#কালো_হরিণ_চোখ (পর্ব ৭)
নুসরাত জাহান লিজা
প্রিয়মের সময়টা কাটল ভীষণ ব্যস্ততায়, ক্যামেরার লেন্সে চোখ রাখলে সে পুরো জগৎ ভুলে যায়। কিন্তু যেটুকু অবসর জুটল, সেটুকু সময়তে ওকে আচ্ছন্ন করে রাখল অসহ্য অস্থিরতার কালো মেঘ।
এত অস্বস্তির মধ্যে কাজ ভালো হয়েছে ওটুকুই যা স্বস্তির। কাজ শেষে বাসায় ফিরে এলো।
তিন-চারদিন পেরিয়ে গেলেও একদিনও প্রকৃতির দেখা পাওয়া গেল না। প্রায় সবসময় চোখের সামনে থাকা মেয়েটা হঠাৎই যেন ওকে তড়িৎ চৌম্বকীয় আকর্ষন বলে নিজের দিকে টানছিল।
অনেকবার ভেবেছে মাকে জিজ্ঞেস করবে প্রকৃতি আসে কি-না। কিন্তু কী এক সংকোচ বোধ ওকে বাঁধা দিচ্ছিল।
রুবিনা বুঝলেন ছেলে কিছু একটা নিয়ে ভাবিত। কিন্তু কী, তা বুঝতে পারলেন না। প্রিয়ম কখন বলবে সে-ই অপেক্ষায় থাকলেন, নিজে কোনো প্রশ্ন করলেন না। ছেলে বড় হয়েছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিক। তিনি তো সারাজীবন থাকবেন না। তবে তিনিও ভেতরে ভেতরে চিন্তিত হলেন।
প্রিয়মের সময় কাটছিল বিমর্ষতায়। এখনো সে নিজের কাছে স্পষ্ট হতে পারেনি।
***
প্রকৃতি জ্বরে কাহিল ছিল বেশ কয়েকদিন। ধুম জ্বর এসেছিল। এখন কিছুটা সুস্থ হলেও দুর্বলতা কাটেনি। পাশাপাশি পরীক্ষার পড়ার যানজট লেগে আছে। তাই ওর বাড়তি সময় নেই। সকালে একবার ছাদে উঠে গাছগুলোর পরিচর্যা করে আসে, কয়েকদিন এদেরও সময় দিতে পারেনি। সারাদিন আর ছাদে আসা হয় না। আজ ইউনিভার্সিটি যাবে। একটা ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। না করলেই নয়।।
ওদিকে মৃদুল ফোন করেছিল, আজই সে রথিকে প্রপোজ করবে ছেলেটা। বেশ ভয়ে আছে। বন্ধু হিসেবে ওকে সাথে থাকতে বলেছে।
প্রথম ক্লাসটা ছিল শহিদুল্লাহ স্যারের। ভীষণ বোরিং ক্লাস। অনেকবার হাই তুলল। প্রায় ঘুম এসে যাচ্ছিল। বহু কষ্টে ঘুমকে রুখে দিয়েছে প্রকৃতি। দ্বিতীয় ক্লাসটা করার জন্যই সে মূলত এসেছে আজ। দুটো ক্লাস করে বেরিয়ে এলো। মৃদুল হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েছে বেরুতে। সে একটা ক্লাসও করেনি আজ।
রথিও বেরিয়ে আসতে চাইছিল, প্রকৃতি বলল, “তুই ক্লাসটা কর। ইম্পর্ট্যান্ট টপিক পড়াবে। আমাকে ক্লাস খাতাটা দিতে পারবি পরে।”
প্রকৃতি এসে দেখল মৃদুল লাল গোলাপ নিয়ে এসেছে। ওকে দেখে হেসে বলল, “বিশটা এনেছি। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে। ফুল একটা হলেও সমস্যা নাই৷ বলার সময় সুন্দর করে বলবি। না বলতে পারলে হাজারটা ফুল হলেও লাভ নেই।”
“এটাই তো সমস্যা। আমার না হাঁটু কাঁপছে। তুই একটু সুন্দর করে লিখে দে না, কীভাবে বলব!”
প্রকৃতি রেগে বলল, “বুদ্ধু, আর্টিফিশিয়াল হয়ে যাবে মুখস্ত কথা বলতে গেলে। তুই যা ফিল করিস তাই বলবি। মন থেকে বলবি, যা বলবি তাতে যেন হৃদয়ের ছোঁয়া থাকে। তুই যে ওকে ভালোবাসিস, শুধু এটাই নাহয় বল, কিন্তু ও যে স্পেশাল ফিল করে। বুঝলি?”
