প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব ১৮

0
136

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৮

রাস্তায় এমন একটা অঘটন ঘটে যাবে সেটা চারজনের কেউই ভাবতে পারেনি। আচমকা এমন একটা দূর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় হৃদিতা একদম চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাসেল সাহেব তাড়াতাড়ি করে গিয়ে অভ্রকে তুলে দাঁড় করায়। নাহার বেগমও এগিয়ে আসে।

অভ্রর হাতের দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,“খুব জোরে লেগেছে, বাবা?”

রাসেল সাহেব আফসোসের সাথে বলল,“ইশ! কেন যে তোমাকে আমাদের সাথে আসতে বললাম!”

রাসেল সাহেব কথাটা বলতেই অভ্র কপালে হাতে নিজেকে লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করে। লাভ হয় না। নাহার বেগম কথাটা ধরে ফেলেন। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করেন,”কী বললে? তুমি অভ্রকে আমাদের সাথে আসতে বলেছ মানে?”

রাসেল সাহেব কথা কাটিয়ে উঠতে বলেন,“এই যে এই রাস্তাটুকুর কথা বললাম। রাস্তায় আর তামাশা কোরো না চল এখন। হৃদি মা বাড়ি গিয়ে অভ্রর হাতে একটু হালকা গরম সেক দিবি তো তাহলে আর ব্যথা খুব একটা বাড়বে না। ছেলে মানুষ ও, এত সহজে হার মানলে হয় নাকি!”

হৃদিতা এতক্ষণে অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,“আপনার কি খুব জোরে লেগেছে!”

অভ্র দুইপাশে মাথা নাড়িয়ে বলে,“না, চলুন যাওয়া যাক।”

বাড়িতে পৌঁছানোর সাথে আসরিফের মা আয়েশা বেগম এগিয়ে এসে সবাইকে আপ্যায়ন করে। বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে রেস্ট নেওয়ার জায়গাও দেখিয়ে দেয়। আসার পর থেকে হৃদিতার খালাতো বোন ইরা পিছুই ছাড়ছে না। হাতে মেহেদি নেওয়া শেষ হতেই ‘আসছি’ বলেই বেরিয়ে যায় সে। আসার পর থেকে অভ্রর দেখা মিলেনি। অভ্রকে না দেখে কেমন একটা চিন্তা হচ্ছিল তার। বেচারার কী অবস্থা কে জানে! তাকে বাঁচাতে গিয়ে সে অনেক জোরে আঘাত পেয়েছে।

হৃদিতার জন্য ইরার রুমটাই বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নাহার বেগম আত্মীয় স্বজনের সাথে গল্প,আড্ডায় ব্যস্ত ওদিকে রাসেল সাহেবকেও দেখা যাচ্ছে না।
হৃদিতা হাতের ফোনটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রান্নাঘরের দিকে মাকে খুঁজতে এসে পেয়েও যায়।

নাহার বেগমের সাথে আয়েশা বেগমসহ আরও একজন মহিলা বসে আছে। নাহার বেগম হৃদিতাকে দেখেই কাছে ডেকে নেন।

পাশেই বসা মহিলাকে দেখিয়ে বলেন,“উনি তোমার ফাবিহা আন্টি। অভ্রর সাথে দেখা হলো না? অভ্রর মা এটা।”

হৃদিতা মৃদু হেসে সালাম দেয়। বলে,“কেমন আছেন আন্টি?”

