” আমার স্বামী বিদেশ থেকে আসার পর থেকে বাড়ির মানুষগুলোর সাথেই ব্যস্ত। আমার কাছে আসার সময়ই সে পায় না। বলতে গেলে আমার শাশুড়ি তাকে চুম্বকের মতো আটকে রেখেছে। সে বিদেশ থেকে এসেছে জন্য আমার ননদ, ননদের স্বামী সবাই এসেছে। বাড়ির মানুষগুলো তো বাড়ি ছাড়ছেই না। কেউ যাচ্ছে তো আবার কেউ আসছে। এতগুলো মানুষের জন্য রান্না করতে হচ্ছে। শুধু তিনবেলার রান্না নয়, যখন যে যা খেতে চাইছে তাই রান্না করতে হচ্ছে। সারাদিন রান্নায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। রান্নাবান্না, খাওয়া শেষ করে রাত এগারোটার দিকে বিছানায় একটু শরীর এলিয়ে দিতে পারি কিন্তু তখনো রুমে যেয়ে দেখি উনি ঘরে আসেননি। এভাবেই দিন যাচ্ছে। সংসার সংসার করে পরে আছি অথচ সংসারের মানুষগুলো আমার না।”
বলেই সুরাইয়া মুখটা ভারি করে ফেলল। হৃদিতা শাড়ির আঁচলটা কাধের ওপরে রেখে নাভির দিকের কুচিগুলো ঠিক করতে করতে বলল,” বাদ দাও ভাবি এসব। তোমাকে কিছু শিখিয়ে দিলে তুমি সেটা করো না। আমি কি তোমার খারাপ চেয়ে ওগুলো বলি নাকি? আমি এ পর্যন্ত যা যা বলেছি সেগুলো করলে বড়মা এগুলো করার সাহস পেত না। খচ্চর মহিলা একটা। ছেলেকে বউয়ের কাছে পাঠাবে না তাহলে কি রূপ দেখতে বিয়ে দিছিল নাকি? নিজেরটা তো ঠিকই সাথে সাথে রাখে সবসময়৷”
পাশে নাহার বেগম কড়া নজরে হৃদিতাকে চোখ রাঙিয়ে বলে,” হৃদ, তোমার এসব অশ্লীল কথাবার্তা আমি কিন্তু একদম বরদাস্ত করব না। মুখের ভাষার কি শ্রী! ”
হৃদিতা মায়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে সুরাইয়া বলে ওঠে,” অ্যাই থামো, কুচি ঠিক করে দিচ্ছি না? এতো নড়লে ঠিক করব কীভাবে?”
নাহার বেগম চশমাটা খুলে পাশে রেখে বলে,” রাখো তো সুরাইয়া। এতো বড়ো মেয়ে হয়ে গেছে তাও শাড়িটা পরতে পারে না।”
” রান্না পারি তো? রান্না পারলেই হবে৷ আমি শাড়ি পরে কারো সামনে চৌদ্দপাক দেব না। আমার হাতের রান্না খেয়ে পটে যাবে। আজ অনুষ্ঠান জন্য ভাবিকে ডেকেছি। ” বলে হৃদিতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
নাহার বেগম সুরাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,” আশরাফ এখনো তোমার সাথে সময় কাটায়নি?”
সুরাইয়া মুখ গম্ভীর করে বলে,” না কাকি।”
” কী বলো! এসেছে তো দুই তিনদিন হয়ে গেল।”
” হ্যাঁ, রাতে কখন এসে ঘুমায় টের পাই না। সারাদিন অনেক কাজ করে বিছানায় পিঠ ঠেকালেই ঘুম চলে আসে। শরীরটা সবসময় ক্লান্ত থাকে৷ শরীরটা আর পারছে না এতোকিছু সহ্য করতে।”
“শোনো ভাবি, এখন গিয়ে বাড়িতে বলো তোমার আব্বা অসুস্থ। তোমার বাপের বাড়ি যেতে হবে নয়তো এমন শক্ত হও যেন এরকম কাজের মানুষ হয়ে থাকতে না হয়। যে যেমন তার সাথে তেমন হতে শেখো। এরকম মুখবন্ধ করে সহ্য করতে থাকলে তোমাকে বোবা বানিয়ে দেওয়া হবে৷ এটাই সময়, বর এসেছে তার সাথে সময় কাটাবে, ঘুরতে যাবে তা না বাড়ির মানুষের ফরমায়েশ খাটতে হচ্ছে। আমার কথা শোনো নইলে পস্তাতে হবে। ভাইয়া তিনমাসের জন্য এসেছে, এভাবে চললে দেখবে কবে যেন সময় শেষ হয়ে যায়!” বলেই নিজের ঘরে চলে যায় হৃদিতা।
সে ঘর থেকেই চেঁচিয়ে বলে,” আমাদের শেখ সাহেব কবে আসবে? সে আসলেই তো তোমার শাশুড়ি সোজা হয়ে যেত।”
সুরাইয়া বাহিরে রাখা চেয়ারে বসতে বসতে বলে,” উমেদ ভাই? সে হয়তো আজই আসবে।”
হৃদিতা বলে ওঠে,” তোমরা নাকি বন্ধু ছিলে আগে? বিয়ের পর তুই থেকে আপনি আর দোস্ত থেকে ভাই ক্যামনে বলো আমার মাথায় ঢোকে না। বন্ধুকে কোনোদিন সম্মান দেওয়া যায় নাকি!”