বলা শেষে ভরসার হাসি হাসল প্রকৃতি। তবুও পুরোপুরি নির্ভার হতে পারল না মৃদুল৷ উশখুশ করছিল। এরমধ্যেই দেখল রথি এদিকেই আসছে। মৃদুল হাতের ফুলগুলো ত্বরিতগতিতে পেছনে লুকিয়ে ফেলল। হৃদপিণ্ডে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে তুমুল গতিতে।
“কীরে, তুই এখনো আছিস? আর মৃদুল, তুই ক্যাম্পাসে এসে ক্লাসে গেলি না কেন?”
মৃদুল কী করবে বুঝতে না পেরে প্রকৃতির দিকে তাকালে সে ইশারায় বুঝালে শুভক্ষণ উপস্থিত।
মৃদুল রথির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে ফুলগুলো সামনে এনে বাড়িয়ে ধরল। কিন্তু মুখে কথা আসছে না। যেন বোবা হয়ে গেছে। অবশেষে অস্ফুটস্বরে কম্পিত গলায় বলল,
“এটা তোর জন্য রথি। নিবি? কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না, আমার হাতটা ধরবি সারাজীবনের জন্য?”
হতভম্ব রথি কিছুক্ষণ ভাষা খুঁজে পেল না। সে বুঝি বুঝতেও পারল না কী ঘটছে। পরিস্থিতি বুঝতে সে খানিকটা সময় নিল, যখন অনুধাবন করল, তখন চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। এই কান্নায় কোনো গ্লানি নেই, বরং প্রাপ্তি আছে এক পৃথিবী।
“কী হয়েছে রথি? আমি কি তোকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?” মৃদুলের গলায় অস্থিরতা।
রথি মৃদু হাসল, চোখে জল দিয়ে ঠোঁটের হাসিতে সে হয়ে উঠল অনন্যা। হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো নিল। মৃদুলের মনে হলো ফুলগুলো পূর্ণতা পেল।
“এত সময় নিলি এটা বলতে? আমি বহুদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম তুই কবে বলবি।”
মৃদুলের কপালের ভাজ সরল, উদ্ভাসিত হেসে বলল, “তুই আগে থেকেই আমাকে… তাহলে তুইও তো বলতে পারতিস।”
“জ্বি না জনাব, এটা ছেলেদের ডিপার্টমেন্ট। তোকেই বলতে হতো। শোন, আজ একসাথে এত ফুল দিয়েছিস মানে এটাই কিন্তু শেষ না। সপ্তাহে অন্তত একটা করে হলেও ফুল দিবি আমাকে। এরকম রক্ত গোলাপই দিতে হবে।”
মৃদুল রথির হাত ধরে বলল, “সারাজীবন দিতে চাই।”
মুহূর্তটা এত সুন্দর, অদ্ভুত সুন্দর এই মুহূর্তের স্বাক্ষী হয়ে রইল প্রকৃতি। এমন আরাধ্য ক্ষণ সকলের জীবনে আসুক, পৃথিবীর সকল ভালোবাসা পূর্ণতা পাক। মনে মনে কামনা করল প্রকৃতি। নিজের জন্য ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল কেবল।
***
একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষার কাঁটা প্রিয়মকে খোঁচাচ্ছিল। আজ সে নিজের পুরনো ক্যাম্পাসে এসেছিল। এরপর প্রকৃতির ডিপার্টমেন্টের দিকে গিয়েছিল। অনেকদিন দেখা হয় না। ভাবছিল আজ দেখা করবে। বাসায় তো দেখা হবার সুযোগ পাচ্ছে না।
কিন্তু গিয়ে ওর পৃথিবী যেন থমকে গেল। সেদিনের সেই ছেলেটা একগুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, প্রকৃতি তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল হেসে হেসে। এরপরের দৃশ্য আর দেখার মতো মনোবল সে যুগিয়ে উঠতে পারেনি। দ্রুত পায়ে চলে এসেছে। সেই থেকে ছাদে এসে বসে আছে। ওকে সঙ্গ দিচ্ছে প্রকৃতির গাছগুলো।
একসময় প্রকৃতি উঠে এলো ছাদে। এই পোশাকেই ছিল তখন। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেই হয়তো ওর প্রিয় গাছগুলোর খোঁজ নিতে এসেছে। প্রিয়ম অবুঝ রাগে বলল,
“কেমন আছো প্রকৃতি?”
প্রকৃতি দেখল চিরচেনা প্রিয়মের মধ্যে যেন আজ অন্য কেউ। ধীরস্থির ছেলেটার মুখাবয়ব জুড়ে একফোঁটা স্থৈর্য নেই যেন।
“আপনি সুস্থ আছেন প্রিয়ম ভাই?”