ফাবিহা বেগম মৃদু হেসে বলেন,“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?”
“জি আলহামদুলিল্লাহ।”

কিছু সময় সেখানে ব্যয় করেই কিছু একটা ভেবে হৃদিতা ছাদের দিকে চলে যায়। সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে চলে আসতেই দুজনের গলা শুনে চিলেকোঠার দরজায় থেমে যায় হৃদিতা।

তার বাবা আর অভ্রর গলা শুনতে পাচ্ছে সে। রাসেল সাহেব সন্তর্পণে বলে ওঠেন,“আমার মেয়েটা আমার খুব আদরের। যখন যা চেয়েছে তখন সেটাই পেয়েছে। মেয়েটা খুব চাপা স্বভাবের। মনের কথা কাউকে প্রকাশ করতে পারে না৷ সবকিছু নিজের মাঝে চেপে রাখে। তোমার সাথে আমার যেদিন প্রথম দেখা হলো সেদিনই ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমার মেয়ের জন্য পারফেক্ট। তুমি মানুষের ভেতরে দুঃখটা টেনে বের করে এনে হাসাতে পারো। আমার মেয়েটা মন খুলে অনেকদিন হাসে না।”

হৃদিতা দুই একটা কথা শুনতে পাচ্ছিল। যতটুকু শুনতে ততটুকুতে বুঝতে পারে তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে এখানে। দুজনের কথা চলছেই দেখে ফিরে যাওয়ার জন্য পিছন দিকে ঘুরতেই কিছু একটায় পা লেগে শব্দ হতেই রাসেল সাহেব এবং অভ্রর কথা থেমে যায়। এগিয়ে আসে দুজন।

হৃদিতাকে দেখতে পেয়েই রাসেল সাহেব বলে ওঠেন,“হৃদি মা, তুই এখানে?”

হৃদিতা দুজনের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়। স্বাভাবিকভাবেই বলে,“ছাদে আসলাম একটু কিন্তু তোমরা এখানে কেন?”

অভ্র মৃদু গলায় বলে,“আমরা একটু আড্ডা দিচ্ছিলাম আর কি। ”

হৃদিতা বলে ওঠে,“আমি আসলে আপনাকেই খুঁজছিলাম। তখন রাস্তায় আমাকে সরিয়ে দিয়ে আপনি আঘা*ত পেলেন তাই জানতে চাচ্ছিলাম এখন কী অবস্থা আপনার।”

রাসেল সাহেব তৎক্ষনাৎ বলে ওঠেন,“তোমরা তাহলে কথা বলো৷ আমি আসছি।”

রাসেল সাহেব বেরিয়ে যেতে অভ্র বলে ওঠে,“আমি ভাবছিলাম আপনার সাথে দেখা করা ঠিক হবে কি না! আপনি কীভাবে নেবেন বিষয়টা সেজন্যই যাইনি।”

হৃদিতা রেলিং ঘেষে দাঁড়ায়। বুকে হাত গুজে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,“কী মনে করব? আচ্ছা এটা বলুন আপনার হাতের কী অবস্থা?”
“হালকা ব্যথা হয়েছে তাছাড়া সব ঠিকঠাক।”
“সুযোগ পেলেই এভাবে চেয়ে থাকবেন না ট্রেনের মতো। এ বাড়িতে এখন অনেক মানুষ। ”

একটুও ভড়কায় না অভ্র। হৃদিতার কথার পৃষ্ঠে বলে ওঠে,“তাহলে কি এখন দেখে মনের খায়েশ মিটিয়ে নেব?”
“বাবার সাথে কী কথা বলছিলেন?”
“আপনার বাবা আমাকে পছন্দ করেছেন, আপনি কী বলেন?”

হৃদিতা অবাক চোখে অভ্রর দিকে তাকায়। চকিতে বলে ওঠে,“আমার বাবা আপনাকে পছন্দ করেছে মানে?”
“কেন আপনি আমাকে পছন্দ করেননি?”
“আমার মাঝে কী দেখে ভাবলেন যে আমি আপনাকে পছন্দ করেছি?”
“আপনি আমাকে ট্রেনে বারবার দেখছিলেন।”
“এই কাজ তো আপনি করছিলেন।”
“আপনিও আমাকে বারবার না দেখলে বুঝলেন কীভাবে আমি আপনাকে দেখছিলাম?”

