#শেষ_বিকেলের_মায়া (১৮)
সময়ের স্রোতে আজ দুটি মাস পেরিয়ে গেল। আদীব চা কাপে চুমুক দিয়ে বলল,”প্রজেক্ট সফল হলো। আমি আরো বেটার কিছু করতে পারতাম। তবে দেশের মাটি ধরে পড়ে আছি।”
হেসে উঠলেন ইব্রাহিম রহমান। তিনি কোম্পানির মালিক হলেও বর্তমান সময়ে আদীবের কথাই কোম্পানিতে সব। মাত্র দু মাসের ব্যবধানে তার ফুরিয়ে যাওয়া ব্যবসায় সফলতা এনে দিয়েছে আদীব।
“তোমার এই অবদান আমি কখনো ভুলব না আদীব। তাই তো ৫০% শেয়ার করে দিচ্ছি। তুমি চাইলে আমরা দুজন ইতিহাস গড়তে পারব।”
আদীব চা কাপ রেখে সোজা হয়ে বসল।
“আপনি আমাকে ছাড়লেন না মিস্টার রহমান।”
ভদ্রলোক তার দাঁত মেলে হাসল। তিনি নিজের বিজনেসের অর্ধেক ছেড়ে দিচ্ছেন শুধমাত্র আদীবকে ধরে রাখতে। ছেলেটা তুখোড় মেধাবী। এ সাথে থাকলে সত্যিই পিছে ফিরতে হবে না। আদীবের সাথে সমস্ত কথা বার্তা শেষ করে চলে গেলেন ভদ্রলোক। আদীব সেদিন চাকরিটা নিয়েছিল এবং এক মাসের মাথাতেই দারুণ সফলতা এনে দিয়েছে। তারপর ই ইব্রাহিম রহমান ঠিক করেন আদীবকে ছাড়বেন না। তাই বেতন বাড়ালেন কয়েক গুণ। এখন আবার শেয়ার দিয়ে দিচ্ছেন। আদীব চেয়ারে ঠেক দিয়ে বসল। ফারিহার শূন্যতা আড়াল করতে দিন রাত পরিশ্রম করেছে। ছেলেটার কাছে টাকা এলেও ভালোবাসাটা এল না। হয়ত সৃষ্টিকর্তা ওর ভালোবাসার বিনিময়ে ধন দৌলত দান করছেন।
বিগত দুটি মাসে ফারিহার জীবনে অনেক কিছু ঘটল। সবটাই ভালো। মায়ের চিকিৎসা চলছে। রিহান ইতোমধ্যেই তার জন্য পাসপোর্ট তৈরি করে দিয়েছে। সে দ্রুতই মায়ের সাথে দেখা করতে যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হলো। তাও তার প্রিয় সাবজেক্টে। সব মিলিয়ে সময় মন্দ নয়। তবে রিহানের সাথে সম্পর্কটা সে বেশ সমীহ করে চলে। কিন্তু রুনার জন্য অন্তরে তৈরি হওয়া ভালোবাসাটা কেমন মন খারাপ আনে। এই সব মিথ্যের আড়ালে ভালোবাসা কেন জন্মেছে? রুনার সাথে শপিং করে ফিরল সে। সেখানে এক আত্মীয়র সাথে দেখা। সে প্রশ্ন করল রিহানের বিয়ে নিয়ে। রুনা জানিয়েছেন দ্রুত হবে। এই নিয়ে আরেক চিন্তা উদয় হলো। সন্ধ্যায় রিহান বাড়ি এলে ফারিহা ওর ঘরে এল। কথাটা জানাতেই চিন্তায় পড়ল রিহান।
“এখন কেমন করে সামাল দিব। মম ড্যাড কেন বুঝতে পারছে না?”
“রিহান স্যার আপনি শান্ত হোন।”
“কেমন করে? বুঝতে পারছ কি হতে চলেছে?”
“আপনি শান্ত হোন।”
“না, ফারিহা। শান্ত হওয়া যাবে না। তোমার এডমিশনের ঝামেলা শেষ হয়েছে। এখন আমরা কোন অজুহাত দিব?”
ওর কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো না। কিছু ভাবার পূর্বেই রুনা ঘরে এলেন। দুজনকে এক সাথে দেখে বললেন,”যা ভালোই হলো তোমরা এক সাথে আছ।”
রিহানের গলা শুকিয়ে এসেছে। এদিকে ফারিহার ভালো লাগছে না। রুনা কিছু গহনা এনে দিলেন ফারিহার হাতে।
“দেখো তো পছন্দ হয় কী না।”
এ কথা শেষেই ছেলের কাছে ফিরলেন তিনি। রিহান হাসার চেষ্টা করে বলল,”কিছু বলবে মম?”
“তোমার ড্যাড আসছেন আজ।”
“এটা তো ভালো খবর।”
“হুম। সেই সাথে আরেকটি ভালো খবর রয়েছে।”
রিহানের গলা শুকিয়ে এল। সে ভীত নয়নে তাকাল।
“ইলার বাগদান হচ্ছে। সন্ধ্যায় যাব আমরা।”
এ কথায় যেন দম ফিরে পেল রিহান। মা কে জড়িয়ে বলল,”আচ্ছা। ড্যাড কখন আসবে?”
