধর ছুঁইয়ে দিলো অতি অধৈর্য ভঙ্গিতে। অটবী চমকালো, থমকালো। এক মুহুর্তের জন্য রাগলো খুব। ছিটকে সরে গিয়ে বললো, “সমস্যা কি আপনার? এটা কি করলেন এই মাত্র?”

ত্রিস্তান জবাব দিলো না। একটু আগের তার সেই দীর্ঘ হাসিটাও হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছে। তৃষ্ণায় কাতর দেখাচ্ছে মুখটা। অটবী দূরে সরে গেলেও সে আবারও কাছাকাছি এগোলো। সন্তপর্ণে কপাল ঠেকালো অটবীর কাঁধে। লহু স্বরে আহাজারি করলো, “তোমাকে আমার ছাড়তে ইচ্ছে করছে না, অটবী। তোমাকে যদি সারাজীবন কাছে রাখতে পারতাম!”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here