সুরাইয়া মৃদু হেসে বলে,” এখন তো সম্পর্ক ভিন্ন। বিয়ে হোক আগে তারপর বুঝবে।”
হৃদিতা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,” আমার আবার বিয়ে!”
সে আবার নাহার বেগমের হাতে হাত রেখে বলে,” কাকি, আমি যাই তবে৷ এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আবার কথা শুনতে হবে। ”
” আমার মেয়ে কিন্তু ভুল বলেনি সুরাইয়া। নিজেকে আগে শক্ত করো তারপর এ বাড়িতে তোমার জায়গা। বড়ো আপা এখনো আগের দিনের মানসিকতায় চলছে৷ চোখে আঙুল দিয়ে ভুল দেখিয়ে দাও। ”
সুরাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বলে,” হুম। ”
সুরাইয়া বেরিয়ে চলে যায়। নাহার বেগম সুরাইয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে আফসোস করতে থাকেন তিনি।
হৃদিতা ঘর থেকে মাকে ডেকে বলে,” আম্মা, আজ বাসায় আসতে লেট হবে। আমার ব্যাচের সবাই আসবে। আজ প্লিজ প্যারা দিও না প্লিজ। ”
নাহার বেগম রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,” তোর বাবা বাসায় আসবে। ”
” তোমার স্বামীকে বলে দিও সে সাতদিন ট্যুর দিয়ে বাসায় আসছে আমি কিছু বলিনি। আমার কয়েকটা ঘণ্টা যেন নষ্ট না করে দেয়। ”
” মুখের ভাষা ঠিক কর হৃদি। বাবা হয় তোর।”
” তোমার বর হয় না? বাড়ির সব দোষ আমার, তাই না? টাকা দাও।”
” কীসের টাকা?”
” বাহিরে যাচ্ছি লাগবে। আমার গতমাসের পুরো টাকা দিবে আজ শুধু আয়েশ করব।”
” উমেদ আসলে ওকে পাঠিয়ে দেব?”
” না, আমি চলে আসব।”
” ড্রয়ারে টাকা আছে নিয়ে যা।”
হৃদিতার হাতে গিটার দেখে বলে,” গিটার কেন?”
” গান গাইতে হবে।”
নাহার বেগম নিজের কাজে মন দেন। তিনি জানেন মেয়েকে কিছু বলে লাভ নেই। ওর বিরুদ্ধে গিয়ে কোনোকাজ করলে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে ভালো চুপচাপ থাকা। নিজেকে রক্ষা করতে জানে সে।
হৃদিতা রুম থেকে বেরিয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিতে রান্নাঘরে গিয়ে নাহার বেগমকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে চিবুক রেখে বলে,” তোমার সাইড ব্যাগ লাগবে, তাই না?”
নাহার বেগম পেয়াজ কাটতে কাটতে বলে, ” আমার কিচ্ছু লাগবে না। তোমার বাবা কক্সবাজার গেছে আসার সময় এগুলো নিয়েই আসবে।”
” কোনো ব্যাপার না। আমার টাকা বেঁচে গেল। থাকো আসছি।” বলেই হৃদিতা বেরিয়ে যায়।
নাহার বেগম গলা উঁচিয়ে বলেন,” ফেরার পথে মিষ্টি নিয়ে এসো আর হ্যাঁ পাতলা শালটা নিয়ে যাও। সন্ধ্যা পর শীত লাগবে।”
হৃদিতা সদর দরজায় এসে বলে,” ওহ আম্মু, কালকে থেকে তাহলে আমি নতুন বাসায় উঠছি।”
নাহার বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন,” এসব না করলে হয় না?”
হৃদিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,” না, হয় না। আমার খুব কষ্ট হয়।”
__
সুরাইয়া ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিল। ময়না বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন,” নেহা আর রাহাত চলে যাচ্ছে। বের হয়ে এসো।”
সুরাইয়া পিছনে না তাকিয়েই বলল,” আম্মা, আপনার বড়ো ছেলেকে একটু বলবেন আমাকে আমার বাড়িতে রেখে আসতে? সে না গেলেও যেন আমাকে বলে দেয়। ”
ময়না বেগম এগিয়ে এসে বলেন,” তা বাড়ি যাচ্ছ কেন?”
” ভালো লাগছে না। আব্বাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। একটু মায়ের আদর পেতে মন চাইছে।”
” এখানে কি খারাপ আছ? কথা শুনে মনে হচ্ছে এখানে কেউ তোমাকে ভালোবাসে না।”
” বাসেন ভালো? সারাদিন যে বাড়ির এতো এতো কাজ, রান্নাবান্না করি রাত এগারোটায় বিছানায় পিঠ দিতে পারি, দুদিন ধরে গায়ে জ্বর বয়ে বেড়াচ্ছি, জানতে চেয়েছেন কখনো আমার শরীর কেমন আছে?”