“বিকেলের ফ্লাইটে।”
রিহান খুশি হয়ে গেল। সে সময় দেখে নিয়ে তৈরি হলো বাবা কে আনার উদ্দেশ্যে। অথচ সে জানত না তার জন্য কী অপেক্ষা করছে।
সন্ধ্যার পার্টিতে ফারিহাকে পরির মতো সাজিয়ে নিলেন রুনা। এত সব দামি গহনা পরে ফারিহার ভয় হতে লাগল। সে নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে রাখছে। সেটা বুঝতে পারল রিহান। সে ভরসা দিয়ে বলল,”গহনা চুরি যাবার ভয় নেই। তাছাড়া সি সি টিভি তো রয়েছেই।”
তবু ভয় পাচ্ছে মেয়েটি। রিহান ওর হাতটা আগলে নিল।
“আসো আমার সাথে।”
সব সুন্দর ই চলছিল। এক সময় ইলা ওদের কাছে এল। রিহান মেয়েটিকে বিশেষ পছন্দ করে না।
“ও রিহান, কত দিন পরে দেখলাম তোমায়।”
ভদ্রতার খাতিরে হেসে নিল সে। ইলাই বলল,”সি ইজ ইউর…”
ওর কথা কেড়ে নিয়ে রিহান জানাল।
“মাই গার্লফ্রেন্ড এন্ড ফিউচার ওয়াইফ।”
ইলার শরীর কিছুটা জ্বলে ওঠল। সে এত সুন্দরী। তবু রিহান তাকে প্রত্যাখ্যান করল। ফারিহা সম্পর্কে যতদূর জেনেছে এতে করে মেয়েটিকে নাকাল করা সহজ হবে। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ ধরনের আয়োজনে সে নতুন। তাই ইলা সকল কে কাপল ডান্সের জন্য ডেকে নিল। রিহান এসবে পাত্তা দিচ্ছিল না। তবে ইলা আর তার বান্ধবীরা খোঁচা দিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। সেই জন্যেই সে ঠিক করল ডান্স করবে। এদিকে ফারিহা পারছে না কান্না করতে।
“আমি পারব না। এ ধরনের ডান্স আমি কখনো করি নি।”
“পারবে।”
“রিহান স্যার, এটা অসম্ভব।”
“অসম্ভব বলে কিছু নেই।”
“রিহান স্যার।”
“আমি শিখিয়ে দিব, কাম।”
রিহানের এগিয়ে দেওয়া হাতে হাত রাখল ফারিহা। ওর সমস্ত শরীর চনমন করে ওঠল। রিহান তার জীবনের এমন এক অধ্যায়,যাকে না পড়া যাচ্ছে আর না বাদ দেওয়া যাচ্ছে। ওরা দুজন এমন এক সমীকরণে অবস্থান করছে যা থেকে আলাদা হওয়া প্রায় অসম্ভব।
কিছুটা অসুবিধা হলেও রিহান খুব সুন্দর সামলে নিল। এতে ইলার রাগ হলো। সে ইচ্ছে করেই ফারিহার ড্রেসে জুস ফেলে দিল। সুন্দর জামাটা নষ্ট হয়ে গেল বিধায় মেয়েটির চোখে জল নেমে এল। এত টাকার পোশাক! সে প্রায় ছলছল নয়নে তাকাল। রিহান সবটা বুঝতে পারল। ইলার দিকে গরম চোখে তাকাল। ইলা অবশ্য পাত্তা দিল না। সে এক সেকেন্ড সময় সেখানে থাকল না। চলে এল ফারিহাকে নিয়ে। এখন ফারিহার অপরাধবোধ কাজ করছে। পার্টি থেকে ওভাবে বের হয়ে আসা উচিত হয় নি। তবে রিহান রেগে আছে বিধায় সে কথা বলতে পারছে না। এক পর্যায়ে কিয়ার কল এল। সে গাড়ি থামাল। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলল,”হ্যাঁ কিয়া।”
“পার্টিতে গিয়েছিলে?”
“হুম। আবার চলে এসেছি।”
“ইলা মেয়েটা কিছু করেছে?”
কথাটা চেপে গেল রিহান। একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,”না। এমনি চলে এসেছি।”
“ও। আচ্ছা, পৌছে কল কোরো?”
“ঠিক আছে।”
রিহান খুব কম করে কথা শেষ করল। একে তো মেজাজ খারাপ। আবার ফারিহা পাশে বসে। সে পুনরায় গাড়ি চালানো শুরু করল। বাসায় ফিরে সোজা নিজের ঘরে অবস্থান করল। এদিকে ফারিহা ড্রেস বদলে নিয়েছে। রিহানের মেজাজ খারাপ হলেও কিয়ার সাথে কথা বলে মনটা ভালো হচ্ছিল। ওমন সময় ফারিহা রুমে প্রবেশ করল। রিহানের উদাম শরীর। সে সবে শাওয়ার নিয়ে এসেছে। চোখ নামিয়ে ফেলল ফারিহা।
“সরি।”
“ইটস ওকে। কিছু বলবে?”
“আন্টি কল করেছেনে। আপনার নাম্বার বিজি পেয়ে।”
কিয়ার সাথে তখনই কথা শেষ করে রুনাকে কল করল ও। রুনা ব্যস্ত হয়ে বললেন,”না বলে চলে এসেছ কেন রিহান?”
“ভালো লাগছিল না। তোমরা ব্যস্ত ছিলে তাই আর বলি নি।”
“কি করলে এটা! তোমার ড্যাড কে কতটা নিচু হতে হলো।”
রিহানের কপালের রেখা জেগে ওঠল। সে বলল,”কি হয়েছে মম? ড্যাড, কোথায়?”
“পাশেই আছেন। তবে তোমাকে না জানিয়েই তোমার বিয়ের ডেট ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেন।”
এ কথা শুনে রিহানের চোখ লাল হয়ে গেল। ফারিহা ওর পাশেই দাঁড়ানো। রিহানের শক্ত হয়ে যাওয়া মুঠোর দিকে তাকিয়ে মেয়েটা নিজেও ভরকে গেল।
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
|