গলায় কথা আটকে যায় হৃদিতার। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,“না মানে আপনি আমাকে দেখছিলেন কি না সেটা দেখছিলাম।”
“আমার হবু বউকে আমি দেখব না?”
“হবু বউ!”
“জি ম্যাডাম।”
“আমার বিয়ে আর আমিই জানি না?”
“আপনার বাবা জানে শুধু।”
“আমাকে জানাতো।”
“অপছন্দ করলেন না?”
“অপছন্দ কেন করব? আমার বিয়ের বয়স অনেক আগেই হয়েই গেছে। আপনি কী ভেবেছিলেন? আমি ন্যাকা ন্যাকা করে বলব, আমি এখনই বিয়ে করব না, চেনা-জানা হোক তারপর বিয়ে করব? না ভাই, আমি ওগুলো করব না। আমার বাবা-মা আমার জন্য যাকে ভালো মনে করবে তাকেই বিয়ে করব।”

অভ্র এগিয়ে এসে বলে,“আমার কাজ কী তবে সহজ হয়ে গেল?”

“জানি না।” বলেই হৃদিতা স্থান পরিত্যাগ করে। অভ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হৃদিতার চলে যাওয়া দেখতে থাকে। তার নিজেরও মনে হয়নি হৃদিতা তাকে অপছন্দ করবে কিন্তু এত তাড়াতাড়ি মেনে নিবে সেটাও ভাবেনি সে।
গতবছর এই সময়েই রাসেল সাহেবের সাথে অভ্রর দেখা হয়েছিল। কাজের সূত্রে আলাপ হলেও ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে রাসেল সাহেবের দিক থেকে। একে তো আত্মীয় তার সাথে ছেলেটা এত সুন্দর একটা মানুষ। নিজের মেয়ের জন্য মনে মনে পছন্দ করে রেখছিলেন তিনি। এই তো আসরিফের বিয়ের অনুষ্ঠানে আসার আগেই আবার যোগাযোগ হয়েছে। তিনিই টিকিট কেটেছিলেন চারজনের চারটা। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে-মেয়ে একটু চেনা পরিচিত হয়ে নিক। তিনি মনে মনে নিশ্চিত ছিলেন হৃদিতা অভ্রকে অপছন্দ অন্তত করবে না।

রাত নয়টা।
বিয়ে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশিরা এসে আড্ডা জমিয়েছে। আসরিফকে ঘিরে ধরে আড্ডায় মেতে উঠেছে সবাই। আসরিফের পাশেই বসে আছে অভ্র। তাদের ঠিক সামনা-সামনি ইরা চাচাতো বোনদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছে। ইরা এবার ক্লাস টেনে পড়ছে। মেয়েটা দেখতে যেমন সুন্দর ব্যবহারও তেমন।

আসর ছেড়ে আসরিফ অভ্রকে নিয়ে উঠে আসে। হবু বউ কল করেছে। কল না রিসিভ করলে তুল-কালাম বাধিয়ে দেবে সেই ভয়ে অভ্রকে দাঁড় করিয়ে ফোনালাপে ব্যস্ত হয় সে। অভ্র মাঝেমাঝে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হৃদিতাকে দেখা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পিছন দিক থেকে গলা খাঁকারির শব্দ শুনে ফিরে তাকায় আসরিফ। হৃদিতাকে দেখে অভ্রও এগিয়ে আসে।

হৃদিতাকে দেখে আসরিফ ফোনের ওপাশে থাকা নারীকে নরম কণ্ঠে বলে ওঠে,“ফোনটা একটু রাখো তো। হৃদিতা কী যেন বলবে।”

হৃদিতা আসরিফের থেকে ফোনটা নিয়ে বলে ওঠে,“ভাবি, মাঝে আর একটা দিন এরপর প্রেম করিও। এখন বরটাকে আমাদের সেবায় ছাড়ো একটু।”

আসরিফ ফোনটা নিয়ে বলে, “কী বলবি? বল।”

হৃদিতা অভ্রর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,“আপনি আসরিফ ভাইয়াকে সাথে নিয়ে ঘুরে আসুন। এই কাগজে আমার ওষুধের নাম লেখা আছে, মাইগ্রেন বেড়েছে। এটা এনে দিলে খুব উপকার হতো। ”

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here