” কইছো কিছু? একবারও কইছো যে তোমার জ্বর? না কইলে টের পামু ক্যামনে?”
সুরাইয়া ময়না বেগমের দিকে ফিরে তাকান। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,” দেখেন তো আম্মা, আমার দিকে ভালো করে দেখেই বলেন বোঝা যায় কি না? আসল ব্যাপার কী বলেন তো, এ বাড়ির সবার জন্য আমি থাকলেও আমার জন্য কেউ নাই, কেউ নাই।”
আশরাফ দরজায় এসে দাঁড়ালে সুরাইয়া তাকে দেখে বলে,” আমার স্বামীও নাই আমার জন্য। আমার আসলে কেউ নাই এখানে। তাই এখানে আর মন টিকছে না। জনমানবহীন জায়গায় একা দিন কাটানো যায় কিন্তু যেখানে মানুষ দিয়ে ভর্তি অথচ নিজের মানুষ নাই সেখানে দম বন্ধ হয়ে আসে।”
” বউকে সামলা আশরাফ, বউয়ের সাহস আর আহ্লাদ দুইডাই বাড়ছে।” আশরাফের উপস্থিতি বুঝে ময়না বেগম কথাটা বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
সুরাইয়ার চোখ টলমল করছে। বারবার চোখের পাতা ফেলে পানি লুকিয়ে ফেলে সে। আশরাফ এগিয়ে আসে সুরাইয়ার দিকে।
বিছানায় বসে ব্যাগ সরিয়ে রেখে বলে,” কী হয়েছে?”
সুরাইয়া অল্পশব্দ ব্যয়ে বলে,” কিছু না। বাড়ি যাব।”
” বাড়ি কেন?”
” ভালো লাগছে না। শান্তিতে শ্বাস নিতে চাই।”
” অশান্তিতে আছ?”
” তুমি প্রশ্ন করছ? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো তো কেমন রেখেছ আমাকে?”
আশরাফ কিছু বলে না। সুরাইয়া এবার ফুঁপিয়ে ওঠে। ভাঙা গলায় বলে,” দুই তিনদিনের বেশি হয়ে গেছে এসেছ৷ আমাকে কতটুকু সময় দিয়েছ বলো তো? সারাদিন রাত আমার রান্নাঘরে কেটে যাচ্ছে, খোঁজ নিয়েছ আমার? রাতে কখন এসে পাশে শুয়ে পড়ো সেটাও জানি না। স্বামী-স্ত্রীর যে ব্যক্তিগত সময় কাটানো প্রয়োজন সেটা উপলব্ধি করতে পারো না? ”
আশরাফ নিম্নস্বরে বলে,” জানোই তো আম্মা অসুস্থ আর বাড়ি ভর্তি মানুষ। সবাইকে সময় দিতে হয় তো।”
” সবার জন্য সময় বরাদ্দ আছে আমার জন্য কোথায়? আম্মা অসুস্থ সেবা করছো আর আমি অসুস্থ সেটার খবর পর্যন্ত নাওনি। অদ্ভুত না?”
” আচ্ছা স্যরি৷ নেহা চলে যাচ্ছে ওদের বিদায় দিয়ে এসো আমরা এটা নিয়ে কথা বলছি।”
” আমি বাড়ি যাব, ওদের সাথে আমাকেও বিদায় দাও তুমি।”
” এমন কোরো না। বোঝার চেষ্টা করো একটু।”
” আমি যথেষ্ট বুঝি, তুমি একটু বুঝলে ভালো হয় আর পুরুষ মানুষ শরীরে না ব্যবহারেও হতে শেখো। সবদিকে ব্যালেন্স রাখতে শেখো। একদিকে সরে গেলে আরেকদিক হারাবে সুতরাং বুঝদার তোমার হওয়া উচিৎ। যে পুরুষ নারীর মন রাখতে পারে না তাকে কী বলে জানো তো? মেরুদন্ডহীন পুরুষ বলে।”
আশরাফ র*ক্তলাল চোখে সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” মুখ সামলে কথা বলবে। কী চাই তোমার? শরীরের ক্ষুধা বেড়েছে?” বলেই দরজা আটকে দেয় সে। আশরাফের কথা শুনে ঘৃণায় সুরাইয়ার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কথা দিয়েও যে কাউকে ক্ষ*তবিক্ষ*ত করে দেওয়া যায় এই মুহূর্তটা যেন তার প্রমাণ।
আশরাফ এসে সুরাইয়ার দুই বাহু শক্ত করে ধরে বিছানায় ফেলে দেয়। সুরাইয়া সেভাবে থেকেই বলে ওঠে,” শরীরের আগে মনের খোরাক মেটাতে শিখুন শেখ সাহেব।”
#চলবে…..
#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#সূচনা_পর্ব