“ছেলেটার সাথে তোমাকে মানিয়েছে ভালো।”
“কোন ছেলে?”
“কেন, যে তোমাকে লাল গোলাপ দিল। কিন্তু আমি জানি না, আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।”
প্রকৃতি বুঝল প্রিয়ম বর্তমানে ঠিক প্রকৃতস্থ নয়।
“প্রকৃতি, তুমি ওকে ভালোবাসো খুব?”
প্রকৃতির খুশি হওয়া উচিত নাকি রেগে যাওয়া উচিত সে বুঝতে পারছিল না। বলল,
“প্রিয়ম ভাই, আপনি একটু স্পষ্ট করে বলুন তো আপনার সমস্যাটা কোথায়?”
“আমি নিজেও বুঝতে পারছি না আমার সমস্যাটা ঠিক কী! নিজেকে ভীষণ অচেনা লাগছে। লাভ এট ফার্স্ট সাইট। আমার মনে হয়েছিল আমার সাথেও জিনিসটা ঘটেছে। ওকে আমি একবারই দেখেছিলাম। এরপর আর খুঁজে পাইনি। তবে অপেক্ষা করেছি এতগুলো দিন ধরে। কিন্তু তোমাকে ওইভাবে দেখে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম। আমার কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছি না। আজ এসে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
অনেকবছর আগে যখন সে কিশোরী ছিল, তখন এমন স্বীকারোক্তি পেলে সে ভীষণ উৎফুল্ল হতো। খুশিতে পৃথিবী ভুলে যেত। কিন্তু আজ ওর রাগ হলো। ভীষণ ভীষণ রাগ।
“প্রিয়ম ভাই, আপনাকে আমার এক্সপ্লেনেশন দেবার কিছু নেই। তবুও বলছি, মৃদুল আমার খুব ভালো একজন বন্ধু। আমার আরেকজন ভালো বন্ধু রথি। ওরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। আজ মৃদুল প্রপোজ করেছে। আমি ওকে সাহস দিয়েছি কেবল।”
প্রিয়মের মুখাবয়ব আচমকা বদলে গেল। একটা সুখ সুখ অনুভূতি হলো ভেতরে। জগদ্দল পাথরটা সরে গেল। প্রকৃতি হারিয়ে যায়নি। খুশিটা প্রকাশ করতে গিয়ে বাঁধা পেল। প্রকৃতির মুখ কঠিন হয়ে আছে।
“আমার কথা শেষ হয়নি, প্রিয়ম ভাই। আমি শেষ করি প্লিজ। আপনি এখনো কনফিউজড। আপনি কাকে চান তাও জানেন না। আমাকে অপশন হিসেবে চাইছেন এখন। যদি ওই মেয়েটাকে পেয়ে যেতেন আমি আপনার চাওয়ায় কখনোই আসতাম না। একটা মেয়েকে আপনি অপশন হিসেবে চাইছেন, বিষয়টা মেয়েটার জন্য কতটা অসম্মানজনক আপনি জানেন?”
“প্রকৃতি, আমি এখন….. ”
“প্লিজ প্রিয়ম ভাই, আমি কিছুক্ষণ একলা থাকতে চাই ছাদে৷ যেহেতু ছাদটা আপনাদেরও, তাই আমি জোর দিয়ে বলতে পারছি না। আমি কি কিছুক্ষণ এখানে একলা থাকতে পারি?”
প্রকৃতির দৃঢ়তায় প্রিয়ম আর কথা বলল না। অদ্ভুত এক বিষাদে ওর সমস্ত মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সে চাপা স্বভাবের মানুষ। নিজেকে প্রকাশ করতে শেখেনি। কীভাবে অনুভূতি গুছিয়ে বলতে হয় সে জানে না। ওর অগোছালো প্রকাশে অনিচ্ছা সত্বেও সে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। অথচ কত কী বলতে চেয়েছিল, সবই অব্যক্ত রয়ে গেল ওর বুকের বদ্ধ প্রকোষ্ঠে।
অবসন্ন প্রিয়ম সিঁড়ির কাছে গিয়ে একবার পেছনে ফিরে তাকাল। হাসিখুশি মেয়েটাকে গাম্ভীর্যের চাদর যেন আচ্ছাদিত করে রেখেছে। বুকে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে সে ফিরে এলো নিজের ঘরে। বিছানায় এলিয়ে দিল বিধ্বস্ত মনকে বেষ্টন করে রাখা আপাত অন্তঃসারশূন্য শরীরটাকে।
………….
(ক্রমশ)
………